জল নিয়ে জলঘোলা করা পানির মত সহজ নয়
আলী হোসেন
সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত সরকারি অনুষ্ঠানে চিত্র শিল্পী শুভাপ্রসন্ন ভট্টাচার্য পানি শব্দকে বাংলা নয় বলে দাবি করেছেন। বলেছেন, "আমরা কোনোদিন কখনও বাংলা ভাষায় পানি (শব্দটা) ব্যবহার করি না"। শুধু তা-ই নয়, পানি শব্দের ব্যবহারের মধ্যে তিনি 'সাম্প্রদায়িকতার ছাপ'ও দেখতে পেয়েছেন।
প্রশ্ন হল - এক, এই ভাবনা কতটা বাংলা ভাষার পক্ষে স্বাস্থ্যকর এবং কতটা 'বাংলা ভাষার ইতিহাস' সম্মত? দুই, জল বা পানি নিয়ে যারা জলঘোলা করছেন তারা কি বাংলাকে ভালোবেসে করছেন? মনে হয় না। কারণ, খোঁজ নিলে দেখা যাবে, এরা কেউ নিজের সন্তানকে বাংলা মিডিয়াম স্কুলে পড়াননি বা পড়ান না। ব্যবহারিক জীবনেও তারা বাংলার ভাষার চেয়ে ইংরেজি বা হিন্দিতে কথা বলতে বা গান শুনতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন, বলা ভালো গর্ববোধ করেন।
প্রসংগত মনে রাখা দরকার, বাংলা মিডিয়াম স্কুলগুলোতে যারা ভর্তি হয়, তারা অধিকাংশই গরীব ঘরের সন্তান। বলা ভালো, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে তারাই বাংলা ভাষাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। কারণ, সন্তানকে বাংলা মিডিয়ামে পড়ানোর পাশাপাশি, বাংলা ভাষাকে এরাই সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করেন তাদের ব্যবহারিক জীবনে। তাদের জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্র ছুঁয়ে থাকে বাংলা ভাষা। সুখে-দুখে, রাগে-অনুরাগে, মান-অভিমানে, ক্ষোভে-বিক্ষোভে বাংলাই তাদের ভাব প্রকাশের একমাত্র মাধ্যম।
মজার কথা হলো, তারা জল, না পানি - এ বিতর্কে জড়ান না। তাদের কাছে জলও যা, পানিও তা-ই। এই শ্রেণির একজন মুসলিম মানুষ কোন হিন্দু বাড়িতে গিয়ে 'জল' চাইতে যেমন দ্বিধা করেন না, তেমনি একজন হিন্দু কোন মুসলিম বাড়িতে গিয়েও 'পানি' বলতে ইতস্তত করেন না। কারণ, তারা জানেন, যা জল, তা-ই পানি। যত সমস্যা বড় বড় ডিগ্রিধারী তথাকথিত শিক্ষিত মানুষ এবং তাদের মগজ ধোলাইয়ের শিকার অল্প শিক্ষিত কিছু মানুষের।
আসুন 'জল' বা 'পানি' শব্দের উৎস অনুসন্ধান করে দেখা যাক। কী বলছে ভাষাতত্ত্বের বা ভাষার বিবর্তনের ইতিহাস।
ব্যুৎপত্তিগত দিক থেকে বিচার করলে এই দুটো শব্দের কোনটাই বাংলা নয়। দুটোই এসেছে সংস্কৃত ধাতু থেকে। পানি এসেছে ‘পা’ ধাতুর সঙ্গে ‘অনীয়’ প্রত্যয় যুক্ত হয়ে তৈরি সংস্কৃত শব্দ (√পা+অনীয়=পানীয়) 'পানীয়'র তদ্ভব রূপ (পানীয়>পানি) হিসেবে, আর জল এসেছে ’জল্’ ধাতুর সঙ্গে ‘অ’ প্রতায় (√জল্+অ=জল) যুক্ত হয়ে। আর তাই যদি হয়, তবে জল বাংলা, আর পানি বাংলা নয় - এটা হয় কীভাবে?
এবার আসুন ইতিহাসে। বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন হচ্ছে চর্যাপদ। সেখানে অবলীলায় ব্যবহৃত হয়েছে পানি শব্দটি। যতটা জানা যাচ্ছে, জল সেখানে নেই। পানি কীভাবে আছে চর্যাপদে দেখুন; চর্যাপদে ভুসুক পা লিখেছেন -
তিণ ন চছুপইী হরিণা পিবই ন পাণী।অর্থাৎ ‘ধৃত হরিণ প্রাণভয়ের হতভম্বতায় ঘাসও খায় না, ‘পাণী' (পানী) পানও করে না।”
হরিণা হরিণির নিলঅ ণ জাণী।।
বড়ু চণ্ডীদাস তাঁর শ্রীকৃষ্ণকীর্ত্তন লিখতে গিয়ে এই দুটো শব্দই ব্যবহার করেছেন অবলীলায়।
মধ্যযুগের কবিরাও অবলীলায় ব্যবহার করছেন এই শব্দ দুটো। চণ্ডীমঙ্গলে লেখা হচ্ছে,
তোহ্মার বোলে কেহো কাহ্নাঞি না বহিব পাণী।বড়ু চন্ডীদাস অসংখ্যবার পাণী বা পাণি শব্দটি ব্যবহার করেছেন, কখন জল, কখনো পানীয় আবার কখনো বৃষ্টির প্রতিশব্দ হিসাবে।
উচিত নিফল হৈব তোর জল ভাবি বুঝ চক্রপাণী।। (যমুনাখণ্ড)
মধ্যযুগের কবিরাও অবলীলায় ব্যবহার করছেন এই শব্দ দুটো। চণ্ডীমঙ্গলে লেখা হচ্ছে,
বিরহ-জ্বরে পতি যদি মরেচৈতন্যমঙ্গলেও এই দুই শব্দের ব্যবহার রয়েছে। নিচের দুটি পংক্তি লক্ষ্য করুন।
কোন ঘাটে খাবে পাণী কাঁখে
হেমঝারি মেনকা সুন্দরী
জল সাধে ঘরে ঘরে (কবিকঙ্কণ)।
এ বোল শুনিয়া পুনঃ প্রভু বিশ্বম্ভর।
কান্দয়ে দ্বিগুণ ঝরে নয়নের জল।।
এবং
মুখে নাহি সরে বানী
দু নয়নে ঝরে পানি...- লোচনদাস।
তাহলে কি দাঁড়ালো? 'পানি' শব্দটি বাংলা ভাষায় আদিকাল থেকেই আছে। কিন্তু 'জল' নেই। জল শব্দটি সংস্কৃত শব্দভাণ্ডার থেকে বাংলা ভাষায় প্রবেশ করেছে। এবং সেটা পানি শব্দের প্রবেশের অনেক পরে। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, ব্যাবহারিক প্রাচীনত্বের কারণে ‘পানি’ শব্দটি অপেক্ষাকৃত গরিব এবং লেখাপড়া না জানা বাঙালি শ্রমজীবী ও কৃষিজীবী সম্প্রদায় (যাদের অধিকাংশই নিম্নবর্ণের মানুষ ছিলেন এবং উচ্চবর্ণের মানুষের দ্বারা অস্পৃশ্য বলে ঘৃণিত ও নিদারুণভাবে শোষিত হত। এই সামাজিক অসাম্য ও অর্থনৈতিক শোষণের হাত থেকে মুক্তি পেতেই যারা ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলিম হয়েছিল) বেশি ব্যবহার করে থাকেন। অন্যদিকে একটি সহজবোধ্য সংস্কৃত শব্দ 'জল' থাকায় সংস্কৃত পণ্ডিতদের ‘পানি’ শব্দটিকে ইসলামি শব্দ এবং অস্পৃশ্যদের ব্যবহার্য শব্দ হিসেবে প্রচার শুরু করেন। ফলে বাংলা সাহিত্যে প্রাচীন কাল থেকে ব্যবহৃত হয়ে আসা ‘পানি’ শব্দটি সংস্কৃত হয়েও হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে নিজস্বতা হারিয়ে ফেলেছে। এই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ ‘পানি’ শব্দের পরিবর্তে ‘জল’ ব্যবহার করতে শুরু করেন এবং ‘জল’ হয়ে যায় হিন্দুয়ানি শব্দ আর পানি মুসলমানি শব্দ।
লক্ষণীয় হল, কে কোন শব্দ ব্যবহার করবেন তা নির্ভর করে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর। তার মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দুটি বিষয়ের একটি হল পরিবেশগত, অন্যটা উচ্চারণে সুবিধাগত। উচ্চারণের সুবিধার দিক থেকে জল ও পানি দুটোই সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। তাই দুটোই কালোত্তীর্ণ এবং বাংলা ভাষায় সমান গুরুত্ব পায়। তবে পরিবেশগত কারণে (সংস্কৃত পণ্ডিতদের প্রচারের কারণে) শব্দ দুটো দুই ঘরানায় বিভক্ত হয়ে গেছে। যে অঞ্চলে হিন্দু সম্প্রদায়ের বিশেষ করে উচ্চ বর্ণের মানুষের বসবাস ও প্রভাব বেশি সেখানে জল এবং যে অঞ্চলে মুসলিম ও নিম্ন বর্ণের মানুষের বসবাস বেশি সেখানে পানি জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
এই পরিবেশগত কারণেই হিন্দু প্রধান পশ্চিম বাংলায় হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে বেশিরভাগ মানুষ 'জল' এবং মুসলিম প্রধান পূর্ববঙ্গে উভয় সম্প্রদায়ের বেশিরভাগ মানুষ 'পানি' শব্দটা ব্যবহার করে থাকেন।
প্রশ্ন হল তাহলে এই জল নিয়ে জল ঘোলা করার উৎস কোথায়? দুভাবে বিষয়টি ভাবা যেতে পারে।
এক, ভাষার উৎপত্তি ও তার বিকাশ বিষয়ে ঐতিহাসিক তথ্য না থাকা এবং তা সত্ত্বেও নিজেকে একজন ভাষাতাত্ত্বিক হিসাবে জাহির করার প্রবণতা (শুভাপ্রসন্ন ভট্টাচার্য-এর ক্ষেত্রে কি সেটাই ঘটেছে?)। অথবা
দুই, বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে বিভাজনের রাজনীতিকে উসকে দেওয়ার চেষ্টা করা।
বর্তমান ভারতের প্রেক্ষাপটে দ্বিতীয় উদ্দেশ্যটি গুরুত্ব পাচ্ছে বেশি। কারণ, এক্ষেত্রে বাঙালি ভোট-ব্যাংককে আড়াআড়ি ভাবে দুভাবে বিভক্ত করে ফেলার সুযোগ রয়েছে। এটা করতে পারলে বিভাজনের রাজনীতি করে যারা ক্ষমতায় আসার স্বপ্ন দেখে তাদের সুবিধা হয়। তাই তাদের যারা শুভাকাঙ্ক্ষী আছেন তারা জেনে বুঝেই এই ধরনের অপচেষ্টা করে থাকেন।
এই দুই শ্রেণির মানুষেরই একটি সাধারণ মিল আছে। এরা বাংলা ভাষা নিয়ে দরদ দেখান কিন্তু নিজের সন্তানকে বাংলা ভাষা শিক্ষা কিংবা বাংলা মিডিয়ামে পড়ানোর ক্ষেত্রে সীমাহীন অনীহা প্রকাশ করেন। তাদের শিক্ষার এই দৈন্যই বোধ হয় তাদের ভুলিয়ে দেয় যে, জল নিয়ে জলঘোলা করা সহজ, কিন্তু পানির মত সহজ নয়।
----------x--------
দিন দর্পণ পত্রিকায় প্রকাশিত, ১ লা মার্চ ২০২৩
📗 পাঠকের প্রতিক্রিয়া দেখুন ফেসবুকে এখানে ক্লিক করুন।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন