সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ভাগ্য : মুসলিম মনস্তত্ত্ব, ধর্মদর্শন ও প্রগতি

ভাগ্য : মুসলিম মনস্তত্ত্ব, ধর্মদর্শন ও প্রগতি - লিখছেন আলী হোসেন 

কপালের লেখন খণ্ডায় কার সাধ্য? জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে কিংবা লেখাপড়া জানা-নাজানা নির্বিশেষে সমস্ত মানুষের সিংহভাগই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এই কথাটা মেনে নেয়। জীবনের উত্থান-পতনের ইতিহাসে কপালের লেখনকে জায়গা করে দিতে তারা কুণ্ঠাবোধ করে না। বরং বলা ভালো এব্যাপারে তারা অতিমাত্রায় উদার। মানুষের মনস্তত্বের এ-এক জটিল স্তর বিন্যাস। একই মানুষ বিভিন্ন সময়ে একই বিষয়ের বিচার বিশ্লেষণে ভিন্নভিন্ন দৃষ্টিকোণ ব্যবহার করে। এ রকমই একটি দৃষ্টিকোণ হলো কপাল বা ভাগ্যের ভূমিকাকে সাফল্যের চাবিকাঠি বলে ভাবা। কখনও সে ভাগ্যের নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠার চেষ্টা করে, আবার কখনও নিজেই ভাগ্যের কাছে নির্দিধায় আত্ম সমর্পন করে। নিজের ব্যার্থতার পিছনে ভাগ্যের অদৃশ্য হাতের কারসাজির কল্পনা করে নিজের ব্যার্থতাকে ঢাকা দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে থাকে।

মজার কথা, এক্ষেত্রে মুসলিম মানসের মনস্তত্ত্ব কখনও চেতনমনে আবার কখনও অবচেতন মনে উপরওয়ালাকে (আল্লাহকে) কাঠ গড়ায় তোলে বিনা দ্বিধায়। নির্দিধায় বলে দেয়, উপরওয়ালা রাজি না থাকলে কিছুই করার থাকেনা। সাফল্য কিংবা ব্যর্থতা সবই তাঁর (আল্লার) হাতে। বিশ্লেষণের ধরণটা এমন হয়, যে এক ঢিলে দুই নয়, তিন পাখি শিকার করে ফেলে তারা। এক) ঈশ্বরকে সর্বশক্তিমান বলে মেনে নেয়। এবং তাঁর কাছে আত্মসমর্পন করলাম - এটা ভাবতে পেরে নিজেকে সাচ্ছা ধার্মিক হিসাবে গণ্য হওয়াজনিত আত্মতৃপ্তি লাভ করে, দুই) নিজের ব্যর্থতার দায় সর্বংসহা আল্লাহ-এর ঘাড়ে চাপিয়ে ভার-মুক্ত হয়ে যায়। তিন) সর্বশক্তিমান মানা ও আত্মসমর্পণ করার বার্তার মাধ্যমে ভবিষ্যতে ঈশ্বরের কৃপালাভের রাস্তাকে খানিকটা হলেও খুলে গেল - এই ভাবনায় মনের জোর খানিকটা বাড়িয়ে নেয়।

আসলে মানুষ জগৎ ও জীবনের সীমাহীন রহস্যের অনেক কিছুই এখনও উৎঘাটন করতে পারেনি। ভবিষ্যতে মানুষ কতটা এগোবে, তাও নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। যে গতিতে বিজ্ঞান এগোচ্ছে, কোথায় গিয়ে মানুষ থামবে, বলা মুশকিল। কিন্তু একথা বলা মুশকিল নয় যে, জগতের সব রহস্যের ভিত্তিভূমি হল কার্যকারণ সম্পর্ক। কারণ, কারণ ছাড়া কোন কিছুই ঘটে না। আমার জীবনে যা-ই ঘটুক, তার এক বা একাধিক নির্দিষ্ট কারণ অবশ্যই থাকবে। সেই কারণের হদিশ যতদিন মানুষ পায় না, ততদিন সে কারণ হিসাবে অলৌকিক শক্তির ভূমিকাকে কল্পনা করে। এক্ষেত্রে ভাগ্যটাই কারণ হিসাবে উপস্থাপিত হয়।

কিন্তু ভাগ্যকে কারণ হিসাবে দাড় করানোটা যুক্তিবিজ্ঞান মানে না। যুক্তি-বিজ্ঞানের কাছে এটা একটা হাস্যকর প্রচেষ্টা মাত্র। আসলে মানুষ নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত কার্যক্রমকে ভাগ্য বলে মনে করে। যেদিন ওই নিয়ন্ত্রনকারীকে মানুষ জেনে ফেলে এবং তার উপর নিজের নিয়ন্ত্রন কায়েম করতে সক্ষম হয়, তখন তা আর তার কাছে ভাগ্যের বিষয় বলে বিবেচিত হয় না। সাধারণ মানুষের কাছে ভাবনার এই দৈন্যতার প্রকাশ একটা সাধারণ বিষয়। চেতন কিংবা অবচেতন মনে অধিকাংশ মানুষ এভাবেই ভাবতে ও ভাবাতে অভ্যস্ত যুগ যুগ ধরে।

যারা ভাগ্যের নিয়ন্ত্রক হিসাবে আল্লাহকে উপস্থাপন করে, তাদের কাছে এই যুক্তির অবতারনা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। অথচ আল কোরান ভাগ্যের উপর নির্ভরতাকে স্বীকার করে না। সুরা ‘আশ শামস’এর বক্তব্যকে ব্যখ্যা করলে দেখা যায়, আল্লাহ মানুষকে দেহ, ইন্দ্রিয় ও মানসশক্তি সম্পন্ন করে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন, অসহায়ভাবে পৃথিবীতে ছেড়ে দেন নি। সেই সঙ্গে দিয়েছেন এক সহজাত (ইলহামী) জ্ঞান। যারা দ্বারা তার অবচেতন মন পাপপূন্যের পার্থক্য, ভালোমন্দের তারতম্য ও বিভিন্ন অনুভূতির পার্থক্য ধরতে পারে। এই সব পার্থক্যবোধ, ইচ্ছা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের শক্তি, যা তিনি দান করেছেন, সেগুলোকে ব্যবহার করে মানুষ ভালো ও মন্দ প্রবনতাগুলোকে নিয়ন্ত্রন করতে পারে। কোন্ প্রবণতাকে মানুষ বলবান করবে আর কোনটিকে দমন করবে তার উপর তার ভবিষ্যৎ সম্পূর্ণ নির্ভর করে। সুরা ‘আশ শামস’-এর ৮নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘ফা আল হামাহা ফুজুরাহা অ তাকউয়াহা। অর্থাৎ অতঃপর তাকে (মানুষকে) তার অসৎ কর্ম ও সৎ কর্মের জ্ঞান (সহজাত / ইলহামি জ্ঞান) দান করেছেন। ৯নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘ক্বাদ আফলাহা মান যাক্কাহা’। অর্থাৎ যে নিজেকে (ঐ জ্ঞান দ্বারা) শুদ্ধ করে, সে সফল হয়। ১০নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘অক্বাদ খাবা মান দাসসাহা’। অর্থাৎ এবং যে নিজেকে কলুষিত করে সে ব্যর্থ মনোরথ হয়। লক্ষ্যনীয়, ১৫নং আয়াতে আল্লাহ-এর তরফে স্পষ্ট করে ঘোষণা করা হয়েছে, ‘অলা ইয়াখাফু উক্ববাহা’। অর্থাৎ আল্লাহ মানুষের এইরূপ ধ্বংসাত্মক পরিণতির কোন বিরূপ পরিনতির আশঙ্ক্ষা করেন না।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে, (ধর্মশাস্ত্র অনুসারেও) মানুষের সাফল্য ও ব্যর্থতায় আল্লাহ কোন অন্যায্য নিয়ন্ত্রন রাখেন না। তাই ভাগ্য নয়, কর্মই মানুষের উত্থান-পতনের ইতিহাসকে নিয়ন্ত্রন করে। সে-কর্ম যদি একক প্রচেষ্টার পরিণতি হয়, তবে তার দায় একান্তই নিজের ঘাড়ে বর্তায়। আর যদি তা যৌথ প্রচেষ্টার উপর নির্ভর করে, তবে তা ঐ গ্রুপের যেকোন ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের যেকোন ভুল কিম্বা অন্যায় আচরনের কারণে ঘটতে পারে। আমি যখন পথ হাঁটি, তখন আমার পথ নিরাপত্তার বিষয়টি শুধুমাত্র আমার সচেতনার উপর নির্ভর করে না। আমি একশো ভাগ সতর্ক থাকা সত্ত্বেও একজন গাড়ি চালকের ভুলের কারণেও আমার নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে। এটাকে কখনই ভাগ্য বলা যায় না। কারণ পথ-নিরাপত্তা নামক কার্যটি যৌথ প্রচেষ্টার ফসল।

মুসলিম জনমানস ধর্মীয় মনস্তত্ত্বের নিরিখে তিনটি নির্দিষ্ট শ্রেণিতে বিভক্ত হয়ে আছে। ১) ধর্মপ্রাণ, ২) ধর্মজীবি, ৩) ধর্মবিমুখ। ধর্মপ্রাণ মুসলিম হল সেই শ্রেণির মুসলিম যারা মানসিকভাবে সৎ এবং ধর্মের ভালোমন্দের চুলচেরা বিশ্লেষণে কখনই নিজেকে নিমগ্ন রাখে না। ধর্মের যে দিকগুলো ভালো বলে তার কাছে মনে হয়, সে-বিষয়েই শুধু মনোনিবেশ করে; আচার আচরণে এক’শ শতাংশ সৎ ও নিষ্ঠাবান ধার্মিক হওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করে। তাদের একমাত্র লক্ষ্য পারলৌকিক জীবনে সুখ-শান্তি লাভ করা।

ধর্মজীবি মুসলিম যারা, তারা ধর্মপালনের বিষয়ে দুটি হিসেব মাথায় রাখে। একটি ইহলৌকিক, অন্যটি পারলৌকিক। জীবন-জীবিকার জন্য এরা ধর্মকে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে কাজে লাগায়। আর অন্য মানুষকে নিজ ধর্মের অনুসারি করে তোলার চেষ্টা করে বাড়তি লাভের (ছোওয়াবের) আশায়। অনেকেই ধর্মকে জীবিকার মাধ্যম হিসাবে নির্দিধায় ব্যবহার করে। অর্থাৎ জীবিকা নির্বাহের সাথে সাথে আল্লাহ-এর নৈকট্যলাভের কাজে এরা ধর্মকে অবলীলায় কাজে লাগায়।

অন্যদিকে, যারা ধর্মবিমুখ মুসলিম তারা ধর্মকে ইহলৌকিক কিংবা পারলৌকিক কোনকালেরই সুখ-শান্তি লাভের কাজে ব্যবহারের বিপক্ষে। ধর্মীয় অনুশাসন গ্রহনের ক্ষেত্রে বিচার-বিবেচনাকে কাজে লাগাতে তারা দ্বিধা করে না। ধর্মীয় উৎসবকে মুসলিমদের সামাজিক উৎসব হিসাবে বিবেচনা করতেই এরা বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে।

মুসলিম সমাজে এই দ্বিতীয় শ্রেণির মানুষেরই সংখ্যাধিক্য রয়েছে। এদের মনস্তত্ত্ব খুবই জটিল। এরাই মানুষের সাফল্য ও ব্যর্থতার পিছনে ভাগ্যের ভূমিকাকে গুরুত্ব দিতে বেশি আগ্রহী। আবার এরাই প্রয়োজনে ধার্মিক, অতিধার্মিক, এমনকি অধার্মিক হতেও (অবশ্যই গোপনীয়তা বজায় রেখে) দ্বিধা করে না। ধর্মের আনুষ্ঠানিকতাকে প্রকৃত ধর্মপালনের অবশ্য-কর্তব্য বিষয় হিসাবে ব্যাখ্যা করে। আধুনিক শিক্ষার চেয়ে দ্বিনের (ধর্ম শিক্ষা) শিক্ষাদানের দিকে এদের ঝোঁক বেশি। তাই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ মহল্লায় ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে উঠে মোক্তব ও মাদ্রাসা। এই মাদ্রাসাগুলি ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের অর্থ সাহায্যে এবং কিছু কিছু মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলির অর্থানুকূল্যে চলে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো কেন এই সাহায্য করে তা আলাদাভাবে আলোচ্য বিষয় হতে পারে।

লক্ষ্যনীয় বিষয় হল এইসব মাদ্রাসাগুলি আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চার পরিবর্তে সনাতন ধর্মশিক্ষার উপর বেশি জোর দিচ্ছে। আর্থিকদিক থেকে অত্যন্ত পিছিয়ে পড়া ঘরের ছেলেমেয়েরা এখান থেকে আরবি ভাষাটা কোনরকমে পড়তে শেখে। সঙ্গে ইসলামি ধর্মদর্শন বিষয়ে যতসামান্য, বলা ভালো অসম্পুর্ন জ্ঞান নিয়ে এরা সংসার জীবনে প্রবেশ করে। এরপর কেউ বিল বই হাতে বেরিয়ে পড়ে মাদ্রাসার নামে দান-খয়রাত তুলতে। কেউ মসজিদে মসজিদে যৎসামান্য অর্থে নেমে যায় ইমামতি করতে। বলা বাহুল্য, এই সামান্য পয়সায় তাঁর সংসার চলার কথা না। কিন্তু তবু তারা তা করে, কারণ তাদের আশা থাকে ইমামতির দৌলতে পানি-পড়া, ঝাড়-ফুক এবং তাবিজ মাদুলি বিক্রি করে আরও বাড়তি কিছু রোজগারের ব্যবস্থা হয়ে যাবে। একবিংশ শতকে এসেও সংখ্যা গরিষ্ঠ মুসলমানের এই যদি জীবনদর্শন হয়, তবে কীভাবে এগোবে মুসলিম সমাজ! গভীর মনোযোগ দিয়ে ভাবতে হবে।

এভাবে চললে মুসলিম সমাজের পিছিয়ে পড়ার অশুভ প্রক্রিয়াকে থামানো যাবে না। আধুনিক রাষ্ট্র-সমাজ-অর্থনীতি-সংস্কৃতি বিষয়ে অজ্ঞ মুসলিম সমাজ তাদের নাগরিক অধিকার আদায়ের বিষয়ে যোগ্য হয়ে উঠতে পারবে না। তাই ভাগ্য নয়, আধুনিক যুগের উপযোগী নাগরিক শিক্ষা গ্রহনের উপর জোর দেওয়া ছাড়া মুসলিম সমাজের আর কোন নির্ভরতার বিষয় নেই। আর একাজ করতে হলে মুসলিমদেরই উদ্যোগী হয়ে মহল্লায় মহল্লায় মাদ্রাসা গজিয়ে ওঠার প্রবণতাকে রুখতে হবে এবং চলতি মাদ্রাসাগুলিকে হয় বন্ধ করে দিতে হবে অথবা তাদেরকে আধুনিক শিক্ষালয়ের রীতিনীতি ও কার্যক্রমকে আত্মস্থ করে নিতে হবে। মুসলিম মনস্তত্ত্বকে সুরা ‘আশ শামসে’র আলোকে আলোকিত করতে উদ্যোগ নিতে হবে, এবং তা এখনি।


উৎস : ম্যাগাজিন, ফেসবুক

মন্তব্যসমূহ

📂 আলী হোসেনের জনপ্রিয় প্রবন্ধগুলি

হিন্দু কারা? তারা কীভাবে হিন্দু হল?

হিন্দু কারা? কীভাবে তারা হিন্দু হল? যদি কেউ প্রশ্ন করেন, অমিত শাহ হিন্দু হলেন কবে থেকে? অবাক হবেন তাই তো? কিন্তু আমি হবো না। কারণ, তাঁর পদবী বলে দিচ্ছে উনি এদেশীয়ই নন, ইরানি বংশোদ্ভুত। কারণ, ইতিহাস বলছে পারস্যের রাজারা ‘শাহ’ উপাধি গ্রহণ করতেন। এবং ‘শাহ’ শব্দটি পার্শি বা ফার্সি। লালকৃষ্ণ আদবানির নামও শুনেছেন আপনি। মজার কথা হল আদবানি শব্দটিও এদেশীয় নয়। আরবি শব্দ ‘আদবান’ থেকে উদ্ভূত। সুতরাং তাঁর পদবীও বলছে, তিনিও এদেশীয় নন। ভাষাতত্ত্ব ও নৃতত্ত্বের বিশ্লেষণ বলছে, উচ্চবর্ণের বিশেষ করে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের মানুষদের, উৎসভূমি হল পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চল। তারও আগে ছিল ইউরোপের ককেশাস অঞ্চলে। আসলে এরা (উচ্চবর্ণের মানুষ) কেউই এদেশীয় নয়। তারা নিজেদের আর্য বলে পরিচয় দিতেন এবং এই পরিচয়ে তারা গর্ববোধ করতেন। সিন্ধু সভ্যতা পরবর্তীকালে তারা পারস্যের বিভিন্ন এলাকা থেকে হিন্দুকুশ পর্বতের গিরিপথ ধরে এদেশে অভিবাসিত হয়েছেন। আর মধ্যযুগে এসে এদেরই উত্তরসূরী ইরানিরা (অমিত শাহের পূর্বপুরুষ) অর্থাৎ পারস্যের কিছু পর্যটক-ঐতিহাসিক, এদেশের আদিম অধিবাসীদের ’হিন্দু’ বলে অভিহিত করেছেন তাদের বিভিন্ন ভ্রমণ বৃত্তান্তে।

রবীন্দ্রনাথের ধর্মভাবনা ও তার বিবর্তন

রবীন্দ্রনাথের ধর্মভাবনা ও তার বিবর্তন আলী হোসেন  যদি প্রশ্ন করা হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ধর্ম কী? মনে হয় অনেকেই ঘাবড়ে যাবেন। কেউ বলবেন, তাঁর বাবা যখন ব্রাহ্ম ছিলেন তাহলে তিনি নিশ্চয়ই ব্রাহ্ম। যারা লেখাপড়া জানেন না, তারা বলবেন, কেন! উনি তো হিন্দু ছিলেন। আবার কেউ কেউ তথ্য সহযোগে এও বলার চেষ্টা করবেন যে, উনি নাস্তিক ছিলেন; না হলে কেউ বলতে পারেন, ধর্মমোহের চেয়ে নাস্তিকতা অনেক ভালো? ¹ রবীন্দ্রনাথের ধর্ম ভাবনার বিবর্তন  তাহলে সঠিক উত্তরটা কী? আসলে এর কোনোটাই সঠিক উত্তর নয়। চিন্তাশীল মানুষ-মাত্রই সারা জীবন ধরে ভাবেন, ভাবতে ভাবতে তাঁর উপলব্ধি বাড়তে থাকে ক্রমশঃ প্রগতির পথে। জগৎ ও জীবন থেকে তথ্য সংগ্রহ করে একে একে গড়ে তোলেন নিত্যনতুন জীবনদর্শন। তাই এ ধরনের মানুষ আজীবন এক এবং অখণ্ড জীবনদর্শনের বার্তা বহন করেন না। সময়ের সাথে সাথে পাল্টে যায় তাঁর পথচলার গতিমুখ। মানুষ রবীন্দ্রনাথও তাই পাল্টে ফেলেছেন তাঁর জীবন ও ধর্মদর্শন সময়ের বয়ে যাওয়াকে অনুসরণ করে। রবীন্দ্রনাথ ও  হিন্দু জাতীয়তাবাদ ১৮৬১ সালের ৭ই মে সোমবার রাত্রি ২টা ৩৮ মিনিট ৩৭ সেকেন্ডে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে জন্ম গ্রহণ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এর

সীমান্ত আখ্যান, বাঙালির আত্মানুসন্ধানের ডিজিটাল আখ্যান

সময়ের সঙ্গে সমস্যার চরিত্র বদলায়। কিন্তু মুলটা বদলায় না। যদি সে সমস্যা ইচ্ছা করে তৈরি হয়ে থাকে বিশেষ সুবিধা ভোগেই লোভে, তবে তো অন্য কথা চলেই না। স্বনামধন্য স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাতা সৌমিত্র দস্তিদারের ডকুমেন্টারি ফিল্প 'সীমান্ত আখ্যান' দেখার পর এই উপলব্ধি মাথা জুড়ে ঘুরপাক খাচ্ছে। দেখলাম, দেশ ভাগ হয়েছে। কিন্তু সমস্যার অবসান হয়নি। শুধু সমস্যার চরিত্রটা পাল্টেছে। এই যে সমস্যা রয়ে গেল, কোন গেল? তার উত্তর ও পাওয়া গেল 'সীমান্ত আখ্যান' এ। আসলে দেশ ভাগ তো দেশের জনগণ চাননি, চেয়েছেন দেশের নেতারা। চেয়েছেন তাঁদের ব্যক্তিগত, সম্প্রদায়গত সুবিধাকে নিজেদের কুক্ষিগত করার নেশায়। আর এই নেশার রসদ যোগান দিতে পারার নিশ্চয়তা নির্ভর করে রাজনৈতিক ক্ষমতার লাগাম নিজের হাতে থাকার ওপর। তাই রাজনীতিকরা এই ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য জনগণকে 'ডিভাইড এন্ড রুল' পলিছি দ্বারা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চেষ্টা করেছেন এবং করে চলেছেন। এ সমস্যা নতুন না, ব্রিটিশ সরকার এর বীজ রোপণ করে গেছেন, এখন কেউ তার সুফল ভোগ করছে (রাজনীতিকরা) আর কেউ কুফল (জনগন)। 'সীমান্ত আখ্যান চোখে আঙুল দিয়ে দে

কাশ্মীর ফাইলস : প্রপাগান্ডার এক নয়া ব্রান্ড, কর্পোরেট পুঁজি ও রাজনৈতিক দলের গলাগলির এক সুচারু প্রদর্শনী

কাশ্মীর ফাইলস : প্রপাগান্ডার এক নয়া ব্রান্ড, কর্পোরেট পুঁজি ও রাজনৈতিক দলের গলাগলির এক সুচারু প্রদর্শনী রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয় উলুখাগড়ার প্রাণ যায়। ১৯৪৭ সালের পর থেকে জম্মু ও কাশ্মিরের জনগণের ভাগ্যলিপিতে লেখা হয়ে গেছে এই বিখ্যাত প্রবাদটির বিস্তারিত সারাৎসার। একদিকে পাকিস্তান আর অন্যদিকে ভারত – এই দুই প্রতিবেশি দেশের ভুরাজনৈতিক স্বার্থের যাঁতাকলে পড়ে তাদের এই হাল। কিন্তু কেন এমন হল? এই প্রশ্নের উত্তর জানে না এমন মানুষ ভুভারতে হয়তো বা নেই। কিন্তু সেই জানার মধ্যে রয়েছে বিরাট ধরণের ফাঁক। সেই ফাঁক গলেই ঢুকেছে কাশ্মির ফাইলসের মত বিজেপির রাজনৈতিক ন্যারেটিভ যা তারা বহুকাল ধরে করে চলেছে অন্য আঙ্গিকে। এবার নতুন মাধ্যমে এবং নবরূপে তার আগমন ঘটেছে, যায় নাম সিনেমা বা সেলুলয়েড প্রদর্শনী। যদিও ডিজিটাল মাধ্যমে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সৌজন্যে অনেক আগেই সফলভাবে তারা এই ন্যারেটিভ দিয়ে বিভাজনের রাজনীতি করে চলেছে বেশ কয়েক বছর ধরে। টেলিভিশন সম্প্রচারে কর্পোরেট পুজির অনুপ্রবেশের মাধ্যমে যার সূচনা হয়েছিল। রাষ্ট্রশক্তিকে কুক্ষিগত করতে না পারলে দেশের সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রন আনা সম্ভব নয়, একথা সাধারণ নিরক্ষর নাগরিক এবং ত

শিক্ষা কী, কেন প্রয়োজন এবং কীভাবে অর্জন করা যায়?

শিক্ষা কী, কেন এবং কীভাবে অর্জন করতে হয়? সূচিপত্র : What is education, why it is needed and how to achieve it শিক্ষা কী শিক্ষা হল এক ধরনের অর্জন, যা নিজের ইচ্ছা শক্তির সাহায্যে নিজে নিজেই নিজের মধ্যে জমা করতে হয়। প্রকৃতি থেকেই সেই অর্জন আমাদের চেতনায় আসে। সেই চেতনাই আমাদের জানিয়ে দেয়, জগৎ ও জীবন পরিচালিত হয় প্রকৃতির কিছু অলংঘনীয় নিয়ম-নীতির দ্বারা। গভীর পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ শক্তিকে বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে কাজে লাগালেই এই নিয়মনীতিগুলো আমাদের আয়ত্বে আসে। এই নিয়ম-নীতিগুলো জানা এবং সেই জানার ওপর ভিত্তি করেই জগৎ ও জীবনকে সর্বোত্তম পর্যায়ে পৌঁছে দেয়ার পথ খুঁজে বের করার শক্তি অর্জনই শিক্ষা। মনে রাখতে হবে, এই শিক্ষা কখনও কারও মধ্যে জোর করে ঢুকিয়ে দেওয়া যায় না। এখন প্রশ্ন হল, শিক্ষা অর্জনের বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিটা আসলে কী। সেই আলোচনায় যাওয়ার আগে জানতে হবে, এই শিক্ষার সূচনা হয় কখন এবং কীভাবে? শিক্ষার সূচনা কখন হয় : এই অর্জনের সূচনা হয় মাতৃগর্ভে এবং তা প্রাকৃতিক ভাবেই। প্রকৃতির দেওয়া কিছু সহজাত শিক্ষাকে অবলম্বন করেই তার সূচনা। এই সহজাত শিক্ষাকে অবলম্বন করেই মানুষ তার পরবর্তী প

জল, না পানি : জল নিয়ে জলঘোলা করা পানির মত সহজ নয়

জল নিয়ে জলঘোলা করা পানির মত সহজ নয় আলী হোসেন  সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত সরকারি অনুষ্ঠানে চিত্র শিল্পী শুভাপ্রসন্ন ভট্টাচার্য পানি শব্দকে বাংলা নয় বলে দাবি করেছেন। বলেছেন, "আমরা কোনোদিন কখনও বাংলা ভাষায় পানি (শব্দটা) ব্যবহার করি না"। শুধু তা-ই নয়, পানি শব্দের ব্যবহারের মধ্যে তিনি 'সাম্প্রদায়িকতার ছাপ'ও দেখতে পেয়েছেন। প্রশ্ন হল - এক, এই ভাবনা কতটা বাংলা ভাষার পক্ষে স্বাস্থ্যকর এবং কতটা 'বাংলা ভাষার ইতিহাস' সম্মত? দুই, জল বা পানি নিয়ে যারা জলঘোলা করছেন তারা কি বাংলাকে ভালোবেসে করছেন? মনে হয় না। কারণ, খোঁজ নিলে দেখা যাবে, এরা কেউ নিজের সন্তানকে বাংলা মিডিয়াম স্কুলে পড়াননি বা পড়ান না। ব্যবহারিক জীবনেও তারা বাংলার ভাষার চেয়ে ইংরেজি বা হিন্দিতে কথা বলতে বা গান শুনতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন, বলা ভালো গর্ববোধ করেন। প্রসংগত মনে রাখা দরকার, বাংলা মিডিয়াম স্কুলগুলোতে যারা ভর্তি হয়, তারা অধিকাংশই গরীব ঘরের সন্তান। বলা ভালো, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে তারাই বাংলা ভাষাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। কারণ, সন্তানকে বাংলা মিডিয়ামে পড়ানোর পাশাপাশি, বা

নিম্নবর্গের মানুষ মার খাচ্ছে কেন

নিম্নবর্গের মানুষ কীভাবে পিছিয়ে পড়েছেন? সমাধান কীভাবে? এদেশের নিম্নবর্গের মানুষ নিজেদের বাঁচাতে যুগ যুগ ধরে ধর্ম পরিবর্তন করেছে। কখনও বৌদ্ধ (প্রাচীন যুগ), কখনও মুসলমান (মধুযুগ), কিম্বা কখনো খ্রিস্টান (আধুনিক যুগ) হয়েছে। কিন্তু কখনই নিজেদের চিন্তা-চেতনাকে পাল্টানোর কথা ভাবেনি। পরিবর্তন হচ্ছে অলংঘনীয় প্রাকৃতিক নিয়ম। যারা এই নিয়ম মেনে সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে পারে, তারাই লাভবান হয়, টিকে থাকে। “পাল্টে গেলেই জীবন বাড়ে না পাল্টালে নয়, জীবন মানেই এগিয়ে যাওয়া নইলে মৃত্যু হয়” জীবনের এই চরম সত্য তারা অধিকাংশই উপলব্ধি করতে পারেনি। পৃথিবীর যেকোন উন্নত জাতির দিকে তাকান, তারা দ্রুততার সঙ্গে এই পরিবর্তনকে মেনে নিজেদেরকে পুনর্গঠন করে নিয়েছে। যারা পারেনি বা নেয়নি তারাই মার খাচ্ছে, অতীতেও খেয়েছে। বুদ্ধিমান জাতি নিজের দুর্বলতাকে মেনে নেয় এবং ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য সময়ের সঙ্গে তাল রেখে নিজেদের চিন্তা এবং চেতনায় পরিবর্তন আনে। খ্রিষ্টান, ইহুদি-সহ এশিয়া, ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন জাতি - যারাই এই পরিবর্তন মেনে নিয়েছে তারাই আরও উন্নত এবং শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। মহানবীর (সঃ) গৌরবময় উত্থান (যা এক ধরণ

আধুনিক মিডিয়া : কর্পোরেট পুঁজির (পুঁজিপতিদের) তোতাপাখি

গোদি মিডিয়া : কর্পোরেট পুঁজির তোতাপাখি পশ্চিমী মিডিয়াকে 'ইসরাইল সরকারের তোতাপাখি' নামে পরিচয় দেওয়া হয় সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী স্বাধীন ও নিরপেক্ষ মিডিয়া হাউজের পক্ষ থেকে। সম্প্রতি একইভাবে ভারতীয় কর্পোরেট মিডিয়া ভারত সরকার তথা 'কর্পোরেট পুঁজির  তোতাপাখি' হিসাবে পরিচয় পাচ্ছে, যাকে নিন্দুকেরা 'গোদী মিডিয়া' নামে অভিহিত করে থাকে। মধ্যপ্রাচ্যের ঘটনা সম্পর্কে ইসরাইল যা বলে, ইউরোপ ও আমেরিকার মিডিয়া, তোতা পাখির মতো তা-ই প্রচার করে। সাংবাদিকতার প্রধান প্রধান শর্তগুলোকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ইসরাইলের দেওয়া তথ্যই তারা প্রচার করে অন্ধ ও নির্লজ্জভাবে। ভারতের ক্ষেত্রেও করপোরেট মিডিয়া বর্তমানে সেটাই করছে বলে অভিযোগ। অভিযোগ, নত মস্তকে ভারত সরকারের দেওয়া তথ্য বিনা বিচারে প্রচার করে চলেছে অধিকাংশ মিডিয়া হাউজ।  অর্থাৎ তাদের সম্প্রচারিত খবরের বড় অংশই হয় নিয়ন্ত্রিত অথবা কখনও কখনও অসত্য - এমন দাবিও করা হয়।  আসলে সিংহভাগ মিডিয়ার মালিক হচ্ছেন এক-একজন  করপোরেট পুঁজির মালিক বা পুঁজিপতি। এরা কি কখনও নিজের স্বার্থের বিরুদ্ধে যায় - এমন খবর, তথ্য বা তত্ত্ব প্রচার করবে? করবে না, করেও না। আর এ

সংখ্যালঘুর মুখই গণতন্ত্রের আয়না

  সংখ্যালঘুর মুখই গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় এবং শক্তিশালী আয়না। The face of the minority is the mirror of democracy কোন দেশ কতটা গণতান্ত্রিক, তা বোঝা যায় সে দেশের সংখ্যালঘু মানুষের জীবন ও সম্পত্তির সুরক্ষা কতটা মজবুত, তা থেকে। কারণ, সংখ্যালঘুর মুখই হচ্ছে গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় এবং শক্তিশালী আয়না। সংখ্যালঘুরা সঙ্গত কারণেই সংখ্যাগরিষ্ঠদের চেয়ে বেশি বঞ্চনাজনিত মনস্তাত্ত্বিক চাপে থাকে। এই চাপ দু’ভাবে তৈরি হয়। ১) সংখ্যাগিষ্ঠতাজনিত সুবিধা যা সংখ্যাগুরুরা পায়, সংখ্যালঘুরা কখনই তা পায় না বা পাবে না - এই ধারণা, যার কিছুটা হলেও ভিত্তি রয়েছে ২) সংখ্যাগরিষ্ঠদের মধ্যে বৃহত্তম (?) জনগোষ্ঠীর অংশ হওয়ার সুবাদে যে কর্তৃত্ববাদী মানসিকতা তৈরি হয় এবং যা বহুজনের মধ্যে দৃষ্টিকটুভাবে প্রকাশ হয়ে পড়ে, তার ভয়ে। এই চাপ কতটা গভীর তা সংখ্যালঘু ছাড়া বোঝা খুব মুশকিল। তবে আলোকপ্রাপ্ত মানুষ মাত্রই যে তা উপলব্ধি করতে পারেন, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। এই ধরণের চাপ তৈরি করে কিছু অসাধু মানুষ যখন সংখ্যালঘুদের জীবন ও সম্পত্তির সামনে হুমকি হয়ে দাঁড়ায়, তখন তা কমানোর ক্ষমতা একমাত্র গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রশক্তির হাতেই থাকে