সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ধর্মের দুর্বলতা বা সীমাবদ্ধতা ও তা দূর করার উপায়?

ধর্মের দুর্বলতা কী? ধর্মের দুর্বলতা দূর করার উপায় কি আছে?

মনুষ্য সমাজকে সবচেয়ে বেশি বিভাজিত করেছে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম।
অথচ, প্রতিটি ধর্মের উৎপত্তি হয়েছিল মানব কল্যাণকে নিশ্চিত করার জন্য। কিন্তু যখনই তা সাধারণ মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, তখনই তার দখল নিয়েছে ক্ষমতালিপ্সু একদল মানুষ। জন্ম দিয়েছে ধর্মের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ। নানা রকম বিধি বিধান তৈরি করে, সহজ ও সরল বিশ্বাসকে কৌশলে জটিল ও কুটিল করে দেওয়া হয়েছে। লক্ষ্য, মানুষকে একটি ‘সবজান্তা প্রতিষ্ঠানে’র মুখাপেক্ষী করে তোলা। ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করার বাসনায় ধর্মকে এভাবেই তারা হাতিয়ার করেছে। ধর্মের নামে মানুষকে বিভাজিত করার এই অভিনব কৌশলটাই হল সেই হাতিয়ার। ফলে মানুষ দলে দলে বিভক্ত হয়ে গেছেন নানা রঙের প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের ছত্র-ছায়ায়।

ধর্মের দুর্বলতা এখানেই যে সে ক্ষমতালিপ্সু এই সব মানুষদের কাছ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারেনি। তাই কোন প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম নয়, মানুষের প্রকৃত ধর্ম হওয়া উচিত মানব ধর্ম। ধর্ম যদি মানতেই হয় মানবধর্মকেই মানা উচিৎ, মানুষের কল্যাণই যেখানে এক এবং একমাত্র লক্ষ্য। উদ্দেশ্যও বটে।

ধর্ম কী কেবলই বিশ্বাস?

আসলে ধর্ম একটা বিশ্বাস, কিন্তু তা অন্ধ নয়। অথচ যারা ধর্ম পালন করেন, তাদের সিংহভাগই অন্ধ বিশ্বাস থেকেই তা পালন করেন।

কারণ, নামাজ বা পূজো অর্চনা করার সময় সাধারণ মানুষ আল্লাহ বা ভগবানের কাছে কী বলছেন, বা কী চাইছেন, তা তারা জানেনই না। কারণ, মাতৃ ভাষায় ধর্মীয় রীতিনীতি পালন করার বিধান নেই। ইদানিং এটার স্বীকৃতি মিললেও সিংহভাগ মানুষই অধিক নেকী বা পুণ্যের আশায় তা মূল ভাষাতেই পড়ে থাকেন। এবং সেভাবে পড়তেই উৎসাহিত করা হয়। ফলে একজন ধার্মিক মানুষ জানেনই না, যে আল্লাহ বা ভগবানের উদ্দেশ্যে নমাজ বা পুজো করার সময় তিনি কী কী পড়ে (উচ্চারণ করে) গেলেন! জানেন না, সেটা পড়ার মাধ্যমে সর্বশক্তিমান-এর কাছে কোন্ বার্তাই বা তিনি পৌঁছে দিলেন! সেগুলো বলায় সর্বশক্তিমান কেন খুশি হবেন, বা হবেন না, তার কোন যুক্তি গ্রাহ্য বিশ্লেষণ বা ব্যাখ্যাও তাই তার কাছে নেই।

অথচ, সৃষ্টি কর্তা (যদি ধরে নেওয়া হয়, তিনি আছেন) এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে নিখুঁত কার্যকারণ নীতির ওপর দাঁড় করিয়ে পরিচালনা করছেন। এর কোন ব্যতিক্রম ঐতিহাসিক যুগ ব্যাপী একটাও খুঁজে পাওয়া যায় নি। যাবে বলে মনেও হয় না। প্রত্যেকটি ঘটনাই ঘটাচ্ছেন তিনি সুনির্দিষ্ট কিছু নিয়মের বাঁধনে বেঁধে। এই নিয়মগুলো খুঁজে পাওয়া যায় তখন, যখন মানুষ তার যুক্তি ও বুদ্ধিকে প্রয়োগ করে তার ব্যাখ্যা খোঁজার চেষ্টা করেন। এটাকেই মানুষ বিজ্ঞান চর্চা বলে। মনে রাখতে হবে, এই বিজ্ঞানে বিশ্বাস আছে, কিন্তু সে বিশ্বাসে অন্ধত্ব নেই। কারণ, যুক্তির দ্বারা এই বিশ্বাস জারিত ও পরিচালিত হয়।

সুতরাং অন্ধের মত যারা ধর্মচর্চা করেন, বিচার বুদ্ধিহীন এবং যুক্তি বহির্ভূত বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরেন, তারা প্রকৃতপক্ষে ধর্ম পালন করছেন না। চোখ বন্ধ করে ফাঁকা রাস্তা পার হচ্ছেনা মাত্র, যেখানে গাড়ি-ঘোড়া নেই, যানজট নেই কিম্বা নেই কোন অতিরিক্ত মানুষের কোলাহল। আর একারণেই এই বিশ্বাসের পথে যখনই কোন সংকট আসে, আমরা আমাদের শুধমাত্র বিশ্বাসের উপর ভর করে নিশ্চিন্তে বসে থাকতে পারিনা। আমাদের ছুটে যেতে হয় কোন ডাক্তারের কাছে, ইঞ্জিনিয়ার-এর কাছে কিম্বা প্রশাসনের কাছে সমস্যার সমাধানের জন্য। আর এক্ষেত্রে আমরা অবলিয়ায় ভুলে যাই, এই মানুষগুলো যে টুলস বা বিজ্ঞান দিয়ে আমাদের উদ্ধার করেন, তা কোন যুক্তি বুদ্ধিহীন অন্ধবিশ্বাসে ভর করে পাওয়া নয়।

অনেকে বিশ্বাসের সঙ্গে বিজ্ঞানের কোন সম্পর্ক খুঁজে পান না। হ্যাঁ, নিশ্চয়ই অন্ধবিশ্বাসের সঙ্গে বিজ্ঞানের কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, বিশ্বাসের সঙ্গে বিজ্ঞানের কোনো সম্পর্ক নেই। মানুষ চাঁদে যাওয়ার আগে তাকে এই বিশ্বাস করতে হয়েছে যে, চাঁদে যাওয়া সম্ভব। এই বিশ্বাসই তাকে একটু একটু এগিয়ে নিয়ে গেছে। এবং অবশেষে চাঁদে যাওয়ার পদ্ধতি এবং উপায় বের করতে পেরেছে মানুষ। প্রাথমিক এই বিশ্বাস যদি না থাকতো, বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব যে আবিষ্কারগুলো আজ আমরা চোখের সামনে দেখছি, উপভোগ করছি, তা কখনোই সম্ভব হতো না। 
মানুষ একটা বিশ্বাস থেকে বেরিয়ে আর একটা বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরেছিলেন বলেই আজ এত কিছু আবিষ্কার করা সম্ভব হয়েছে।
আর সে বিশ্বাস হল যুক্তি ও বুদ্ধির প্রতি বিশ্বাস। যে বিশ্বাস মানুষকে শিখিয়েছে, কোন অলৌকিক শক্তি নয়, মানুষই পারে তার ভাগ্যকে পরিবর্তন করতে।

আল্লাহ বা ভগবান আছেন তা যেমন প্রমাণ হয়নি, তেমনি সেই সত্তা যে নেই, তাও এখনও প্রমাণ হয়নি। সুতরাং ঈশ্বর আছেন এটা যেমন একটা বিশ্বাস। ঠিক তেমনি, তাঁর অস্তিত্ব নেই — এটাও একটা বিশ্বাস।

যুক্তি বুদ্ধিহীন বিশ্বাস ‘শাঁখের করাতের’ মতো। তাকে যেভাবেই ব্যবহার করো না কেন, সে ক্ষত তৈরি করবেই।
যুক্তি বুদ্ধিহীন বিশ্বাস ‘শাঁখের করাতের’ মতো।
একজন মানুষ হিসাবে তাই দুই পক্ষেরই অধিকার আছে, তার নিজের নিজের বিশ্বাসকে বহন, লালন বা পালন করার।
কিন্তু লক্ষ্য রাখতে হবে, এই বিশ্বাস যেন অন্ধ না হয়ে যায়। অন্ধ হলেই তা ভয়ংকর পরিস্থিতির জন্ম দেয়। কারণ, সেখানে যুক্তি-বুদ্ধি কাজ করে না। যুক্তি বুদ্ধি কাজ না করলে, এই বিশ্বাসকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। আর এই অনিয়ন্ত্রিত বিশ্বাস, মানুষকে বিকারগ্রস্থ করে ফেলে। এই অবস্থায় একজন মানুষ হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে জঘন্য অপরাধ করতেও দ্বিধা করে না। কারণ, এই অপরাধ করা তার কাছে বৈধ হিসেবে এবং নৈতিক কাজ হিসাবে প্রতিপন্ন হয়। সে বুঝতে পারে না যে, এটা অন্যায় কেন অথবা ন্যায় নয় কেন? মনে রাখতে হবে,
যুক্তি বুদ্ধিহীন বিশ্বাস ‘শাঁখের করাতের’ মতো। তাকে যেভাবেই ব্যবহার করো না কেন, সে ক্ষত তৈরি করবেই।
সমস্ত ধর্মের মূল কথাই হল ঈশ্বর বলে একটি সত্তা আছেন এটা বিশ্বাস করা এবং তার বিধিবিধান মেনে চলা। এই বিধিবিধানগুলো মূল ধর্ম গ্রন্থে নির্দিষ্ট করে লেখা আছে। উদাহরণ দিয়ে বোঝানো আছে। এই লেখাগুলোর উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষকে এভাবে নিয়ন্ত্রণ করা, যাতে একজনের দ্বারা আরেকজন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। সবাই সৎকর্মে নিযুক্ত থাকে এবং প্রত্যেক মানুষ পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে ভালবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হয়। কারণ এটা করতে পারলেই মানবজাতির মঙ্গল হয়, না পারলে ভয়ংকরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বেদ, বাইবেল কোরআন প্রভৃতি গ্রন্থে তা স্পস্ট করা আছে।

এই গ্রন্থগুলোর প্রতি বিশ্বাস থাকলে এবং সেই বিশ্বাস যুক্তি বুদ্ধির দ্বারা জারিত হলে, বোঝা যায় যে, সেগুলো সমকালীন আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় পরিমণ্ডলের প্রেক্ষাপটে তথ্য, উদাহরণ ও ব্যাখ্যার মধ্যমে মানুষকে সত্যের পথে চলার বিধান দেওয়া হয়েছে। এই তথ্য, উদাহরণ এবং তার বিশ্লেষণ করলে কিছু সাধারন সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়। সেই সাধারণ সিদ্ধান্ত হল মানুষকে এক. ঐশ্বরিক সত্তাকে বিশ্বাস করতে হবে, দুই. সৎ কাজ করতে হবে এবং তিন. সত্যবাদী হতে হবে। এবং সর্বোপরি হিংসা বিদ্বেষ নয়, ভালোবাসার বন্ধনে একজন মানুষ আর একজন মানুষকে আপন করে নেবে। এর বাইরে কিছু না।

এই সাধারণ সিদ্ধান্তকে যুক্তি বুদ্ধি দিয়ে বিশ্লেষণ করে পরবর্তীকালে তাকে যুগের উপযোগী করে ব্যবহার করতে হবে। এটা ঠিকঠাক করতে পারাই ধর্ম পালন। এর এক রত্তি বেশিও নয়, কমও নয়। মনে রাখতে হবে,
যুক্তি বুদ্ধিহীন বিশ্বাস ‘শাঁখের করাতের’ মতো। তাকে যেভাবেই ব্যবহার করো না কেন, সে ক্ষত তৈরি করবেই।

লেখার উৎস

মন্তব্যসমূহ

📂 আলী হোসেনের জনপ্রিয় প্রবন্ধগুলি

হিন্দু কারা? তারা কীভাবে হিন্দু হল?

হিন্দু কারা? কীভাবে তারা হিন্দু হল? যদি কেউ প্রশ্ন করেন, অমিত শাহ হিন্দু হলেন কবে থেকে? অবাক হবেন তাই তো? কিন্তু আমি হবো না। কারণ, তাঁর পদবী বলে দিচ্ছে উনি এদেশীয়ই নন, ইরানি বংশোদ্ভুত। কারণ, ইতিহাস বলছে পারস্যের রাজারা ‘শাহ’ উপাধি গ্রহণ করতেন। এবং ‘শাহ’ শব্দটি পার্শি বা ফার্সি। লালকৃষ্ণ আদবানির নামও শুনেছেন আপনি। মজার কথা হল আদবানি শব্দটিও এদেশীয় নয়। আরবি শব্দ ‘আদবান’ থেকে উদ্ভূত। সুতরাং তাঁর পদবীও বলছে, তিনিও এদেশীয় নন। ভাষাতত্ত্ব ও নৃতত্ত্বের বিশ্লেষণ বলছে, উচ্চবর্ণের বিশেষ করে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের মানুষদের, উৎসভূমি হল পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চল। তারও আগে ছিল ইউরোপের ককেশাস অঞ্চলে। আসলে এরা (উচ্চবর্ণের মানুষ) কেউই এদেশীয় নয়। তারা নিজেদের আর্য বলে পরিচয় দিতেন এবং এই পরিচয়ে তারা গর্ববোধ করতেন। সিন্ধু সভ্যতা পরবর্তীকালে তারা পারস্যের বিভিন্ন এলাকা থেকে হিন্দুকুশ পর্বতের গিরিপথ ধরে এদেশে অভিবাসিত হয়েছেন। আর মধ্যযুগে এসে এদেরই উত্তরসূরী ইরানিরা (অমিত শাহের পূর্বপুরুষ) অর্থাৎ পারস্যের কিছু পর্যটক-ঐতিহাসিক, এদেশের আদিম অধিবাসীদের ’হিন্দু’ বলে অভিহিত করেছেন তাদের বিভিন্ন ভ্রমণ বৃত্তান্তে। ...

রবীন্দ্রনাথের ধর্মভাবনা ও তার বিবর্তন

রবীন্দ্রনাথের ধর্মভাবনা ও তার বিবর্তন আলী হোসেন  যদি প্রশ্ন করা হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ধর্ম কী? মনে হয় অনেকেই ঘাবড়ে যাবেন। কেউ বলবেন, তাঁর বাবা যখন ব্রাহ্ম ছিলেন, তখন তিনি নিশ্চয়ই ব্রাহ্ম হবেন। যারা লেখাপড়া জানেন না, তারা বলবেন, কেন! উনি তো হিন্দু ছিলেন। আবার কেউ কেউ তথ্য সহযোগে এও বলার চেষ্টা করবেন যে, উনি নাস্তিক ছিলেন। না হলে কেউ বলতে পারেন, ধর্মমোহের চেয়ে নাস্তিকতা অনেক ভালো?¹ রবীন্দ্রনাথের ধর্ম ভাবনার বিবর্তন  তাহলে সঠিক উত্তরটা কী? আসলে এর কোনোটাই সঠিক উত্তর নয়। চিন্তাশীল মানুষ-মাত্রই সারা জীবন ধরে ভাবতে থাকেন। ভাবতে ভাবতে তাঁর উপলব্ধি এগোতে থাকে ক্রমশঃ প্রগতির পথে। এই সময়কালে জগৎ ও জীবন থেকে তথ্য সংগ্রহ করে একে একে গড়ে তোলেন জীবনদর্শনের নিত্যনতুন পর্ব। তাই এ ধরনের চিন্তাশীল মানুষ আজীবন এক এবং অখণ্ড জীবনদর্শনের বার্তা বহন করেন না। সময়ের সাথে সাথে পাল্টে যায় তাঁর পথচলার গতিমুখ, গড়ে ওঠে উন্নততর জীবন দর্শন। মানুষ রবীন্দ্রনাথও তাই পাল্টে ফেলেছেন তাঁর জীবন ও ধর্মদর্শন; সময়ের এগিয়ে যাওয়াকে অনুসরণ করে। রবীন্দ্রনাথ ও  হিন্দু জাতীয়তাবাদ ১৮৬১ সালের ৭ই মে সোমবার রাত্রি ২টা ৩৮ ...

ভাগ্য : মুসলিম মনস্তত্ত্ব, ধর্মদর্শন ও প্রগতি

ভাগ্য : মুসলিম মনস্তত্ত্ব, ধর্মদর্শন ও প্রগতি - লিখছেন আলী হোসেন  কপালের লেখন খণ্ডায় কার সাধ্য? জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে কিংবা লেখাপড়া জানা-নাজানা নির্বিশেষে সমস্ত মানুষের সিংহভাগই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এই কথাটা মেনে নেয়। জীবনের উত্থান-পতনের ইতিহাসে কপালের লেখনকে জায়গা করে দিতে তারা কুণ্ঠাবোধ করে না। বরং বলা ভালো এব্যাপারে তারা অতিমাত্রায় উদার। মানুষের মনস্তত্বের এ-এক জটিল স্তর বিন্যাস। একই মানুষ বিভিন্ন সময়ে একই বিষয়ের বিচার বিশ্লেষণে ভিন্নভিন্ন দৃষ্টিকোণ ব্যবহার করে। এ রকমই একটি দৃষ্টিকোণ হলো কপাল বা ভাগ্যের ভূমিকাকে সাফল্যের চাবিকাঠি বলে ভাবা। কখনও সে ভাগ্যের নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠার চেষ্টা করে, আবার কখনও নিজেই ভাগ্যের কাছে নির্দিধায় আত্ম সমর্পন করে। নিজের ব্যার্থতার পিছনে ভাগ্যের অদৃশ্য হাতের কারসাজির কল্পনা করে নিজের ব্যার্থতাকে ঢাকা দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে থাকে। মজার কথা, এক্ষেত্রে মুসলিম মানসের মনস্তত্ত্ব কখনও চেতনমনে আবার কখনও অবচেতন মনে উপরওয়ালাকে (আল্লাহকে) কাঠ গড়ায় তোলে বিনা দ্বিধায়। নির্দিধায় বলে দেয়, উপরওয়ালা রাজি না থাকলে কিছুই করার থাকেনা। সাফল্য কিংবা ব্যর্থতা সবই তাঁর (আল...

সীমান্ত আখ্যান, বাঙালির আত্মানুসন্ধানের ডিজিটাল আখ্যান

সময়ের সঙ্গে সমস্যার চরিত্র বদলায়। কিন্তু মুলটা বদলায় না। যদি সে সমস্যা ইচ্ছা করে তৈরি হয়ে থাকে বিশেষ সুবিধা ভোগেই লোভে, তবে তো অন্য কথা চলেই না। স্বনামধন্য স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাতা সৌমিত্র দস্তিদারের ডকুমেন্টারি ফিল্প 'সীমান্ত আখ্যান' দেখার পর এই উপলব্ধি মাথা জুড়ে ঘুরপাক খাচ্ছে। দেখলাম, দেশ ভাগ হয়েছে। কিন্তু সমস্যার অবসান হয়নি। শুধু সমস্যার চরিত্রটা পাল্টেছে। এই যে সমস্যা রয়ে গেল, কোন গেল? তার উত্তর ও পাওয়া গেল 'সীমান্ত আখ্যান' এ। আসলে দেশ ভাগ তো দেশের জনগণ চাননি, চেয়েছেন দেশের নেতারা। চেয়েছেন তাঁদের ব্যক্তিগত, সম্প্রদায়গত সুবিধাকে নিজেদের কুক্ষিগত করার নেশায়। আর এই নেশার রসদ যোগান দিতে পারার নিশ্চয়তা নির্ভর করে রাজনৈতিক ক্ষমতার লাগাম নিজের হাতে থাকার ওপর। তাই রাজনীতিকরা এই ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য জনগণকে 'ডিভাইড এন্ড রুল' পলিছি দ্বারা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চেষ্টা করেছেন এবং করে চলেছেন। এ সমস্যা নতুন না, ব্রিটিশ সরকার এর বীজ রোপণ করে গেছেন, এখন কেউ তার সুফল ভোগ করছে (রাজনীতিকরা) আর কেউ কুফল (জনগন)। 'সীমান্ত আখ্যান চোখে আঙুল দিয়ে দে...

কাশ্মীর ফাইলস : প্রপাগান্ডার এক নয়া ব্রান্ড, কর্পোরেট পুঁজি ও রাজনৈতিক দলের গলাগলির এক সুচারু প্রদর্শনী

কাশ্মীর ফাইলস : প্রপাগান্ডার এক নয়া ব্রান্ড, কর্পোরেট পুঁজি ও রাজনৈতিক দলের গলাগলির এক সুচারু প্রদর্শনী রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয় উলুখাগড়ার প্রাণ যায়। ১৯৪৭ সালের পর থেকে জম্মু ও কাশ্মিরের জনগণের ভাগ্যলিপিতে লেখা হয়ে গেছে এই বিখ্যাত প্রবাদটির বিস্তারিত সারাৎসার। একদিকে পাকিস্তান আর অন্যদিকে ভারত – এই দুই প্রতিবেশি দেশের ভুরাজনৈতিক স্বার্থের যাঁতাকলে পড়ে তাদের এই হাল। কিন্তু কেন এমন হল? এই প্রশ্নের উত্তর জানে না এমন মানুষ ভুভারতে হয়তো বা নেই। কিন্তু সেই জানার মধ্যে রয়েছে বিরাট ধরণের ফাঁক। সেই ফাঁক গলেই ঢুকেছে কাশ্মির ফাইলসের মত বিজেপির রাজনৈতিক ন্যারেটিভ যা তারা বহুকাল ধরে করে চলেছে অন্য আঙ্গিকে। এবার নতুন মাধ্যমে এবং নবরূপে তার আগমন ঘটেছে, যায় নাম সিনেমা বা সেলুলয়েড প্রদর্শনী। যদিও ডিজিটাল মাধ্যমে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সৌজন্যে অনেক আগেই সফলভাবে তারা এই ন্যারেটিভ দিয়ে বিভাজনের রাজনীতি করে চলেছে বেশ কয়েক বছর ধরে। টেলিভিশন সম্প্রচারে কর্পোরেট পুজির অনুপ্রবেশের মাধ্যমে যার সূচনা হয়েছিল। রাষ্ট্রশক্তিকে কুক্ষিগত করতে না পারলে দেশের সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রন আনা সম্ভব নয়, একথা সাধারণ নিরক্ষর নাগরিক এবং ত...

শিক্ষা কী, কেন প্রয়োজন এবং কীভাবে অর্জন করা যায়?

শিক্ষা কী, কেন এবং কীভাবে অর্জন করতে হয়? সূচিপত্র : What is education, why it is needed and how to achieve it শিক্ষা কী শিক্ষা হল এক ধরনের অর্জন, যা নিজের ইচ্ছা শক্তির সাহায্যে নিজে নিজেই নিজের মধ্যে জমা করতে হয়। প্রকৃতি থেকেই সেই অর্জন আমাদের চেতনায় আসে। সেই চেতনাই আমাদের জানিয়ে দেয়, জগৎ ও জীবন পরিচালিত হয় প্রকৃতির কিছু অলংঘনীয় নিয়ম-নীতির দ্বারা। গভীর পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ শক্তিকে বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে কাজে লাগালেই এই নিয়মনীতিগুলো আমাদের আয়ত্বে আসে। এই নিয়ম-নীতিগুলো জানা এবং সেই জানার ওপর ভিত্তি করেই জগৎ ও জীবনকে সর্বোত্তম পর্যায়ে পৌঁছে দেয়ার পথ খুঁজে বের করার শক্তি অর্জনই শিক্ষা। মনে রাখতে হবে, এই শিক্ষা কখনও কারও মধ্যে জোর করে ঢুকিয়ে দেওয়া যায় না। এখন প্রশ্ন হল, শিক্ষা অর্জনের বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিটা আসলে কী। সেই আলোচনায় যাওয়ার আগে জানতে হবে, এই শিক্ষার সূচনা হয় কখন এবং কীভাবে? শিক্ষার সূচনা কখন হয় : এই অর্জনের সূচনা হয় মাতৃগর্ভে এবং তা প্রাকৃতিক ভাবেই। প্রকৃতির দেওয়া কিছু সহজাত শিক্ষাকে অবলম্বন করেই তার সূচনা। এই সহজাত শিক্ষাকে অবলম্বন করেই মানুষ তার পরবর্তী প...

জল, না পানি : জল নিয়ে জলঘোলা করা পানির মত সহজ নয়

জল নিয়ে জলঘোলা করা পানির মত সহজ নয় আলী হোসেন  সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত সরকারি অনুষ্ঠানে চিত্র শিল্পী শুভাপ্রসন্ন ভট্টাচার্য পানি শব্দকে বাংলা নয় বলে দাবি করেছেন। বলেছেন, "আমরা কোনোদিন কখনও বাংলা ভাষায় পানি (শব্দটা) ব্যবহার করি না"। শুধু তা-ই নয়, পানি শব্দের ব্যবহারের মধ্যে তিনি 'সাম্প্রদায়িকতার ছাপ'ও দেখতে পেয়েছেন। প্রশ্ন হল - এক, এই ভাবনা কতটা বাংলা ভাষার পক্ষে স্বাস্থ্যকর এবং কতটা 'বাংলা ভাষার ইতিহাস' সম্মত? দুই, জল বা পানি নিয়ে যারা জলঘোলা করছেন তারা কি বাংলাকে ভালোবেসে করছেন? মনে হয় না। কারণ, খোঁজ নিলে দেখা যাবে, এরা কেউ নিজের সন্তানকে বাংলা মিডিয়াম স্কুলে পড়াননি বা পড়ান না। ব্যবহারিক জীবনেও তারা বাংলার ভাষার চেয়ে ইংরেজি বা হিন্দিতে কথা বলতে বা গান শুনতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন, বলা ভালো গর্ববোধ করেন। প্রসংগত মনে রাখা দরকার, বাংলা মিডিয়াম স্কুলগুলোতে যারা ভর্তি হয়, তারা অধিকাংশই গরীব ঘরের সন্তান। বলা ভালো, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে তারাই বাংলা ভাষাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। কারণ, সন্তানকে বাংলা মিডিয়ামে পড়ানোর পাশাপাশি, বা...

আধুনিক মিডিয়া : কর্পোরেট পুঁজির (পুঁজিপতিদের) তোতাপাখি

গোদি মিডিয়া : কর্পোরেট পুঁজির তোতাপাখি পশ্চিমী মিডিয়াকে 'ইসরাইল সরকারের তোতাপাখি' নামে পরিচয় দেওয়া হয় সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী স্বাধীন ও নিরপেক্ষ মিডিয়া হাউজের পক্ষ থেকে। সম্প্রতি একইভাবে ভারতীয় কর্পোরেট মিডিয়া ভারত সরকার তথা 'কর্পোরেট পুঁজির  তোতাপাখি' হিসাবে পরিচয় পাচ্ছে, যাকে নিন্দুকেরা 'গোদী মিডিয়া' নামে অভিহিত করে থাকে। মধ্যপ্রাচ্যের ঘটনা সম্পর্কে ইসরাইল যা বলে, ইউরোপ ও আমেরিকার মিডিয়া, তোতা পাখির মতো তা-ই প্রচার করে। সাংবাদিকতার প্রধান প্রধান শর্তগুলোকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ইসরাইলের দেওয়া তথ্যই তারা প্রচার করে অন্ধ ও নির্লজ্জভাবে। ভারতের ক্ষেত্রেও করপোরেট মিডিয়া বর্তমানে সেটাই করছে বলে অভিযোগ। অভিযোগ, নত মস্তকে ভারত সরকারের দেওয়া তথ্য বিনা বিচারে প্রচার করে চলেছে অধিকাংশ মিডিয়া হাউজ।  অর্থাৎ তাদের সম্প্রচারিত খবরের বড় অংশই হয় নিয়ন্ত্রিত অথবা কখনও কখনও অসত্য - এমন দাবিও করা হয়।  আসলে সিংহভাগ মিডিয়ার মালিক হচ্ছেন এক-একজন  করপোরেট পুঁজির মালিক বা পুঁজিপতি। এরা কি কখনও নিজের স্বার্থের বিরুদ্ধে যায় - এমন খবর, তথ্য বা তত্ত্ব প্রচার করবে? করবে না, করেও না। আর এ...

নিম্নবর্গের মানুষ মার খাচ্ছে কেন

নিম্নবর্গের মানুষ কীভাবে পিছিয়ে পড়েছেন? সমাধান কীভাবে? এদেশের নিম্নবর্গের মানুষ নিজেদের বাঁচাতে যুগ যুগ ধরে ধর্ম পরিবর্তন করেছে। কখনও বৌদ্ধ (প্রাচীন যুগ), কখনও মুসলমান (মধুযুগ), কিম্বা কখনো খ্রিস্টান (আধুনিক যুগ) হয়েছে। কিন্তু কখনই নিজেদের চিন্তা-চেতনাকে পাল্টানোর কথা ভাবেনি। পরিবর্তন হচ্ছে অলংঘনীয় প্রাকৃতিক নিয়ম। যারা এই নিয়ম মেনে সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে পারে, তারাই লাভবান হয়, টিকে থাকে। “পাল্টে গেলেই জীবন বাড়ে না পাল্টালে নয়, জীবন মানেই এগিয়ে যাওয়া নইলে মৃত্যু হয়” জীবনের এই চরম সত্য তারা অধিকাংশই উপলব্ধি করতে পারেনি। পৃথিবীর যেকোন উন্নত জাতির দিকে তাকান, তারা দ্রুততার সঙ্গে এই পরিবর্তনকে মেনে নিজেদেরকে পুনর্গঠন করে নিয়েছে। যারা পারেনি বা নেয়নি তারাই মার খাচ্ছে, অতীতেও খেয়েছে। বুদ্ধিমান জাতি নিজের দুর্বলতাকে মেনে নেয় এবং ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য সময়ের সঙ্গে তাল রেখে নিজেদের চিন্তা এবং চেতনায় পরিবর্তন আনে। খ্রিষ্টান, ইহুদি-সহ এশিয়া, ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন জাতি - যারাই এই পরিবর্তন মেনে নিয়েছে তারাই আরও উন্নত এবং শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। মহানবীর (সঃ) গৌরবময় উত্থান (যা এক ধরণ...

সংখ্যালঘুর মুখই গণতন্ত্রের আয়না

  সংখ্যালঘুর মুখই গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় এবং শক্তিশালী আয়না। The face of the minority is the mirror of democracy কোন দেশ কতটা গণতান্ত্রিক, তা বোঝা যায় সে দেশের সংখ্যালঘু মানুষের জীবন ও সম্পত্তির সুরক্ষা কতটা মজবুত, তা থেকে। কারণ, সংখ্যালঘুর মুখই হচ্ছে গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় এবং শক্তিশালী আয়না। সংখ্যালঘুরা সঙ্গত কারণেই সংখ্যাগরিষ্ঠদের চেয়ে বেশি বঞ্চনাজনিত মনস্তাত্ত্বিক চাপে থাকে। এই চাপ দু’ভাবে তৈরি হয়। ১) সংখ্যাগিষ্ঠতাজনিত সুবিধা যা সংখ্যাগুরুরা পায়, সংখ্যালঘুরা কখনই তা পায় না বা পাবে না - এই ধারণা, যার কিছুটা হলেও ভিত্তি রয়েছে ২) সংখ্যাগরিষ্ঠদের মধ্যে বৃহত্তম (?) জনগোষ্ঠীর অংশ হওয়ার সুবাদে যে কর্তৃত্ববাদী মানসিকতা তৈরি হয় এবং যা বহুজনের মধ্যে দৃষ্টিকটুভাবে প্রকাশ হয়ে পড়ে, তার ভয়ে। এই চাপ কতটা গভীর তা সংখ্যালঘু ছাড়া বোঝা খুব মুশকিল। তবে আলোকপ্রাপ্ত মানুষ মাত্রই যে তা উপলব্ধি করতে পারেন, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। এই ধরণের চাপ তৈরি করে কিছু অসাধু মানুষ যখন সংখ্যালঘুদের জীবন ও সম্পত্তির সামনে হুমকি হয়ে দাঁড়ায়, তখন তা কমানোর ক্ষমতা একমাত্র গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রশক্তির হাতেই ...