সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

আধুনিক মিডিয়া : কর্পোরেট পুঁজির (পুঁজিপতিদের) তোতাপাখি

গোদি মিডিয়া : কর্পোরেট পুঁজির তোতাপাখি

গোদি মিডিয়া : কর্পোরেট পুঁজির তোতাপাখি

পশ্চিমী মিডিয়াকে 'ইসরাইল সরকারের তোতাপাখি' নামে পরিচয় দেওয়া হয় সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী স্বাধীন ও নিরপেক্ষ মিডিয়া হাউজের পক্ষ থেকে। সম্প্রতি একইভাবে ভারতীয় কর্পোরেট মিডিয়া ভারত সরকার তথা 'কর্পোরেট পুঁজির তোতাপাখি' হিসাবে পরিচয় পাচ্ছে, যাকে নিন্দুকেরা 'গোদী মিডিয়া' নামে অভিহিত করে থাকে।

মধ্যপ্রাচ্যের ঘটনা সম্পর্কে ইসরাইল যা বলে, ইউরোপ ও আমেরিকার মিডিয়া, তোতা পাখির মতো তা-ই প্রচার করে। সাংবাদিকতার প্রধান প্রধান শর্তগুলোকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ইসরাইলের দেওয়া তথ্যই তারা প্রচার করে অন্ধ ও নির্লজ্জভাবে। ভারতের ক্ষেত্রেও করপোরেট মিডিয়া বর্তমানে সেটাই করছে বলে অভিযোগ। অভিযোগ, নত মস্তকে ভারত সরকারের দেওয়া তথ্য বিনা বিচারে প্রচার করে চলেছে অধিকাংশ মিডিয়া হাউজ।  অর্থাৎ তাদের সম্প্রচারিত খবরের বড় অংশই হয় নিয়ন্ত্রিত অথবা কখনও কখনও অসত্য - এমন দাবিও করা হয়। 

আসলে সিংহভাগ মিডিয়ার মালিক হচ্ছেন এক-একজন  করপোরেট পুঁজির মালিক বা পুঁজিপতি। এরা কি কখনও নিজের স্বার্থের বিরুদ্ধে যায় - এমন খবর, তথ্য বা তত্ত্ব প্রচার করবে? করবে না, করেও না। আর এটাই স্বাভাবিক। চমস্কি এজন্যই বলেছিলেন, 'মিডিয়া যেমন আমাদের তথ্য, আনন্দ আর বিনোদন দেয়, তেমনি সে আমাদের মধ্যে কিছু বিশ্বাস, মূল্যবোধ এবং আচরণ প্রোথিত করে দেয়, যা আমাদেরকে সমাজের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর সমগ্রতার মধ্যে স্থিত রাখবে।' মনে রাখতে হবে, এই বিশ্বাস, মূল্যবোধ ও আচরণগুলোর কাজ হল পুঁজিপতিদের জন্য সহায়ক একটা উর্বর চারণক্ষেত্র গড়ে তোলা। এজন্য মিডিয়াকে বলা হয় একটি 'চেতনা নির্মাণ শিল্প' (consciousness industry), যার কাজ হচ্ছে,  ওয়াল্টার লিপম্যান-এর কথায়, জনগণের 'সম্মতি উৎপাদন' (manufacture of consent) করা।

অর্থাৎ পুঁজিবাদী কর্পোরেট মিডিয়ার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হল, আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে পুঁজির সার্থে পুঁজিবাদী সরকার যা করবে, তার মধ্যে যেন সাধারণ গরীব ও মধ্যবিত্ত নিজেদের মঙ্গল দেখতে পায় - সেটা নিশ্চিত করা। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা হয় না, সরকারি স্কুলে পড়াশোনা হয় না - এই মর্মে খবর সংগ্রহ ও প্রচারে কর্পোরেট মিডিয়া সদাব্যস্ত। কেন? না, সরকার পরিচালিত প্রতিষ্ঠানের চিকিৎসক বা শিক্ষকরা ফাঁকিবাজ - এটা দেখানো এবং এই সিদ্ধান্ত নিতে উৎসাহিত করা যে, সুতরাং সরকারি পরিষেবা তুলে দেওয়াই উচিৎ। আমাদের দুর্ভাগ্য, এই ভাবনা মানুষের মধ্যে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। কে ছড়াচ্ছে? মিডিয়া। উদ্দেশ্য, সরকারি পরিষেবার বিরুদ্ধে, লিপম্যান-এর কথায়, জনগণের সম্মতি আদায় (manufacture of consent) করা।

সরকারি পরিষেবায় খুঁত  ধরার জন্য এরা শকুনের দৃষ্টি নিয়ে উড়ে বেড়ায়। অথচ বেসরকারি সেক্টরের বেলায় এরা অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র সেজে বসে থাকে। এতে কার লাভ? পুঁজি বিনিয়োগকারীর অর্থাৎ পুঁজিপতিদের। সরকারি পরিষেবা উঠে গেলেই সেখানে নিশ্চিন্তে ঝুঁকিহীন পুঁজি বিনিয়োগ করা যাবে। কার ক্ষতি? সাধারণ গরীব ও মধ্যবিত্তের। কেন? সরকারি স্কুল ও হাসপাতাল উঠে গেলে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য পরিষেবা দুর্মূল্য হয়ে উঠবে। আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে গরীব ও মধ্যবিত্ত তা থেকে বঞ্চিত হবে। ফলে অভাবী ও শিক্ষাদীক্ষাহীন মানুষের শ্রম কমদামে কেনা যাবে। পুঁজিপতির পুঁজির পাহাড় মসৃণ গতিতে বাড়ানো সম্ভব হবে। 

তাই পুঁজিবাদী শাসক শ্রেণি মিডিয়াকে নানাভাবে ব্যবহার ও নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। সে কখনও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে, আবার কখনও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে নিজেদের অনুগত মিডিয়া তৈরি করে, যাতে ভিন্নমতকে অনুপুস্থিত রাখা যায় বা পুঁজির নিরাপত্তার স্বার্থে যতটুকু না রাখলেই নয়, ততটুকু রাখা যায়। বিশেষ বয়ানকে প্রতিষ্ঠা, উৎপাদন ও পুনরুৎপাদনে এই ধরণের মিডিয়ার জুড়ি মেলা ভার। এইজন্যই, লুইস আলথুসার তাঁর 'Ideology and Ideological State Apparatuses' গ্রন্থে মিডিয়াকে আইডিওলজিকাল স্টেট এপারেটাস বা মতদর্শ তৈরির কারখানা বলেছেন।

আমরা, দেশের অধিকাংশ খেটে খাওয়া মানুষ, এই সব সত্য জানি না। এও জানি না যে, সাধারণ মানুষের স্বার্থের সঙ্গে কর্পোরেটদের স্বার্থ পরস্পর বিপরীত মেরুতে অবস্থিত। এরা একে অপরের পরিপূরক নয়। যদিও পরিপূরক হিসেবেই ওরা দেখাতে চায়। প্রচারও সেভাবেই করে। কিন্তু আসল সত্য হল,  কর্পোরেটরা চায় সমাজে আর্থিক বৈষম্য থাক। কারণ, বৈষম্য জন্ম দেয় অভাব। আর আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, অভাব থাকলেই অভাবীকে কম মজুরিতে খাটানো যায় এবং তার ফলেই পুঁজির পাহাড় জমানো সহজ হয়। সুতরাং যেকোন মূল্যে বৈষম্য টিকিয়ে রাখাই তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য। পুঁজিপতিদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত সরকার সেটাই করে। চোখে ধুলো দেওয়ার জন্য ছিটেফোঁটা দান-খয়রাতও করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য। অথচ, দান-খয়রাত যে কখনও অভাব মুক্তির প্রকৃত পন্থা হতে পারে না - এবিষয়ে অর্থনীতিবিদদের মধ্যে কোন দ্বিমত নেই। তাদের মতে, এক্ষেত্রে জরুরী হল, সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় কর্মসংস্থানের নিশ্চিত গ্যারান্টি তৈরি করা। বিস্ময়ের বিষয় হল, পুঁজিবাদী সরকার জেনে বুঝেই তা করে না, বা কর্পোরেট পুঁজির কর্ণধাররা তা করতে দেয় না। কর্পোরেট পুঁজি এভাবে সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে তার কারণ সরকারে থাকা পুঁজিবাদী দল এদের কাছ থেকেই নির্বাচনী খরচের টাকা পেয়ে থাকে। অর্থাৎ পুঁজিবাদী দলগুলোর, শহরের ট্রাম রুটের ট্রামের মত, টিকি বাঁধা (থাকে কর্পোরেটদের) তারে। 

আর এই সত্যটি ভুলিয়ে ও গুলিয়ে দেওয়াই করপোরেট মিডিয়ার অন্যতম প্রধান কাজ। একাজ তারা নিষ্ঠার সঙ্গে করে। সাধারণ মানুষ শিক্ষার অভাবে জানতে পারে না মিডিয়া এটা কীভাবে করে। জগত ও জীবনের চালিকাশক্তির আসল রহস্য তাদের কাছে, প্রকৃত শিক্ষার অভাবে, অধরাই থেকে যায় । 

এই কর্পোরেট পুঁজির মালিকরা কিছু অসৎ ধর্মগুরুদের সহায়তা নিতেও পিছপা হয় না। এদের সহায়তা নিয়ে লাগাতার প্রচার করে যায়, তোমার ভাগ্যের একমাত্র নিয়ন্ত্রক হচ্ছেন ঈশ্বর। তিনি না চাইলে তোমার ভাগ্যের পরিবর্তন হবে না। সুতরাং সব কিছু ভুলে অন্ধভাবে ধর্মীয় বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরো। টিভির খবরে, সিরিয়ালে, অথবা সিনেমা, ধর্ম সম্মেলন ইত্যাদির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করে সেটাই প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে যাচ্ছে তারা প্রতিদিন। প্রকৃত অর্থে অন্ধবিশ্বাসকেই কর্পোরেট মিডিয়া ধর্মবিশ্বাসে রূপান্তরিত করে দিচ্ছে। অথচ, কোন ধর্মেই কর্মের গুরুত্বকে খাটো করে দেখানো হয় নি। বরং বেশি বলেই দেখানো হয়েছে।

এই কর্পোরেট পুঁজির মালিকরা কিছু অসৎ ধর্মগুরুদের সহায়তা নিতেও পিছপা হয় না। এদের সহায়তা নিয়ে লাগাতার প্রচার করে যায়, তোমার ভাগ্যের একমাত্র নিয়ন্ত্রক হচ্ছেন ঈশ্বর। তিনি না চাইলে তোমার ভাগ্যের পরিবর্তন হবে না। সুতরাং সব কিছু ভুলে অন্ধভাবে ধর্মীয় বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরো। টিভির খবরে, সিরিয়ালে, অথবা সিনেমা, ধর্ম সম্মেলন ইত্যাদির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করে সেটাই প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে যাচ্ছে তারা প্রতিদিন। প্রকৃত অর্থে অন্ধবিশ্বাসকেই কর্পোরেট মিডিয়া ধর্মবিশ্বাসে রূপান্তরিত করে দিচ্ছে। অথচ, কোন ধর্মেই কর্মের গুরুত্বকে খাটো করে দেখানো হয় নি। বরং বেশি বলেই দেখানো হয়েছে।

ধর্মগুরুদেরকেও পুঁজির মালিকরা কখনও কখনও প্রত্যক্ষ ভাবে, আবার কখনও পরোক্ষভাবে কাজে লাগায় ধর্ম প্রচারের কিম্বা নিজেদের সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতার নাম করে। এক্ষেত্রে ধর্মগুরুরা সুকৌশলে ধর্মের সাথে যুক্ত করে দেয় ধর্মান্ধতা। সাধারণ মানুষ ধর্ম মানতে গিয়ে নিজের অজান্তেই ঢুকে পড়ে সেই ধর্মান্ধতার গভীর খাদে, যেখান থেকে বেরিয়ে আসা অশিক্ষার অন্ধকারে থাকা মানুষদের পক্ষে আর সম্ভব হয় না।

প্রকৃত শিক্ষার আলো চিন্তা ও চেতনার গভীরে না পড়লে এটা বোঝা যায় না। বোঝা যায় না, এই মিডিয়া কীভাবে ধর্মের সুড়সুড়ি দিয়ে জনগনকে বোকা বানিয়ে দেশের সম্পদকে নিজেদের কুক্ষিগত করছে, যা আসলে আপামর জনগণের সম্পদ।  বোঝা যায় না, সরকার এবং তাদের বিভিন্ন অনুসারী ধর্মীয় সংগঠন কীভাবে হিন্দু ধর্মের সুড়সুড়ি দিয়ে বিভিন্ন ইস্যু তৈরি করছে আর করপোরেট মিডিয়া সেগুলো নিয়ে মাতামাতি করে জনগনকে মাতিয়ে রাখছে। এবং এও বোঝা যায় না, সেই ফাঁকে অনুগত শাসকদলকে দিয়ে কীভাবে একের পর এক জনগনের সম্পত্তি (যা সরকারি সম্পত্তি নামে পরিচিত) পুঁজির মালিকদের হাতে প্রায় বিনামূল্যে তুলে দিচ্ছে।

আমরা, ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনায় যাদের বলা হয়েছে : We, the people of India এবং যেখানে আমরা ভারতকে একটি সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তোলার অঙ্গীকার করেছি, তারাই ধর্ম ও সংস্কৃতির সঙ্গে গণতন্ত্রের ককলেট বানিয়ে ধর্মান্ধতার ঝোলে মেখে তাকে তারিয়ে তারিয়ে খাচ্ছি; আর সুকুমার রায়ের 'পাজি পিটার' গল্পের পিটারের সেই বিখ্যাত মিথ্যা-ভাষণকে লোভী সওদাগারের মত সত্যি বলে ভাবছি। ভাবছি আর খালি পেটে নেচে নেচে গাইছি, 'ধিন তাধিনা তাধেই ধেই / স্বর্গে যাওয়ার রাস্তা এই'। নাচতে নাচতে ভোট দিয়ে আসছি পুঁজির মালিকদের রাজনৈতিক এজেন্টকে। দিনান্তে অদৃশ্য ঈশ্বরকে সামনে রেখে ভাগ্য ফেরানোর মন্ত্র জপ করছি জীবনভর - প্রতিদিন, প্রতিক্ষণ। ভুলে যাচ্ছি, বর্তমানে দেশের এই বিশাল সংখ্যক গরীব ও মধ্যবিত্ত মানুষকে বোকা বানানোর বিশাল কর্মকাণ্ডের প্রধান কারিগরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে কর্পোরেট পুঁজির তোতাপাখি অর্থাৎ তথাকথিত 'আধুনিক ভারতীয় মিডিয়া হাউজ', যার পরিচয় হওয়ার কথা ছিল গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ নামে একটি স্বাধীন ও সত্যিকার প্রহরী হিসাবে। একবিংশ শতাব্দীতে এসেও জনগণের মধ্যে এই হাস্যকর ‘জীবন সংগ্রামে'র দৃশ্য দেখে লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে আসে।
----------xx--------

📰 নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছে দিনদর্পণ দৈনিকের উত্তর সম্পাদকীয় বিভাগে। 
🅳 প্রকাশের তারিখ : ০৮/০৫/২০২৩ 

মন্তব্যসমূহ

📂 আলী হোসেনের জনপ্রিয় প্রবন্ধগুলি

হিন্দু কারা? তারা কীভাবে হিন্দু হল?

হিন্দু কারা? কীভাবে তারা হিন্দু হল? যদি কেউ প্রশ্ন করেন, অমিত শাহ হিন্দু হলেন কবে থেকে? অবাক হবেন তাই তো? কিন্তু আমি হবো না। কারণ, তাঁর পদবী বলে দিচ্ছে উনি এদেশীয়ই নন, ইরানি বংশোদ্ভুত। কারণ, ইতিহাস বলছে পারস্যের রাজারা ‘শাহ’ উপাধি গ্রহণ করতেন। এবং ‘শাহ’ শব্দটি পার্শি বা ফার্সি। লালকৃষ্ণ আদবানির নামও শুনেছেন আপনি। মজার কথা হল আদবানি শব্দটিও এদেশীয় নয়। আরবি শব্দ ‘আদবান’ থেকে উদ্ভূত। সুতরাং তাঁর পদবীও বলছে, তিনিও এদেশীয় নন। ভাষাতত্ত্ব ও নৃতত্ত্বের বিশ্লেষণ বলছে, উচ্চবর্ণের বিশেষ করে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের মানুষদের, উৎসভূমি হল পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চল। তারও আগে ছিল ইউরোপের ককেশাস অঞ্চলে। আসলে এরা (উচ্চবর্ণের মানুষ) কেউই এদেশীয় নয়। তারা নিজেদের আর্য বলে পরিচয় দিতেন এবং এই পরিচয়ে তারা গর্ববোধ করতেন। সিন্ধু সভ্যতা পরবর্তীকালে তারা পারস্যের বিভিন্ন এলাকা থেকে হিন্দুকুশ পর্বতের গিরিপথ ধরে এদেশে অভিবাসিত হয়েছেন। আর মধ্যযুগে এসে এদেরই উত্তরসূরী ইরানিরা (অমিত শাহের পূর্বপুরুষ) অর্থাৎ পারস্যের কিছু পর্যটক-ঐতিহাসিক, এদেশের আদিম অধিবাসীদের ’হিন্দু’ বলে অভিহিত করেছেন তাদের বিভিন্ন ভ্রমণ বৃত্তান্তে।

রবীন্দ্রনাথের ধর্মভাবনা ও তার বিবর্তন

রবীন্দ্রনাথের ধর্মভাবনা ও তার বিবর্তন আলী হোসেন  যদি প্রশ্ন করা হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ধর্ম কী? মনে হয় অনেকেই ঘাবড়ে যাবেন। কেউ বলবেন, তাঁর বাবা যখন ব্রাহ্ম ছিলেন তাহলে তিনি নিশ্চয়ই ব্রাহ্ম। যারা লেখাপড়া জানেন না, তারা বলবেন, কেন! উনি তো হিন্দু ছিলেন। আবার কেউ কেউ তথ্য সহযোগে এও বলার চেষ্টা করবেন যে, উনি নাস্তিক ছিলেন; না হলে কেউ বলতে পারেন, ধর্মমোহের চেয়ে নাস্তিকতা অনেক ভালো? ¹ রবীন্দ্রনাথের ধর্ম ভাবনার বিবর্তন  তাহলে সঠিক উত্তরটা কী? আসলে এর কোনোটাই সঠিক উত্তর নয়। চিন্তাশীল মানুষ-মাত্রই সারা জীবন ধরে ভাবেন, ভাবতে ভাবতে তাঁর উপলব্ধি বাড়তে থাকে ক্রমশঃ প্রগতির পথে। জগৎ ও জীবন থেকে তথ্য সংগ্রহ করে একে একে গড়ে তোলেন নিত্যনতুন জীবনদর্শন। তাই এ ধরনের মানুষ আজীবন এক এবং অখণ্ড জীবনদর্শনের বার্তা বহন করেন না। সময়ের সাথে সাথে পাল্টে যায় তাঁর পথচলার গতিমুখ। মানুষ রবীন্দ্রনাথও তাই পাল্টে ফেলেছেন তাঁর জীবন ও ধর্মদর্শন সময়ের বয়ে যাওয়াকে অনুসরণ করে। রবীন্দ্রনাথ ও  হিন্দু জাতীয়তাবাদ ১৮৬১ সালের ৭ই মে সোমবার রাত্রি ২টা ৩৮ মিনিট ৩৭ সেকেন্ডে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে জন্ম গ্রহণ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এর

সীমান্ত আখ্যান, বাঙালির আত্মানুসন্ধানের ডিজিটাল আখ্যান

সময়ের সঙ্গে সমস্যার চরিত্র বদলায়। কিন্তু মুলটা বদলায় না। যদি সে সমস্যা ইচ্ছা করে তৈরি হয়ে থাকে বিশেষ সুবিধা ভোগেই লোভে, তবে তো অন্য কথা চলেই না। স্বনামধন্য স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাতা সৌমিত্র দস্তিদারের ডকুমেন্টারি ফিল্প 'সীমান্ত আখ্যান' দেখার পর এই উপলব্ধি মাথা জুড়ে ঘুরপাক খাচ্ছে। দেখলাম, দেশ ভাগ হয়েছে। কিন্তু সমস্যার অবসান হয়নি। শুধু সমস্যার চরিত্রটা পাল্টেছে। এই যে সমস্যা রয়ে গেল, কোন গেল? তার উত্তর ও পাওয়া গেল 'সীমান্ত আখ্যান' এ। আসলে দেশ ভাগ তো দেশের জনগণ চাননি, চেয়েছেন দেশের নেতারা। চেয়েছেন তাঁদের ব্যক্তিগত, সম্প্রদায়গত সুবিধাকে নিজেদের কুক্ষিগত করার নেশায়। আর এই নেশার রসদ যোগান দিতে পারার নিশ্চয়তা নির্ভর করে রাজনৈতিক ক্ষমতার লাগাম নিজের হাতে থাকার ওপর। তাই রাজনীতিকরা এই ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য জনগণকে 'ডিভাইড এন্ড রুল' পলিছি দ্বারা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চেষ্টা করেছেন এবং করে চলেছেন। এ সমস্যা নতুন না, ব্রিটিশ সরকার এর বীজ রোপণ করে গেছেন, এখন কেউ তার সুফল ভোগ করছে (রাজনীতিকরা) আর কেউ কুফল (জনগন)। 'সীমান্ত আখ্যান চোখে আঙুল দিয়ে দে

ভাগ্য : মুসলিম মনস্তত্ত্ব, ধর্মদর্শন ও প্রগতি

ভাগ্য : মুসলিম মনস্তত্ত্ব, ধর্মদর্শন ও প্রগতি - লিখছেন আলী হোসেন  কপালের লেখন খণ্ডায় কার সাধ্য? জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে কিংবা লেখাপড়া জানা-নাজানা নির্বিশেষে সমস্ত মানুষের সিংহভাগই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এই কথাটা মেনে নেয়। জীবনের উত্থান-পতনের ইতিহাসে কপালের লেখনকে জায়গা করে দিতে তারা কুণ্ঠাবোধ করে না। বরং বলা ভালো এব্যাপারে তারা অতিমাত্রায় উদার। মানুষের মনস্তত্বের এ-এক জটিল স্তর বিন্যাস। একই মানুষ বিভিন্ন সময়ে একই বিষয়ের বিচার বিশ্লেষণে ভিন্নভিন্ন দৃষ্টিকোণ ব্যবহার করে। এ রকমই একটি দৃষ্টিকোণ হলো কপাল বা ভাগ্যের ভূমিকাকে সাফল্যের চাবিকাঠি বলে ভাবা। কখনও সে ভাগ্যের নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠার চেষ্টা করে, আবার কখনও নিজেই ভাগ্যের কাছে নির্দিধায় আত্ম সমর্পন করে। নিজের ব্যার্থতার পিছনে ভাগ্যের অদৃশ্য হাতের কারসাজির কল্পনা করে নিজের ব্যার্থতাকে ঢাকা দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে থাকে। মজার কথা, এক্ষেত্রে মুসলিম মানসের মনস্তত্ত্ব কখনও চেতনমনে আবার কখনও অবচেতন মনে উপরওয়ালাকে (আল্লাহকে) কাঠ গড়ায় তোলে বিনা দ্বিধায়। নির্দিধায় বলে দেয়, উপরওয়ালা রাজি না থাকলে কিছুই করার থাকেনা। সাফল্য কিংবা ব্যর্থতা সবই তাঁর (আল্লার

কাশ্মীর ফাইলস : প্রপাগান্ডার এক নয়া ব্রান্ড, কর্পোরেট পুঁজি ও রাজনৈতিক দলের গলাগলির এক সুচারু প্রদর্শনী

কাশ্মীর ফাইলস : প্রপাগান্ডার এক নয়া ব্রান্ড, কর্পোরেট পুঁজি ও রাজনৈতিক দলের গলাগলির এক সুচারু প্রদর্শনী রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয় উলুখাগড়ার প্রাণ যায়। ১৯৪৭ সালের পর থেকে জম্মু ও কাশ্মিরের জনগণের ভাগ্যলিপিতে লেখা হয়ে গেছে এই বিখ্যাত প্রবাদটির বিস্তারিত সারাৎসার। একদিকে পাকিস্তান আর অন্যদিকে ভারত – এই দুই প্রতিবেশি দেশের ভুরাজনৈতিক স্বার্থের যাঁতাকলে পড়ে তাদের এই হাল। কিন্তু কেন এমন হল? এই প্রশ্নের উত্তর জানে না এমন মানুষ ভুভারতে হয়তো বা নেই। কিন্তু সেই জানার মধ্যে রয়েছে বিরাট ধরণের ফাঁক। সেই ফাঁক গলেই ঢুকেছে কাশ্মির ফাইলসের মত বিজেপির রাজনৈতিক ন্যারেটিভ যা তারা বহুকাল ধরে করে চলেছে অন্য আঙ্গিকে। এবার নতুন মাধ্যমে এবং নবরূপে তার আগমন ঘটেছে, যায় নাম সিনেমা বা সেলুলয়েড প্রদর্শনী। যদিও ডিজিটাল মাধ্যমে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সৌজন্যে অনেক আগেই সফলভাবে তারা এই ন্যারেটিভ দিয়ে বিভাজনের রাজনীতি করে চলেছে বেশ কয়েক বছর ধরে। টেলিভিশন সম্প্রচারে কর্পোরেট পুজির অনুপ্রবেশের মাধ্যমে যার সূচনা হয়েছিল। রাষ্ট্রশক্তিকে কুক্ষিগত করতে না পারলে দেশের সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রন আনা সম্ভব নয়, একথা সাধারণ নিরক্ষর নাগরিক এবং ত

শিক্ষা কী, কেন প্রয়োজন এবং কীভাবে অর্জন করা যায়?

শিক্ষা কী, কেন এবং কীভাবে অর্জন করতে হয়? সূচিপত্র : What is education, why it is needed and how to achieve it শিক্ষা কী শিক্ষা হল এক ধরনের অর্জন, যা নিজের ইচ্ছা শক্তির সাহায্যে নিজে নিজেই নিজের মধ্যে জমা করতে হয়। প্রকৃতি থেকেই সেই অর্জন আমাদের চেতনায় আসে। সেই চেতনাই আমাদের জানিয়ে দেয়, জগৎ ও জীবন পরিচালিত হয় প্রকৃতির কিছু অলংঘনীয় নিয়ম-নীতির দ্বারা। গভীর পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ শক্তিকে বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে কাজে লাগালেই এই নিয়মনীতিগুলো আমাদের আয়ত্বে আসে। এই নিয়ম-নীতিগুলো জানা এবং সেই জানার ওপর ভিত্তি করেই জগৎ ও জীবনকে সর্বোত্তম পর্যায়ে পৌঁছে দেয়ার পথ খুঁজে বের করার শক্তি অর্জনই শিক্ষা। মনে রাখতে হবে, এই শিক্ষা কখনও কারও মধ্যে জোর করে ঢুকিয়ে দেওয়া যায় না। এখন প্রশ্ন হল, শিক্ষা অর্জনের বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিটা আসলে কী। সেই আলোচনায় যাওয়ার আগে জানতে হবে, এই শিক্ষার সূচনা হয় কখন এবং কীভাবে? শিক্ষার সূচনা কখন হয় : এই অর্জনের সূচনা হয় মাতৃগর্ভে এবং তা প্রাকৃতিক ভাবেই। প্রকৃতির দেওয়া কিছু সহজাত শিক্ষাকে অবলম্বন করেই তার সূচনা। এই সহজাত শিক্ষাকে অবলম্বন করেই মানুষ তার পরবর্তী প

জল, না পানি : জল নিয়ে জলঘোলা করা পানির মত সহজ নয়

জল নিয়ে জলঘোলা করা পানির মত সহজ নয় আলী হোসেন  সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত সরকারি অনুষ্ঠানে চিত্র শিল্পী শুভাপ্রসন্ন ভট্টাচার্য পানি শব্দকে বাংলা নয় বলে দাবি করেছেন। বলেছেন, "আমরা কোনোদিন কখনও বাংলা ভাষায় পানি (শব্দটা) ব্যবহার করি না"। শুধু তা-ই নয়, পানি শব্দের ব্যবহারের মধ্যে তিনি 'সাম্প্রদায়িকতার ছাপ'ও দেখতে পেয়েছেন। প্রশ্ন হল - এক, এই ভাবনা কতটা বাংলা ভাষার পক্ষে স্বাস্থ্যকর এবং কতটা 'বাংলা ভাষার ইতিহাস' সম্মত? দুই, জল বা পানি নিয়ে যারা জলঘোলা করছেন তারা কি বাংলাকে ভালোবেসে করছেন? মনে হয় না। কারণ, খোঁজ নিলে দেখা যাবে, এরা কেউ নিজের সন্তানকে বাংলা মিডিয়াম স্কুলে পড়াননি বা পড়ান না। ব্যবহারিক জীবনেও তারা বাংলার ভাষার চেয়ে ইংরেজি বা হিন্দিতে কথা বলতে বা গান শুনতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন, বলা ভালো গর্ববোধ করেন। প্রসংগত মনে রাখা দরকার, বাংলা মিডিয়াম স্কুলগুলোতে যারা ভর্তি হয়, তারা অধিকাংশই গরীব ঘরের সন্তান। বলা ভালো, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে তারাই বাংলা ভাষাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। কারণ, সন্তানকে বাংলা মিডিয়ামে পড়ানোর পাশাপাশি, বা

নিম্নবর্গের মানুষ মার খাচ্ছে কেন

নিম্নবর্গের মানুষ কীভাবে পিছিয়ে পড়েছেন? সমাধান কীভাবে? এদেশের নিম্নবর্গের মানুষ নিজেদের বাঁচাতে যুগ যুগ ধরে ধর্ম পরিবর্তন করেছে। কখনও বৌদ্ধ (প্রাচীন যুগ), কখনও মুসলমান (মধুযুগ), কিম্বা কখনো খ্রিস্টান (আধুনিক যুগ) হয়েছে। কিন্তু কখনই নিজেদের চিন্তা-চেতনাকে পাল্টানোর কথা ভাবেনি। পরিবর্তন হচ্ছে অলংঘনীয় প্রাকৃতিক নিয়ম। যারা এই নিয়ম মেনে সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে পারে, তারাই লাভবান হয়, টিকে থাকে। “পাল্টে গেলেই জীবন বাড়ে না পাল্টালে নয়, জীবন মানেই এগিয়ে যাওয়া নইলে মৃত্যু হয়” জীবনের এই চরম সত্য তারা অধিকাংশই উপলব্ধি করতে পারেনি। পৃথিবীর যেকোন উন্নত জাতির দিকে তাকান, তারা দ্রুততার সঙ্গে এই পরিবর্তনকে মেনে নিজেদেরকে পুনর্গঠন করে নিয়েছে। যারা পারেনি বা নেয়নি তারাই মার খাচ্ছে, অতীতেও খেয়েছে। বুদ্ধিমান জাতি নিজের দুর্বলতাকে মেনে নেয় এবং ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য সময়ের সঙ্গে তাল রেখে নিজেদের চিন্তা এবং চেতনায় পরিবর্তন আনে। খ্রিষ্টান, ইহুদি-সহ এশিয়া, ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন জাতি - যারাই এই পরিবর্তন মেনে নিয়েছে তারাই আরও উন্নত এবং শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। মহানবীর (সঃ) গৌরবময় উত্থান (যা এক ধরণ

সংখ্যালঘুর মুখই গণতন্ত্রের আয়না

  সংখ্যালঘুর মুখই গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় এবং শক্তিশালী আয়না। The face of the minority is the mirror of democracy কোন দেশ কতটা গণতান্ত্রিক, তা বোঝা যায় সে দেশের সংখ্যালঘু মানুষের জীবন ও সম্পত্তির সুরক্ষা কতটা মজবুত, তা থেকে। কারণ, সংখ্যালঘুর মুখই হচ্ছে গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় এবং শক্তিশালী আয়না। সংখ্যালঘুরা সঙ্গত কারণেই সংখ্যাগরিষ্ঠদের চেয়ে বেশি বঞ্চনাজনিত মনস্তাত্ত্বিক চাপে থাকে। এই চাপ দু’ভাবে তৈরি হয়। ১) সংখ্যাগিষ্ঠতাজনিত সুবিধা যা সংখ্যাগুরুরা পায়, সংখ্যালঘুরা কখনই তা পায় না বা পাবে না - এই ধারণা, যার কিছুটা হলেও ভিত্তি রয়েছে ২) সংখ্যাগরিষ্ঠদের মধ্যে বৃহত্তম (?) জনগোষ্ঠীর অংশ হওয়ার সুবাদে যে কর্তৃত্ববাদী মানসিকতা তৈরি হয় এবং যা বহুজনের মধ্যে দৃষ্টিকটুভাবে প্রকাশ হয়ে পড়ে, তার ভয়ে। এই চাপ কতটা গভীর তা সংখ্যালঘু ছাড়া বোঝা খুব মুশকিল। তবে আলোকপ্রাপ্ত মানুষ মাত্রই যে তা উপলব্ধি করতে পারেন, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। এই ধরণের চাপ তৈরি করে কিছু অসাধু মানুষ যখন সংখ্যালঘুদের জীবন ও সম্পত্তির সামনে হুমকি হয়ে দাঁড়ায়, তখন তা কমানোর ক্ষমতা একমাত্র গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রশক্তির হাতেই থাকে