সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

জল, না পানি : জল নিয়ে জলঘোলা করা পানির মত সহজ নয়

জল নিয়ে জলঘোলা করা পানির মত সহজ নয়

আলী হোসেন 


সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত সরকারি অনুষ্ঠানে চিত্র শিল্পী শুভাপ্রসন্ন ভট্টাচার্য পানি শব্দকে বাংলা নয় বলে দাবি করেছেন। বলেছেন, "আমরা কোনোদিন কখনও বাংলা ভাষায় পানি (শব্দটা) ব্যবহার করি না"। শুধু তা-ই নয়, পানি শব্দের ব্যবহারের মধ্যে তিনি 'সাম্প্রদায়িকতার ছাপ'ও দেখতে পেয়েছেন।

প্রশ্ন হল - এক, এই ভাবনা কতটা বাংলা ভাষার পক্ষে স্বাস্থ্যকর এবং কতটা 'বাংলা ভাষার ইতিহাস' সম্মত? দুই, জল বা পানি নিয়ে যারা জলঘোলা করছেন তারা কি বাংলাকে ভালোবেসে করছেন? মনে হয় না। কারণ, খোঁজ নিলে দেখা যাবে, এরা কেউ নিজের সন্তানকে বাংলা মিডিয়াম স্কুলে পড়াননি বা পড়ান না। ব্যবহারিক জীবনেও তারা বাংলার ভাষার চেয়ে ইংরেজি বা হিন্দিতে কথা বলতে বা গান শুনতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন, বলা ভালো গর্ববোধ করেন।

প্রসংগত মনে রাখা দরকার, বাংলা মিডিয়াম স্কুলগুলোতে যারা ভর্তি হয়, তারা অধিকাংশই গরীব ঘরের সন্তান। বলা ভালো, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে তারাই বাংলা ভাষাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। কারণ, সন্তানকে বাংলা মিডিয়ামে পড়ানোর পাশাপাশি, বাংলা ভাষাকে এরাই সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করেন তাদের ব্যবহারিক জীবনে। তাদের জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্র ছুঁয়ে থাকে বাংলা ভাষা। সুখে-দুখে, রাগে-অনুরাগে, মান-অভিমানে, ক্ষোভে-বিক্ষোভে বাংলাই তাদের ভাব প্রকাশের একমাত্র মাধ্যম।

মজার কথা হলো, তারা জল, না পানি - এ বিতর্কে জড়ান না। তাদের কাছে জলও যা, পানিও তা-ই। এই শ্রেণির একজন মুসলিম মানুষ কোন হিন্দু বাড়িতে গিয়ে 'জল' চাইতে যেমন দ্বিধা করেন না, তেমনি একজন হিন্দু কোন মুসলিম বাড়িতে গিয়েও  'পানি' বলতে ইতস্তত করেন না। কারণ, তারা জানেন, যা জল, তা-ই পানি। যত সমস্যা বড় বড় ডিগ্রিধারী তথাকথিত শিক্ষিত মানুষ এবং তাদের মগজ ধোলাইয়ের শিকার অল্প শিক্ষিত কিছু মানুষের। 

আসুন 'জল' বা 'পানি' শব্দের উৎস অনুসন্ধান করে দেখা যাক। কী বলছে ভাষাতত্ত্বের বা ভাষার  বিবর্তনের ইতিহাস।

ব্যুৎপত্তিগত দিক থেকে বিচার করলে এই দুটো শব্দের কোনটাই বাংলা নয়। দুটোই এসেছে সংস্কৃত ধাতু থেকে। পানি এসেছে ‘পা’ ধাতুর সঙ্গে ‘অনীয়’ প্রত্যয় যুক্ত হয়ে তৈরি সংস্কৃত শব্দ (√পা+অনীয়=পানীয়) 'পানীয়'র তদ্ভব রূপ (পানীয়>পানি) হিসেবে, আর জল এসেছে ’জল্‌’ ধাতুর সঙ্গে ‘অ’ প্রতায় (√জল্‌+অ=জল) যুক্ত হয়ে। আর তাই যদি হয়, তবে জল বাংলা, আর পানি বাংলা নয় - এটা হয় কীভাবে?

এবার আসুন ইতিহাসে। বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন হচ্ছে চর্যাপদ। সেখানে অবলীলায় ব্যবহৃত হয়েছে পানি শব্দটি। যতটা জানা যাচ্ছে, জল সেখানে নেই। পানি কীভাবে আছে চর্যাপদে দেখুন; চর্যাপদে ভুসুক পা লিখেছেন -
তিণ ন চছুপইী হরিণা পিবই ন পাণী।
হরিণা হরিণির নিলঅ ণ জাণী।।
অর্থাৎ ‘ধৃত হরিণ প্রাণভয়ের হতভম্বতায় ঘাসও খায় না, ‘পাণী' (পানী) পানও করে না।”

বড়ু চণ্ডীদাস তাঁর শ্রীকৃষ্ণকীর্ত্তন লিখতে গিয়ে এই দুটো শব্দই ব্যবহার করেছেন অবলীলায়।
তোহ্মার বোলে কেহো কাহ্নাঞি না বহিব পাণী।
উচিত নিফল হৈব তোর জল ভাবি বুঝ চক্রপাণী।। (যমুনাখণ্ড)
বড়ু চন্ডীদাস অসংখ্যবার পাণী বা পাণি শব্দটি ব্যবহার করেছেন, কখন জল, কখনো পানীয় আবার কখনো বৃষ্টির প্রতিশব্দ হিসাবে।

মধ্যযুগের কবিরাও অবলীলায় ব্যবহার করছেন এই শব্দ দুটো। চণ্ডীমঙ্গলে লেখা হচ্ছে,
বিরহ-জ্বরে পতি যদি মরে
কোন ঘাটে খাবে পাণী কাঁখে
হেমঝারি মেনকা সুন্দরী
জল সাধে ঘরে ঘরে (কবিকঙ্কণ)।
চৈতন্যমঙ্গলেও এই দুই শব্দের ব্যবহার রয়েছে। নিচের দুটি পংক্তি লক্ষ্য করুন।
এ বোল শুনিয়া পুনঃ প্রভু বিশ্বম্ভর।
কান্দয়ে দ্বিগুণ ঝরে নয়নের জল।।
এবং 
মুখে নাহি সরে বানী
দু নয়নে ঝরে পানি...- লোচনদাস।
তাহলে কি দাঁড়ালো? 'পানি' শব্দটি বাংলা ভাষায় আদিকাল থেকেই আছে। কিন্তু 'জল' নেই। জল শব্দটি সংস্কৃত শব্দভাণ্ডার থেকে বাংলা ভাষায় প্রবেশ করেছে। এবং সেটা পানি শব্দের প্রবেশের অনেক পরে। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, ব্যাবহারিক প্রাচীনত্বের কারণে ‘পানি’ শব্দটি অপেক্ষাকৃত গরিব এবং লেখাপড়া না জানা বাঙালি শ্রমজীবী ও কৃষিজীবী সম্প্রদায় (যাদের অধিকাংশই নিম্নবর্ণের মানুষ ছিলেন এবং উচ্চবর্ণের মানুষের দ্বারা অস্পৃশ্য বলে ঘৃণিত ও নিদারুণভাবে শোষিত হত। এই সামাজিক অসাম্য ও অর্থনৈতিক শোষণের হাত থেকে মুক্তি পেতেই যারা ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলিম হয়েছিল) বেশি ব্যবহার করে থাকেন। অন্যদিকে একটি সহজবোধ্য সংস্কৃত শব্দ 'জল' থাকায় সংস্কৃত পণ্ডিতদের ‘পানি’ শব্দটিকে ইসলামি শব্দ এবং অস্পৃশ্যদের ব্যবহার্য শব্দ হিসেবে প্রচার শুরু করেন। ফলে বাংলা সাহিত্যে প্রাচীন কাল থেকে ব্যবহৃত হয়ে আসা ‘পানি’ শব্দটি সংস্কৃত হয়েও হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে নিজস্বতা হারিয়ে ফেলেছে। এই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ ‘পানি’ শব্দের পরিবর্তে ‘জল’ ব্যবহার করতে শুরু করেন এবং ‘জল’ হয়ে যায় হিন্দুয়ানি শব্দ আর পানি মুসলমানি শব্দ।

লক্ষণীয় হল, কে কোন শব্দ ব্যবহার করবেন তা নির্ভর করে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর। তার মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দুটি বিষয়ের একটি হল পরিবেশগত, অন্যটা উচ্চারণে সুবিধাগত। উচ্চারণের সুবিধার দিক থেকে জল ও পানি দুটোই সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। তাই দুটোই কালোত্তীর্ণ এবং বাংলা ভাষায় সমান গুরুত্ব পায়। তবে পরিবেশগত কারণে (সংস্কৃত পণ্ডিতদের প্রচারের কারণে) শব্দ দুটো দুই ঘরানায় বিভক্ত হয়ে গেছে। যে অঞ্চলে হিন্দু সম্প্রদায়ের বিশেষ করে উচ্চ বর্ণের মানুষের বসবাস ও প্রভাব বেশি সেখানে জল এবং যে অঞ্চলে মুসলিম ও নিম্ন বর্ণের মানুষের বসবাস বেশি সেখানে পানি জনপ্রিয়তা পেয়েছে।

এই পরিবেশগত কারণেই হিন্দু প্রধান পশ্চিম বাংলায় হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে বেশিরভাগ মানুষ 'জল' এবং মুসলিম প্রধান পূর্ববঙ্গে উভয় সম্প্রদায়ের বেশিরভাগ মানুষ 'পানি' শব্দটা ব্যবহার করে থাকেন।

প্রশ্ন হল তাহলে এই জল নিয়ে জল ঘোলা করার উৎস কোথায়? দুভাবে বিষয়টি ভাবা যেতে পারে।
এক, ভাষার উৎপত্তি ও তার বিকাশ বিষয়ে ঐতিহাসিক তথ্য না থাকা এবং তা সত্ত্বেও নিজেকে একজন ভাষাতাত্ত্বিক হিসাবে জাহির করার প্রবণতা (শুভাপ্রসন্ন ভট্টাচার্য-এর ক্ষেত্রে কি সেটাই ঘটেছে?)। অথবা
দুই, বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে বিভাজনের রাজনীতিকে উসকে দেওয়ার চেষ্টা করা।

বর্তমান ভারতের প্রেক্ষাপটে দ্বিতীয় উদ্দেশ্যটি গুরুত্ব পাচ্ছে বেশি। কারণ, এক্ষেত্রে বাঙালি ভোট-ব্যাংককে আড়াআড়ি ভাবে দুভাবে বিভক্ত করে ফেলার সুযোগ রয়েছে। এটা করতে পারলে বিভাজনের রাজনীতি করে যারা ক্ষমতায় আসার স্বপ্ন দেখে তাদের সুবিধা হয়। তাই তাদের যারা শুভাকাঙ্ক্ষী আছেন তারা জেনে বুঝেই এই ধরনের অপচেষ্টা করে থাকেন।

এই দুই শ্রেণির মানুষেরই একটি সাধারণ মিল আছে। এরা বাংলা ভাষা নিয়ে দরদ দেখান কিন্তু নিজের সন্তানকে বাংলা ভাষা শিক্ষা কিংবা বাংলা মিডিয়ামে পড়ানোর ক্ষেত্রে সীমাহীন অনীহা প্রকাশ করেন। তাদের শিক্ষার এই দৈন্যই বোধ হয় তাদের ভুলিয়ে দেয় যে, জল নিয়ে জলঘোলা করা সহজ, কিন্তু পানির মত সহজ নয়।
----------x--------
দিন দর্পণ পত্রিকায় প্রকাশিত, ১ লা মার্চ ২০২৩ 
📗 পাঠকের প্রতিক্রিয়া দেখুন ফেসবুকে এখানে ক্লিক করুন

মন্তব্যসমূহ

📂 আলী হোসেনের জনপ্রিয় প্রবন্ধগুলি

হিন্দু কারা? তারা কীভাবে হিন্দু হল?

হিন্দু কারা? কীভাবে তারা হিন্দু হল? যদি কেউ প্রশ্ন করেন, অমিত শাহ হিন্দু হলেন কবে থেকে? অবাক হবেন তাই তো? কিন্তু আমি হবো না। কারণ, তাঁর পদবী বলে দিচ্ছে উনি এদেশীয়ই নন, ইরানি বংশোদ্ভুত। কারণ, ইতিহাস বলছে পারস্যের রাজারা ‘শাহ’ উপাধি গ্রহণ করতেন। এবং ‘শাহ’ শব্দটি পার্শি বা ফার্সি। লালকৃষ্ণ আদবানির নামও শুনেছেন আপনি। মজার কথা হল আদবানি শব্দটিও এদেশীয় নয়। আরবি শব্দ ‘আদবান’ থেকে উদ্ভূত। সুতরাং তাঁর পদবীও বলছে, তিনিও এদেশীয় নন। ভাষাতত্ত্ব ও নৃতত্ত্বের বিশ্লেষণ বলছে, উচ্চবর্ণের বিশেষ করে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের মানুষদের, উৎসভূমি হল পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চল। তারও আগে ছিল ইউরোপের ককেশাস অঞ্চলে। আসলে এরা (উচ্চবর্ণের মানুষ) কেউই এদেশীয় নয়। তারা নিজেদের আর্য বলে পরিচয় দিতেন এবং এই পরিচয়ে তারা গর্ববোধ করতেন। সিন্ধু সভ্যতা পরবর্তীকালে তারা পারস্যের বিভিন্ন এলাকা থেকে হিন্দুকুশ পর্বতের গিরিপথ ধরে এদেশে অভিবাসিত হয়েছেন। আর মধ্যযুগে এসে এদেরই উত্তরসূরী ইরানিরা (অমিত শাহের পূর্বপুরুষ) অর্থাৎ পারস্যের কিছু পর্যটক-ঐতিহাসিক, এদেশের আদিম অধিবাসীদের ’হিন্দু’ বলে অভিহিত করেছেন তাদের বিভিন্ন ভ্রমণ বৃত্তান্তে।

রবীন্দ্রনাথের ধর্মভাবনা ও তার বিবর্তন

রবীন্দ্রনাথের ধর্মভাবনা ও তার বিবর্তন আলী হোসেন  যদি প্রশ্ন করা হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ধর্ম কী? মনে হয় অনেকেই ঘাবড়ে যাবেন। কেউ বলবেন, তাঁর বাবা যখন ব্রাহ্ম ছিলেন তাহলে তিনি নিশ্চয়ই ব্রাহ্ম। যারা লেখাপড়া জানেন না, তারা বলবেন, কেন! উনি তো হিন্দু ছিলেন। আবার কেউ কেউ তথ্য সহযোগে এও বলার চেষ্টা করবেন যে, উনি নাস্তিক ছিলেন; না হলে কেউ বলতে পারেন, ধর্মমোহের চেয়ে নাস্তিকতা অনেক ভালো? ¹ রবীন্দ্রনাথের ধর্ম ভাবনার বিবর্তন  তাহলে সঠিক উত্তরটা কী? আসলে এর কোনোটাই সঠিক উত্তর নয়। চিন্তাশীল মানুষ-মাত্রই সারা জীবন ধরে ভাবেন, ভাবতে ভাবতে তাঁর উপলব্ধি বাড়তে থাকে ক্রমশঃ প্রগতির পথে। জগৎ ও জীবন থেকে তথ্য সংগ্রহ করে একে একে গড়ে তোলেন নিত্যনতুন জীবনদর্শন। তাই এ ধরনের মানুষ আজীবন এক এবং অখণ্ড জীবনদর্শনের বার্তা বহন করেন না। সময়ের সাথে সাথে পাল্টে যায় তাঁর পথচলার গতিমুখ। মানুষ রবীন্দ্রনাথও তাই পাল্টে ফেলেছেন তাঁর জীবন ও ধর্মদর্শন সময়ের বয়ে যাওয়াকে অনুসরণ করে। রবীন্দ্রনাথ ও  হিন্দু জাতীয়তাবাদ ১৮৬১ সালের ৭ই মে সোমবার রাত্রি ২টা ৩৮ মিনিট ৩৭ সেকেন্ডে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে জন্ম গ্রহণ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এর

সীমান্ত আখ্যান, বাঙালির আত্মানুসন্ধানের ডিজিটাল আখ্যান

সময়ের সঙ্গে সমস্যার চরিত্র বদলায়। কিন্তু মুলটা বদলায় না। যদি সে সমস্যা ইচ্ছা করে তৈরি হয়ে থাকে বিশেষ সুবিধা ভোগেই লোভে, তবে তো অন্য কথা চলেই না। স্বনামধন্য স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাতা সৌমিত্র দস্তিদারের ডকুমেন্টারি ফিল্প 'সীমান্ত আখ্যান' দেখার পর এই উপলব্ধি মাথা জুড়ে ঘুরপাক খাচ্ছে। দেখলাম, দেশ ভাগ হয়েছে। কিন্তু সমস্যার অবসান হয়নি। শুধু সমস্যার চরিত্রটা পাল্টেছে। এই যে সমস্যা রয়ে গেল, কোন গেল? তার উত্তর ও পাওয়া গেল 'সীমান্ত আখ্যান' এ। আসলে দেশ ভাগ তো দেশের জনগণ চাননি, চেয়েছেন দেশের নেতারা। চেয়েছেন তাঁদের ব্যক্তিগত, সম্প্রদায়গত সুবিধাকে নিজেদের কুক্ষিগত করার নেশায়। আর এই নেশার রসদ যোগান দিতে পারার নিশ্চয়তা নির্ভর করে রাজনৈতিক ক্ষমতার লাগাম নিজের হাতে থাকার ওপর। তাই রাজনীতিকরা এই ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য জনগণকে 'ডিভাইড এন্ড রুল' পলিছি দ্বারা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চেষ্টা করেছেন এবং করে চলেছেন। এ সমস্যা নতুন না, ব্রিটিশ সরকার এর বীজ রোপণ করে গেছেন, এখন কেউ তার সুফল ভোগ করছে (রাজনীতিকরা) আর কেউ কুফল (জনগন)। 'সীমান্ত আখ্যান চোখে আঙুল দিয়ে দে

ভাগ্য : মুসলিম মনস্তত্ত্ব, ধর্মদর্শন ও প্রগতি

ভাগ্য : মুসলিম মনস্তত্ত্ব, ধর্মদর্শন ও প্রগতি - লিখছেন আলী হোসেন  কপালের লেখন খণ্ডায় কার সাধ্য? জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে কিংবা লেখাপড়া জানা-নাজানা নির্বিশেষে সমস্ত মানুষের সিংহভাগই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এই কথাটা মেনে নেয়। জীবনের উত্থান-পতনের ইতিহাসে কপালের লেখনকে জায়গা করে দিতে তারা কুণ্ঠাবোধ করে না। বরং বলা ভালো এব্যাপারে তারা অতিমাত্রায় উদার। মানুষের মনস্তত্বের এ-এক জটিল স্তর বিন্যাস। একই মানুষ বিভিন্ন সময়ে একই বিষয়ের বিচার বিশ্লেষণে ভিন্নভিন্ন দৃষ্টিকোণ ব্যবহার করে। এ রকমই একটি দৃষ্টিকোণ হলো কপাল বা ভাগ্যের ভূমিকাকে সাফল্যের চাবিকাঠি বলে ভাবা। কখনও সে ভাগ্যের নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠার চেষ্টা করে, আবার কখনও নিজেই ভাগ্যের কাছে নির্দিধায় আত্ম সমর্পন করে। নিজের ব্যার্থতার পিছনে ভাগ্যের অদৃশ্য হাতের কারসাজির কল্পনা করে নিজের ব্যার্থতাকে ঢাকা দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে থাকে। মজার কথা, এক্ষেত্রে মুসলিম মানসের মনস্তত্ত্ব কখনও চেতনমনে আবার কখনও অবচেতন মনে উপরওয়ালাকে (আল্লাহকে) কাঠ গড়ায় তোলে বিনা দ্বিধায়। নির্দিধায় বলে দেয়, উপরওয়ালা রাজি না থাকলে কিছুই করার থাকেনা। সাফল্য কিংবা ব্যর্থতা সবই তাঁর (আল্লার

কাশ্মীর ফাইলস : প্রপাগান্ডার এক নয়া ব্রান্ড, কর্পোরেট পুঁজি ও রাজনৈতিক দলের গলাগলির এক সুচারু প্রদর্শনী

কাশ্মীর ফাইলস : প্রপাগান্ডার এক নয়া ব্রান্ড, কর্পোরেট পুঁজি ও রাজনৈতিক দলের গলাগলির এক সুচারু প্রদর্শনী রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয় উলুখাগড়ার প্রাণ যায়। ১৯৪৭ সালের পর থেকে জম্মু ও কাশ্মিরের জনগণের ভাগ্যলিপিতে লেখা হয়ে গেছে এই বিখ্যাত প্রবাদটির বিস্তারিত সারাৎসার। একদিকে পাকিস্তান আর অন্যদিকে ভারত – এই দুই প্রতিবেশি দেশের ভুরাজনৈতিক স্বার্থের যাঁতাকলে পড়ে তাদের এই হাল। কিন্তু কেন এমন হল? এই প্রশ্নের উত্তর জানে না এমন মানুষ ভুভারতে হয়তো বা নেই। কিন্তু সেই জানার মধ্যে রয়েছে বিরাট ধরণের ফাঁক। সেই ফাঁক গলেই ঢুকেছে কাশ্মির ফাইলসের মত বিজেপির রাজনৈতিক ন্যারেটিভ যা তারা বহুকাল ধরে করে চলেছে অন্য আঙ্গিকে। এবার নতুন মাধ্যমে এবং নবরূপে তার আগমন ঘটেছে, যায় নাম সিনেমা বা সেলুলয়েড প্রদর্শনী। যদিও ডিজিটাল মাধ্যমে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সৌজন্যে অনেক আগেই সফলভাবে তারা এই ন্যারেটিভ দিয়ে বিভাজনের রাজনীতি করে চলেছে বেশ কয়েক বছর ধরে। টেলিভিশন সম্প্রচারে কর্পোরেট পুজির অনুপ্রবেশের মাধ্যমে যার সূচনা হয়েছিল। রাষ্ট্রশক্তিকে কুক্ষিগত করতে না পারলে দেশের সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রন আনা সম্ভব নয়, একথা সাধারণ নিরক্ষর নাগরিক এবং ত

শিক্ষা কী, কেন প্রয়োজন এবং কীভাবে অর্জন করা যায়?

শিক্ষা কী, কেন এবং কীভাবে অর্জন করতে হয়? সূচিপত্র : What is education, why it is needed and how to achieve it শিক্ষা কী শিক্ষা হল এক ধরনের অর্জন, যা নিজের ইচ্ছা শক্তির সাহায্যে নিজে নিজেই নিজের মধ্যে জমা করতে হয়। প্রকৃতি থেকেই সেই অর্জন আমাদের চেতনায় আসে। সেই চেতনাই আমাদের জানিয়ে দেয়, জগৎ ও জীবন পরিচালিত হয় প্রকৃতির কিছু অলংঘনীয় নিয়ম-নীতির দ্বারা। গভীর পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ শক্তিকে বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে কাজে লাগালেই এই নিয়মনীতিগুলো আমাদের আয়ত্বে আসে। এই নিয়ম-নীতিগুলো জানা এবং সেই জানার ওপর ভিত্তি করেই জগৎ ও জীবনকে সর্বোত্তম পর্যায়ে পৌঁছে দেয়ার পথ খুঁজে বের করার শক্তি অর্জনই শিক্ষা। মনে রাখতে হবে, এই শিক্ষা কখনও কারও মধ্যে জোর করে ঢুকিয়ে দেওয়া যায় না। এখন প্রশ্ন হল, শিক্ষা অর্জনের বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিটা আসলে কী। সেই আলোচনায় যাওয়ার আগে জানতে হবে, এই শিক্ষার সূচনা হয় কখন এবং কীভাবে? শিক্ষার সূচনা কখন হয় : এই অর্জনের সূচনা হয় মাতৃগর্ভে এবং তা প্রাকৃতিক ভাবেই। প্রকৃতির দেওয়া কিছু সহজাত শিক্ষাকে অবলম্বন করেই তার সূচনা। এই সহজাত শিক্ষাকে অবলম্বন করেই মানুষ তার পরবর্তী প

নিম্নবর্গের মানুষ মার খাচ্ছে কেন

নিম্নবর্গের মানুষ কীভাবে পিছিয়ে পড়েছেন? সমাধান কীভাবে? এদেশের নিম্নবর্গের মানুষ নিজেদের বাঁচাতে যুগ যুগ ধরে ধর্ম পরিবর্তন করেছে। কখনও বৌদ্ধ (প্রাচীন যুগ), কখনও মুসলমান (মধুযুগ), কিম্বা কখনো খ্রিস্টান (আধুনিক যুগ) হয়েছে। কিন্তু কখনই নিজেদের চিন্তা-চেতনাকে পাল্টানোর কথা ভাবেনি। পরিবর্তন হচ্ছে অলংঘনীয় প্রাকৃতিক নিয়ম। যারা এই নিয়ম মেনে সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে পারে, তারাই লাভবান হয়, টিকে থাকে। “পাল্টে গেলেই জীবন বাড়ে না পাল্টালে নয়, জীবন মানেই এগিয়ে যাওয়া নইলে মৃত্যু হয়” জীবনের এই চরম সত্য তারা অধিকাংশই উপলব্ধি করতে পারেনি। পৃথিবীর যেকোন উন্নত জাতির দিকে তাকান, তারা দ্রুততার সঙ্গে এই পরিবর্তনকে মেনে নিজেদেরকে পুনর্গঠন করে নিয়েছে। যারা পারেনি বা নেয়নি তারাই মার খাচ্ছে, অতীতেও খেয়েছে। বুদ্ধিমান জাতি নিজের দুর্বলতাকে মেনে নেয় এবং ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য সময়ের সঙ্গে তাল রেখে নিজেদের চিন্তা এবং চেতনায় পরিবর্তন আনে। খ্রিষ্টান, ইহুদি-সহ এশিয়া, ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন জাতি - যারাই এই পরিবর্তন মেনে নিয়েছে তারাই আরও উন্নত এবং শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। মহানবীর (সঃ) গৌরবময় উত্থান (যা এক ধরণ

আধুনিক মিডিয়া : কর্পোরেট পুঁজির (পুঁজিপতিদের) তোতাপাখি

গোদি মিডিয়া : কর্পোরেট পুঁজির তোতাপাখি পশ্চিমী মিডিয়াকে 'ইসরাইল সরকারের তোতাপাখি' নামে পরিচয় দেওয়া হয় সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী স্বাধীন ও নিরপেক্ষ মিডিয়া হাউজের পক্ষ থেকে। সম্প্রতি একইভাবে ভারতীয় কর্পোরেট মিডিয়া ভারত সরকার তথা 'কর্পোরেট পুঁজির  তোতাপাখি' হিসাবে পরিচয় পাচ্ছে, যাকে নিন্দুকেরা 'গোদী মিডিয়া' নামে অভিহিত করে থাকে। মধ্যপ্রাচ্যের ঘটনা সম্পর্কে ইসরাইল যা বলে, ইউরোপ ও আমেরিকার মিডিয়া, তোতা পাখির মতো তা-ই প্রচার করে। সাংবাদিকতার প্রধান প্রধান শর্তগুলোকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ইসরাইলের দেওয়া তথ্যই তারা প্রচার করে অন্ধ ও নির্লজ্জভাবে। ভারতের ক্ষেত্রেও করপোরেট মিডিয়া বর্তমানে সেটাই করছে বলে অভিযোগ। অভিযোগ, নত মস্তকে ভারত সরকারের দেওয়া তথ্য বিনা বিচারে প্রচার করে চলেছে অধিকাংশ মিডিয়া হাউজ।  অর্থাৎ তাদের সম্প্রচারিত খবরের বড় অংশই হয় নিয়ন্ত্রিত অথবা কখনও কখনও অসত্য - এমন দাবিও করা হয়।  আসলে সিংহভাগ মিডিয়ার মালিক হচ্ছেন এক-একজন  করপোরেট পুঁজির মালিক বা পুঁজিপতি। এরা কি কখনও নিজের স্বার্থের বিরুদ্ধে যায় - এমন খবর, তথ্য বা তত্ত্ব প্রচার করবে? করবে না, করেও না। আর এ

সংখ্যালঘুর মুখই গণতন্ত্রের আয়না

  সংখ্যালঘুর মুখই গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় এবং শক্তিশালী আয়না। The face of the minority is the mirror of democracy কোন দেশ কতটা গণতান্ত্রিক, তা বোঝা যায় সে দেশের সংখ্যালঘু মানুষের জীবন ও সম্পত্তির সুরক্ষা কতটা মজবুত, তা থেকে। কারণ, সংখ্যালঘুর মুখই হচ্ছে গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় এবং শক্তিশালী আয়না। সংখ্যালঘুরা সঙ্গত কারণেই সংখ্যাগরিষ্ঠদের চেয়ে বেশি বঞ্চনাজনিত মনস্তাত্ত্বিক চাপে থাকে। এই চাপ দু’ভাবে তৈরি হয়। ১) সংখ্যাগিষ্ঠতাজনিত সুবিধা যা সংখ্যাগুরুরা পায়, সংখ্যালঘুরা কখনই তা পায় না বা পাবে না - এই ধারণা, যার কিছুটা হলেও ভিত্তি রয়েছে ২) সংখ্যাগরিষ্ঠদের মধ্যে বৃহত্তম (?) জনগোষ্ঠীর অংশ হওয়ার সুবাদে যে কর্তৃত্ববাদী মানসিকতা তৈরি হয় এবং যা বহুজনের মধ্যে দৃষ্টিকটুভাবে প্রকাশ হয়ে পড়ে, তার ভয়ে। এই চাপ কতটা গভীর তা সংখ্যালঘু ছাড়া বোঝা খুব মুশকিল। তবে আলোকপ্রাপ্ত মানুষ মাত্রই যে তা উপলব্ধি করতে পারেন, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। এই ধরণের চাপ তৈরি করে কিছু অসাধু মানুষ যখন সংখ্যালঘুদের জীবন ও সম্পত্তির সামনে হুমকি হয়ে দাঁড়ায়, তখন তা কমানোর ক্ষমতা একমাত্র গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রশক্তির হাতেই থাকে