সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা কবজ কী এবং কেন?
আধুনিক শিক্ষাই একমাত্র সংখ্যালঘুর শক্তি-স্বল্পতার বিকল্প উৎস হতে পারে।
জুন মাস (২০১৯) হংকং এ একটি সংখ্যালঘু শ্রেণির বিক্ষোভ |
যারা সংখ্যালঘু বিদ্বেষ ছড়ানোর চেষ্টা করছেন, তাদের বিরুদ্ধে পাল্টা বিদ্বেষ ছড়ানোয় সংখ্যালঘুদের কোন লাভ নেই। কারণ, যারা সংখ্যায় লঘু হয়, তাদের দেওয়া পাল্টা বিদ্বেষ ভাষণ, যৌক্তিক কারণেই কোন কাজে আসে না। উল্টে ভয়ংকর ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কেননা, এতে সংখ্যাগুরুর বিদ্বেষ ভাষণকারি অংশের হাতে যেটা এতদিন ছিল অজুহাত, তা ন্যায্যতা পেতে শুরু করে। অর্থাৎ সংখ্যালঘুর বিদ্বেষ ভাষণকে সামনে এনে তারা তাদের অজুহাতকে ন্যায্যতা দেয়ার সুযোগ পেয়ে যায়। |
তাছাড়া, লড়াই যখন অসম সংখ্যার মধ্যে হয়, তখন পেশী শক্তি বা বিদ্বেষ ভাষণ কখনই ইতিবাচক ফলাফল এনে দিতে পারে না। এক্ষেত্রে শিক্ষাই হল একমাত্র হাতিয়ার। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি যেমন শ্রমিকের শ্রমশক্তির (স্বল্পতার) বিকল্প হয়, তেমনভাবেই আধুনিক শিক্ষাই একমাত্র সংখ্যালঘুর শক্তি-স্বল্পতার বিকল্প উৎস হতে পারে।
বস্তুত, সংখ্যালঘুদের মনে রাখতে হবে, বিদ্বেষ ভাষণকারীদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত জবাব রয়েছে আপনার আধুনিক শিক্ষা গ্রহণের আগ্রাসী চেষ্টার মধ্যে। কেননা, এর মাধ্যমে নিজেদেরকে দেশের যোগ্যতম নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা যায় এবং তার মধ্যেই রয়েছে এর মোক্ষম জবাব। অর্থাৎ শিক্ষায় যোগ্যতম হয়ে ওঠাই সংখ্যালঘুদের একমাত্র সুরক্ষা কবজ। কোন ধর্মীয় নেতা বা রাজনৈতিক নেতার নেতৃত্বে বিদ্বেষ ভাষণ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে, হিংসা বা সরকারি সম্পত্তি ক্ষতির মাধ্যমে তা কখনোই পাওয়া সম্ভব হবে না। মনে রাখতে হবে, শিক্ষাই মানুষের একমাত্র বন্ধু, যে কখনো প্রতিদান চায়না। বিনা প্রতিদানেই সময় অসময়ে, বিপদে আপদে, সুখে-দুঃখে - সব সময়ই সে মানুষকে উত্তরণের পথ দেখায় এবং উত্তরণের শক্তি যোগায়। সুতরাং বর্তমান সময়ে তো বটেই, এটা চিরকালীন সত্য যে, শিক্ষাকে আঁকড়ে ধরাই সংখ্যালঘু বা দুর্বল মানুষের এক এবং অদ্বিতীয় কর্তব্য।
সময়ের দাবি হল, উন্নত থেকে উন্নততর পর্যায়ে পৌঁছানোর চেষ্টা করা। আজ দেশে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের যে অংশ বিদ্বেষ ছড়াচ্ছেন, তারা সময়ের এই দাবি উপেক্ষা করে পিছনের দিকে যেতে চাইছেন। ইতিহাস থেকে বিজ্ঞান - সব ক্ষেত্রেই তারা এই পথে হাঁটছেন। সমাজে অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের চাষ করছেন। সুতরাং তারা গাড্ডায় পড়বেই। ভাবতে হবে সংখ্যালঘুরাও কি সেই পথেই হাঁটবে?
এই পরিস্থিতিতে, সংখ্যালঘুদের কর্তব্য হল, আধুনিক শিক্ষা গ্রহণকে পাখির চোখ করা। এবং তা অর্জন করে নিজেদেরকে দেশের যোগ্যতম নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা। মনে রাখতে হবে, যোগ্যতমকে কখনও কোন ভাবেই আটকে রাখা যায় না। আজ হোক বা কাল, অযোগ্যকে তার কাছে নতজানু হতেই হয়।
প্রশ্ন হতে পারে, সংখ্যালঘুরা কি তাহলে আন্দোলন বিমুখ হয়ে থাকবে? মোটেই না। আন্দোলন নিশ্চয়ই হবে এবং হতেই হবে। কারণ, না কাঁদলে মা যেমন শিশুকে দুধ দেয় না, তেমনি আন্দোলন ছাড়া মানুষের অধিকার দাবি দাওয়া আদায় সম্ভব নয়। কিন্তু তার আগে দরকার প্রস্তুতি। প্রস্তুতির প্রথম স্তরটাই হলো সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা, যুগের উপযোগী করে তোলা। আধুনিক যুগে বসে মধ্য বা প্রাচীন যুগের রাষ্ট্র, সমাজ ও ধর্ম দর্শনকে অলংঘনীয় বলে আঁকড়ে থাকলে তা সম্ভব হবে না।
আজকের সময়ে সহিংস আন্দোলন সমর্থনযোগ্য নয়। এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায় যদি এ পথে হাঁটার চেষ্টা করে তাহলে সে আন্দোলনের ব্যর্থতা ১০০% এর বেশি হবে। তাই সহিংস আন্দোলন কোনভাবেই সংখ্যালঘুদের দাবি-দাওয়া আদায়ের অস্ত্র হতে পারেনা। কারণ, ১) এই আন্দোলনে সংখ্যাগুরুর সমর্থন থাকবে না এবং সংখ্যাগুরুর সমর্থন না থাকলে সংখ্যালঘুর দাবী দাওয়া আওদায় আকাশ কুসুম কল্পনা মাত্র। ২) বর্তমান সময়ে রাষ্ট্রশক্তির হাতে থাকা আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের সামনে মাথা তুলে দাঁড়ানোটার চেষ্টাটা আত্মহত্যার চেষ্টা ছাড়া আর কিছু নয়।
এক্ষেত্রে একমাত্র খোলা রাস্তা হল অহিংস পদ্ধতিতে আন্দোলন করা। আশার কথা হল, বর্তমান সময়ের পরিসংখ্যান বলছে, সহিংস আন্দোলনের চেয়ে অহিংস আন্দোলন সাফল্য পাচ্ছে বেশি। ১৯৮৬ সালে লক্ষ লক্ষ ফিলিপিনো ম্যানিলার রাস্তায় নেমে এসে শান্তিপূর্ণভাবে প্রার্থনা করতে শুরু করে। সেই বিক্ষোভের চতুর্থ দিনে ফিলিপাইন্সের স্বৈরশাসক মার্কোস শাসনামলের অবসান ঘটে। ২০০৩ সালে জর্জিয়ায় রক্তপাতহীন এক বিপ্লব হয়, যেখানে বিক্ষোভকারীরা গোলাপ হাতে পার্লামেন্ট ভবনে ঢুকে পড়ে। এরপর পদত্যাগ করতে বাধ্য হন দেশটির তৎকালীন শাসক এডুয়ার্ড সেভর্দনাদজে। অতি সম্প্রতি হংকং এ (জুন মাস ২০১৯) মাত্র ৩ শতাংশ মানুষের শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের কারণে বিতর্কিত এক প্রত্যর্পণ বিল অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করেছে সরকার।
পরিসংখ্যান বলছে, অহিংস আন্দোলনের সাফল্যের হার শতকরা ৫৩ শতাংশ এবং সহিংস আন্দোলনের হার মাত্র ২৬ শতাংশ। সম্প্রতি হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের গবেষক এরিকা চেনোয়েত এই তথ্য তুলে ধরে দেখিয়েছেন, শান্তিপূর্ণ নাগরিক আন্দোলনের নৈতিক জোর অত্যন্ত বেশি হয়। এবং সে কারণেই এ ধরণের আন্দোলন সফল হবার সম্ভাবনাও বেশি। তিনি হংকং-এর উদাহরণ টেনে সংখ্যালঘু শ্রেণির অহিংস আন্দোলনের সাফল্যকে নিশ্চিত করার চেষ্টা করেছেন।
লক্ষ্য করার বিষয় হলো, এ ধরনের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সাফল্য নির্ভর করে আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা সম্পর্কিত শিক্ষা, আন্দোলনের নেতা এবং সামর্থকদের আছে কিনা তার ওপর। বলতে দ্বিধা নেই, ভারতের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বিশেষত মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে আধুনিক শিক্ষার চেয়ে ধর্ম শিক্ষার প্রতি মনযোগ বেশি। যদিও সরকারি মাদ্রাসাগুলোতে আধুনিক পাঠক্রম অনুযায়ী পড়াশোনা চললেও শিক্ষার্থীদের মধ্যে মূল ফোকাস হয়ে থাকে ধর্মদর্শন সংক্রান্ত জ্ঞান লাভ করা। ফলে আধুনিক গণতন্ত্র এবং তাকে রাজনৈতিক আন্দোলনের হাতিয়ার করে তোলার ব্যাপারে তাদের ধারণায় অস্পষ্টতা থেকে যায় অনেক বেশি। ফলে বর্তমান সময়ের সংঘঠিত অধিকাংশ আন্দোলন তার অভিমুখ হারিয়ে ফেলছে। আর এর প্রধান কারণ, আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী মানুষদের অধিকাংশই আধুনিক রাষ্ট্র দর্শন সংক্রান্ত পড়াশোনার বাইরে থাকা মানুষজন। মূলত ধর্মীয় ভাবাবেগকে সম্বল করেই তারা আন্দোলনের মাঠে নামছেন। স্বাভাবিকভাবেই আন্দোলনগুলো রক্তাল্পতায় ভুগছে।
এ অবস্থা থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ হলো সংখ্যালঘু জনমানসকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা এবং সেখান থেকেই নেতৃত্ব তুলে আনা। এই শিক্ষিত নেতৃত্বই অহিংস আন্দোলনের চাবিকাঠি এবং তা প্রয়োগের সঠিক পদ্ধতি জানবে। সংখ্যালঘ ু জনসমাজকে ভাবতে হবে তারা কি এই পর্যায়ে পৌঁছেছেন? যদি না পৌঁছান, তবে তাদের একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত আধুনিক শিক্ষার স্বপক্ষে প্রচার এবং প্রসার। বলতে বাধা থাকা উচিত নয় যে, পাড়ায় পাড়ায় লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে ধর্মীয় জলসা করার চেয়েও গুরুত্ব পাওয়া উচিত আধুনিক শিক্ষার প্রসার বিষয়ক প্রচার। আশার কথা হল আল-আমিন মিশন সহ বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষার আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি সীমাবদ্ধতা নজরে আসছে। তারা তাদের লক্ষ্যকে নির্দিষ্ট করেছেন বিজ্ঞান বিষয়ক শিক্ষার উপর। ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার তৈরি করার দিকেই তাদের নজর বেশি। ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ারসহ বিজ্ঞান বিভাগের কৃতি ছাত্ররা সমাজের যে যে ক্ষেত্রে অবদান রাখতে পারে তার মধ্যে রাজনীতি অনুপস্থিত। মূলত ইতিহাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞানসহ কলা বিভাগের বিষয়গুলি নেতৃত্ব তৈরীর ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। এই বিষয়গুলি নিয়ে উচ্চশিক্ষা এবং গবেষণাকে সমান গুরুত্ব দেওয়া দরকার। এই দিকটা এখনো অবহেলায় রয়ে গেছে।
------xx-----
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন