ধর্মের দুর্বলতা কী? ধর্মের দুর্বলতা দূর করার উপায় কি আছে?
মনুষ্য সমাজকে সবচেয়ে বেশি বিভাজিত করেছে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম।
অথচ, প্রতিটি ধর্মের উৎপত্তি হয়েছিল মানব কল্যাণকে নিশ্চিত করার জন্য। কিন্তু যখনই তা সাধারণ মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, তখনই তার দখল নিয়েছে ক্ষমতালিপ্সু একদল মানুষ। জন্ম দিয়েছে ধর্মের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ। নানা রকম বিধি বিধান তৈরি করে, সহজ ও সরল বিশ্বাসকে কৌশলে জটিল ও কুটিল করে দেওয়া হয়েছে। লক্ষ্য, মানুষকে একটি ‘সবজান্তা প্রতিষ্ঠানে’র মুখাপেক্ষী করে তোলা। ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করার বাসনায় ধর্মকে এভাবেই তারা হাতিয়ার করেছে। ধর্মের নামে মানুষকে বিভাজিত করার এই অভিনব কৌশলটাই হল সেই হাতিয়ার। ফলে মানুষ দলে দলে বিভক্ত হয়ে গেছেন নানা রঙের প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের ছত্র-ছায়ায়।
ধর্মের দুর্বলতা এখানেই যে সে ক্ষমতালিপ্সু এই সব মানুষদের কাছ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারেনি। তাই কোন প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম নয়, মানুষের প্রকৃত ধর্ম হওয়া উচিত মানব ধর্ম। ধর্ম যদি মানতেই হয় মানবধর্মকেই মানা উচিৎ, মানুষের কল্যাণই যেখানে এক এবং একমাত্র লক্ষ্য। উদ্দেশ্যও বটে।
ধর্ম কী কেবলই বিশ্বাস?
আসলে ধর্ম একটা বিশ্বাস, কিন্তু তা অন্ধ নয়। অথচ যারা ধর্ম পালন করেন, তাদের সিংহভাগই অন্ধ বিশ্বাস থেকেই তা পালন করেন।
কারণ, নামাজ বা পূজো অর্চনা করার সময় সাধারণ মানুষ আল্লাহ বা ভগবানের কাছে কী বলছেন, বা কী চাইছেন, তা তারা জানেনই না। কারণ, মাতৃ ভাষায় ধর্মীয় রীতিনীতি পালন করার বিধান নেই। ইদানিং এটার স্বীকৃতি মিললেও সিংহভাগ মানুষই অধিক নেকী বা পুণ্যের আশায় তা মূল ভাষাতেই পড়ে থাকেন। এবং সেভাবে পড়তেই উৎসাহিত করা হয়। ফলে একজন ধার্মিক মানুষ জানেনই না, যে আল্লাহ বা ভগবানের উদ্দেশ্যে নমাজ বা পুজো করার সময় তিনি কী কী পড়ে (উচ্চারণ করে) গেলেন! জানেন না, সেটা পড়ার মাধ্যমে সর্বশক্তিমান-এর কাছে কোন্ বার্তাই বা তিনি পৌঁছে দিলেন! সেগুলো বলায় সর্বশক্তিমান কেন খুশি হবেন, বা হবেন না, তার কোন যুক্তি গ্রাহ্য বিশ্লেষণ বা ব্যাখ্যাও তাই তার কাছে নেই।
অথচ, সৃষ্টি কর্তা (যদি ধরে নেওয়া হয়, তিনি আছেন) এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে নিখুঁত কার্যকারণ নীতির ওপর দাঁড় করিয়ে পরিচালনা করছেন। এর কোন ব্যতিক্রম ঐতিহাসিক যুগ ব্যাপী একটাও খুঁজে পাওয়া যায় নি। যাবে বলে মনেও হয় না। প্রত্যেকটি ঘটনাই ঘটাচ্ছেন তিনি সুনির্দিষ্ট কিছু নিয়মের বাঁধনে বেঁধে। এই নিয়মগুলো খুঁজে পাওয়া যায় তখন, যখন মানুষ তার যুক্তি ও বুদ্ধিকে প্রয়োগ করে তার ব্যাখ্যা খোঁজার চেষ্টা করেন। এটাকেই মানুষ বিজ্ঞান চর্চা বলে। মনে রাখতে হবে, এই বিজ্ঞানে বিশ্বাস আছে, কিন্তু সে বিশ্বাসে অন্ধত্ব নেই। কারণ, যুক্তির দ্বারা এই বিশ্বাস জারিত ও পরিচালিত হয়।
সুতরাং অন্ধের মত যারা ধর্মচর্চা করেন, বিচার বুদ্ধিহীন এবং যুক্তি বহির্ভূত বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরেন, তারা প্রকৃতপক্ষে ধর্ম পালন করছেন না। চোখ বন্ধ করে ফাঁকা রাস্তা পার হচ্ছেনা মাত্র, যেখানে গাড়ি-ঘোড়া নেই, যানজট নেই কিম্বা নেই কোন অতিরিক্ত মানুষের কোলাহল। আর একারণেই এই বিশ্বাসের পথে যখনই কোন সংকট আসে, আমরা আমাদের শুধমাত্র বিশ্বাসের উপর ভর করে নিশ্চিন্তে বসে থাকতে পারিনা। আমাদের ছুটে যেতে হয় কোন ডাক্তারের কাছে, ইঞ্জিনিয়ার-এর কাছে কিম্বা প্রশাসনের কাছে সমস্যার সমাধানের জন্য। আর এক্ষেত্রে আমরা অবলিয়ায় ভুলে যাই, এই মানুষগুলো যে টুলস বা বিজ্ঞান দিয়ে আমাদের উদ্ধার করেন, তা কোন যুক্তি বুদ্ধিহীন অন্ধবিশ্বাসে ভর করে পাওয়া নয়।
অনেকে বিশ্বাসের সঙ্গে বিজ্ঞানের কোন সম্পর্ক খুঁজে পান না। হ্যাঁ, নিশ্চয়ই অন্ধবিশ্বাসের সঙ্গে বিজ্ঞানের কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, বিশ্বাসের সঙ্গে বিজ্ঞানের কোনো সম্পর্ক নেই। মানুষ চাঁদে যাওয়ার আগে তাকে এই বিশ্বাস করতে হয়েছে যে, চাঁদে যাওয়া সম্ভব। এই বিশ্বাসই তাকে একটু একটু এগিয়ে নিয়ে গেছে। এবং অবশেষে চাঁদে যাওয়ার পদ্ধতি এবং উপায় বের করতে পেরেছে মানুষ। প্রাথমিক এই বিশ্বাস যদি না থাকতো, বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব যে আবিষ্কারগুলো আজ আমরা চোখের সামনে দেখছি, উপভোগ করছি, তা কখনোই সম্ভব হতো না।
মানুষ একটা বিশ্বাস থেকে বেরিয়ে আর একটা বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরেছিলেন বলেই আজ এত কিছু আবিষ্কার করা সম্ভব হয়েছে।
আর সে বিশ্বাস হল যুক্তি ও বুদ্ধির প্রতি বিশ্বাস। যে বিশ্বাস মানুষকে শিখিয়েছে, কোন অলৌকিক শক্তি নয়, মানুষই পারে তার ভাগ্যকে পরিবর্তন করতে।
আল্লাহ বা ভগবান আছেন তা যেমন প্রমাণ হয়নি, তেমনি সেই সত্তা যে নেই, তাও এখনও প্রমাণ হয়নি। সুতরাং ঈশ্বর আছেন এটা যেমন একটা বিশ্বাস। ঠিক তেমনি, তাঁর অস্তিত্ব নেই — এটাও একটা বিশ্বাস।
যুক্তি বুদ্ধিহীন বিশ্বাস ‘শাঁখের করাতের’ মতো। |
একজন মানুষ হিসাবে তাই দুই পক্ষেরই অধিকার আছে, তার নিজের নিজের বিশ্বাসকে বহন, লালন বা পালন করার।
কিন্তু লক্ষ্য রাখতে হবে, এই বিশ্বাস যেন অন্ধ না হয়ে যায়। অন্ধ হলেই তা ভয়ংকর পরিস্থিতির জন্ম দেয়। কারণ, সেখানে যুক্তি-বুদ্ধি কাজ করে না। যুক্তি বুদ্ধি কাজ না করলে, এই বিশ্বাসকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। আর এই অনিয়ন্ত্রিত বিশ্বাস, মানুষকে বিকারগ্রস্থ করে ফেলে। এই অবস্থায় একজন মানুষ হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে জঘন্য অপরাধ করতেও দ্বিধা করে না। কারণ, এই অপরাধ করা তার কাছে বৈধ হিসেবে এবং নৈতিক কাজ হিসাবে প্রতিপন্ন হয়। সে বুঝতে পারে না যে, এটা অন্যায় কেন অথবা ন্যায় নয় কেন? মনে রাখতে হবে,
যুক্তি বুদ্ধিহীন বিশ্বাস ‘শাঁখের করাতের’ মতো। তাকে যেভাবেই ব্যবহার করো না কেন, সে ক্ষত তৈরি করবেই।
সমস্ত ধর্মের মূল কথাই হল ঈশ্বর বলে একটি সত্তা আছেন এটা বিশ্বাস করা এবং তার বিধিবিধান মেনে চলা। এই বিধিবিধানগুলো মূল ধর্ম গ্রন্থে নির্দিষ্ট করে লেখা আছে। উদাহরণ দিয়ে বোঝানো আছে। এই লেখাগুলোর উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষকে এভাবে নিয়ন্ত্রণ করা, যাতে একজনের দ্বারা আরেকজন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। সবাই সৎকর্মে নিযুক্ত থাকে এবং প্রত্যেক মানুষ পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে ভালবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হয়। কারণ এটা করতে পারলেই মানবজাতির মঙ্গল হয়, না পারলে ভয়ংকরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বেদ, বাইবেল কোরআন প্রভৃতি গ্রন্থে তা স্পস্ট করা আছে।
এই গ্রন্থগুলোর প্রতি বিশ্বাস থাকলে এবং সেই বিশ্বাস যুক্তি বুদ্ধির দ্বারা জারিত হলে, বোঝা যায় যে, সেগুলো সমকালীন আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় পরিমণ্ডলের প্রেক্ষাপটে তথ্য, উদাহরণ ও ব্যাখ্যার মধ্যমে মানুষকে সত্যের পথে চলার বিধান দেওয়া হয়েছে। এই তথ্য, উদাহরণ এবং তার বিশ্লেষণ করলে কিছু সাধারন সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়। সেই সাধারণ সিদ্ধান্ত হল মানুষকে এক. ঐশ্বরিক সত্তাকে বিশ্বাস করতে হবে, দুই. সৎ কাজ করতে হবে এবং তিন. সত্যবাদী হতে হবে। এবং সর্বোপরি হিংসা বিদ্বেষ নয়, ভালোবাসার বন্ধনে একজন মানুষ আর একজন মানুষকে আপন করে নেবে। এর বাইরে কিছু না।
এই সাধারণ সিদ্ধান্তকে যুক্তি বুদ্ধি দিয়ে বিশ্লেষণ করে পরবর্তীকালে তাকে যুগের উপযোগী করে ব্যবহার করতে হবে। এটা ঠিকঠাক করতে পারাই ধর্ম পালন। এর এক রত্তি বেশিও নয়, কমও নয়। মনে রাখতে হবে,
যুক্তি বুদ্ধিহীন বিশ্বাস ‘শাঁখের করাতের’ মতো। তাকে যেভাবেই ব্যবহার করো না কেন, সে ক্ষত তৈরি করবেই।
লেখার উৎস
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন