নীতির রাজা, না রাজার নীতি - কোন্ পথে নির্বাচনী রাজনীতি?
নীতির রাজা, না রাজার নীতি - কোন পথে নির্বাচনী রাজনীতি |
আলী হোসেন
নির্বাচন কেন করা হয় :
এক কথায়, ভোট বা নির্বাচনের উদ্দেশ্য হল, দেশে পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য শাসক নির্বাচন করা। এখন এই নির্বাচন প্রক্রিয়ায় শাসক হিসাবে জনগণ কাকে, কেন, কীভাবে এবং কিসের ভিত্তিতে নির্বাচন করবেন - এগুলো অত্যন্ত জরুরী এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এই প্রশ্নের সদুত্তর জানা না থাকলে, জনগণের কাছে আধুনিক ভোট বা নির্বাচন ব্যবস্থা অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায়।নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা কী :
তাই, এই নির্বাচন উপলক্ষে আগামীতে কোন্ দল কোন্ কোন্ পরিকল্পনার মাধ্যমে দেশকে অর্থনৈতিকভাবে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে এবং আরও ভালোভাবে সমাজে সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার পরিবেশ তৈরি করতে পারবে, তার খতিয়ান মানুষের কাছে উপস্থাপন করার কথা। এটাই রাজনৈতিক দলগুলোর প্রাথমিক কাজ।আসলে এগুলোই আধুনিক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার মূল ভিত্তি। এবং তা মেনেই প্রত্যেকটি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী রাজনৈতিক দলকে কাজ করতে হয়। এগুলো বাদ দিলে দেশ আধুনিক ও গণতান্ত্রিক - এ দাবি করা যায় না। বাদ দিলে, তার অর্থ দাঁড়ায়, দেশ মধ্যযুগীয়, কিংবা প্রাচীনযুগীয় মানসিকতা নিয়ে এগোতে চাইছে। বলা বাহুল্য, পিছন দিকে হাঁটলে, মানুষ এগোতে পারে না; পিছিয়েই যায়। ভোটে অংশ নেওয়ার আগে এই ভাবনাও মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। অর্থাৎ আধুনিক ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ নাগরিক সমাজের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া এবং জনগণকে রাজনৈতিকভাবে শিক্ষিত করে তোলাও রাজনৈতিক দলগুলোর দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
নির্বাচন প্রক্রিয়ার উদ্দেশ্য :
দেশের নাগরিক সম্প্রদায় নির্বাচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উপরোক্ত আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রধান শর্তগুলো সম্পর্কে জানবেন এবং তার ভিত্তিতে, সবচেয়ে ভালো পরিকল্পনা যাদের ইস্তাহারে আছে, তাদেরকে বেছে নেয়ার সুযোগ পাবেন, ভোটদান প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। এটাই নির্বাচন প্রক্রিয়ার আসল উদ্দেশ্য। সোজা কথায় : ১) অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় স্বাধীনতাকে (এগুলো আধুনিকতার ও গণতান্ত্রিক ধ্যান ধারণার প্রধান শর্ত) মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য কোন্ দল কীভাবে কাজ করবে, তারই আলোচনা, পর্যালোচনা কিংবা সমালোচনা করার সুযোগ করে দেওয়া। ২) এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে নাগরিক সমাজকে দেশ পরিচালনার দায়িত্বভার সবচেয়ে উপযুক্ত মানুষদের হাতে অর্পণ করার সুযোগ করে দেওয়া হল নির্বাচন প্রক্রিয়ার প্রকৃত উদ্দেশ্য।আমাদের দেশে কী হচ্ছে :
কিন্তু দুর্ভাগ্যের হলেও সত্যি, আমাদের দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল (কিছুটা ব্যতিক্রম বামপন্থীরা) এগুলোকে তাদের রাজনৈতিক এজেন্ডার মধ্যেই আনে না। তাদের এজেন্ডায় থাকে হিংসা, ষড়যন্ত্র, একে অপরের নামে ব্যক্তিগত কুৎসা, ধর্মের নামে বিভাজন, লাগামহীন মিথ্যাচার ইত্যাদি নিম্নমানের ও নিম্নরুচির বিষয়, যা আসলে আধুনিক রাষ্ট্রনীতির ঘোরতর পরিপন্থী। আধুনিক ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ নাগরিক সমাজের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া এবং জনগণকে রাজনৈতিকভাবে শিক্ষিত করে তোলার এই দায়িত্ব রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষ করে দক্ষিণপন্থী দলগুলো, সযত্নে এড়িয়ে চলে। বর্তমানে এদের কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে জনগণকে ধর্মশিক্ষা দেওয়া, যার সঙ্গে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা কিংবা স্বাস্থ্য বিষয়ক মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের কোন সম্পর্কই নেই। মন্দির-মসজিদ তৈরীর মধ্য দিয়ে যে মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ হওয়ার নয়, তা তারা জনগণকে বুঝতে দেন না। তাদের মূল লক্ষ্য, জনগণকে যতটা পারো ধর্মান্ধ করে ফেলো এবং তাদের সেই অন্ধকারে রেখে দেশের সম্পদ লুটেপুটে খাও। আর অভুক্ত জনগণকে ঈশ্বর ও পরকালের লোভ দেখিয়ে তার মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে বাধ্য করো।আমাদের দুর্ভাগ্য, আমরা সাধারণ মানুষ, রাজনৈতিক নেতা ও তাদের পৃষ্ঠপোষক কর্পোরেট শ্রেণি যে ধার্মিকের ছদ্মবেশে আমাদের শাসন ও শোষণের রাস্তা পাকা করে নেওয়ার চেষ্টা করছে - এটাই বুঝতে পারিনা। জানতে পারি না, মানব সভ্যতার আদিকাল থেকে শাসকগোষ্ঠী এটাই করে আসছে। প্রাচীন মিশরের রাজা আখেনাটেন (৩৩০০ বছর আগে) থেকে আজকের মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ মুসলিম শাসকগণ - এটাই করে আসছে। আমরাও আবার নতুন করে সেই রাস্তায় হাঁটার শপথ নিচ্ছি। নিচ্ছি কারণ, এটা বুঝতে গেলে, যে শিক্ষার প্রয়োজন, তা আমাদের নেই। রাজনৈতিক দলগুলোও চায় না, জনগণের মধ্যে এই শিক্ষার প্রসার ঘটুক।
মিডিয়ার ভূমিকা কেমন :
গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ নামে পরিচিত মিডিয়াগুলো সারাদিন অতীত ঐতিহ্যের নাম করে পিছিয়ে পড়া ও প্রাচীন ধ্যান-ধারণাকে জনগণের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। তাদের আলোচনা-পর্যালোচনা বা সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দু হল এগুলোকে নতুন করে প্রতিষ্ঠা করা। ২৪ ঘন্টা জুড়ে যদি মানুষের সামনে নেগেটিভ অ্যাটিটিউট নিয়েই আলোচনা হয়, তাহলে নাগরিক সমাজের মনস্তত্ত্ব থেকে পজেটিভ ও প্রগতিশীল অ্যাটিটিউডগুলো বিলুপ্ত হতে বাধ্য। এভাবে চললে, নতুন প্রজন্মের মধ্যেও দ্রুত এই ধরনের নেতিবাচক ও পিছিয়ে পড়া মনোভাব ছড়িয়ে পড়বে। কারণ, নতুন প্রজন্মের শিক্ষা এবং রাজনৈতিক চেতনা গঠনে মিডিয়ার গভীর প্রভাব থাকে। গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া প্রতিনিয়ত সেই চেষ্টাই করে চলেছে। অধিকাংশ সাধারণ নাগরিকের মধ্যে তাই নেতিবাচক মনোভাব ভয়ংকর ভাবে বাড়ছে।পরিবারের পিতা-মাতা ও শিক্ষক-শিক্ষিকার পর নাগরিক সমাজের নৈতিক চরিত্র গঠনে রাজনৈতিক নেতাদের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব থাকে। রাজনৈতিক নেতারা যদি লাগামহীন দুর্নীতির মধ্যে ডুবে থাকে, অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারকে প্রমোট করে, সাধারণ মানুষও দুর্নীতিকে বৈধ এবং কুসংস্কারকে বিজ্ঞান বলে ভাবতে শুরু করে। নিরপেক্ষ, উন্নত ও আধুনিক প্রগতিশীল সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ মিডিয়াই একমাত্র পারে রাজনৈতিক নেতাদের এই লাগামহীন দুর্নীতি রুখতে ও জনগণকে বিজ্ঞানমনস্ক করে তুলতে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের হলেও সত্যি, মিডিয়াগুলোর অধিকাংশই নিরপেক্ষভাবে এই কাজ করছে না। ধর্মের নামে অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারকে প্রমোট করে যাচ্ছে অবলীলায়। মিডিয়ার কর্পোরেট মালিক সরকারের কাছ থেকে সুবিধা আদায়ের জন্য সরকার পক্ষের দুর্নীতিকে অবলীলায় আড়াল করে, নিম্নমানের এবং পিছিয়ে পড়া রাষ্ট্র দর্শনের স্বপক্ষে আলোচনায় ব্যস্ত থাকছে।
আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষ ও জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রনীতির অনুসারী হওয়া। রাষ্ট্রদর্শনে এই ধর্মনিরপেক্ষতার দুটো মুখ। একটা পুরনো, অন্যটা আধুনিক। পুরনো ধর্মনিরপেক্ষ নীতির বৈশিষ্ট্য হলো, রাষ্ট্র সব ধর্মকে সমান চোখে দেখবে এবং সমানভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করবে। প্রয়োজনে তাকে রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের হাতিয়ার হিসেবেও ব্যবহার করবে। এই রাষ্ট্র দর্শন মূলত মধ্যযুগীয়। আমাদের দেশে আকবর থেকে শিবাজী - অধিকাংশ রাষ্ট্রনেতা এই নীতি অনুসরণ করে রাজ্য শাসন করেছেন। কিন্তু আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষতার বৈশিষ্ট্য হলো, রাষ্ট্র সমস্ত রকম ধর্মীয় অনুষঙ্গ থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখবে। কারণ ধর্ম মানুষের ব্যক্তিগত বিশ্বাসের বিষয়। তা মানুষ ভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়। সরকার একপক্ষকে সমর্থন করলে, অন্য পক্ষ ক্ষুব্ধ হবেন এবং দেশ সংকটে পড়বে।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে জহরলাল নেহরুর রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনায় এ ধরনের নীতির উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু পরবর্তী সময়ের রাজনীতিকরা ধর্মনিরপেক্ষতার এই আদর্শকে কৌশলে এড়িয়ে গিয়ে মধ্যযুগীয় রীতিনীতি অনুসরণ শুরু করে। বর্তমানে, কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন দল আরও একধাপ এগিয়ে শুধুমাত্র সংখ্যাগুরুর ধর্মকে পৃষ্ঠপোষকতা শুরু করেছে। আধুনিক রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থার জন্য এটা ভয়ানক নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। অথচ আমাদের দেশের মিডিয়া এর বিরোধিতা না করে, হিংসা ও বিদ্বেষ ভাষণকে কেন্দ্র করে, প্রাইম টাইমকে ব্যবহার করে, এই অসুস্থ ও পিছিয়ে পড়া চেতনাকেই উৎসাহিত করে চলেছে লাগামহীন ভাবে।
বেশিরভাগ মিডিয়া এবং তাদের উপস্থাপকদের কথা বলার টোন শুনলে এবং বাচনভঙ্গি ও বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দেখলে, যাত্রাপালার হিরো কিংবা সঙদের কথা মনে পড়ে যায়। কখনো পাড়ায় পাড়ায় গুজব ছড়িয়ে বেড়ানো, হল্লা মাচানোর স্বভাব নিয়ে ছোটাছুটি করে বেড়ানো যে সব অকাম্মাক দেখা যায়, কেন জানিনা, (সত্যিই কি জানিনা?) তাদের কথাও মনে পড়ে। শান্ত ও নম্র ভাবে, ভদ্র ও পরিশীলিত শব্দচয়নে এবং বুদ্ধিদীপ্ত বাচনভঙ্গি দিয়ে নিরপেক্ষভাবে একটি মনোজ্ঞ অনুষ্ঠান উপস্থাপন করার বিষয়টি প্রায় বিলুপ্ত হতে বসেছে। কে, কত জোরে চেঁচিয়ে সত্যকে মিথ্যার আর মিথ্যাকে সত্যের সঙ্গে গুলিয়ে দিতে পারে, যেন তারই ট্রায়াল চলে স্টুডিও জুড়ে। আর তারা যাদের বক্তা করে নিয়ে আসে, তারা এতই অসহিষ্ণু যে, আলোচনা করার বিজ্ঞানসম্মত বিধি ও নীতি না মেনে, অশিক্ষিত মানুষের মত ঝগড়ায় নেমে পড়ে। নিরপেক্ষতা শব্দটা তো মিডিয়ার অভিধান থেকে আগেই বিদায় নিয়েছে।
এসবের পরিণতি :
গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ যদি সারাদিন ধরে এইভাবে এ ধরনের কাজই করে চলে এবং রাজনৈতিক দলগুলো যদি সারাদিন ধরে এই হিংসা, ষড়যন্ত্র, কেচ্ছা নিয়ে ব্যস্ত থাকে, তবে সাধারণ মানুষ রাজনীতি বলতে যা বোঝায়, তা তো ভুলে যাবে! দেশে যারা নতুন নাগরিক হিসেবে উঠে আসছে, তাদের কাছে এটাই প্রতিষ্ঠিত হবে যে, রাজনীতি মানেই হচ্ছে হিংসা, ষড়যন্ত্র ও বিদ্বেষ ভাষণ দিয়ে যেনতেনও প্রকারণে ক্ষমতা দখল করার লড়াই। ভাববে, এটাই রাজনীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য এবং ন্যায় সঙ্গত পদ্ধতি। রাজনীতি তাদের কাছে ‘নীতির রাজা’ না হয়ে, ‘রাজার নীতি’ হয়ে দেখা দেবে। ফলে রাষ্ট্র ও সমাজে স্বৈরতান্ত্রিক মানসিকতার প্রসার ঘটবে, যা একমাত্র প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ছিল। দুঃখের হলেও সত্যি, ভারত ইতিমধ্যেই বিশ্বের প্রথম ১০টি স্বৈরতান্ত্রিক দেশের তালিকার অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে।দেশের ভবিষ্যৎ :
সুতরাং এভাবে যদি একটা দেশের নেতারা এবং মিডিয়াগুলো রাজনীতি করে, লিখে নিন, সে-দেশ কখনো আধুনিক জগত সভায় মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। মাথা তুলছি, অনুগত মিডিয়ার মাধ্যমে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে হয় তো বলা যাবে, কিন্তু বাস্তবে মাথা হেঁটই হবে। ইতিমধ্যেই আমরা এমন ঘটনার মুখোমুখি হয়েছি। মিডিয়া দেখাচ্ছে, আমরা পৃথিবীর পঞ্চম অর্থনীতির দেশ হতে চলেছি, আর বৈশ্বিক ক্ষুদার সূচক (২০২৩) দেখাচ্ছে, ১২৫টি দেশের মধ্যে আমরা ১১১ তম স্থান ‘অলংকৃত’ করছি।--------xx--------
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন