শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি : নেতিবাচক রাজনীতি চর্চায় সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস
শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি : নেতিবাচক রাজনীতি চর্চা - আলী হোসেন
আলী হোসেন
বিচার একটি যৌথ প্রচেষ্টার ফসল। বিচারক কখনোই সঠিক সিদ্ধান্তে আসতে পারেন না, যদি না এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন সংস্থা ও তার কর্মকর্তারা উপযুক্ত তথ্য সংগ্রহ এবং বিচারককে তা সরবরাহ করতে পারেন। আর বিচার ব্যবস্থা হচ্ছে একটি শক্তির আধার; তা যার হাতে থাকে, তিনিই বিচারক। এই শক্তি ন্যায়বিচার তখনই দিতে পারে, যখন বিচারক নিরপেক্ষ থাকার সৎ সাহস দেখান এবং সাংবিধানিক আইন এবং তার প্রয়োগ বিষয়ে আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে বিশেষ পারদর্শিতা অর্জন করেন।তবে তাঁর সফলতা নির্ভর করে তথ্য সংগ্রহকারী বিভিন্ন সংস্থা এবং আইনজীবীরা কতটা সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে সেই তথ্য বিচারকের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন, তার উপর। তাই বিচারক বা বিচার ব্যবস্থা যা বিধান দেয়, তা সব সময় সঠিক এবং যুক্তিযুক্ত হবেই - এভাবে নিশ্চিত করা যায় না। এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত কোনো একটি পক্ষ যদি পক্ষপাতদুষ্ট হয়, তাহলে ন্যায় বিচার পাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।
মনে রাখতে হবে, বিচার ব্যবস্থা যদি বিচারকের রায় মানেই ঠিক এবং নাগরিক সমাজ তার পক্ষে নিঃশর্ত সমর্থন জানাতে বাধ্য থাকবে - এই দাবি করে - তবে তা আধুনিক বিচার ব্যবস্থার একটা গুরুতর সীমাবদ্ধতা বলে বিবেচিত হবে। কারণ, বিচার ব্যবস্থা ব্যক্তি নিরপেক্ষ নয় এবং একশ শতাংশ ত্রুটিমুক্ত কোন সার্বজনীন সত্তাও নয়, যে সে কখনই ভুল করতে পারেন না। তাই বিচার ব্যবস্থার সাফল্য সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে একজন বিচারকের জানা-বোঝা ও তা মেনে চলার মত সৎ সাহসের ওপর, যা আসলে নিয়ন্ত্রিত হয় ওই মানুষের লোভ, ভয়, মোহ, কিংবা ব্যক্তি স্বার্থের মত আবেগ বা অনুভূতির দ্বারা। একজন মানুষের পক্ষে এই আবেগ ও অনুভূতিগুলো অতিক্রম করা নিশ্চয়ই সম্ভব, তবে তা খুবই দুরূহ কাজ। তাই বিচারকের রায় সবসময় মানুষের প্রশ্ন করার অধিকারকে অতিক্রম করতে পারে না।
স্বাভাবিকভাবেই, শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতির ক্ষেত্রে বিচার ব্যবস্থার পক্ষ থেকে যে নিদান এসেছে, তা নিয়ে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ ও আনন্দ একসঙ্গে মিলেমিশে এক গভীর বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। যারা অর্থের মাধ্যমে চাকরি কিনেছে, তারা এই রায় মানতে বাধ্য। কারণ, তাদের কাছে এই রায় কাঙ্ক্ষিত না হলেও একেবারেই অপ্রত্যাশিত ছিল না।
কিন্তু যারা মেধা ও পরিশ্রমের জোরে চাকরি পেয়েছিলেন, তাদের কাছে এই রায় হতাশাজনক। স্বাভাবিকভাবেই তারা ক্ষুব্ধ।
প্রশ্ন হল, এই ক্ষোভ কার বিরুদ্ধে? সরকারপক্ষের মানুষ বলবেন এর দায় বিচারক এবং বিচার ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত সহকারী সংস্থা ও ব্যক্তিবর্গের। কারণ, সত্য উদঘাটনে তারা ব্যর্থ হয়েছেন। অন্যদিকে সরকার-বিরোধীরা বলবেন দুর্নীতি যেহেতু সরকার করেছে, তাই তার দায় সম্পূর্ণভাবেই তাদের। সরকার পক্ষের পাল্টা যুক্তি, এই দুর্নীতি সরকার করেনি, করেছে সরকার পক্ষের কিছু নেতা, মন্ত্রী এবং আমলা। আমরা চাই তাদের শাস্তি হোক। তাই জড়িতরা এখন বিচারকের অধীনে জেলখানায়। আমরা তার বিরোধিতা করছি না। তারা এই কাজের সঙ্গে কতটা জড়িত অথবা জড়িত নয়, তা বিচারব্যবস্থাই নির্ণয় করবে। তাই যতক্ষণ না তা প্রমাণ হবে, ততক্ষণ তার দায় আমরা নিতে যাব না।
এখন যারা চাকরি পেয়েছেন, তারা সবাই কী অবৈধ পথে নিয়োগ পেয়েছেন? না। তাই যাঁরা বৈধভাবে চাকরিতে নিয়োগ পেয়েছেন, তাদের চাকরি যাবে কেন - এ প্রশ্নকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া অযৌক্তিক এবং অমানবিক। অন্যদিকে, বিরোধীদের বক্তব্য সরকার দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিয়েছে, এবং সে কারণেই এই রায়। তাই যোগ্য ব্যক্তিদের এই দুর্ভোগের দায় একমাত্র সরকারকেই নিতে হবে।
এই যে সিদ্ধান্ত, সরকার এবং বিরোধী পক্ষের, রাজনীতির মাঠে একটা বহুল প্রচলিত রাজনৈতিক খেলা। কারণ, রাজনীতির লক্ষ্য হচ্ছে ক্ষমতা ধরে রাখা অথবা ক্ষমতার অলিন্দে প্রবেশ করার চাবিকাঠি হস্তগত করা। ইতিহাস বলছে, ক্ষমতার অন্বেষণকারীদের কাছে, এক্ষেত্রে, ন্যায়-নীতি, উচিত-অনুচিত, মানুষের মৃত্যু - একেবারেই জল ভাত খাওয়ার মতই প্রয়োজনীয় বলে বিবেচিত হয়। আদিম সাম্যবাদের যুগ পার করে মানুষ যখন রাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার অধীনস্থ হয়েছে, তখন থেকেই এটাকে শুধু মান্যতা নয়, অত্যাবশ্যকীয় কর্তব্য বলে বিবেচিত হয়ে এসেছে।
কিন্তু ইউরোপে, ফরাসি বিপ্লবের সূত্র ধরে, এই রাষ্ট্রদর্শনে পরিবর্তন এসেছে। সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার আদর্শ রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। মানব কল্যাণ হয়ে উঠেছে রাজনীতির মূল উদ্দেশ্য। এটাই সারা পৃথিবীতে এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য ও মান্য রাষ্ট্রদর্শন। প্রাচীন ভারতে সম্রাট অশোকের যুদ্ধ বিজয় নীতি ত্যাগ করে ধর্ম বিজয় নীতি গ্রহণের মধ্যে এই রাষ্ট্র দর্শনের প্রথম প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। কলিঙ্গ যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখার পর তিনি প্রজাকে 'নিজের সন্তান' বলে অভিহিত করেছিলেন এবং প্রজার কল্যাণকে রাষ্ট্রের অবশ্য কর্তব্য বলে ঘোষণা করেছিলেন। তাই ইতিহাস তাকে 'মহামতি' এবং 'প্রথম জনকল্যাণকামী' শাসক হিসেবে চিহ্নিত করেছে। আধুনিক গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা এই উদ্দেশ্য পূরণের একটি আধুনিকতম অস্ত্র। এই অস্ত্রের প্রধান লক্ষ্য তাই মানুষের কল্যাণ, ব্যক্তি মানুষের স্বাধীনতা ও ন্যায় বিচারকে নিশ্চিত করা। এর সূত্রেই তা মানবতাবাদী।
মানবতাবাদী আধুনিক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা তাই মানুষের কল্যাণকেই একমাত্র লক্ষ্য বলে বিবেচনা করে। কোনো অজুহাতে, কোন একজন সৎ মানুষকেও ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত করা যায় না। একজনের অপরাধের ফল অন্য কোন নিরপরাধ মানুষ ভোগ করবে - হতে পারে না। কোন আইন যদি এক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে, তবে তা বাতিল বলে বিবেচিত হয়। কারণ, এ ধরনের রাষ্ট্রব্যবস্থা এই নৈতিক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে থাকার কথা। কারণ, এটা তার অন্যতম প্রধান ভিত্তি এবং শর্তও।
প্রশ্ন হল, কারা যোগ্য তা কীভাবে প্রমাণ হবে? সরকার সহযোগিতা করছে না। তাহলে পাল্টা প্রশ্ন উঠবে সরকার সহযোগিতা না করলে যদি সত্য প্রকাশ না পায়, তবে তদন্তকারী সংস্থা কিংবা বিচার ব্যবস্থার কি কোন গুরুত্ব থাকে? অপরাধী সহযোগিতা না করলে যদি অপরাধ বা সত্য উদঘাটন সম্ভব না হয়, তাহলে কোন সংস্থার অস্তিত্বের পাশে প্রশ্নচিহ্ন উঠবে না কেন? তাদের অক্ষমতার ফল সাধারণ জনগণ ভুগবে কেন? মানুষ কাদের ওপর তবে ভরসা করবে? চোর তো চুরি করে প্রমাণ লোপাটের চেষ্টা করবেই। এবং ইতিহাস বলছে চোর সম্পূর্ণ প্রমাণ লোপাট করতে কখনোই সফল হয় না। এক্ষেত্রেও হয়নি। তার প্রমাণ, পাহাড় প্রমাণ দুর্নীতি জনসমক্ষে এসেছে।
কোন ডাটা যদি একবার ইন্টারনেটে আপলোড হয়, তবে তার একটা ক্লোন বা কপি ক্লাউড স্টোরেজে জমা হয়ে যায় ইনক্রিপটেড ডাটা হিসাবে, যা সাধারণ মানুষের পক্ষে পাঠ করা কিম্বা উদ্ধার করা অসম্ভব। বঞ্চিত প্রার্থীরা যে তথ্য সামনে এনেছেন এবং যার ভিত্তিতে ইনভেস্টিগেশন শুরু করে প্রমাণ হয়েছে যে বড় ধরনের দুর্নীতি হয়েছে, তা তারা সংগ্রহ করেছে ইন্টারনেট থেকেই। তা যদি হয়, তাহলে তা সরকারি কোন সংস্থার কম্পিউটারের হার্ডডিস্কে তা থাকলো কি থাকলো না, তার ওপর একমাত্র নির্ভরশীল হওয়ার প্রয়োজন হয় না। কারণ, তার ক্লোন কপি ক্লাউড স্টোরেজে জমা আছে। এই ক্লাউড স্টোরেজগুলোর সিংহভাগ নিয়ন্ত্রণ করে আমেরিকাসহ বিদেশী রাষ্ট্রের অধীন বড় বড় কোম্পানিগুলো। সরকার বা ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট চাইলেই ক্লাউড স্টোরেজ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে এই সব তথ্য সংগ্রহ করতে পারেন। আর এটা সরকার-সহ সব পক্ষই জানেন। কম্পিউটার এবং নেটওয়ার্কবিষয়ক বিশেষজ্ঞের মতামত হল এভাবে প্রায় সমস্ত ডাটাই পুনরুদ্ধার করা করা সম্ভব।
যদি তাই হয়, তবে প্রশ্ন উঠবে, সরকার-সহ এই বিভাগগুলো তা করছে না কেন? তাহলে তারা কি চাইছে সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস হয়ে যাক? মানুষ এই ব্যবস্থার প্রতি আস্থা হারাক এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান মুখী হোক?
প্রশ্ন উঠতে বাধ্য, এতো সংখ্যক শিক্ষক শিক্ষিকার স্কুলে যাওয়ার ও শিক্ষক হিসেবে কাজ করার সুযোগ কেড়ে নিয়ে স্কুলগুলোকেই কি আসলে পঙ্গু করে দেওয়া হল না? আরও সময় নিয়ে অনুসন্ধান করলে অসুবিধা কোথায়? অযোগ্যদের খুঁজে বের করতে পারিনি বলে সবাইকে শাস্তি দেওয়ার এত ব্যস্ততা কিসের? এর কি কোন বিকল্প ছিল না? যে সাড়ে ৫ হাজার-এর বিরুদ্ধে সরাসরি প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে তদন্তকারী সংস্থা দাবি করছে, তাদের বরখাস্ত করা এবং সন্দেহভাজনদের আংশিক বেতনের মাধ্যমে স্কুলগুলোতে কাজ চালিয়ে যাওয়ার বিধান কি দেওয়া যেত না, যতদিন সত্য খুঁজে বের করার ক্ষেত্রে উপরোক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো সফল না হয়? যদি এটা হয় যে সরকার সহযোগিতা করছে না - তা তো সরকারের দোষ। তার ফল সাধারণ মানুষ (যোগ্য চাকরিজীবি এবং ছাত্রছাত্রী) কেন ভোগ করবে?
তাছাড়া, দুর্নীতি কেবলমাত্র শিক্ষা বিভাগেই হয়েছে এমন তো নয়, নিরপেক্ষ সংবাদ মাধ্যমগুলো নজরে আনলে সহজেই অনুমান করা যায়, তা অন্যান্য ক্ষেত্রেও হয়েছে। এবং সেক্ষেত্রে কেন্দ্র ও রাজ্য কেউ কম যায় না। অন্যগুলোর ক্ষেত্রে তদন্তের নামে ঝুলিয়ে রেখে কেবলমাত্র শিক্ষা ব্যবস্থাকে টার্গেট করার মধ্যে কি গভীর কোন উদ্দেশ্য কাজ করছে বলে অনুমান করা যায় না? নাগরিক সমাজ সে কথা ভাবছে।
আসলে ভারতবর্ষে জুড়ে শুরু হয়েছে নেতিবাচক রাজনীতির চর্চা। কর্পোরেট পুঁজির চাপে ইতিবাচক রাজনীতির নাভিশ্বাস উঠছে। নিশ্চিত মুনাফার এমন ক্ষেত্র সরকারি হাতে থাকলে গরিব মানুষের জগৎ, জীবন ও নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠতে পারে বটে, কিন্তু কর্পোরেট পুঁজির মুনাফায় ঘাটতি তৈরি হয়। তাই নেতিবাচক রাজনীতির চর্চা আজ কর্পোরেট মিডিয়া জুড়ে। সাধারণ মানুষ (শিক্ষক ও ছাত্র সমাজ) পুঁজির হাঁড়ি কাটে গলা দেয়া এক একজন বলির পাঁঠা মাত্র।
-------------xx-----------
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন