প্রায় অর্ধ শতাব্দী ধরিয়া আমি অধ্যাপনার কাজ করিয়া আসিতেছি এবং সে উপলক্ষ্যে কত হাজার হাজার ছাত্রকে বুঝাইয়া দিয়াছি যে, সূর্য এবং চন্দ্রগ্রহণ রাহু নামক কোনাে রাক্ষসের ক্ষুধা নিবারণের চেষ্টায় সংঘটিত হয় না এবং শেষে মর্তবাসীদের কাসর, ঘণ্টা, ঝাঝর এবং খােল-করতালের সহযােগে পূজা-অর্চনায় রাক্ষসাধিপতি রাহু তৃপ্ত এবং তুষ্ট হইয়া চন্দ্র-সূর্যকে ছাড়িয়া দেওয়ার ফলেই তাহার মুক্তি সংঘটিত হয় না। এই যে জনশ্রুতি—ইহা নিছক মিথ্যা এবং কল্পনাপ্রসূত।। ৫১৯. (পৃথিবী চন্দ্র এবং সূর্য আপন কক্ষপথে নিয়ত ঘুরিতেছে। এইরূপ ভ্রাম্যমাণ অবস্থায় পৃথিবীর ছায়া চন্দ্রের উপর অথবা চন্দ্রের ছায়া পৃথিবীর উপর পড়িলেই চন্দ্রগ্রহণ অথবা সূর্যের অংশবিশেষ ছায়ায় ঢাকা পড়ে এবং তাহাই গ্রহণ রূপে পৃথিবীতে দেখ যায়। ইহাই চন্দ্র এবং সূর্যগ্রহণের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা ইহার মধ্যে রাহুর আক্রমণ এবং তাহার মুখগহ্বর হইতে চন্দ্র-সূর্যের নিষ্কৃতি ওমুক্তির যে মিথ্য এবং কাল্পনিক কাহিনি রচিত হইয়াছে তাহাবুটা।
[আজ পূর্ণগ্রাস চন্দ্রগ্রহণ। শিক্ষিত মানুষদের উদ্দেশ্যে বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় মহাশয়ের মূল্যবান লেখাটি রইলো। এত বছর পর আজও প্রাসঙ্গিক। সমাজ আজও প্রায় একই জায়গায় আছে। পরিবর্তন তেমন কিছুই ঘটেনি। বিজ্ঞানের উন্নতি হয়েছে ঠিকই তবে মানুষের মানসিক বিকাশ সময়ের সাথে সাথে এগোয়নি। অন্ধত্বে আজও ডুবে আছে সমাজ। ]
সত্য ও অসত্য
----আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়
প্রায় অর্ধ-শতাব্দী ধরিয়া আমি অধ্যাপনার কাজ করিয়া আসিতেছি এবং সেই উপলক্ষে কত হাজার হাজার ছাত্রকে বুঝাইয়া দিয়াছি যে, সূর্য -এবং চন্দ্র গ্রহণ রাহুনামক কোনো রাক্ষসের ক্ষুধা নিবারণের চেষ্টায় সংঘটিত হয় না, এবং শেষে মর্ত্যবাসীদের কাঁসর, ঘন্টা, ঝাঁঝর এবং খোল - করতালের সহযোগে পূজা- অর্চনায় রাক্ষসাধিপতি রাহু তৃপ্ত এবং তুষ্ট হইয়া চন্দ্র - সূর্যকে ছাড়িয়া দেওয়ার ফলেই তাহার মুক্তি সংঘটিত হয় না। এই যে জনশ্রুতি - ইহা নিছক মিথ্যা এবং কল্পনাপ্রসূত।
পৃথিবী, চন্দ্র, এবং সূর্য আপন কক্ষপথে নিয়ত ঘুরিতেছে। এইরূপ ভ্রাম্যমাণ অবস্হায় পৃথিবীর ছায়া চন্দ্রের উপর অথবা চন্দ্রের ছায়া পৃথিবীর উপর পড়িলেই চন্দ্র অথবা সূর্যের অংশবিশেষ ছায়ায় ঢাকা পড়ে এবং তাহাই গ্রহণরূপে পৃথিবীতে দেখা যায়। ইহাই চন্দ্র এবং সূর্য-গ্রহণের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা। ইহার মধ্যে রাহুর আক্রমণ এবং তাহার মুখগহ্বর হইতে চন্দ্রসূর্যের নিষ্কৃতি ও মুক্তির যে মিথ্যা এবং কাল্পনিক কাহিনী রচিত হইয়াছে তাহা ঝুটা।
প্রায় অর্ধ-শতাব্দী ধরিয়া ছাত্রদিগকে এই বৈজ্ঞানিক সত্যের ব্যাখ্যা করিয়া বুঝাইয়া আসিলাম। তাহারাও বেশ বুঝিল এবং মানিয়া লইল, কিন্তু গ্রহণের দিন যেই ঘরে ঘরে শঙ্খঘন্টা বাজিয়া উঠে এবং খোল-করতালের সহযোগে দলে দলে কীর্তনীয়রা রাস্তায় মিছিল বাহির করে, অমনি সেই সকল সত্যের পূজারীরাও সকল শিক্ষাদীক্ষায় জলাঞ্জলি দিয়া দলে দলে ভিড়িতে আরম্ভ করে এবং ঘরে ঘরে অশৌচান্তের মতো হাঁড়িকুড়ি ফেলার ধুম লাগিয়া যায়।
আমি অশিক্ষিত অথবা নিরক্ষর লোকের কথা বলিতেছি না, কারণ যুক্তির দ্বারা সত্য মিথ্যা বাছিয়া লইবার মতো শিক্ষা বা সামর্থ্য তাহাদের নাই। কিন্তু যে জাতির শিক্ষিত সম্প্রদায় সত্য কী তাহা জানে, অথচ জীবনে তারা বরণ করিয়া লইতে প্রস্তুত নহে, যে মনের গোপনে সত্যের নিকট লজ্জায় মস্তক অবনত করিতেছে, অথচ বাহিরে জনসমাজে এবং সভার মাঝারে তাহাকে স্বীকার করিবার সাহস নাই- সে জাতি কেমন করিয়া জগতের নিকট সগর্বে মাথা তুলিয়া দাঁড়াইবে, তাহা আমার বুদ্ধির অতীত। (সংক্ষেপিত)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন