সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

বাংলার লোকসংস্কৃতি, মাতৃতান্ত্রিকতা থেকে পুরুষতান্ত্রিকতা

বাংলার লোকসংস্কৃতির বিবর্তন : মাতৃতান্ত্রিকতা থেকে পুরুষতান্ত্রিকতা

Evolution of folk culture of Bengal

পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাবের প্রাথমিক লগ্নে মানুষ ছিল খাদ্য সংগ্রাহক। খাদ্য উৎপাদনের কৌশল সে জানতো না। তাই একজন মানুষের সঙ্গে একটা পশুর জীবনধারণের তেমন কোন মৌলিক পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যেত না। এই সময় পশুর ধর্ম ছিল পশুত্ব আর তার সংস্কৃতির নাম ছিল ‘খাদ্য সংগ্রাহক’।

কোন পশুই তার ধর্ম এবং সংস্কৃতিকে পরিবর্তন বা বিবর্তন ঘটাতে পারেনি। কিন্তু মানুষ পেরেছে। সংস্কৃতির আধুনিক সংজ্ঞা অনুযায়ী, তাই পশুর সেই অর্থে কোন সংস্কৃতি নেই, কিন্তু মানুষের,আগে না থাকলেও, এখন আছে।

সংস্কৃতি কী?

সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষের জ্ঞানচক্ষু উন্মোচিত হয়। চিন্তা চেতনায় আসে আমূল পরিবর্তন। ক্রমশ জন্ম নেয় তার একটি যুক্তিবাদী মন। সেই মন তাকে ভাবতে বাধ্য করে, তার অস্তিত্বের সংকট ও সম্ভাবনা সম্পর্কে। ভাবতে বাধ্য করে, বেঁচে থাকাকে আরো নিরাপদ ও সুন্দর করে গড়ে তোলার উপায় কী? এই উপায় খুঁজতে গিয়েই মানুষ জন্ম দিয়েছে তার সংস্কৃতির।

সংস্কৃতির জন্ম কীভাবে?

জগৎ ও জীবনকে আরও নিরাপদ ও সুন্দর করে গড়ে তোলার জন্য প্রথমেই সে বের করে নতুন নতুন কৌশল। তারপর শুরু করে সেই কৌশলকে আরও উন্নত এবং কার্যকরী করে তোলার অক্লান্ত চেষ্টা। ফলে সময়ের সাথে সাথে পাল্টে যায় তার সেই কৌশলের ধরণ। পাল্টে যাওয়া কৌশল পায় নতুন নাম। জন্ম হয নতুন সংস্কৃতির।

মানব সভ্যতার শুরুতেই মানুষের সাংস্কৃতির নাম ছিল ‘খাদ্য সংগ্রাহক’। হাত, পা, চোখ, কান-সহ তার পঞ্চ ইন্দ্রিয়ই ছিল তাঁর হাতিয়ার। তারপর ক্রমান্বয়ে গাছের ডালপালা হয়ে পাথরের টুকরো'য় এসে পৌঁছয় মানুষ। হাতিয়ার হিসেবে বেছে নেয় পাথরের টুকরোকে এবং নতুন জীবিকায় যোগ হয় পশু শিকার। এভাবেই মানুষ তার জীবনের নিরাপত্তাকে বাড়াতে জন্ম দেয় প্রস্তর সংস্কৃতির। ইতিহাসের পাতায় আমরা তাকে প্রস্তরযুগীয় সংস্কৃতি বলে অভিহিত করি। 

এভাবেই যুগ যুগ ধরে মানুষের সংস্কৃতির বিবর্তন ঘটেছে। কৃষির আবিষ্কারের সাথে সাথে মানুষ খাদ্য সংগ্রাহকের সংস্কৃতি ত্যাগ করে খাদ্য উৎপাদক বা কৃষি সংস্কৃতির জন্ম দেয়। এভাবে - আগুন, ধাতু, জীবাশ্ম জ্বালানির স্তর পার হয়ে আজ ডিজিটাল প্রযুক্তিকে মাধ্যম করে মানুষ আরও এক নতুন ও অত্যাধুনিক ডিজিটাল সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে। মানুষের জীবনকে পৌঁছে দিয়েছে একটি উন্নততর পর্যায়ে।

সুতরাং সংস্কৃতি হল বিভিন্ন প্রাকৃতিক উপাদানকে ব্যবহার করে গড়ে তোলা এক ধরণের মৌলিক জীবন-কৌশল বা জীবনবোধ যা মানুষ যুগ যুগ ধরে বিবর্তনের বিভিন্ন পর্যায় পেরিয়ে ক্রমশ উন্নত থেকে উন্নততর পর্যায়ে পৌঁছানোর চেষ্টা করে। মনে রাখতে হবে, এই জীবন-কৌশল বা জীবন-বোধ মানুষের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রকে (সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্ম, ভাষা, বিনোদন ইত্যাদি) ছুঁয়ে যায় এবং তাকে নিয়ন্ত্রণ করে।

বাংলা ও বাঙালির লৌকিক সংস্কৃতি

সংস্কৃতির এই পরিবর্তন বা বিবর্তন মানুষের জীবনের সঙ্গে সঙ্গে জগতের ভৌগোলিক তথা প্রাকৃতিক পরিবেশের দ্বারা পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়। কারণ, মাটি, জল, হাওয়া ইত্যাদি প্রাকৃতিক পরিবেশের এই উপাদানগুলিও মানুষের জীবনের মান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এক কথায়, এগুলোর দ্বারা মানুষের জীবনের নিরাপত্তা ও সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার প্রক্রিয়াটি নিয়ন্ত্রিত হয়।

তাই ভিন্ন ভিন্ন জল হওয়ায় এবং ভিন্ন ভূ-প্রাকৃতিক অবস্থানের কারণে মানুষের জীবনধারণের উপাদান ও তাকে ব্যবহার করার কৌশল ভিন্ন ভিন্ন রকমের হয়। তাই পৃথিবীব্যাপী ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির অবস্থান আমরা টের পাই।

স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের নদী বিধৌত ও উর্বর পলিগঠিত ভূপ্রকৃতি এবং মৌসুমী জলবায়ুর প্রভাবে এখানকার মানুষের মধ্যে জন্ম নিয়েছিল এক বিশেষ ধরণের  কৃষি ভিত্তিক জীবন বোধ বা জীবন কৌশল। অবিভক্ত বাংলাদেশের সেই ভৌগোলিক পরিচয়কে সামনে রেখে আমরা তাকে ‘বাংলা বা বাঙালির সংস্কৃতি’ নামে অভিহিত করে থাকি।

সংস্কৃতির বিবর্তন :

সংস্কৃতিকে আমরা দুটি ধারায় ক্রিয়াশীল থাকতে দেখি। একটি শাস্ত্রীয় ধারা। অন্যটি লোক-ধারা। প্রসঙ্গগত মনে রাখা দরকার, ধর্মের সঙ্গে সংস্কৃতির সম্পর্ক গভীর। সে কারণেই শাস্ত্রীয় ধারায় রয়েছে শাস্ত্রীয় ধর্মের গভীর প্রভাব। আর লোক-ধারায় রয়েছে লৌকিক ধর্মের। অর্থাৎ শাস্ত্রীয় ধর্মের অনুসারী মানুষের জীবনধারণের প্রতিটি ক্ষেত্রকে ছুঁয়ে যায় শাস্ত্রীয় ধর্মের নানান আচার-বিচার, রীতিনীতি বা নিয়ম-কানুন। অন্যদিকে লৌকিক ধর্মের অনুসারীদের জীবনবোধকে প্রভাবিত করে লৌকিক ধর্মের নানার আচরণ অনুষ্ঠান ও রীতিনীতি।

লক্ষণীয় বিষয় হল, বাংলার মাটিতে কোন শাস্ত্রীয় ধর্মের আবির্ভাব ঘটেনি। শাস্ত্রীয় ধর্মের যে প্রভাব আমরা এখানে দেখি তা মূলত বহিরাগত আর্য ও ইসলামিক সংস্কৃতির প্রভাব। আর্যদের ভারত আগমনের বহু পরে তা বাংলার মাটিতে প্রবেশ করে। তাই শাস্ত্রীয় ধর্ম বাংলাদেশে বহিরাগত। স্বাভাবিক কারণেই আর্যপূর্ব কাল থেকেই বাংলাদেশের মানুষ নিজস্ব ধর্ম ও সংস্কৃতি ধারণ করে আসছে, যা ‘বাংলার লোকসংস্কৃতি’ নামে পরিচিত। এই সংস্কৃতি, তাই নানা আচার-বিচার, শাস্ত্রীয় মন্ত্র কিংবা যাগযজ্ঞের ভারে ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠেনি। আর্য সংস্কৃতির এই সমস্ত বৈশিষ্ট্য প্রকটভাবে লক্ষ্য করা যায়, উত্তর, মধ্য ও পশ্চিম ভারতে। সে কারণ এখানে আলোচ্য নয়।

 আর বাংলাদেশে বাঙালির নিজস্ব লৌকিক ধর্মমতগুলো বাংলার উর্বর মাটিতে ফসলের মত বেড়ে উঠেছে এবং তাতে পুষ্টি জুগিয়েছে বাঙালির নিজস্ব জীবনমুখী সহজ সরল ইহলোককেন্দ্রিক যৌথ-জীবন দর্শন। তাই বাঙালির লৌকিক ধর্মকে না বুঝলে বাঙালির লোকসংস্কৃতি ও দর্শনকে বোঝা যাবে না। শাস্ত্রীয় ধর্মের কঠিন আচার বিচার, মন্দির মসজিদকেন্দ্রিক পূজা বা উপাসনা, জাতিভেদ ইত্যাদিকে নিঃসংকচে ত্যাগ করে বেড়ে উঠেছে বাঙালির লৌকিক ধর্ম। এই ধর্মে পুজোর মন্দিরের চেয়ে ‘হৃদয় মন্দিরে’র গুরুত্ব বেশি। কাগজের শাস্ত্র অপেক্ষা ‘দেল-কেতাব’ চর্চার গুরুত্ব বেশি।

বাংলার এই নিজস্ব লৌকিক ধর্ম ও সংস্কৃতির কারণে বৈদিক ব্রাহ্মণ্য ধর্মশাস্ত্রগুলোতে বাংলাদেশের মানুষদের পরিচয় দিতে গিয়ে নিন্দাসূচক শব্দবন্ধ ব্যবহার করা হয়েছে। বাংলার অধিবাসীদের ‘মহাভারতে ম্লেচ্ছ, ভাগবত পুরাণে ‘পাপ কোম’, এবং ‘ঐতরেয় ব্রাহ্মণ’ গ্রন্থে ‘দস্যু’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। বৌদ্ধ ‘আর্য মঞ্জুশ্রী মূলকল্প’ গ্রন্থে বাঙালির ভাষাকে ‘অসুর’ ভাষা এবং ‘ঐতরেও আরণ্যকে’ এই অঞ্চলের ভাষাকে পাখির ভাষার (দুর্বোধ্য) সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। এমনকি বহিরাগত মুসলমানরাও বাংলা সম্পর্কে অবজ্ঞা ও উন্নাসিকতা প্রকাশ করেছে। তারা এই এলাকাকে ‘দার উল হারব’ বা বসবাসের অযোগ্য ও অশান্তির এলাকা বলে চিহ্নিত করেছে। স্বাভাবিকভাবেই এখানকার মানুষরা শাস্ত্রীয় ধর্মের বিধি-বিধান অর্থাৎ শাস্ত্রীয় ধারার সংস্কৃতিকে বিনা প্রতিরোধে গ্রহণ করেনি। বিভিন্ন সময় (যেমন বল্লাল সেনের সময় ব্রাহ্মণ্য ধর্ম) রাজানুকূল্য পাওয়া বাইরের ধর্মসংস্কৃতির নির্যাসকে নিজস্ব ভাব ও সংস্কৃতির জারক রসে জারিত করে নিজের ঘরের জিনিস বানিয়ে গ্রহণ করেছে। ফলে বাংলার লোকসংস্কৃতি তার নিজস্বতা সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেলেনি। অর্থাৎ বাংলার লোকসংস্কৃতি বিবর্তনের মধ্য দিয়ে এলেও নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রেখেছে। বাঙালির লৌকিক ধর্ম, বিশেষ করে নাথধর্ম, সহজযান, মন্ত্রযান, সহজিয়া বাউল, সহজিয়া বৈষ্ণব, লৌকিক সূফীবাদ, সাংখ্য, যোগ ইত্যাদি এই সংস্কৃতিকে পুষ্ট করে রেখেছে।

উল্লেখ্য, শাস্ত্রীয় ধর্মের প্রতি রাষ্ট্রীয় আনুকুল্য, পুঁজির পৃষ্ঠপোষকতা ইত্যাদিকে উপেক্ষা করে নিজের অস্তিত্বকে কতদিন টিকিয়ে রাখতে পারবে, সে বিষয়ে প্রশ্ন চিহ্ন উঠতে শুরু করেছে। কারণ, এই দুই আনুকূল্য বর্তমান সময়ে শাস্ত্রীয় ধর্ম ও সংস্কৃতিকে অনেকটাই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এগিয়ে রাখছে। ডিজিটাল প্রযুক্তি এক্ষেত্রে শাস্ত্রীয় ধর্মের প্রচারকদের প্রধান অস্ত্র হয়ে উঠেছে যা লৌকিক ধর্মের অনুসারীদের প্রায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। কেন বাইরে সে কথায় পরে আসছি।

দেবতা নয়, দেবীর প্রাধান্য:

অসংখ্য নদ, নদী শিরা-উপশিরার মত ছড়িয়ে আছে সারা বাংলা জুড়ে। এই নদীবাহিত পলি দ্বারা গঠিত উর্বর মাটি উৎপাদিকা শক্তিতে ভরপুর। ঠিক যেন নারীর সন্তান উৎপাদনের শক্তির মতো। স্বাভাবিকভাবেই বাঙালির লৌকিক সংস্কৃতিতে নারী পেয়েছে মায়ের মর্যাদা। বাংলাদেশে তাই নারী আর প্রকৃতি সমানভাবে গুরুত্ব পায় এবং পুজিত হয়। লৌকিক ধর্ম ও সংস্কৃতিতে নারী দেবতার প্রাধান্য তাই চোখে পড়ার মতো। বাংলার সাধারন মানুষের আরাধ্য দেবতারা সবাই দেবীরূপে কল্পিত হয়। শাস্ত্রীয় ধর্মগুলোর বিকাশ পুরুতান্ত্রিক সমাজে হলেও প্রাক-আর্য বাংলায় ধর্ম ও দর্শন চিন্তা বিকাশ লাভ করেছিল মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার মধ্যেই। তাই পরবর্তীকালে পৌরাণিক ধর্মে মাতৃ দেবীর প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়, যা বৈদিক যুগে ছিল না। সেখানে ছিল পুরুষ দেবতার আধিপত্য।

এ কারণেই বাংলার কর্তা ভজা, লৌকিক বৈষ্ণব, আউল বাউল সম্প্রদায়ের মধ্যে নারী বিশেষ মর্যাদায় সু প্রতিষ্ঠিত। বাউল সাধন তত্ত্বের সাধনায় একজন বাউল তাই নির্দ্বিধায় বলতে পারে -

মেয়ের চরণ নেরে মাথায় করে।
মেয়ে বিনে এ ভবনে গতি নাইরে।।”

লৌকিক তন্ত্রশাস্ত্র নির্দ্বিধায় নিদান দিতে পারে :

“স্ত্রী গুরুর কাছে মন্ত্র গ্রহণ করলে শুভ ফল হয়। মায়ের কাছে মন্ত্র গ্রহণে আট গুণ অধিক ফল হয়।”

শুধু তাই নয় বাংলার লোকসংস্কৃতির অন্দরে উকি মারলে সেখানেও নারীর একচেটিয়া প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। বাঙালির ব্রত অনুষ্ঠানগুলোতে আমরা তা-ই লক্ষ্য করি। বাঙালি মেয়েরা স্বামী সন্তান সহ সমগ্র পরিবারের মঙ্গল ও সমৃদ্ধি কামনায় নিষ্ঠার সঙ্গে ব্রত পালন করে, যা বাঙালির পারিবারিক জীবনকে দিয়েছে বিশিষ্টতা এবং সংসার জীবনকে করে তুলেছে মাধুর্যময়।

এই ব্রত অনুষ্ঠানগুলোর জন্ম বাংলাদেশের আদিম সমাজে। জাদুবিদ্যা বা ইন্দ্রজালের আবাহ তৈরি করার মধ্য দিয়ে অতিপ্রাকৃতিক বা প্রাকৃতিক শক্তিকে বশ করার চেষ্টা থেকে এর জন্ম। আর্চার টেলারের কথা অনুযায়ী জাদুবিদ্যা হল অতিপ্রাকৃতিক শক্তিকে বশ করার এবং অতিপ্রাকৃত উপায়ে প্রকৃতিকে জানা বোঝা ও জয় করার কৌশল। লোকসংস্কৃতির গবেষক মফিজুর রহমান রুন্ নু এই যাদু বিদ্যাকে বিজ্ঞানের আদিম অবস্থা বলে বর্ণনা করেছেন। কারণ এখানে প্রকৃতিকে জানা বোঝা ও জয় করার অদম্য ইচ্ছা শক্তি কাজ করে। কোন কিছুতে দেবত্ব আরোপ করে তার পায়ে মাথা নিচু করে আবেদন নিবেদনের কোন চেষ্টা এখানে দেখা যায় না, যা প্রাতিষ্ঠানিক বা শাস্ত্রীয় ধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। প্রাতিষ্ঠানিক বা শাস্ত্রীয় সংস্কৃতির মধ্যে যেখানে ভক্তি ও আত্মসমর্পণই মূল কথা, সেখানে লৌকিক সংস্কৃতির মধ্যে থাকা যাদু বিদ্যা বা ইন্দ্রজালে আত্মসমর্পণের কোন প্রশ্নই নেই। এখানে দলবদ্ধভাবে যাদু অনুষ্ঠানের মাধ্যমে যৌথ প্রচেষ্টায় প্রকৃতিকে জয় করে নিজেদের জীবনের নিরাপত্তা বিধান করার তাগিদ দৃঢ়ভাবে ফুটে ওঠে। এখানে কোন পুরোহিত লাগেনা,লাগেনা কোন মাওলানা কিম্বা মৌলবি ।

কৃষি আবিষ্কারের ফলে প্রাকৃতিক সম্পদকে কিছু মানুষ নিজেদের দখলে রাখার চেষ্টা করলে, মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির যে বশে আনার লড়াই, তার অভিমুখ পাল্টে যায়। যাদুবিদ্যা বা ইন্দ্রজালের মাধ্যমে প্রকৃতিকে নিজের ইচ্ছা পূরণে বাধ্য করার ধারণার সাথে জুড়ে যায় কিছু শ্রমবিমুখ বুদ্ধিমান অসাধু মানুষের কাছে অর্জিত সম্পদ না হারানোর লড়াই। এই লড়াইয়ে যাদুবিদ্যা অকার্যকর হয়ে পড়ে। কারণ, প্রকৃতির সঙ্গে যে লড়াই তা ছিল ছায়ার সঙ্গে লড়াই। এ লড়াইয়ে ছিল প্রাপ্তি আর অপ্রাপ্তি নিরাপদ কাহিনী। কিন্তু শ্রমবিমুখ মানুষের সঙ্গে লড়াইয়ে এই দুটোর বাইরে ছিল সব হারানোর ভয়। অসহায় সাধারণ মানুষ তাই এই কর্মবিমুখ বুদ্ধিমান (পড়ুন চালাক) মানুষের তৈরি শাস্ত্রীয়ধর্মকে আঁকড়ে ধরে বাঁচার চেষ্টা করে। আর সুন্দর পরকালের আশ্বাসে জীবনমৃত্যুকে পায়ের ভৃত্য করতে বাধ্য হয়।

এভাবে আদিম যাদুবিদ্যা নির্ভর সংস্কৃতি গুরুত্ব হারাতে শুরু করে। তারই কিছু কিছু এখনো আমরা আমাদের সমাজে ধুকপুক করে টিকে থাকতে দেখি। আমাদের ধর্মীয় আচার-আচরণের মধ্যেই তারা মন্ত্রগুপ্তি, তুকতাক, বাণমারা, তাবিজ-মাদুলি গ্রহণের মধ্যে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। কৃষিভিত্তিক সামাজিক পরিবেশের কারণে মেয়েরাই এগুলো বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে ব্রত অনুষ্ঠানের মত আচার অনুষ্ঠানকে সামনে রেখে।

নব্য প্রস্তর যুগের জনসমাজে কৃষি আবিষ্কারের মধ্য উদ্ভিদের ফলন বৃদ্ধি ও প্রজনন সংক্রান্ত বিষয় গুরুত্ব পায়। এক্ষেত্রে মেয়েদের ভূমিকা প্রধান হয়ে দাঁড়ায়। কারণ, মাটির উর্বরতা কামনায় নারী বেশি শক্তিশালী রূপে সমাজের চিহ্নিত হতো। ধরা হতো, মাটি আর নারী উভয়ই উর্বরতার প্রতীক এবং সৃষ্টির মূল চালিকাশক্তি। স্বাভাবিকভাবে প্রকৃতির কাছ থেকে দাবি আদায়ে নারীর সক্ষমতা বেশি ধরে নিয়ে ধরিত্রীর কাছ থেকে দাবি আদায়ের ব্রত অনুষ্ঠান তাদের হাতেই নিবেদিত হয়।

আর্যরা ভারতবর্ষে প্রবেশ করার পর লক্ষ্য করেছিল এখানকার মানুষেরা যাগযজ্ঞ করে না, করে ব্রত পালন। তাই আদিম জনজাতিকে তারা নাম দিয়েছিল অন্যব্রত। বৈদিক সাহিত্যের শেষের দিকে তাই ব্রত কথাটি উল্লেখ থাকতে দেখি। মনুসংহিতায় ভারতের আদি জনসমাজকে সেকারণই ‘ব্রাত্য ক্ষত্রিয়’ বা ব্রতধারী ক্ষত্রিয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

কিন্তু আর্যদের আসার পর বৈদিক ধর্মের চাপে ব্রত অনুষ্ঠানগুলি ক্রমশ হয় বিলুপ্ত হয়েছে, নয়তো চরিত্র পাল্টে গেছে। নীহার রঞ্জন রায় বলছেন, “আমাদের গ্রাম্য সমাজে বিশেষভাবে নারীদের ভিতর যেসব ব্রত আজও প্রচলিত আছে তাহার অধিকাংশই অবৈদিক, অস্মার্ত, অপৌরাণিক ও অব্রাহ্মণ্য এবং মূলত গুহ্য যাদু ও প্রজনন শক্তির পূজা, যে-পূজা গ্রাম্য কৃষি সমাজের সঙ্গে একান্ত সম্পৃক্ত”।

মজার ব্যাপার হলো বৈদিক যুগ থেকে আজ পর্যন্ত হিন্দু ধর্মের পূজো ও নানা রকমের ধর্মানুষ্ঠানের মধ্যে আদিম জাদুর প্রভাব রয়ে গেছে। ম্যাকডোনাল উল্লেখ করেছেন বৈদিক যজ্ঞ অনুষ্ঠানগুলোতে যাদুমূলক উপাদানের উপস্থিতির কথা। শুধু তাই নয় লৌকিক ধর্মের সংস্পর্শে ব্রাহ্মণ্য ধর্মেও অনেক পরিবর্তন ঘটে গেছে। প্রচুর অবৈদিক ও অব্রাহ্মণ্য উপাদান ব্রাহ্মণ্য ধর্মে প্রবেশ করেছে। এই সূত্রেই ব্রত অনুষ্ঠান ব্রাহ্মণ্য ও পৌরাণিক পরিমণ্ডলে ঢুকে পড়ে। এই ধরনের অনুষ্ঠানে ব্রাহ্মণ পুরোহিত এর প্রয়োজন হয়। কিন্তু বাঙালি মেয়েদের একান্ত নিজস্ব যে প্রচুর ব্রত পালনের আচার অনুষ্ঠান রয়েছে, সেখানে মেয়েরাই সব,কোন পুরোহিতের দরকার হয় না।

শুধু ব্রত অনুষ্ঠানই নয় আদিম যাদু বিশ্বাসের প্রভাব রয়েছে লোকসংস্কৃতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে। যেমন বৃষ্টি কামনা, গাজন, মাগন, ফসল কামনা, ব্যাধি নিরাময়, ওঝা বা গুনিনদের উচ্চারিত মন্ত্র, নানা আচার অনুষ্ঠান, প্রথাপার্বণ, মৃতদেহ সৎকার ইত্যাদিতে এই যাদু বিশ্বাসের ছোঁয়া দেখতে পাওয়া যায়। বাংলার কৃষি প্রধান অঞ্চলে এই ধরনের ব্রতকথা পাঠ করতে দেখা যায়।

হাত ধুইয়া দিলাম পানি
ধান হয় যেন শ'মন খানি।

অথবা

আয়রে তরা ভুঁই নিড়াইতে যাই।
ভুঁই মোর গো মাতা-পিতা ভুঁই মোর গো পুত।
ভূঁইর দৌলতে মোর গো আশী কোঠা সুখ।
ওগো সপ্তডিঙা মধুকরে যত ধান্য ধরে
এবার যেন সোনার ধানে আমার গলা ভরে।

লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, শাস্ত্রীয় ব্রতের সঙ্গে লৌকিক ব্রতের বেশ কিছু মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। শাস্ত্রীয় ব্রতে পারলৌকিক সুখের অন্বেষণ করা হয় আর লৌকিক ব্রতের মাধ্যমে পারিবারিক ও সামাজিক; এক কথায় ইহলৌকিক সুখের অন্বেষণ করা হয়। স্বাভাবিকভাবেই সাধারণ খেটে খাওয়া কৃষিভিত্তিক জনজাতি অর্থাৎ বাঙালি লৌকিক ব্রতের প্রতি বেশি আগ্রহ দেখায়। এ ধরনের একটি ব্রতের নাম আদর্শ সিংহাসন ব্রত। এই ব্রত অনুষ্ঠানের জনপ্রিয়তায় ব্রাহ্মণ্য ধর্মে শুরু করা হয় ব্রাহ্মণাদর ব্রত

এই দুটি ব্রত অনুষ্ঠানের পার্থক্য হল আদর্শ সিংহাসন ব্রততে একজন সধবা নারীকে হাত পায়ের নখ কেটে, সিঁথিতে সিঁদুর দিয়ে, লাল শাড়ি পরিয়ে, নানা রকম উপহার দিয়ে তাকে আপ্যায়ন করা হয়। একজন নারী তার স্বামীর কাছ থেকে যে ধরণের আদর, আপ্যায়ন বা মূল্যায়ন আশা করে, তা-ই এখানে পূরণ করার চেষ্টা হয়। এখানে কোন পুরোহিত লাগেনা। অন্যদিকে ব্রাহ্মণাদর ব্রতে একজন ব্রাহ্মণকে এভাবে আপ্যায়িত করা হয়। শাস্ত্রীয় ব্রত পালন সংক্রান্ত কয়েকটি ব্রতের নাম হলো ব্রাহ্মণব্রত, বামন দ্বাদশী ব্রত, দধি সংক্রান্তি ব্রত, ষোলকলাব্রত, তালনবমী ব্রত, ফসল সংক্রান্তি ব্রত, কলাছড়া ব্রত, ঘৃত সংক্রান্তি ব্রত, মিস্টি সংক্রান্তি ব্রত, দাড়িম্ব সংক্রান্তি ব্রত, ধন-গছানো ব্রত ইত্যাদি। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গবেষণা থেকে উঠে আসছে এগুলো কেবল নৈবেদ্য ও দক্ষিণার লোভ থেকে পূজারীরা সৃষ্টি করেছে।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে নানা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে বাংলার লোকসংস্কৃতি আজ বর্তমান অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। এখন প্রশ্ন হল, বাঙালি কি তাদের লোকসংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবে? এই অবস্থায় শাস্ত্রীয় সংস্কৃতিকে বৃহৎ কর্পোরেট পুঁজির পৃষ্ঠপোষকতা এবং ডিজিটাল মিডিয়াকে ব্যবহার করার মধ্য দিয়ে ভারত ভূখণ্ডে বসবাসকারী বাঙালি যেভাবে নিজস্ব সংস্কৃতির কথা ভুলে উত্তর, মধ্য ও পশ্চিম ভারতীয় ভাষা ও শাস্ত্রীয় সংস্কৃতির তথা ব্রাহ্মণ্য ধর্মের দ্বারা পৃষ্ঠপোষিত পুরুষকেন্দ্রিক সংস্কৃতিকে আপন করার উদার্য দেখাচ্ছে, তাতে বাঙালির মাতৃকেন্দ্রিক সংস্কৃতির নাভিশ্বাস উঠবে বলে সংস্কৃতি জগতের মানুষজন আশঙ্কা প্রকাশ করছেন।


মন্তব্যসমূহ

📂 আলী হোসেনের জনপ্রিয় প্রবন্ধগুলি

হিন্দু কারা? তারা কীভাবে হিন্দু হল?

হিন্দু কারা? কীভাবে তারা হিন্দু হল? যদি কেউ প্রশ্ন করেন, অমিত শাহ হিন্দু হলেন কবে থেকে? অবাক হবেন তাই তো? কিন্তু আমি হবো না। কারণ, তাঁর পদবী বলে দিচ্ছে উনি এদেশীয়ই নন, ইরানি বংশোদ্ভুত। কারণ, ইতিহাস বলছে পারস্যের রাজারা ‘শাহ’ উপাধি গ্রহণ করতেন। এবং ‘শাহ’ শব্দটি পার্শি বা ফার্সি। লালকৃষ্ণ আদবানির নামও শুনেছেন আপনি। মজার কথা হল আদবানি শব্দটিও এদেশীয় নয়। আরবি শব্দ ‘আদবান’ থেকে উদ্ভূত। সুতরাং তাঁর পদবীও বলছে, তিনিও এদেশীয় নন। ভাষাতত্ত্ব ও নৃতত্ত্বের বিশ্লেষণ বলছে, উচ্চবর্ণের বিশেষ করে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের মানুষদের, উৎসভূমি হল পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চল। তারও আগে ছিল ইউরোপের ককেশাস অঞ্চলে। আসলে এরা (উচ্চবর্ণের মানুষ) কেউই এদেশীয় নয়। তারা নিজেদের আর্য বলে পরিচয় দিতেন এবং এই পরিচয়ে তারা গর্ববোধ করতেন। সিন্ধু সভ্যতা পরবর্তীকালে তারা পারস্যের বিভিন্ন এলাকা থেকে হিন্দুকুশ পর্বতের গিরিপথ ধরে এদেশে অভিবাসিত হয়েছেন। আর মধ্যযুগে এসে এদেরই উত্তরসূরী ইরানিরা (অমিত শাহের পূর্বপুরুষ) অর্থাৎ পারস্যের কিছু পর্যটক-ঐতিহাসিক, এদেশের আদিম অধিবাসীদের ’হিন্দু’ বলে অভিহিত করেছেন তাদের বিভিন্ন ভ্রমণ বৃত্তান্তে।

রবীন্দ্রনাথের ধর্মভাবনা ও তার বিবর্তন

রবীন্দ্রনাথের ধর্মভাবনা ও তার বিবর্তন আলী হোসেন  যদি প্রশ্ন করা হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ধর্ম কী? মনে হয় অনেকেই ঘাবড়ে যাবেন। কেউ বলবেন, তাঁর বাবা যখন ব্রাহ্ম ছিলেন তাহলে তিনি নিশ্চয়ই ব্রাহ্ম। যারা লেখাপড়া জানেন না, তারা বলবেন, কেন! উনি তো হিন্দু ছিলেন। আবার কেউ কেউ তথ্য সহযোগে এও বলার চেষ্টা করবেন যে, উনি নাস্তিক ছিলেন; না হলে কেউ বলতে পারেন, ধর্মমোহের চেয়ে নাস্তিকতা অনেক ভালো? ¹ রবীন্দ্রনাথের ধর্ম ভাবনার বিবর্তন  তাহলে সঠিক উত্তরটা কী? আসলে এর কোনোটাই সঠিক উত্তর নয়। চিন্তাশীল মানুষ-মাত্রই সারা জীবন ধরে ভাবেন, ভাবতে ভাবতে তাঁর উপলব্ধি বাড়তে থাকে ক্রমশঃ প্রগতির পথে। জগৎ ও জীবন থেকে তথ্য সংগ্রহ করে একে একে গড়ে তোলেন নিত্যনতুন জীবনদর্শন। তাই এ ধরনের মানুষ আজীবন এক এবং অখণ্ড জীবনদর্শনের বার্তা বহন করেন না। সময়ের সাথে সাথে পাল্টে যায় তাঁর পথচলার গতিমুখ। মানুষ রবীন্দ্রনাথও তাই পাল্টে ফেলেছেন তাঁর জীবন ও ধর্মদর্শন সময়ের বয়ে যাওয়াকে অনুসরণ করে। রবীন্দ্রনাথ ও  হিন্দু জাতীয়তাবাদ ১৮৬১ সালের ৭ই মে সোমবার রাত্রি ২টা ৩৮ মিনিট ৩৭ সেকেন্ডে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে জন্ম গ্রহণ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এর

সীমান্ত আখ্যান, বাঙালির আত্মানুসন্ধানের ডিজিটাল আখ্যান

সময়ের সঙ্গে সমস্যার চরিত্র বদলায়। কিন্তু মুলটা বদলায় না। যদি সে সমস্যা ইচ্ছা করে তৈরি হয়ে থাকে বিশেষ সুবিধা ভোগেই লোভে, তবে তো অন্য কথা চলেই না। স্বনামধন্য স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাতা সৌমিত্র দস্তিদারের ডকুমেন্টারি ফিল্প 'সীমান্ত আখ্যান' দেখার পর এই উপলব্ধি মাথা জুড়ে ঘুরপাক খাচ্ছে। দেখলাম, দেশ ভাগ হয়েছে। কিন্তু সমস্যার অবসান হয়নি। শুধু সমস্যার চরিত্রটা পাল্টেছে। এই যে সমস্যা রয়ে গেল, কোন গেল? তার উত্তর ও পাওয়া গেল 'সীমান্ত আখ্যান' এ। আসলে দেশ ভাগ তো দেশের জনগণ চাননি, চেয়েছেন দেশের নেতারা। চেয়েছেন তাঁদের ব্যক্তিগত, সম্প্রদায়গত সুবিধাকে নিজেদের কুক্ষিগত করার নেশায়। আর এই নেশার রসদ যোগান দিতে পারার নিশ্চয়তা নির্ভর করে রাজনৈতিক ক্ষমতার লাগাম নিজের হাতে থাকার ওপর। তাই রাজনীতিকরা এই ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য জনগণকে 'ডিভাইড এন্ড রুল' পলিছি দ্বারা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চেষ্টা করেছেন এবং করে চলেছেন। এ সমস্যা নতুন না, ব্রিটিশ সরকার এর বীজ রোপণ করে গেছেন, এখন কেউ তার সুফল ভোগ করছে (রাজনীতিকরা) আর কেউ কুফল (জনগন)। 'সীমান্ত আখ্যান চোখে আঙুল দিয়ে দে

ভাগ্য : মুসলিম মনস্তত্ত্ব, ধর্মদর্শন ও প্রগতি

ভাগ্য : মুসলিম মনস্তত্ত্ব, ধর্মদর্শন ও প্রগতি - লিখছেন আলী হোসেন  কপালের লেখন খণ্ডায় কার সাধ্য? জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে কিংবা লেখাপড়া জানা-নাজানা নির্বিশেষে সমস্ত মানুষের সিংহভাগই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এই কথাটা মেনে নেয়। জীবনের উত্থান-পতনের ইতিহাসে কপালের লেখনকে জায়গা করে দিতে তারা কুণ্ঠাবোধ করে না। বরং বলা ভালো এব্যাপারে তারা অতিমাত্রায় উদার। মানুষের মনস্তত্বের এ-এক জটিল স্তর বিন্যাস। একই মানুষ বিভিন্ন সময়ে একই বিষয়ের বিচার বিশ্লেষণে ভিন্নভিন্ন দৃষ্টিকোণ ব্যবহার করে। এ রকমই একটি দৃষ্টিকোণ হলো কপাল বা ভাগ্যের ভূমিকাকে সাফল্যের চাবিকাঠি বলে ভাবা। কখনও সে ভাগ্যের নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠার চেষ্টা করে, আবার কখনও নিজেই ভাগ্যের কাছে নির্দিধায় আত্ম সমর্পন করে। নিজের ব্যার্থতার পিছনে ভাগ্যের অদৃশ্য হাতের কারসাজির কল্পনা করে নিজের ব্যার্থতাকে ঢাকা দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে থাকে। মজার কথা, এক্ষেত্রে মুসলিম মানসের মনস্তত্ত্ব কখনও চেতনমনে আবার কখনও অবচেতন মনে উপরওয়ালাকে (আল্লাহকে) কাঠ গড়ায় তোলে বিনা দ্বিধায়। নির্দিধায় বলে দেয়, উপরওয়ালা রাজি না থাকলে কিছুই করার থাকেনা। সাফল্য কিংবা ব্যর্থতা সবই তাঁর (আল্লার

কাশ্মীর ফাইলস : প্রপাগান্ডার এক নয়া ব্রান্ড, কর্পোরেট পুঁজি ও রাজনৈতিক দলের গলাগলির এক সুচারু প্রদর্শনী

কাশ্মীর ফাইলস : প্রপাগান্ডার এক নয়া ব্রান্ড, কর্পোরেট পুঁজি ও রাজনৈতিক দলের গলাগলির এক সুচারু প্রদর্শনী রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয় উলুখাগড়ার প্রাণ যায়। ১৯৪৭ সালের পর থেকে জম্মু ও কাশ্মিরের জনগণের ভাগ্যলিপিতে লেখা হয়ে গেছে এই বিখ্যাত প্রবাদটির বিস্তারিত সারাৎসার। একদিকে পাকিস্তান আর অন্যদিকে ভারত – এই দুই প্রতিবেশি দেশের ভুরাজনৈতিক স্বার্থের যাঁতাকলে পড়ে তাদের এই হাল। কিন্তু কেন এমন হল? এই প্রশ্নের উত্তর জানে না এমন মানুষ ভুভারতে হয়তো বা নেই। কিন্তু সেই জানার মধ্যে রয়েছে বিরাট ধরণের ফাঁক। সেই ফাঁক গলেই ঢুকেছে কাশ্মির ফাইলসের মত বিজেপির রাজনৈতিক ন্যারেটিভ যা তারা বহুকাল ধরে করে চলেছে অন্য আঙ্গিকে। এবার নতুন মাধ্যমে এবং নবরূপে তার আগমন ঘটেছে, যায় নাম সিনেমা বা সেলুলয়েড প্রদর্শনী। যদিও ডিজিটাল মাধ্যমে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সৌজন্যে অনেক আগেই সফলভাবে তারা এই ন্যারেটিভ দিয়ে বিভাজনের রাজনীতি করে চলেছে বেশ কয়েক বছর ধরে। টেলিভিশন সম্প্রচারে কর্পোরেট পুজির অনুপ্রবেশের মাধ্যমে যার সূচনা হয়েছিল। রাষ্ট্রশক্তিকে কুক্ষিগত করতে না পারলে দেশের সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রন আনা সম্ভব নয়, একথা সাধারণ নিরক্ষর নাগরিক এবং ত

শিক্ষা কী, কেন প্রয়োজন এবং কীভাবে অর্জন করা যায়?

শিক্ষা কী, কেন এবং কীভাবে অর্জন করতে হয়? সূচিপত্র : What is education, why it is needed and how to achieve it শিক্ষা কী শিক্ষা হল এক ধরনের অর্জন, যা নিজের ইচ্ছা শক্তির সাহায্যে নিজে নিজেই নিজের মধ্যে জমা করতে হয়। প্রকৃতি থেকেই সেই অর্জন আমাদের চেতনায় আসে। সেই চেতনাই আমাদের জানিয়ে দেয়, জগৎ ও জীবন পরিচালিত হয় প্রকৃতির কিছু অলংঘনীয় নিয়ম-নীতির দ্বারা। গভীর পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ শক্তিকে বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে কাজে লাগালেই এই নিয়মনীতিগুলো আমাদের আয়ত্বে আসে। এই নিয়ম-নীতিগুলো জানা এবং সেই জানার ওপর ভিত্তি করেই জগৎ ও জীবনকে সর্বোত্তম পর্যায়ে পৌঁছে দেয়ার পথ খুঁজে বের করার শক্তি অর্জনই শিক্ষা। মনে রাখতে হবে, এই শিক্ষা কখনও কারও মধ্যে জোর করে ঢুকিয়ে দেওয়া যায় না। এখন প্রশ্ন হল, শিক্ষা অর্জনের বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিটা আসলে কী। সেই আলোচনায় যাওয়ার আগে জানতে হবে, এই শিক্ষার সূচনা হয় কখন এবং কীভাবে? শিক্ষার সূচনা কখন হয় : এই অর্জনের সূচনা হয় মাতৃগর্ভে এবং তা প্রাকৃতিক ভাবেই। প্রকৃতির দেওয়া কিছু সহজাত শিক্ষাকে অবলম্বন করেই তার সূচনা। এই সহজাত শিক্ষাকে অবলম্বন করেই মানুষ তার পরবর্তী প

জল, না পানি : জল নিয়ে জলঘোলা করা পানির মত সহজ নয়

জল নিয়ে জলঘোলা করা পানির মত সহজ নয় আলী হোসেন  সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত সরকারি অনুষ্ঠানে চিত্র শিল্পী শুভাপ্রসন্ন ভট্টাচার্য পানি শব্দকে বাংলা নয় বলে দাবি করেছেন। বলেছেন, "আমরা কোনোদিন কখনও বাংলা ভাষায় পানি (শব্দটা) ব্যবহার করি না"। শুধু তা-ই নয়, পানি শব্দের ব্যবহারের মধ্যে তিনি 'সাম্প্রদায়িকতার ছাপ'ও দেখতে পেয়েছেন। প্রশ্ন হল - এক, এই ভাবনা কতটা বাংলা ভাষার পক্ষে স্বাস্থ্যকর এবং কতটা 'বাংলা ভাষার ইতিহাস' সম্মত? দুই, জল বা পানি নিয়ে যারা জলঘোলা করছেন তারা কি বাংলাকে ভালোবেসে করছেন? মনে হয় না। কারণ, খোঁজ নিলে দেখা যাবে, এরা কেউ নিজের সন্তানকে বাংলা মিডিয়াম স্কুলে পড়াননি বা পড়ান না। ব্যবহারিক জীবনেও তারা বাংলার ভাষার চেয়ে ইংরেজি বা হিন্দিতে কথা বলতে বা গান শুনতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন, বলা ভালো গর্ববোধ করেন। প্রসংগত মনে রাখা দরকার, বাংলা মিডিয়াম স্কুলগুলোতে যারা ভর্তি হয়, তারা অধিকাংশই গরীব ঘরের সন্তান। বলা ভালো, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে তারাই বাংলা ভাষাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। কারণ, সন্তানকে বাংলা মিডিয়ামে পড়ানোর পাশাপাশি, বা

নিম্নবর্গের মানুষ মার খাচ্ছে কেন

নিম্নবর্গের মানুষ কীভাবে পিছিয়ে পড়েছেন? সমাধান কীভাবে? এদেশের নিম্নবর্গের মানুষ নিজেদের বাঁচাতে যুগ যুগ ধরে ধর্ম পরিবর্তন করেছে। কখনও বৌদ্ধ (প্রাচীন যুগ), কখনও মুসলমান (মধুযুগ), কিম্বা কখনো খ্রিস্টান (আধুনিক যুগ) হয়েছে। কিন্তু কখনই নিজেদের চিন্তা-চেতনাকে পাল্টানোর কথা ভাবেনি। পরিবর্তন হচ্ছে অলংঘনীয় প্রাকৃতিক নিয়ম। যারা এই নিয়ম মেনে সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে পারে, তারাই লাভবান হয়, টিকে থাকে। “পাল্টে গেলেই জীবন বাড়ে না পাল্টালে নয়, জীবন মানেই এগিয়ে যাওয়া নইলে মৃত্যু হয়” জীবনের এই চরম সত্য তারা অধিকাংশই উপলব্ধি করতে পারেনি। পৃথিবীর যেকোন উন্নত জাতির দিকে তাকান, তারা দ্রুততার সঙ্গে এই পরিবর্তনকে মেনে নিজেদেরকে পুনর্গঠন করে নিয়েছে। যারা পারেনি বা নেয়নি তারাই মার খাচ্ছে, অতীতেও খেয়েছে। বুদ্ধিমান জাতি নিজের দুর্বলতাকে মেনে নেয় এবং ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য সময়ের সঙ্গে তাল রেখে নিজেদের চিন্তা এবং চেতনায় পরিবর্তন আনে। খ্রিষ্টান, ইহুদি-সহ এশিয়া, ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন জাতি - যারাই এই পরিবর্তন মেনে নিয়েছে তারাই আরও উন্নত এবং শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। মহানবীর (সঃ) গৌরবময় উত্থান (যা এক ধরণ

আধুনিক মিডিয়া : কর্পোরেট পুঁজির (পুঁজিপতিদের) তোতাপাখি

গোদি মিডিয়া : কর্পোরেট পুঁজির তোতাপাখি পশ্চিমী মিডিয়াকে 'ইসরাইল সরকারের তোতাপাখি' নামে পরিচয় দেওয়া হয় সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী স্বাধীন ও নিরপেক্ষ মিডিয়া হাউজের পক্ষ থেকে। সম্প্রতি একইভাবে ভারতীয় কর্পোরেট মিডিয়া ভারত সরকার তথা 'কর্পোরেট পুঁজির  তোতাপাখি' হিসাবে পরিচয় পাচ্ছে, যাকে নিন্দুকেরা 'গোদী মিডিয়া' নামে অভিহিত করে থাকে। মধ্যপ্রাচ্যের ঘটনা সম্পর্কে ইসরাইল যা বলে, ইউরোপ ও আমেরিকার মিডিয়া, তোতা পাখির মতো তা-ই প্রচার করে। সাংবাদিকতার প্রধান প্রধান শর্তগুলোকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ইসরাইলের দেওয়া তথ্যই তারা প্রচার করে অন্ধ ও নির্লজ্জভাবে। ভারতের ক্ষেত্রেও করপোরেট মিডিয়া বর্তমানে সেটাই করছে বলে অভিযোগ। অভিযোগ, নত মস্তকে ভারত সরকারের দেওয়া তথ্য বিনা বিচারে প্রচার করে চলেছে অধিকাংশ মিডিয়া হাউজ।  অর্থাৎ তাদের সম্প্রচারিত খবরের বড় অংশই হয় নিয়ন্ত্রিত অথবা কখনও কখনও অসত্য - এমন দাবিও করা হয়।  আসলে সিংহভাগ মিডিয়ার মালিক হচ্ছেন এক-একজন  করপোরেট পুঁজির মালিক বা পুঁজিপতি। এরা কি কখনও নিজের স্বার্থের বিরুদ্ধে যায় - এমন খবর, তথ্য বা তত্ত্ব প্রচার করবে? করবে না, করেও না। আর এ

সংখ্যালঘুর মুখই গণতন্ত্রের আয়না

  সংখ্যালঘুর মুখই গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় এবং শক্তিশালী আয়না। The face of the minority is the mirror of democracy কোন দেশ কতটা গণতান্ত্রিক, তা বোঝা যায় সে দেশের সংখ্যালঘু মানুষের জীবন ও সম্পত্তির সুরক্ষা কতটা মজবুত, তা থেকে। কারণ, সংখ্যালঘুর মুখই হচ্ছে গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় এবং শক্তিশালী আয়না। সংখ্যালঘুরা সঙ্গত কারণেই সংখ্যাগরিষ্ঠদের চেয়ে বেশি বঞ্চনাজনিত মনস্তাত্ত্বিক চাপে থাকে। এই চাপ দু’ভাবে তৈরি হয়। ১) সংখ্যাগিষ্ঠতাজনিত সুবিধা যা সংখ্যাগুরুরা পায়, সংখ্যালঘুরা কখনই তা পায় না বা পাবে না - এই ধারণা, যার কিছুটা হলেও ভিত্তি রয়েছে ২) সংখ্যাগরিষ্ঠদের মধ্যে বৃহত্তম (?) জনগোষ্ঠীর অংশ হওয়ার সুবাদে যে কর্তৃত্ববাদী মানসিকতা তৈরি হয় এবং যা বহুজনের মধ্যে দৃষ্টিকটুভাবে প্রকাশ হয়ে পড়ে, তার ভয়ে। এই চাপ কতটা গভীর তা সংখ্যালঘু ছাড়া বোঝা খুব মুশকিল। তবে আলোকপ্রাপ্ত মানুষ মাত্রই যে তা উপলব্ধি করতে পারেন, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। এই ধরণের চাপ তৈরি করে কিছু অসাধু মানুষ যখন সংখ্যালঘুদের জীবন ও সম্পত্তির সামনে হুমকি হয়ে দাঁড়ায়, তখন তা কমানোর ক্ষমতা একমাত্র গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রশক্তির হাতেই থাকে