বিজেপির শিক্ষা ও রাষ্ট্রনীতি এবং তার পরিণতি
দেশের বড় বড় বিজ্ঞান শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেভাবে বেদ ও পুরাণসহ ধর্মশাস্ত্র পড়ানোর ধুম লেগেছে তাতে ভারতবর্ষ খুব তাড়াতাড়ি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মত অশিক্ষার কানাগলিতে ঢুকে যাবে। এভাবে চলতে থাকলে, বলা ভালো যেতে বাধ্য হবে।সম্প্রতি শিবপুর আই আই ই এস টি-তে বেদ ও পুরাণ ভিত্তিক কুইজ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে। সেই সঙ্গে গোলওয়ালকরের ছবি ও বই রেখে যেভাবে বিচ্ছিন্নতা ও সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন মতাদর্শকে হাইলাইট করা হচ্ছে, তাতে ভারতের ভবিষ্যত দুর্দশার রূপটি স্পস্ট হয়ে উঠছে বলে অনেকের অভিমত
এক সময়ের আরবীয় (ইসলামিক) সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রভাবে উত্তর আফ্রিকা ও দক্ষিণ ইউরোপের বিস্তীর্ণ এলাকার (ভূমধযসাগরীয় এলাকা) মানুষ জ্ঞান-বিজ্ঞানের শিখর ছুঁয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে অর্থাৎ জনসমর্থনকে সহজে কব্জা করতে শাসক শ্রেণি রাজনীতির সঙ্গে ধর্মান্ধতাকে জুড়ে অন্ধ ভক্ত বানাতে শুরু করে। ফলে বিজ্ঞানচিন্তাকে পিছনে ফেলে ধর্মীয় অন্ধতা রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতায় প্রচন্ড গতিতে বাড়তে থাকে। আধুনিক বিজ্ঞান প্রযুক্তির চর্চা ও তার উন্নয়নের জন্য গবেষণা ছেড়ে জনগণকে বেশি বেশি করে আধ্যাত্মবাদী দর্শন চিন্তায় ঠেলে দেওয়া হয়। ফলে, সারাসেনীয় জাতি ( আরবভুমির মুসলমানরা) ক্রমশ অশিক্ষার অন্ধকারে তলিয়ে যেতে থাকে। অথচ ইতিহাস বলছে, হজরত মহম্মদ-এর জীবৎকালেই আরব ভুমিতে আধুনিক শিক্ষার ভ্রূণ সৃষ্টি হয়েছিল, যার প্রভাবে পরবর্তীকালে বাগদাদ, সালার্নো, কায়রো ও কর্দোভার বিশ্ববিদ্যালয় রূপী মহীরুহের আবির্ভাব ঘটেছিল। আর এটা সম্ভব হয়েছিল নবিজির সেই উপদেশের সুত্র ধরে, যেখানে বলা হচ্ছে, "একাগ্রচিত্তে একঘণ্টা ধরে স্রষ্টার সৃষ্টিকর্ম সম্পর্কে চিন্তা সত্তর বছর ধরে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনার চেয়ে অনেক ভালো।" যেদিন থেকে তাঁর এই বিজ্ঞান চিন্তার দর্শন ছেড়ে শুধুমাত্র আধ্যাত্ববাদী দর্শন চর্চায় ঢুকল, ঐক্যবদ্ধ আরবীয় সভ্যতা সেদিন থেকে ক্রমশ দুর্বল হতে থাকে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে যা ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। বর্তমান মধ্যপ্রাচ্যের দিকে তাকিয়ে দেখলেই বোঝা যায় জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চা ছেড়ে দিয়ে কীভাবে ইউরোপ ও আমেরিকার মুখাপেক্ষী হয়ে পড়েছে তারা। বলা যায় আমেরিকার হাতের পুতুলের মতো নাচতে বাধ্য হচ্ছে।
আরবীয় সভ্যতার এই অধঃপতনের প্রেক্ষাপট সামনে রেখে আমাদের দেশের বর্তমান শাসক শ্রেণির শিক্ষা ও রাষ্ট্রনীতি বিশ্লেষণ করলে প্রশ্ন ওঠে, ভারতীয় সভ্যতাও কি সেদিকেই যাচ্ছে?
অন্য দিকে পরাজিত ইউরোপ আরবীয় জ্ঞানবিজ্ঞানকে হাতিয়ার করে নিজেদের এগিয়ে নেওয়াকেই অগ্রাধীকার দেয়। ফলে পিছিয়ে পড়া জনজাতি জ্ঞানবিজ্ঞানে পারদর্শী হয়ে একসময় আরবীয় শাসকদের হারিয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করে নেয়। রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রদর্শনকে ত্যাগ করে জগতের চাহিদাকে মান্যতা দিয়ে তারা গনতান্ত্রিক ও ধর্মনরপেক্ষ ভাবধারাকে স্বাগত জানায়। এই পটপরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল তাদের যুক্তিবাদী চিন্তাধারা, বিজ্ঞানচেতনা বা বিজ্ঞানমনস্কতা ও ধর্মনরপেক্ষ রাষ্ট্র দর্শনকে মান্যতা দেওয়ার মত বিষয়।
অনেকেই ইরানকে সামনে আনছেন বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব সাফল্যের নজির হিসেবে, যেখানে ধর্মীয় অনুশাসন অনুযায়ী দেশ শাসিত হয়। এ কথা ঠিক যে, শরীয়তি আওতায় থাকা দেশগুলোর মধ্যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে অবশ্যই এগিয়ে আছে ইরান। মাথা তুলে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে দুর্দান্ত উদ্যম নিয়ে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এই উদ্যোগ ও উদ্যম উপযুক্ত ফলাফল আনতে পারছে না। পাচ্ছে না তার কারণ, এরা এখনো মৌলিক প্রযুক্তি উদ্ভাবনের জায়গায় পৌঁছাতে পারেনি। ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে তারা যে ড্রোন ( 'শাহেদ ১৩৬' যা রাশিয়ায় 'কামেকাজি' নামে পরিচিত) উৎপাদন ও রপ্তানিতে উল্লেখযোগ্য উন্নতি করেছে বলে শোনা যাচ্ছে, তা মূলত মার্কিন মিডিয়ার প্রচার থেকে আমরা জানতে পারছি। মজার কথা হল, ইরান সরকারিভাবে এখনো তা স্বীকারও করেনি। হতে পারে, এটা তাদের রাজনৈতিক কৌশল। ভারত ও বাংলাদেশের ইসলাম ধর্মের ধর্মপ্রাণ মানুষ উৎফুল্ল হচ্ছেন এই ভেবে যে ইসলামের রাজনৈতিক প্রয়োগের দৌলতেই বুঝি তাদের এই উত্থান ঘটেছে।
একথা অস্বীকার করা যায় না যে, ড্রোন প্রযুক্তি ইরানের নিজস্ব প্রযুক্তি নয়। এই প্রযুক্তির উদ্ভাবক আমেরিকা। আমেরিকার থেকে তা ক্রমশ পৃথিবীর কয়েকটি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। ইরান যে ড্রোনের জন্য প্রচারে এসেছে তা তারা নিজেরা দেশীয় উপাদান দিয়ে অ্যাসেম্বেল করেছে মাত্র। এসেম্বল করা আর প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা এক জিনিস নয়। এই অ্যাসেম্বেলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি উপাদান মাইক্রোচিপস এবং জিপিএস মডিউল এর আবিষ্কারক আমেরিকা। আমেরিকান কোম্পানির কাছ থেকে এগুলো আমদানি করেই তারা নিজের মতো ডিজাইন করে এই ড্রোনগুলো তৈরি করেছে। প্রাকৃতিকভাবে পাওয়া তেলের টাকায় দুবাইতে পৃথিবীর সর্বোচ্চ বিল্ডিং বানানো আর ওই বিল্ডিং বানানোর মৌলিক প্রযুক্তি আবিষ্কার করা এক জিনিস নয়। এটা আমরা অনেক ধর্মপ্রাণ বা বলা ভালো ধর্মান্ধ মানুষ বুঝতে ভুল করি।
মনে রাখতে হবে, কিছু প্রযুক্তি আমদানি এবং তাকে মোডিফাই করে কিছু ড্রোন ডেভেলপ করলেই সে দেশ উন্নত হয়ে যায় না। নতুন ও মৌলিক প্রযুক্তি যারা আবিষ্কার করতে পারে, তারাই প্রকৃত উন্নত দেশ। তা পারে পৃথিবীর মধ্যে হাতে গোনা কয়েকটি দেশ যেমন, আমেরিকা, চিন, রাশিয়া, উত্তর কোরিয়া ইত্যাদি। অন্যসব দেশ এই দেশগুলোর সঙ্গে কোলাবারেশনে তারা তাদের সামরিক প্রযুক্তি ডেভেলপ করে মাত্র। খেয়াল করলে দেখা যায়, এই চারটি দেশ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দর্শনের দিক থেকে ভিন্ন মতাদর্শে বিশ্বাসী হলেও ধর্ম নিয়ে এরা বাড়াবাড়ি করে না, জনগণকে তা করতে দেয়ও না। ধর্মনিরেক্ষতা তাদের মূল হাতিয়ার। যেকোন মূল্যে তারা তাদের দেশের মধ্যে অস্থিরতা তৈরি হতে দেয় না। আর কে না জানে, যুগ যুগ ধরে রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে অস্থিরতার জন্য একটা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা।
পাশাপাশি ছোট্ট রাষ্ট্র ইসরাইলের দিকে তাকান। যে দ্রুততার সঙ্গে একটা ছোট্ট রাষ্ট্র, যা ১৯৬৭ সালে আমেরিকা এবং ব্রিটেন পাশে না দাঁড়ালে পৃথিবীতে তার কোন অস্তিত্বই নেই, সে কীভাবে পৃথিবীর রাজনীতি ও মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে তা সত্যিই নজরবিহীন। হিটলারের জার্মানিতে নজিরবিহীন গণহত্যার শিকার হয়েও তারা যে ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছে, তা তাদের আধুনিক বিজ্ঞান শিক্ষাকে হাতিয়ার করেই পেরেছে।
তবে এক্ষেত্রেও মনে রাখতে হবে। ওরা যা করতে পেরেছে তা আমেরিকার সহায়তা ছাড়া হত না। ওদের যে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা (আয়রন ডোম) যা পৃথিবী বিখ্যাত, এমন কি আমেরিকান সরকারও যা হাতে পেতে চায়, তা আমেরিকান কোম্পানির সঙ্গে যৌথ প্রচেষ্টারই ফল।
তবে দুটো ক্ষেত্রে ইসরাইল বিশিষ্টতা অর্জন করেছে। ১) সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট (উদ্ভাবন নয়) ২) গুপ্তচর সংস্থার অভাবনীয় এবং নজর কাড়া সাফল্য। ছোট্ট ভূখণ্ডের মালিক হয়েও (যদিও তার অধিকাংশই জবরদখল) যে দ্রুততার সঙ্গে শক্তি অর্জন এবং মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদেরকে টিকিয়ে রেখেছে তা সম্ভব হয়েছে আধুনিক শিক্ষাকে হাতিয়ার করেই। আধুনিক শিক্ষাকে হাতিয়ার করেই তারা বিশ্ব রাজনীতির বড় বড় নীতি নির্ধারক দেশগুলির পার্লামেন্টে নিজেদের প্রভাব বিস্তারকারি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক বা লবি তৈরি করেছে। সেখানকার রাজনীতিতে ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে শিক্ষাকে হাতিয়ার করেই নিজেদের প্রতিনিধিত্ব বাড়িয়েছে, যা মধ্যপ্রাচ্যের অন্য কোন দেশ করতে পারিনি।
আমাদের দেশের বর্তমান সরকার মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মতোই ধর্মদর্শন ভিত্তিক রাষ্ট্রদর্শন গড়ে তোলার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। এদিকে লক্ষ্য রেখেই বিজ্ঞান শিক্ষার পাশাপাশি বিজ্ঞান বিরোধী মতাদর্শকে বিজ্ঞান বলে চালানোর চেষ্টা চলছে। ধর্মীয় অসহিষ্ণুতাকে বজায় রেখে একটা জাতিকে বিভাজিত করে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার চেষ্টা চলছে। এই কৌশল পিছিয়ে পড়া এবং মধ্যযুগীয়। মধ্যযুগীয় ধ্যান ধারণা নিয়ে আধুনিক যুগে নিজের সাফল্য নিশ্চিত করা যায় না। যুগের চাহিদাকে অস্বীকার করে পুরাতনপন্থাকে আশ্রয় করলে সাময়িকভাবে দলীয় স্বার্থে রাজনৈতিক জয় হলেও শেষ পর্যন্ত অস্ট্রিয়ার শাসক মেটারনিকের পরিণতিকেই বরণ করে নিতে হবে। আর ততদিনে দেশের অগ্রগতি বিশবাও দূরে চলে যাবে। স্বাধীনতা উত্তর ভারতীয় রাষ্ট্রের অগ্রগতির মডেলকে সামনে রাখলে যা মোটেই কাম্য বলে বিবেচিত হবে না।
ফেসবুকে দেখুন এখানে ক্লিক করে
অন্য দিকে পরাজিত ইউরোপ আরবীয় জ্ঞানবিজ্ঞানকে হাতিয়ার করে নিজেদের এগিয়ে নেওয়াকেই অগ্রাধীকার দেয়। ফলে পিছিয়ে পড়া জনজাতি জ্ঞানবিজ্ঞানে পারদর্শী হয়ে একসময় আরবীয় শাসকদের হারিয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করে নেয়। রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রদর্শনকে ত্যাগ করে জগতের চাহিদাকে মান্যতা দিয়ে তারা গনতান্ত্রিক ও ধর্মনরপেক্ষ ভাবধারাকে স্বাগত জানায়। এই পটপরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল তাদের যুক্তিবাদী চিন্তাধারা, বিজ্ঞানচেতনা বা বিজ্ঞানমনস্কতা ও ধর্মনরপেক্ষ রাষ্ট্র দর্শনকে মান্যতা দেওয়ার মত বিষয়।
অনেকেই ইরানকে সামনে আনছেন বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব সাফল্যের নজির হিসেবে, যেখানে ধর্মীয় অনুশাসন অনুযায়ী দেশ শাসিত হয়। এ কথা ঠিক যে, শরীয়তি আওতায় থাকা দেশগুলোর মধ্যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে অবশ্যই এগিয়ে আছে ইরান। মাথা তুলে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে দুর্দান্ত উদ্যম নিয়ে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এই উদ্যোগ ও উদ্যম উপযুক্ত ফলাফল আনতে পারছে না। পাচ্ছে না তার কারণ, এরা এখনো মৌলিক প্রযুক্তি উদ্ভাবনের জায়গায় পৌঁছাতে পারেনি। ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে তারা যে ড্রোন ( 'শাহেদ ১৩৬' যা রাশিয়ায় 'কামেকাজি' নামে পরিচিত) উৎপাদন ও রপ্তানিতে উল্লেখযোগ্য উন্নতি করেছে বলে শোনা যাচ্ছে, তা মূলত মার্কিন মিডিয়ার প্রচার থেকে আমরা জানতে পারছি। মজার কথা হল, ইরান সরকারিভাবে এখনো তা স্বীকারও করেনি। হতে পারে, এটা তাদের রাজনৈতিক কৌশল। ভারত ও বাংলাদেশের ইসলাম ধর্মের ধর্মপ্রাণ মানুষ উৎফুল্ল হচ্ছেন এই ভেবে যে ইসলামের রাজনৈতিক প্রয়োগের দৌলতেই বুঝি তাদের এই উত্থান ঘটেছে।
একথা অস্বীকার করা যায় না যে, ড্রোন প্রযুক্তি ইরানের নিজস্ব প্রযুক্তি নয়। এই প্রযুক্তির উদ্ভাবক আমেরিকা। আমেরিকার থেকে তা ক্রমশ পৃথিবীর কয়েকটি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। ইরান যে ড্রোনের জন্য প্রচারে এসেছে তা তারা নিজেরা দেশীয় উপাদান দিয়ে অ্যাসেম্বেল করেছে মাত্র। এসেম্বল করা আর প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা এক জিনিস নয়। এই অ্যাসেম্বেলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি উপাদান মাইক্রোচিপস এবং জিপিএস মডিউল এর আবিষ্কারক আমেরিকা। আমেরিকান কোম্পানির কাছ থেকে এগুলো আমদানি করেই তারা নিজের মতো ডিজাইন করে এই ড্রোনগুলো তৈরি করেছে। প্রাকৃতিকভাবে পাওয়া তেলের টাকায় দুবাইতে পৃথিবীর সর্বোচ্চ বিল্ডিং বানানো আর ওই বিল্ডিং বানানোর মৌলিক প্রযুক্তি আবিষ্কার করা এক জিনিস নয়। এটা আমরা অনেক ধর্মপ্রাণ বা বলা ভালো ধর্মান্ধ মানুষ বুঝতে ভুল করি।
মনে রাখতে হবে, কিছু প্রযুক্তি আমদানি এবং তাকে মোডিফাই করে কিছু ড্রোন ডেভেলপ করলেই সে দেশ উন্নত হয়ে যায় না। নতুন ও মৌলিক প্রযুক্তি যারা আবিষ্কার করতে পারে, তারাই প্রকৃত উন্নত দেশ। তা পারে পৃথিবীর মধ্যে হাতে গোনা কয়েকটি দেশ যেমন, আমেরিকা, চিন, রাশিয়া, উত্তর কোরিয়া ইত্যাদি। অন্যসব দেশ এই দেশগুলোর সঙ্গে কোলাবারেশনে তারা তাদের সামরিক প্রযুক্তি ডেভেলপ করে মাত্র। খেয়াল করলে দেখা যায়, এই চারটি দেশ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দর্শনের দিক থেকে ভিন্ন মতাদর্শে বিশ্বাসী হলেও ধর্ম নিয়ে এরা বাড়াবাড়ি করে না, জনগণকে তা করতে দেয়ও না। ধর্মনিরেক্ষতা তাদের মূল হাতিয়ার। যেকোন মূল্যে তারা তাদের দেশের মধ্যে অস্থিরতা তৈরি হতে দেয় না। আর কে না জানে, যুগ যুগ ধরে রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে অস্থিরতার জন্য একটা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা।
পাশাপাশি ছোট্ট রাষ্ট্র ইসরাইলের দিকে তাকান। যে দ্রুততার সঙ্গে একটা ছোট্ট রাষ্ট্র, যা ১৯৬৭ সালে আমেরিকা এবং ব্রিটেন পাশে না দাঁড়ালে পৃথিবীতে তার কোন অস্তিত্বই নেই, সে কীভাবে পৃথিবীর রাজনীতি ও মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে তা সত্যিই নজরবিহীন। হিটলারের জার্মানিতে নজিরবিহীন গণহত্যার শিকার হয়েও তারা যে ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছে, তা তাদের আধুনিক বিজ্ঞান শিক্ষাকে হাতিয়ার করেই পেরেছে।
তবে এক্ষেত্রেও মনে রাখতে হবে। ওরা যা করতে পেরেছে তা আমেরিকার সহায়তা ছাড়া হত না। ওদের যে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা (আয়রন ডোম) যা পৃথিবী বিখ্যাত, এমন কি আমেরিকান সরকারও যা হাতে পেতে চায়, তা আমেরিকান কোম্পানির সঙ্গে যৌথ প্রচেষ্টারই ফল।
তবে দুটো ক্ষেত্রে ইসরাইল বিশিষ্টতা অর্জন করেছে। ১) সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট (উদ্ভাবন নয়) ২) গুপ্তচর সংস্থার অভাবনীয় এবং নজর কাড়া সাফল্য। ছোট্ট ভূখণ্ডের মালিক হয়েও (যদিও তার অধিকাংশই জবরদখল) যে দ্রুততার সঙ্গে শক্তি অর্জন এবং মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদেরকে টিকিয়ে রেখেছে তা সম্ভব হয়েছে আধুনিক শিক্ষাকে হাতিয়ার করেই। আধুনিক শিক্ষাকে হাতিয়ার করেই তারা বিশ্ব রাজনীতির বড় বড় নীতি নির্ধারক দেশগুলির পার্লামেন্টে নিজেদের প্রভাব বিস্তারকারি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক বা লবি তৈরি করেছে। সেখানকার রাজনীতিতে ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে শিক্ষাকে হাতিয়ার করেই নিজেদের প্রতিনিধিত্ব বাড়িয়েছে, যা মধ্যপ্রাচ্যের অন্য কোন দেশ করতে পারিনি।
আমাদের দেশের বর্তমান সরকার মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মতোই ধর্মদর্শন ভিত্তিক রাষ্ট্রদর্শন গড়ে তোলার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। এদিকে লক্ষ্য রেখেই বিজ্ঞান শিক্ষার পাশাপাশি বিজ্ঞান বিরোধী মতাদর্শকে বিজ্ঞান বলে চালানোর চেষ্টা চলছে। ধর্মীয় অসহিষ্ণুতাকে বজায় রেখে একটা জাতিকে বিভাজিত করে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার চেষ্টা চলছে। এই কৌশল পিছিয়ে পড়া এবং মধ্যযুগীয়। মধ্যযুগীয় ধ্যান ধারণা নিয়ে আধুনিক যুগে নিজের সাফল্য নিশ্চিত করা যায় না। যুগের চাহিদাকে অস্বীকার করে পুরাতনপন্থাকে আশ্রয় করলে সাময়িকভাবে দলীয় স্বার্থে রাজনৈতিক জয় হলেও শেষ পর্যন্ত অস্ট্রিয়ার শাসক মেটারনিকের পরিণতিকেই বরণ করে নিতে হবে। আর ততদিনে দেশের অগ্রগতি বিশবাও দূরে চলে যাবে। স্বাধীনতা উত্তর ভারতীয় রাষ্ট্রের অগ্রগতির মডেলকে সামনে রাখলে যা মোটেই কাম্য বলে বিবেচিত হবে না।
------------XX------------
ফেসবুকে দেখুন এখানে ক্লিক করে
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন