সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

সংখ্যালঘুর মুখই গণতন্ত্রের আয়না

 সংখ্যালঘুর মুখই গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় এবং শক্তিশালী আয়না।

The face of the minority is the mirror of democracy - Ali Hossain

The face of the minority is the mirror of democracy

কোন দেশ কতটা গণতান্ত্রিক, তা বোঝা যায় সে দেশের সংখ্যালঘু মানুষের জীবন ও সম্পত্তির সুরক্ষা কতটা মজবুত, তা থেকে। কারণ, সংখ্যালঘুর মুখই হচ্ছে গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় এবং শক্তিশালী আয়না।

সংখ্যালঘুরা সঙ্গত কারণেই সংখ্যাগরিষ্ঠদের চেয়ে বেশি বঞ্চনাজনিত মনস্তাত্ত্বিক চাপে থাকে। এই চাপ দু’ভাবে তৈরি হয়। ১) সংখ্যাগিষ্ঠতাজনিত সুবিধা যা সংখ্যাগুরুরা পায়, সংখ্যালঘুরা কখনই তা পায় না বা পাবে না - এই ধারণা, যার কিছুটা হলেও ভিত্তি রয়েছে ২) সংখ্যাগরিষ্ঠদের মধ্যে বৃহত্তম (?) জনগোষ্ঠীর অংশ হওয়ার সুবাদে যে কর্তৃত্ববাদী মানসিকতা তৈরি হয় এবং যা বহুজনের মধ্যে দৃষ্টিকটুভাবে প্রকাশ হয়ে পড়ে, তার ভয়ে।

এই চাপ কতটা গভীর তা সংখ্যালঘু ছাড়া বোঝা খুব মুশকিল। তবে আলোকপ্রাপ্ত মানুষ মাত্রই যে তা উপলব্ধি করতে পারেন, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।

এই ধরণের চাপ তৈরি করে কিছু অসাধু মানুষ যখন সংখ্যালঘুদের জীবন ও সম্পত্তির সামনে হুমকি হয়ে দাঁড়ায়, তখন তা কমানোর ক্ষমতা একমাত্র গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রশক্তির হাতেই থাকে।

সম্প্রতি রামনবমীকে কেন্দ্র করে পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া-সহ বিহারের সাসারাম, নালন্দা কিংবা কর্ণাটকের হুবলীতে যে ধরণের সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়িয়েছে তাতে সংখ্যালঘুর মধ্যে এই চাপ যে উচ্চমাত্রায় পৌঁছেবে - একথা বলার অপেক্ষা রাখে না। মাননীয় রাজ্যপাল বলেছেন, ‘সাধারণ মানুষের শান্তিতে বাঁচার অধিকার রয়েছে।’ অস্বীকার করার উপায় নেই, আধুনিক গণতন্ত্রই পারে এই অধিকার নিশ্চিত করতে এবং সংখ্যাগুরুর সমর্থনেই কেবল তা কার্যকর করা সম্ভব। কারণ, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রশক্তির হাত এবং সংখ্যাগুরুর সদিচ্ছার সমন্বয়ে গড়ে ওঠে নিশ্চয়তার দুর্ভেদ্য আশ্বাসই একমাত্র পারে এই মনস্তাত্ত্বিক চাপ কমিয়ে তাদের অধিকার নিশ্চিত করতে।

‘আধুনিক’ শব্দের (যুগের) কিছু ইউনিক বৈশিষ্ট্য আছে, যেগুলোকে বাদ দিলে এই শব্দটার উজ্জ্বল্য হারিয়ে যায়। বলা যায় একটা অর্থহীন শব্দবন্ধতে পরিণত হয় 'আধুনিক' কথাটা। এই বৈশিষ্ট্যগুলো হল, ১) যুক্তিবাদ, ২) বিজ্ঞানমনস্কতা এবং ৩) মানবতাবাদ। তিনটি শব্দের মধ্যে রয়েছে এক অন্তর্নিহিত যোগ সূত্র, যা পরস্পর পরস্পরকে দৃঢ়ভাবে বেঁধে রেখেছে। এই পারস্পরিক বন্ধনই এদের অন্তর্নিহিত শক্তি, এদের অস্তিত্বের ভিত্তি ভূমি। কারণ, যুক্তিবাদ জন্ম না নিলে, মনের মধ্যে বিজ্ঞানমনস্কতা জন্মায় না। আর বিজ্ঞানমনস্কতা না জন্মালে মানবতাবাদের জন্ম হয় না। রাম নবমী উপলক্ষে যারা অশান্তি ছড়ালেন, তাদের মধ্যে এই মানবতবোধের লেশমাত্র উপস্থিতিও নেই।

প্রশ্ন হল যুক্তিবাদ, বিজ্ঞানমনস্কতা ও মানবতাবাদ আসলে কী?

যুক্তিবাদ হল এক ধরনের বোধ যা জগৎ ও জীবন সম্পর্কে সত্য উদঘাটনের জন্য কার্যকারণ সম্পর্ককে অপরিহার্য বলে ভাবতে শেখায়। এই বোধ মানুষকে উৎসাহিত করে কোনো কিছুকে গ্রহণ করার আগে তাকে যুক্তি দিয়ে, বুদ্ধি দিয়ে এবং তথ্য দিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করে তার সত্যাসত্য যাচাই করে তবে তা গ্রহণ বা বর্জন করার সিদ্ধান্ত নিতে। একজন মানুষের মধ্যে যখন এই কার্যকারণ সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা যুক্তিবোধ মাথা তোলে, তখনই সে উপলব্ধি করতে পারে যে, জগতের বা জীবনের ক্ষেত্রে ঘটে চলা প্রত্যেকটা ঘটনার পিছনে রয়েছে এক বা একাধিক নির্দিষ্ট কিছু কারণ।

এই কারণকে খুঁজে পেতেই প্রয়োজন বিজ্ঞানমনস্কতা। কোন বিশেষ কারণে কোন বিশেষ কাজটি সংঘটিত হচ্ছে, তা নির্দিষ্ট করে জানার জন্য যে বিশেষভাবে পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষণ পদ্ধতি অবলম্বন করার দরকার পড়ে, তাকে মান্যতা দেওয়ার মানসিকতাই হলো বিজ্ঞানমনস্কতা।

আর যখন কোনো মানুষ বিজ্ঞানমনস্ক হয়, তখন সে উপলব্ধি করে কারণই কার্যকে সংগঠিত হতে বাধ্য করে। আমি যদি কাউকে ঠকাই বা বঞ্চিত করি তাহলে বুঝতে হবে, কোনো ব্যক্তির বঞ্চিত হওয়ার মূলে রয়েছে আমার বঞ্চনা করার মোটিভ। এই মোটিভটা হল কারণ এবং বঞ্চনাটা হলো কাজ।

আবার এই যুক্তিবাদী চিন্তাধারা আমাকে ভাবতে বাধ্য করে যে, আমি যদি কাউকে বঞ্চিত করি তবে সেও আমাকে বঞ্চিত করার কৌশল খুঁজতে থাকবে। নিউটনের গতিসূত্রের মত। কারণ, প্রত্যেক ক্রিয়ারই বিপরীত ও সমান প্রতিক্রিয়া থাকে। এবং এইভাবে পারস্পরিক কৌশল খুঁজে পরস্পরকে জব্দ করার শেষ পরিণতি হল পারস্পরিক শক্তি ক্ষয়, যার পরিণাম ধ্বংস। যুক্তিবাদী মন ছাড়া এই উপলব্ধি কোনো মানুষের মধ্যে আসতে পারে না।

সুতরাং যুক্তিবাদী মন ও বিজ্ঞানমনস্কতা মানুষকে পরস্পরের বিরুদ্ধে নয়, পরস্পরের সহযোগিতায় হাত বাড়ানোর প্রেরণা যোগায়। এখান থেকেই জন্ম হয় মানবতাবাদের।

এখন প্রশ্ন হল, এই মানবতাবাদের প্রচার, প্রসার ও তাকে শক্তিশালী করার উপায় কী?

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই জন্ম হয়েছে গণতন্ত্র নামক এক বিশেষ রাজনৈতিক তত্ত্বের। আসলে গণতন্ত্রের জন্মমূলে রয়েছে সেই বৈপ্লবিক ধারণা যা দুর্বল মানুষের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করার রাজনৈতিক শক্তি যোগায়। সবলের সঙ্গে সবলের যে বিরোধ, তার মীমাংসা বলপ্রয়োগ দিয়ে সম্ভব। সমানে সমানে লড়াই, একদিকে যেমন নৈতিকতার মানদন্ডে গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়, তেমনি তার বাস্তবসম্মত প্রয়োগও সম্ভব।

কিন্তু সবলের সঙ্গে দুর্বলের যে লড়াই, সেখানে বলপ্রয়োগ মূল্যহীন। কারণ, সে লড়াই আসলে এক অসম লড়াই। এখানেই গণতন্ত্রের শক্তি। গণতন্ত্র এই দুই মেরুর মানুষকে এমন একটা প্লাটফর্মে এনে দাঁড় করায়, যেখানে সবল মানুষের কর্তৃত্ববাদী শক্তির ক্ষয় হয় এবং দুর্বল মানুষের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে পরস্পরকে সমমান ও মর্যাদার আসনে দাঁড় করায়। ফলে অধিকার আদায়ের মুখোমুখি লড়াই একটি আধুনিক, উন্নত ও মানবিক রূপ পায়। এখানেই গণতন্ত্রের প্রয়োজনীয়তা ও স্বার্থকতা।

অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে তৈরি শ্রেণি বিভক্ত সমাজে সুবিধাভোগী ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষ দুই মেরুতে দাঁড়িয়ে আছে। এবং তাদের পরস্পরের স্বার্থ পরস্পর বিপরীত মুখী হওয়ায় প্রতি মুহূর্তে সংঘাতধর্মী শক্তির উদ্ভব হয়। এই শক্তির কারণেই বিবাদ বা সংঘাত অনিবার্য হয়ে পড়ে। গণতন্ত্র এই সংঘাতকে এড়িয়ে চলার এবং মানবতার অনুসারী হয়ে ওঠার পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে।

কিন্তু সমস্যা হল শ্রেণি বিভক্ত সমাজ তৈরির পিছনে শক্তিশালী অনুঘটকের কাজ করে ধর্ম দর্শনের বিকৃত তত্ত্ব। যুগ যুগ ধরে ধর্ম দর্শনকে বিকৃত করার কাজে সবচেয়ে বেশি ও বিপদজনক ভূমিকা নিয়েছে রাষ্ট্রনেতারা। তাদের দ্বারা বিকৃত এই ধর্মতত্ত্ব বিশ্বব্যাপী মনুষ্য সমাজকে হাজারও গোষ্ঠীতে বিভক্ত করে ফেলেছে। এবং সার্থান্বেষী ধর্ম তাত্ত্বিকরা সুবিধাভোগী রাজনীতিকদের ( যারা বৈষম্যের সৌজন্যে সুবিধা ভোগ করে) সঙ্গে হাত মিলিয়ে আর্থিক বৈষম্যের বিষয়টির সঙ্গে আরও একটি অভিমুখ যোগ করে দিয়েছে। এই নতুন অভিমুখ হল সামাজিক বৈষম্য; যার ভিত্তিও এই বিকৃত ধর্ম দর্শন। এইভাবে বিকৃত ধর্ম দর্শনকে কাজে লাগিয়ে মনুষ্য সমাজে তৈরি করা হয়েছে এক 'কৃত্রিম সংখ্যালঘু' সম্প্রদায়, যারা সবচেয়ে সুবিধা বঞ্চিত এবং কখনও কখনও চরমভাবে শোষিত। 'কৃত্রিম সংখ্যালঘু' বলা হচ্ছে এ কারণে যে, বহু ধর্মে-বর্ণে বিভক্ত বঞ্চিত মানুষের সংখ্যা যোগ করলে তারাই আসলে সংখ্যাগুরু।

এই ‘কৃত্রিম সংখ্যালঘু’ মানুষেরই সবচেয়ে বেশি দরকার পড়ে রাষ্ট্রের সুরক্ষাকবচ। কারণ, তাদের জীবন ও সম্পত্তি তথাকথিত সংখ্যাগুরুদের দ্বারা বেশি হুমকির মুখে পড়ে বা পড়ার সম্ভাবনা থাকে। আধুনিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই কেবলমাত্র সংখ্যালঘুদের মতামতকেও সমানভাবে গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলে। অর্থাৎ দুর্বলকেও সবলের সঙ্গে এক সারিতে দাড়িয়ে কথা বলা বা সমান অধিকার ভোগের স্বীকৃতি দেয়। এই স্বীকৃতির অর্থই হচ্ছে মানবতার স্বীকৃতি।

মনে রাখা দরকার, সবলদের জন্য গণতন্ত্র নামক সুরক্ষা কবচের প্রয়োজন হয় না। সেখানে গণতন্ত্র কেবল সমশক্তির অধিকারী ভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে কে মোড়লী করবে তার মীমাংসায় মধ্যস্থতাকারী মাত্র।

সুতরাং কোনো দেশে সংখ্যালঘু মানুষ কেমন আছেন, তার নিরিখেই সেদেশের গণতন্ত্রের কার্যকারিতা ও সক্ষমতা বিচার্য হয়। তাই সংখ্যাগুরু নাগরিক ও রাষ্ট্রনেতাদের মনে রাখতে হবে, সংখ্যালঘুর মুখই গণতন্ত্রের আয়না এবং এটাই গণতন্ত্রের স্বাস্থ্য যাচাইয়ের সবচেয়ে বড় মানদণ্ড।
---------x--------

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দিনদর্পণ দৈনিকের উত্তর সম্পাদকীয় বিভাগে (০৬/০৪/২০২৩) । পত্রিকায় পড়ার জন্য এখানে ক্লিক করুন

পাঠকের মতামত দেখুন ফেসবুকে

মন্তব্যসমূহ

📂 আলী হোসেনের জনপ্রিয় প্রবন্ধগুলি

হিন্দু কারা? তারা কীভাবে হিন্দু হল?

হিন্দু কারা? কীভাবে তারা হিন্দু হল? যদি কেউ প্রশ্ন করেন, অমিত শাহ হিন্দু হলেন কবে থেকে? অবাক হবেন তাই তো? কিন্তু আমি হবো না। কারণ, তাঁর পদবী বলে দিচ্ছে উনি এদেশীয়ই নন, ইরানি বংশোদ্ভুত। কারণ, ইতিহাস বলছে পারস্যের রাজারা ‘শাহ’ উপাধি গ্রহণ করতেন। এবং ‘শাহ’ শব্দটি পার্শি বা ফার্সি। লালকৃষ্ণ আদবানির নামও শুনেছেন আপনি। মজার কথা হল আদবানি শব্দটিও এদেশীয় নয়। আরবি শব্দ ‘আদবান’ থেকে উদ্ভূত। সুতরাং তাঁর পদবীও বলছে, তিনিও এদেশীয় নন। ভাষাতত্ত্ব ও নৃতত্ত্বের বিশ্লেষণ বলছে, উচ্চবর্ণের বিশেষ করে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের মানুষদের, উৎসভূমি হল পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চল। তারও আগে ছিল ইউরোপের ককেশাস অঞ্চলে। আসলে এরা (উচ্চবর্ণের মানুষ) কেউই এদেশীয় নয়। তারা নিজেদের আর্য বলে পরিচয় দিতেন এবং এই পরিচয়ে তারা গর্ববোধ করতেন। সিন্ধু সভ্যতা পরবর্তীকালে তারা পারস্যের বিভিন্ন এলাকা থেকে হিন্দুকুশ পর্বতের গিরিপথ ধরে এদেশে অভিবাসিত হয়েছেন। আর মধ্যযুগে এসে এদেরই উত্তরসূরী ইরানিরা (অমিত শাহের পূর্বপুরুষ) অর্থাৎ পারস্যের কিছু পর্যটক-ঐতিহাসিক, এদেশের আদিম অধিবাসীদের ’হিন্দু’ বলে অভিহিত করেছেন তাদের বিভিন্ন ভ্রমণ বৃত্তান্তে।

রবীন্দ্রনাথের ধর্মভাবনা ও তার বিবর্তন

রবীন্দ্রনাথের ধর্মভাবনা ও তার বিবর্তন আলী হোসেন  যদি প্রশ্ন করা হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ধর্ম কী? মনে হয় অনেকেই ঘাবড়ে যাবেন। কেউ বলবেন, তাঁর বাবা যখন ব্রাহ্ম ছিলেন তাহলে তিনি নিশ্চয়ই ব্রাহ্ম। যারা লেখাপড়া জানেন না, তারা বলবেন, কেন! উনি তো হিন্দু ছিলেন। আবার কেউ কেউ তথ্য সহযোগে এও বলার চেষ্টা করবেন যে, উনি নাস্তিক ছিলেন; না হলে কেউ বলতে পারেন, ধর্মমোহের চেয়ে নাস্তিকতা অনেক ভালো? ¹ রবীন্দ্রনাথের ধর্ম ভাবনার বিবর্তন  তাহলে সঠিক উত্তরটা কী? আসলে এর কোনোটাই সঠিক উত্তর নয়। চিন্তাশীল মানুষ-মাত্রই সারা জীবন ধরে ভাবেন, ভাবতে ভাবতে তাঁর উপলব্ধি বাড়তে থাকে ক্রমশঃ প্রগতির পথে। জগৎ ও জীবন থেকে তথ্য সংগ্রহ করে একে একে গড়ে তোলেন নিত্যনতুন জীবনদর্শন। তাই এ ধরনের মানুষ আজীবন এক এবং অখণ্ড জীবনদর্শনের বার্তা বহন করেন না। সময়ের সাথে সাথে পাল্টে যায় তাঁর পথচলার গতিমুখ। মানুষ রবীন্দ্রনাথও তাই পাল্টে ফেলেছেন তাঁর জীবন ও ধর্মদর্শন সময়ের বয়ে যাওয়াকে অনুসরণ করে। রবীন্দ্রনাথ ও  হিন্দু জাতীয়তাবাদ ১৮৬১ সালের ৭ই মে সোমবার রাত্রি ২টা ৩৮ মিনিট ৩৭ সেকেন্ডে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে জন্ম গ্রহণ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এর

সীমান্ত আখ্যান, বাঙালির আত্মানুসন্ধানের ডিজিটাল আখ্যান

সময়ের সঙ্গে সমস্যার চরিত্র বদলায়। কিন্তু মুলটা বদলায় না। যদি সে সমস্যা ইচ্ছা করে তৈরি হয়ে থাকে বিশেষ সুবিধা ভোগেই লোভে, তবে তো অন্য কথা চলেই না। স্বনামধন্য স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাতা সৌমিত্র দস্তিদারের ডকুমেন্টারি ফিল্প 'সীমান্ত আখ্যান' দেখার পর এই উপলব্ধি মাথা জুড়ে ঘুরপাক খাচ্ছে। দেখলাম, দেশ ভাগ হয়েছে। কিন্তু সমস্যার অবসান হয়নি। শুধু সমস্যার চরিত্রটা পাল্টেছে। এই যে সমস্যা রয়ে গেল, কোন গেল? তার উত্তর ও পাওয়া গেল 'সীমান্ত আখ্যান' এ। আসলে দেশ ভাগ তো দেশের জনগণ চাননি, চেয়েছেন দেশের নেতারা। চেয়েছেন তাঁদের ব্যক্তিগত, সম্প্রদায়গত সুবিধাকে নিজেদের কুক্ষিগত করার নেশায়। আর এই নেশার রসদ যোগান দিতে পারার নিশ্চয়তা নির্ভর করে রাজনৈতিক ক্ষমতার লাগাম নিজের হাতে থাকার ওপর। তাই রাজনীতিকরা এই ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য জনগণকে 'ডিভাইড এন্ড রুল' পলিছি দ্বারা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চেষ্টা করেছেন এবং করে চলেছেন। এ সমস্যা নতুন না, ব্রিটিশ সরকার এর বীজ রোপণ করে গেছেন, এখন কেউ তার সুফল ভোগ করছে (রাজনীতিকরা) আর কেউ কুফল (জনগন)। 'সীমান্ত আখ্যান চোখে আঙুল দিয়ে দে

ভাগ্য : মুসলিম মনস্তত্ত্ব, ধর্মদর্শন ও প্রগতি

ভাগ্য : মুসলিম মনস্তত্ত্ব, ধর্মদর্শন ও প্রগতি - লিখছেন আলী হোসেন  কপালের লেখন খণ্ডায় কার সাধ্য? জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে কিংবা লেখাপড়া জানা-নাজানা নির্বিশেষে সমস্ত মানুষের সিংহভাগই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এই কথাটা মেনে নেয়। জীবনের উত্থান-পতনের ইতিহাসে কপালের লেখনকে জায়গা করে দিতে তারা কুণ্ঠাবোধ করে না। বরং বলা ভালো এব্যাপারে তারা অতিমাত্রায় উদার। মানুষের মনস্তত্বের এ-এক জটিল স্তর বিন্যাস। একই মানুষ বিভিন্ন সময়ে একই বিষয়ের বিচার বিশ্লেষণে ভিন্নভিন্ন দৃষ্টিকোণ ব্যবহার করে। এ রকমই একটি দৃষ্টিকোণ হলো কপাল বা ভাগ্যের ভূমিকাকে সাফল্যের চাবিকাঠি বলে ভাবা। কখনও সে ভাগ্যের নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠার চেষ্টা করে, আবার কখনও নিজেই ভাগ্যের কাছে নির্দিধায় আত্ম সমর্পন করে। নিজের ব্যার্থতার পিছনে ভাগ্যের অদৃশ্য হাতের কারসাজির কল্পনা করে নিজের ব্যার্থতাকে ঢাকা দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে থাকে। মজার কথা, এক্ষেত্রে মুসলিম মানসের মনস্তত্ত্ব কখনও চেতনমনে আবার কখনও অবচেতন মনে উপরওয়ালাকে (আল্লাহকে) কাঠ গড়ায় তোলে বিনা দ্বিধায়। নির্দিধায় বলে দেয়, উপরওয়ালা রাজি না থাকলে কিছুই করার থাকেনা। সাফল্য কিংবা ব্যর্থতা সবই তাঁর (আল্লার

কাশ্মীর ফাইলস : প্রপাগান্ডার এক নয়া ব্রান্ড, কর্পোরেট পুঁজি ও রাজনৈতিক দলের গলাগলির এক সুচারু প্রদর্শনী

কাশ্মীর ফাইলস : প্রপাগান্ডার এক নয়া ব্রান্ড, কর্পোরেট পুঁজি ও রাজনৈতিক দলের গলাগলির এক সুচারু প্রদর্শনী রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয় উলুখাগড়ার প্রাণ যায়। ১৯৪৭ সালের পর থেকে জম্মু ও কাশ্মিরের জনগণের ভাগ্যলিপিতে লেখা হয়ে গেছে এই বিখ্যাত প্রবাদটির বিস্তারিত সারাৎসার। একদিকে পাকিস্তান আর অন্যদিকে ভারত – এই দুই প্রতিবেশি দেশের ভুরাজনৈতিক স্বার্থের যাঁতাকলে পড়ে তাদের এই হাল। কিন্তু কেন এমন হল? এই প্রশ্নের উত্তর জানে না এমন মানুষ ভুভারতে হয়তো বা নেই। কিন্তু সেই জানার মধ্যে রয়েছে বিরাট ধরণের ফাঁক। সেই ফাঁক গলেই ঢুকেছে কাশ্মির ফাইলসের মত বিজেপির রাজনৈতিক ন্যারেটিভ যা তারা বহুকাল ধরে করে চলেছে অন্য আঙ্গিকে। এবার নতুন মাধ্যমে এবং নবরূপে তার আগমন ঘটেছে, যায় নাম সিনেমা বা সেলুলয়েড প্রদর্শনী। যদিও ডিজিটাল মাধ্যমে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সৌজন্যে অনেক আগেই সফলভাবে তারা এই ন্যারেটিভ দিয়ে বিভাজনের রাজনীতি করে চলেছে বেশ কয়েক বছর ধরে। টেলিভিশন সম্প্রচারে কর্পোরেট পুজির অনুপ্রবেশের মাধ্যমে যার সূচনা হয়েছিল। রাষ্ট্রশক্তিকে কুক্ষিগত করতে না পারলে দেশের সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রন আনা সম্ভব নয়, একথা সাধারণ নিরক্ষর নাগরিক এবং ত

শিক্ষা কী, কেন প্রয়োজন এবং কীভাবে অর্জন করা যায়?

শিক্ষা কী, কেন এবং কীভাবে অর্জন করতে হয়? সূচিপত্র : What is education, why it is needed and how to achieve it শিক্ষা কী শিক্ষা হল এক ধরনের অর্জন, যা নিজের ইচ্ছা শক্তির সাহায্যে নিজে নিজেই নিজের মধ্যে জমা করতে হয়। প্রকৃতি থেকেই সেই অর্জন আমাদের চেতনায় আসে। সেই চেতনাই আমাদের জানিয়ে দেয়, জগৎ ও জীবন পরিচালিত হয় প্রকৃতির কিছু অলংঘনীয় নিয়ম-নীতির দ্বারা। গভীর পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ শক্তিকে বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে কাজে লাগালেই এই নিয়মনীতিগুলো আমাদের আয়ত্বে আসে। এই নিয়ম-নীতিগুলো জানা এবং সেই জানার ওপর ভিত্তি করেই জগৎ ও জীবনকে সর্বোত্তম পর্যায়ে পৌঁছে দেয়ার পথ খুঁজে বের করার শক্তি অর্জনই শিক্ষা। মনে রাখতে হবে, এই শিক্ষা কখনও কারও মধ্যে জোর করে ঢুকিয়ে দেওয়া যায় না। এখন প্রশ্ন হল, শিক্ষা অর্জনের বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিটা আসলে কী। সেই আলোচনায় যাওয়ার আগে জানতে হবে, এই শিক্ষার সূচনা হয় কখন এবং কীভাবে? শিক্ষার সূচনা কখন হয় : এই অর্জনের সূচনা হয় মাতৃগর্ভে এবং তা প্রাকৃতিক ভাবেই। প্রকৃতির দেওয়া কিছু সহজাত শিক্ষাকে অবলম্বন করেই তার সূচনা। এই সহজাত শিক্ষাকে অবলম্বন করেই মানুষ তার পরবর্তী প

জল, না পানি : জল নিয়ে জলঘোলা করা পানির মত সহজ নয়

জল নিয়ে জলঘোলা করা পানির মত সহজ নয় আলী হোসেন  সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত সরকারি অনুষ্ঠানে চিত্র শিল্পী শুভাপ্রসন্ন ভট্টাচার্য পানি শব্দকে বাংলা নয় বলে দাবি করেছেন। বলেছেন, "আমরা কোনোদিন কখনও বাংলা ভাষায় পানি (শব্দটা) ব্যবহার করি না"। শুধু তা-ই নয়, পানি শব্দের ব্যবহারের মধ্যে তিনি 'সাম্প্রদায়িকতার ছাপ'ও দেখতে পেয়েছেন। প্রশ্ন হল - এক, এই ভাবনা কতটা বাংলা ভাষার পক্ষে স্বাস্থ্যকর এবং কতটা 'বাংলা ভাষার ইতিহাস' সম্মত? দুই, জল বা পানি নিয়ে যারা জলঘোলা করছেন তারা কি বাংলাকে ভালোবেসে করছেন? মনে হয় না। কারণ, খোঁজ নিলে দেখা যাবে, এরা কেউ নিজের সন্তানকে বাংলা মিডিয়াম স্কুলে পড়াননি বা পড়ান না। ব্যবহারিক জীবনেও তারা বাংলার ভাষার চেয়ে ইংরেজি বা হিন্দিতে কথা বলতে বা গান শুনতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন, বলা ভালো গর্ববোধ করেন। প্রসংগত মনে রাখা দরকার, বাংলা মিডিয়াম স্কুলগুলোতে যারা ভর্তি হয়, তারা অধিকাংশই গরীব ঘরের সন্তান। বলা ভালো, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে তারাই বাংলা ভাষাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। কারণ, সন্তানকে বাংলা মিডিয়ামে পড়ানোর পাশাপাশি, বা

নিম্নবর্গের মানুষ মার খাচ্ছে কেন

নিম্নবর্গের মানুষ কীভাবে পিছিয়ে পড়েছেন? সমাধান কীভাবে? এদেশের নিম্নবর্গের মানুষ নিজেদের বাঁচাতে যুগ যুগ ধরে ধর্ম পরিবর্তন করেছে। কখনও বৌদ্ধ (প্রাচীন যুগ), কখনও মুসলমান (মধুযুগ), কিম্বা কখনো খ্রিস্টান (আধুনিক যুগ) হয়েছে। কিন্তু কখনই নিজেদের চিন্তা-চেতনাকে পাল্টানোর কথা ভাবেনি। পরিবর্তন হচ্ছে অলংঘনীয় প্রাকৃতিক নিয়ম। যারা এই নিয়ম মেনে সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে পারে, তারাই লাভবান হয়, টিকে থাকে। “পাল্টে গেলেই জীবন বাড়ে না পাল্টালে নয়, জীবন মানেই এগিয়ে যাওয়া নইলে মৃত্যু হয়” জীবনের এই চরম সত্য তারা অধিকাংশই উপলব্ধি করতে পারেনি। পৃথিবীর যেকোন উন্নত জাতির দিকে তাকান, তারা দ্রুততার সঙ্গে এই পরিবর্তনকে মেনে নিজেদেরকে পুনর্গঠন করে নিয়েছে। যারা পারেনি বা নেয়নি তারাই মার খাচ্ছে, অতীতেও খেয়েছে। বুদ্ধিমান জাতি নিজের দুর্বলতাকে মেনে নেয় এবং ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য সময়ের সঙ্গে তাল রেখে নিজেদের চিন্তা এবং চেতনায় পরিবর্তন আনে। খ্রিষ্টান, ইহুদি-সহ এশিয়া, ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন জাতি - যারাই এই পরিবর্তন মেনে নিয়েছে তারাই আরও উন্নত এবং শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। মহানবীর (সঃ) গৌরবময় উত্থান (যা এক ধরণ

আধুনিক মিডিয়া : কর্পোরেট পুঁজির (পুঁজিপতিদের) তোতাপাখি

গোদি মিডিয়া : কর্পোরেট পুঁজির তোতাপাখি পশ্চিমী মিডিয়াকে 'ইসরাইল সরকারের তোতাপাখি' নামে পরিচয় দেওয়া হয় সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী স্বাধীন ও নিরপেক্ষ মিডিয়া হাউজের পক্ষ থেকে। সম্প্রতি একইভাবে ভারতীয় কর্পোরেট মিডিয়া ভারত সরকার তথা 'কর্পোরেট পুঁজির  তোতাপাখি' হিসাবে পরিচয় পাচ্ছে, যাকে নিন্দুকেরা 'গোদী মিডিয়া' নামে অভিহিত করে থাকে। মধ্যপ্রাচ্যের ঘটনা সম্পর্কে ইসরাইল যা বলে, ইউরোপ ও আমেরিকার মিডিয়া, তোতা পাখির মতো তা-ই প্রচার করে। সাংবাদিকতার প্রধান প্রধান শর্তগুলোকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ইসরাইলের দেওয়া তথ্যই তারা প্রচার করে অন্ধ ও নির্লজ্জভাবে। ভারতের ক্ষেত্রেও করপোরেট মিডিয়া বর্তমানে সেটাই করছে বলে অভিযোগ। অভিযোগ, নত মস্তকে ভারত সরকারের দেওয়া তথ্য বিনা বিচারে প্রচার করে চলেছে অধিকাংশ মিডিয়া হাউজ।  অর্থাৎ তাদের সম্প্রচারিত খবরের বড় অংশই হয় নিয়ন্ত্রিত অথবা কখনও কখনও অসত্য - এমন দাবিও করা হয়।  আসলে সিংহভাগ মিডিয়ার মালিক হচ্ছেন এক-একজন  করপোরেট পুঁজির মালিক বা পুঁজিপতি। এরা কি কখনও নিজের স্বার্থের বিরুদ্ধে যায় - এমন খবর, তথ্য বা তত্ত্ব প্রচার করবে? করবে না, করেও না। আর এ