সংখ্যালঘুর মুখই গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় এবং শক্তিশালী আয়না।
The face of the minority is the mirror of democracy
কোন দেশ কতটা গণতান্ত্রিক, তা বোঝা যায় সে দেশের সংখ্যালঘু মানুষের জীবন ও সম্পত্তির সুরক্ষা কতটা মজবুত, তা থেকে। কারণ, সংখ্যালঘুর মুখই হচ্ছে গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় এবং শক্তিশালী আয়না।
সংখ্যালঘুরা সঙ্গত কারণেই সংখ্যাগরিষ্ঠদের চেয়ে বেশি বঞ্চনাজনিত মনস্তাত্ত্বিক চাপে থাকে। এই চাপ দু’ভাবে তৈরি হয়। ১) সংখ্যাগিষ্ঠতাজনিত সুবিধা যা সংখ্যাগুরুরা পায়, সংখ্যালঘুরা কখনই তা পায় না বা পাবে না - এই ধারণা, যার কিছুটা হলেও ভিত্তি রয়েছে ২) সংখ্যাগরিষ্ঠদের মধ্যে বৃহত্তম (?) জনগোষ্ঠীর অংশ হওয়ার সুবাদে যে কর্তৃত্ববাদী মানসিকতা তৈরি হয় এবং যা বহুজনের মধ্যে দৃষ্টিকটুভাবে প্রকাশ হয়ে পড়ে, তার ভয়ে।
এই চাপ কতটা গভীর তা সংখ্যালঘু ছাড়া বোঝা খুব মুশকিল। তবে আলোকপ্রাপ্ত মানুষ মাত্রই যে তা উপলব্ধি করতে পারেন, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।
এই ধরণের চাপ তৈরি করে কিছু অসাধু মানুষ যখন সংখ্যালঘুদের জীবন ও সম্পত্তির সামনে হুমকি হয়ে দাঁড়ায়, তখন তা কমানোর ক্ষমতা একমাত্র গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রশক্তির হাতেই থাকে।
সম্প্রতি রামনবমীকে কেন্দ্র করে পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া-সহ বিহারের সাসারাম, নালন্দা কিংবা কর্ণাটকের হুবলীতে যে ধরণের সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়িয়েছে তাতে সংখ্যালঘুর মধ্যে এই চাপ যে উচ্চমাত্রায় পৌঁছেবে - একথা বলার অপেক্ষা রাখে না। মাননীয় রাজ্যপাল বলেছেন, ‘সাধারণ মানুষের শান্তিতে বাঁচার অধিকার রয়েছে।’ অস্বীকার করার উপায় নেই, আধুনিক গণতন্ত্রই পারে এই অধিকার নিশ্চিত করতে এবং সংখ্যাগুরুর সমর্থনেই কেবল তা কার্যকর করা সম্ভব। কারণ, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রশক্তির হাত এবং সংখ্যাগুরুর সদিচ্ছার সমন্বয়ে গড়ে ওঠে নিশ্চয়তার দুর্ভেদ্য আশ্বাসই একমাত্র পারে এই মনস্তাত্ত্বিক চাপ কমিয়ে তাদের অধিকার নিশ্চিত করতে।
‘আধুনিক’ শব্দের (যুগের) কিছু ইউনিক বৈশিষ্ট্য আছে, যেগুলোকে বাদ দিলে এই শব্দটার উজ্জ্বল্য হারিয়ে যায়। বলা যায় একটা অর্থহীন শব্দবন্ধতে পরিণত হয় 'আধুনিক' কথাটা। এই বৈশিষ্ট্যগুলো হল, ১) যুক্তিবাদ, ২) বিজ্ঞানমনস্কতা এবং ৩) মানবতাবাদ। তিনটি শব্দের মধ্যে রয়েছে এক অন্তর্নিহিত যোগ সূত্র, যা পরস্পর পরস্পরকে দৃঢ়ভাবে বেঁধে রেখেছে। এই পারস্পরিক বন্ধনই এদের অন্তর্নিহিত শক্তি, এদের অস্তিত্বের ভিত্তি ভূমি। কারণ, যুক্তিবাদ জন্ম না নিলে, মনের মধ্যে বিজ্ঞানমনস্কতা জন্মায় না। আর বিজ্ঞানমনস্কতা না জন্মালে মানবতাবাদের জন্ম হয় না। রাম নবমী উপলক্ষে যারা অশান্তি ছড়ালেন, তাদের মধ্যে এই মানবতবোধের লেশমাত্র উপস্থিতিও নেই।
প্রশ্ন হল যুক্তিবাদ, বিজ্ঞানমনস্কতা ও মানবতাবাদ আসলে কী?
যুক্তিবাদ হল এক ধরনের বোধ যা জগৎ ও জীবন সম্পর্কে সত্য উদঘাটনের জন্য কার্যকারণ সম্পর্ককে অপরিহার্য বলে ভাবতে শেখায়। এই বোধ মানুষকে উৎসাহিত করে কোনো কিছুকে গ্রহণ করার আগে তাকে যুক্তি দিয়ে, বুদ্ধি দিয়ে এবং তথ্য দিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করে তার সত্যাসত্য যাচাই করে তবে তা গ্রহণ বা বর্জন করার সিদ্ধান্ত নিতে। একজন মানুষের মধ্যে যখন এই কার্যকারণ সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা যুক্তিবোধ মাথা তোলে, তখনই সে উপলব্ধি করতে পারে যে, জগতের বা জীবনের ক্ষেত্রে ঘটে চলা প্রত্যেকটা ঘটনার পিছনে রয়েছে এক বা একাধিক নির্দিষ্ট কিছু কারণ।
এই কারণকে খুঁজে পেতেই প্রয়োজন বিজ্ঞানমনস্কতা। কোন বিশেষ কারণে কোন বিশেষ কাজটি সংঘটিত হচ্ছে, তা নির্দিষ্ট করে জানার জন্য যে বিশেষভাবে পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষণ পদ্ধতি অবলম্বন করার দরকার পড়ে, তাকে মান্যতা দেওয়ার মানসিকতাই হলো বিজ্ঞানমনস্কতা।
আর যখন কোনো মানুষ বিজ্ঞানমনস্ক হয়, তখন সে উপলব্ধি করে কারণই কার্যকে সংগঠিত হতে বাধ্য করে। আমি যদি কাউকে ঠকাই বা বঞ্চিত করি তাহলে বুঝতে হবে, কোনো ব্যক্তির বঞ্চিত হওয়ার মূলে রয়েছে আমার বঞ্চনা করার মোটিভ। এই মোটিভটা হল কারণ এবং বঞ্চনাটা হলো কাজ।
আবার এই যুক্তিবাদী চিন্তাধারা আমাকে ভাবতে বাধ্য করে যে, আমি যদি কাউকে বঞ্চিত করি তবে সেও আমাকে বঞ্চিত করার কৌশল খুঁজতে থাকবে। নিউটনের গতিসূত্রের মত। কারণ, প্রত্যেক ক্রিয়ারই বিপরীত ও সমান প্রতিক্রিয়া থাকে। এবং এইভাবে পারস্পরিক কৌশল খুঁজে পরস্পরকে জব্দ করার শেষ পরিণতি হল পারস্পরিক শক্তি ক্ষয়, যার পরিণাম ধ্বংস। যুক্তিবাদী মন ছাড়া এই উপলব্ধি কোনো মানুষের মধ্যে আসতে পারে না।
সুতরাং যুক্তিবাদী মন ও বিজ্ঞানমনস্কতা মানুষকে পরস্পরের বিরুদ্ধে নয়, পরস্পরের সহযোগিতায় হাত বাড়ানোর প্রেরণা যোগায়। এখান থেকেই জন্ম হয় মানবতাবাদের।
এখন প্রশ্ন হল, এই মানবতাবাদের প্রচার, প্রসার ও তাকে শক্তিশালী করার উপায় কী?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই জন্ম হয়েছে গণতন্ত্র নামক এক বিশেষ রাজনৈতিক তত্ত্বের। আসলে গণতন্ত্রের জন্মমূলে রয়েছে সেই বৈপ্লবিক ধারণা যা দুর্বল মানুষের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করার রাজনৈতিক শক্তি যোগায়। সবলের সঙ্গে সবলের যে বিরোধ, তার মীমাংসা বলপ্রয়োগ দিয়ে সম্ভব। সমানে সমানে লড়াই, একদিকে যেমন নৈতিকতার মানদন্ডে গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়, তেমনি তার বাস্তবসম্মত প্রয়োগও সম্ভব।
কিন্তু সবলের সঙ্গে দুর্বলের যে লড়াই, সেখানে বলপ্রয়োগ মূল্যহীন। কারণ, সে লড়াই আসলে এক অসম লড়াই। এখানেই গণতন্ত্রের শক্তি। গণতন্ত্র এই দুই মেরুর মানুষকে এমন একটা প্লাটফর্মে এনে দাঁড় করায়, যেখানে সবল মানুষের কর্তৃত্ববাদী শক্তির ক্ষয় হয় এবং দুর্বল মানুষের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে পরস্পরকে সমমান ও মর্যাদার আসনে দাঁড় করায়। ফলে অধিকার আদায়ের মুখোমুখি লড়াই একটি আধুনিক, উন্নত ও মানবিক রূপ পায়। এখানেই গণতন্ত্রের প্রয়োজনীয়তা ও স্বার্থকতা।
অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে তৈরি শ্রেণি বিভক্ত সমাজে সুবিধাভোগী ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষ দুই মেরুতে দাঁড়িয়ে আছে। এবং তাদের পরস্পরের স্বার্থ পরস্পর বিপরীত মুখী হওয়ায় প্রতি মুহূর্তে সংঘাতধর্মী শক্তির উদ্ভব হয়। এই শক্তির কারণেই বিবাদ বা সংঘাত অনিবার্য হয়ে পড়ে। গণতন্ত্র এই সংঘাতকে এড়িয়ে চলার এবং মানবতার অনুসারী হয়ে ওঠার পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে।
কিন্তু সমস্যা হল শ্রেণি বিভক্ত সমাজ তৈরির পিছনে শক্তিশালী অনুঘটকের কাজ করে ধর্ম দর্শনের বিকৃত তত্ত্ব। যুগ যুগ ধরে ধর্ম দর্শনকে বিকৃত করার কাজে সবচেয়ে বেশি ও বিপদজনক ভূমিকা নিয়েছে রাষ্ট্রনেতারা। তাদের দ্বারা বিকৃত এই ধর্মতত্ত্ব বিশ্বব্যাপী মনুষ্য সমাজকে হাজারও গোষ্ঠীতে বিভক্ত করে ফেলেছে। এবং সার্থান্বেষী ধর্ম তাত্ত্বিকরা সুবিধাভোগী রাজনীতিকদের ( যারা বৈষম্যের সৌজন্যে সুবিধা ভোগ করে) সঙ্গে হাত মিলিয়ে আর্থিক বৈষম্যের বিষয়টির সঙ্গে আরও একটি অভিমুখ যোগ করে দিয়েছে। এই নতুন অভিমুখ হল সামাজিক বৈষম্য; যার ভিত্তিও এই বিকৃত ধর্ম দর্শন। এইভাবে বিকৃত ধর্ম দর্শনকে কাজে লাগিয়ে মনুষ্য সমাজে তৈরি করা হয়েছে এক 'কৃত্রিম সংখ্যালঘু' সম্প্রদায়, যারা সবচেয়ে সুবিধা বঞ্চিত এবং কখনও কখনও চরমভাবে শোষিত। 'কৃত্রিম সংখ্যালঘু' বলা হচ্ছে এ কারণে যে, বহু ধর্মে-বর্ণে বিভক্ত বঞ্চিত মানুষের সংখ্যা যোগ করলে তারাই আসলে সংখ্যাগুরু।
এই ‘কৃত্রিম সংখ্যালঘু’ মানুষেরই সবচেয়ে বেশি দরকার পড়ে রাষ্ট্রের সুরক্ষাকবচ। কারণ, তাদের জীবন ও সম্পত্তি তথাকথিত সংখ্যাগুরুদের দ্বারা বেশি হুমকির মুখে পড়ে বা পড়ার সম্ভাবনা থাকে। আধুনিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই কেবলমাত্র সংখ্যালঘুদের মতামতকেও সমানভাবে গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলে। অর্থাৎ দুর্বলকেও সবলের সঙ্গে এক সারিতে দাড়িয়ে কথা বলা বা সমান অধিকার ভোগের স্বীকৃতি দেয়। এই স্বীকৃতির অর্থই হচ্ছে মানবতার স্বীকৃতি।
মনে রাখা দরকার, সবলদের জন্য গণতন্ত্র নামক সুরক্ষা কবচের প্রয়োজন হয় না। সেখানে গণতন্ত্র কেবল সমশক্তির অধিকারী ভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে কে মোড়লী করবে তার মীমাংসায় মধ্যস্থতাকারী মাত্র।
সুতরাং কোনো দেশে সংখ্যালঘু মানুষ কেমন আছেন, তার নিরিখেই সেদেশের গণতন্ত্রের কার্যকারিতা ও সক্ষমতা বিচার্য হয়। তাই সংখ্যাগুরু নাগরিক ও রাষ্ট্রনেতাদের মনে রাখতে হবে, সংখ্যালঘুর মুখই গণতন্ত্রের আয়না এবং এটাই গণতন্ত্রের স্বাস্থ্য যাচাইয়ের সবচেয়ে বড় মানদণ্ড।
---------x--------
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দিনদর্পণ দৈনিকের উত্তর সম্পাদকীয় বিভাগে (০৬/০৪/২০২৩) । পত্রিকায় পড়ার জন্য এখানে ক্লিক করুন
পাঠকের মতামত দেখুন ফেসবুকে
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন