শিক্ষা কী, কেন এবং কীভাবে অর্জন করতে হয়?
What is education, why it is needed and how to achieve it
শিক্ষা কী
শিক্ষা হল এক ধরনের অর্জন, যা নিজের ইচ্ছা শক্তির সাহায্যে নিজে নিজেই নিজের মধ্যে জমা করতে হয়। প্রকৃতি থেকেই সেই অর্জন আমাদের চেতনায় আসে। সেই চেতনাই আমাদের জানিয়ে দেয়, জগৎ ও জীবন পরিচালিত হয় প্রকৃতির কিছু অলংঘনীয় নিয়ম-নীতির দ্বারা। গভীর পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ শক্তিকে বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে কাজে লাগালেই এই নিয়মনীতিগুলো আমাদের আয়ত্বে আসে। এই নিয়ম-নীতিগুলো জানা এবং সেই জানার ওপর ভিত্তি করেই জগৎ ও জীবনকে সর্বোত্তম পর্যায়ে পৌঁছে দেয়ার পথ খুঁজে বের করার শক্তি অর্জনই শিক্ষা।
মনে রাখতে হবে, এই শিক্ষা কখনও কারও মধ্যে জোর করে ঢুকিয়ে দেওয়া যায় না।
এখন প্রশ্ন হল, শিক্ষা অর্জনের বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিটা আসলে কী। সেই আলোচনায় যাওয়ার আগে জানতে হবে, এই শিক্ষার সূচনা হয় কখন এবং কীভাবে?
শিক্ষার সূচনা কখন হয় :
এই অর্জনের সূচনা হয় মাতৃগর্ভে এবং তা প্রাকৃতিক ভাবেই। প্রকৃতির দেওয়া কিছু সহজাত শিক্ষাকে অবলম্বন করেই তার সূচনা। এই সহজাত শিক্ষাকে অবলম্বন করেই মানুষ তার পরবর্তী পার্থিব জীবনের শিক্ষা অর্জনের প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যায়। মানব শরীরের পূর্ণাঙ্গ অবয়ব তৈরি হবার পর থেকেই শুরু হয় তার এই পথ চলা। মাতৃগর্ভের যে প্রাকৃতিক পরিবেশ, সেখানে একজন শিশু নিজেকে সুরক্ষিত রাখার চেষ্টা করে। এই চেষ্টার মাধ্যমেই সে জানান দেয়, সে বেঁচে থাকার নিয়ম শিখছে এবং সেই অনুযায়ী তার প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে ।
একজন মানবশিশু মাতৃগর্ভে জানান দেওয়ার এই কাজটা করে নড়াচড়ার মাধ্যমে। কোন সমস্যা হলে কীভাবে তা তার ধারণকারী মাকে জানাতে হবে, সে সেখান থেকেই শিখে নেয় এবং তা কাজে লাগায়। একইভাবে যখন এই পরিবেশ তার পক্ষে আর সহনশীল থাকে না, তখন সেখান থেকে মুক্তির চেষ্টা করে। নড়াচড়াকে আরও বাড়িয়ে দিয়ে ও অবস্থান পরিবর্তনের মাধ্যমে তার মাকে জানায়, তার এই ইচ্ছার কথা। এই সময় সে নিজের মাথাকে উপর থেকে নিচের দিকে নিয়ে আসার চেষ্টা করে। তার ফলেই শুরু হয় মায়ের গর্ভযন্ত্রণা। এটা সে করে প্রকৃতির ( ধর্মদর্শন অনুযায়ী ঈশ্বরের ) কাছ থেকে পাওয়া কিছু সহজাত শিক্ষা বা জ্ঞানকে কাজে লাগিয়েই। এই প্রকৃতিরই একটি অংশ হচ্ছে তার মা ও বাবা। জেনেটিক্যালি এই শিক্ষার কিছু অংশ সে পেয়ে থাকে তার মা-বাবার কাছ থেকে।
সূচনাকালীন শিক্ষার সাফল্য ও ব্যর্থতা :
প্রকৃতি থেকে পাওয়া এই সহজাত শিক্ষা বা জ্ঞান যেসমস্ত মানব শিশু যথাযথভাবে প্রয়োগ করতে পারে, তারাই স্বাভাবিক ও সুস্থ হয়ে পৃথিবীতে আসতে পারে। যদিও এক্ষেত্রে তার এই অর্জিত শিক্ষা ও তার অর্জিত ফলাফল আরও অনেক পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির উপর নির্ভরশীল। এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় তার মা, যার গর্ভে সে অবস্থান করছে।
আমরা এই পৃথিবীতে অর্জিত জ্ঞানকে কাজে লাগিয়েও যেমন অনেক সময় ব্যর্থ হই, পারিপার্শ্বিক অনুকূল অবস্থার অনুপস্থিতির কারণে, তেমনি সেও মাতৃগর্ভে অনেক সময় ব্যর্থ হয়। ফলে স্বাভাবিক জন্ম তার আর হয়ে ওঠে না। যেমন ধরুন, আমি পথ চলার সমস্ত নিয়মকানুন জানি এবং তা মেনেও চলছি। তা সত্ত্বেও আমি দুর্ঘটনার সম্মুখীন হলাম। কেন হলাম? কারণ, আমি সব নিয়ম মেনে চললেও গাড়ির চালক অথবা তার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তির কোন ভুলের কারণেও গাড়িটি আমার উপর আছড়ে পড়তে পারে। সেক্ষেত্রে আমার অর্জিত শিক্ষা ব্যর্থ হতে বাধ্য। গর্ভে থাকা শিশুর ক্ষেত্রেও এমনটা হতে পারে। এক্ষেত্রে অসহায় মৃত্যুবরণ ছাড়া তার আর কিছুই করার থাকে না।
আসলে অর্জিত শিক্ষা তখনই সফল হয়, যখন তার পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতিও সেই অর্জনের অনুকূলে থাকে। এককভাবে এ পৃথিবীতে কেউ নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারে না। অর্জিত এই শিক্ষার কারণেই সমাজবদ্ধ প্রাণী হিসাবে মানুষ নিজেদের বিবর্তিত করেছে। প্রকৃতির প্রতিটি জীব পরস্পর পরস্পরের উপর নির্ভরশীল - এই শিক্ষা মানুষ প্রকৃতিকে পর্যবেক্ষণ করেই পেয়েছে। তাই প্রত্যেকের দায়িত্ব ও কর্তব্য হল, প্রকৃতির কাছ থেকে নিজের চেষ্টাতেই এই সব নিয়মকানুন শিখে নেওয়া। জেনে নেওয়া দরকার, বেঁচে থাকা ও সাফল্য অর্জনের জন্য এই অর্জিত শিক্ষাকে সঠিকভাবে প্রয়োগ করার সর্বোৎকৃষ্ট কৌশল। যে তা পারে সে-ই শিক্ষিত।
যথার্থ শিক্ষা ও তা অর্জনের পদ্ধতি :
জন্মের পর মানুষ একটু একটু করে বুঝতে পারে, এই চালিকাশক্তি আসলে কিছু অলঙ্ঘনীয় প্রাকৃতিক নিয়ম। প্রতিদিন সে এই প্রকৃতিকে অর্থাৎ জগৎ ও জীবনকে পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করে সেখান থেকেই এই নিয়মগুলি অর্জন করতে থাকে। এই অর্জনই হলো শিক্ষা।
এখন এই শিক্ষা কতটা সঠিক হবে তা নির্ভর করে মানুষের পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণের পদ্ধতির যথার্থতার ওপর। পদ্ধতি যথার্থ হবে তখন, যখন তা হবে বিজ্ঞানসম্মত। আর বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতির প্রধান ভিত্তি হল যুক্তি, বুদ্ধি, তথ্য ও পর্যবেক্ষণ এবং কোন কোন ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা। এই পাঁচটির সমন্বয়ে গড়ে ওঠে বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি। অর্থাৎ আমি যদি জগৎ ও জীবন সম্পর্কে সঠিক সত্য জানতে ( এটাই শিক্ষা ) চাই, তবে কোন বিষয় বা ঘটনা দেখা, শোনা বা অনুমান করার সময় যুক্তি, বুদ্ধি ও তথ্যের সমন্বয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করতে হবে। বিষয়টিকে আমরা এভাবে সংজ্ঞায়িত করতে পারি : আমরা যা দেখি, শুনি বা অনুমান করি তাকে সত্য কিম্বা মিথ্যা বলার আগে তাকে যুক্তি দিয়ে বুদ্ধি দিয়ে এবং তথ্য দিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করে, তার সত্যাসত্য যাচাই করে, তবে তা গ্রহণ কিংবা বর্জন করতে হয়। কিছুটা শুনলাম, তারপর নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে, নিজের পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাকিটা বসিয়ে নিয়ে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত টেনে দিলাম - এটা সঠিক পদ্ধতি নয়।
যে মানুষ এই বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি ব্যবহার করে প্রকৃতির এই অলংঘনীয় নিয়মগুলোকে যতটা জানতে পারে, সে ততটাই শিক্ষিত হিসাবে বিবেচিত হয়। তাই প্রকৃতির অলংঘনীয় নিয়ম-কানুন জানা এবং তাকে প্রয়োগ করার কৌশল আয়ত্ত করার ক্ষমতাই হলো শিক্ষা। মনে রাখতে হবে, প্রকৃতির পাঠশালাই হল শ্রেষ্ঠ বিদ্যালয়, শ্রেষ্ঠ কলেজ অথবা শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়।
শিক্ষা অর্জনের উপায় :
প্রাকৃতিক নিয়ম ছাড়াও শিক্ষার আরো কিছু উপাদান বা উৎস আছে। এদের একটা হল মানুষের সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি ইত্যাদি সংক্রান্ত বিষয়কে কেন্দ্র করে কিছু রাষ্ট্রীয় আইন বা নিয়ম। সেগুলো প্রত্যেকটা মানুষকে জানতে হয় এবং মানতে হয়। এ নিয়মও অলংঘনীয়। তাকে পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে মেনে চলার চেষ্টাও শিক্ষার অঙ্গ।
উল্লেখ্য, এই রাষ্ট্রীয় আইন গুলিও কিন্তু প্রকৃতির নিয়মের বাঁধনের মধ্যে থেকেই তৈরি করতে হয়। রাষ্ট্রীয় আইন এই নিয়মের বাইরে গেলেই তৈরি হয় সংকট। আসলে রাষ্ট্রীয় আইন তৈরি করার সময়ও আইন প্রণেতাকে মাথায় রাখতে হয় প্রাকৃতিক নিয়মকেই। প্রকৃতির কাছ থেকে পাওয়া শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েই একজন আইন প্রণেতাকে রাষ্ট্রীয় আইন তৈরিতে হাত দিতে হয়।
যেমন ধরুন, নির্বিচারে গাছ কাটা প্রকৃতির আইন অনুযায়ী নিষিদ্ধ। কারণ, এই আইন ভাঙ্গলে একদিকে জীবনদায়ী অক্সিজেনের পরিমাণে ঘাটতি দেখা দেবে। অন্যদিকে অনাবৃষ্টির কারণে মরুভূমির প্রসার ঘটবে। উভয়ই মানুষের জন্য ভয়ংকর। হরপ্পা সভ্যতার পতন তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ। এখন কোন আইন প্রণেতা এই প্রাকৃতিক আইন না জানলে এবং নির্বিচারে গাছ কেটে শহর ও শিল্প-কারখানা গড়ে তোলার অধিকার সম্বলিত আইন প্রণয়ন করলে, তা মানুষের জন্য মহাসর্বনাশের কারণ হয়ে উঠবে। সুতরাং আইন প্রণেতার বড় ডিগ্রি থাকলেও তিনি আইন প্রণয়নের যোগ্য নন। কারণ, তিনি শিক্ষা অর্জনে ব্যর্থ।
এখন প্রশ্ন হল, কোথা থেকে এবং কীভাবে এই শিক্ষা অর্জন সম্ভব?
১) প্রকৃতি থেকে স্বশিক্ষার মাধ্যমে। প্রকৃতিতে প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া ঘটনার পর্যবেক্ষণ ও তার কার্যকারণ সম্পর্ক খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে হবে।
২) একাডেমিক শিক্ষার মাধ্যমে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও এই শিক্ষা আমাদের অর্জন করতে হবে। সিলেবাসের অন্তর্গত সমস্ত বিষয় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে এবং বুঝে বুঝে পড়তে হবে। যা পড়লাম তার সঙ্গে বাস্তবের সম্পর্ক স্থাপন ও তার প্রয়োগ করতে শিখতে হবে। ভালো রেজাল্ট করার জন্য শুধুই মুখস্ত, কখনোই করা যাবে না।
৩) একাডেমিক শিক্ষার শেষ স্তরে পৌঁছানোর পর বিভিন্ন বিষয়ের বিশেষজ্ঞদের লেখা বই পড়তে হবে, আমৃত্যু।
৪) এছাড়া বিভিন্ন বিষয়ের ওপর বিশেষ অভিজ্ঞতা সম্পন্ন শিক্ষত প্রবীণ মানুষের মতামত, জগৎ ও জীবন সম্পর্কে তাদের অভিজ্ঞতার কথা শুনতে হবে: সেটা সাক্ষাতকার, বক্তৃতা ইত্যাদি যেকোনো মাধ্যমকে ব্যবহার করে।
আমাদের সমস্যা কোথায় :
আমাদের সমস্যা হলো একাডেমিক শিক্ষা শেষ করার মাধ্যমেই আমরা আমাদের শিক্ষাজীবনের সমাপ্তি ঘটাই। আদতে একাডেমিক শিক্ষার মাধ্যমে যা অর্জন করি তা আসলে শিক্ষা নামক সৌধের একটা ভীত মাত্র। সেখানে না আছে সিঁড়ি না আছে ছাদ। তাই শিক্ষার সৌধে আমাদের আর পৌঁছানো হয় না। আমাদের জানা হয়ে ওঠে না যে এই সৌধে পৌঁছানোর চেষ্টা আমাকে আমৃত্যু করে যেতে হবে।
আমাদের দ্বিতীয় সমস্যা হল, শিক্ষাকে বিশেষ বিশেষ শ্রেণীতে বিভক্ত করে একটিকে পূর্ণাঙ্গ এবং শ্রেষ্ঠ হিসেবে ভাবা। আমরা একটি বিশেষ বিষয়কে কেন্দ্র করে পড়াশোনাকে সীমাবদ্ধ করে ফেলি এবং অন্য বিষয়গুলোকে গুরুত্বহীন ভেবে আত্মশ্লাঘায় নিমগ্ন থাকি। আমাদের বোঝা হয়ে ওঠে না যে, জগতের সমস্ত বিষয়ই পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত এবং নির্ভরশীল।
পরিণতি :
ফলে একাডেমিক শিক্ষার মাধ্যমে যা আমরা অর্জন করি তা হল খন্ড শিক্ষা। তাই এমএ এমএসসি এম কম বা বিভিন্ন পেশাগত ডিগ্রী অর্জনের মাধ্যমে নিজেকে মস্ত বড় শিক্ষিত বলে ভুল করি। এই ভুল আমাদেরকে অর্ধশিক্ষিত বানিয়ে রাখে এবং পন্ডিত মূর্খে পরিণত করে। কোন জাতির সিংহভাগ মানুষ যদি এই অর্ধশিক্ষায় শিক্ষিত হয়, তবে তার বিশ্বজগতে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর সামর্থ্য কখনোই হবে না।
- লেখাটি সম্পূর্ণ হয় নি। লেখার কাজ চলছে ….। অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন