বাংলার লোকসংস্কৃতির বিবর্তন : মাতৃতান্ত্রিকতা থেকে পুরুষতান্ত্রিকতা
Evolution of folk culture of Bengal
পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাবের প্রাথমিক লগ্নে মানুষ ছিল খাদ্য সংগ্রাহক। খাদ্য উৎপাদনের কৌশল সে জানতো না। তাই একজন মানুষের সঙ্গে একটা পশুর জীবনধারণের তেমন কোন মৌলিক পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যেত না। এই সময় পশুর ধর্ম ছিল পশুত্ব আর তার সংস্কৃতির নাম ছিল ‘খাদ্য সংগ্রাহক’।কোন পশুই তার ধর্ম এবং সংস্কৃতিকে পরিবর্তন বা বিবর্তন ঘটাতে পারেনি। কিন্তু মানুষ পেরেছে। সংস্কৃতির আধুনিক সংজ্ঞা অনুযায়ী, তাই পশুর সেই অর্থে কোন সংস্কৃতি নেই, কিন্তু মানুষের,আগে না থাকলেও, এখন আছে।
সংস্কৃতি কী?
সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষের জ্ঞানচক্ষু উন্মোচিত হয়। চিন্তা চেতনায় আসে আমূল পরিবর্তন। ক্রমশ জন্ম নেয় তার একটি যুক্তিবাদী মন। সেই মন তাকে ভাবতে বাধ্য করে, তার অস্তিত্বের সংকট ও সম্ভাবনা সম্পর্কে। ভাবতে বাধ্য করে, বেঁচে থাকাকে আরো নিরাপদ ও সুন্দর করে গড়ে তোলার উপায় কী? এই উপায় খুঁজতে গিয়েই মানুষ জন্ম দিয়েছে তার সংস্কৃতির।
সংস্কৃতির জন্ম কীভাবে?
জগৎ ও জীবনকে আরও নিরাপদ ও সুন্দর করে গড়ে তোলার জন্য প্রথমেই সে বের করে নতুন নতুন কৌশল। তারপর শুরু করে সেই কৌশলকে আরও উন্নত এবং কার্যকরী করে তোলার অক্লান্ত চেষ্টা। ফলে সময়ের সাথে সাথে পাল্টে যায় তার সেই কৌশলের ধরণ। পাল্টে যাওয়া কৌশল পায় নতুন নাম। জন্ম হয নতুন সংস্কৃতির।
মানব সভ্যতার শুরুতেই মানুষের সাংস্কৃতির নাম ছিল ‘খাদ্য সংগ্রাহক’। হাত, পা, চোখ, কান-সহ তার পঞ্চ ইন্দ্রিয়ই ছিল তাঁর হাতিয়ার। তারপর ক্রমান্বয়ে গাছের ডালপালা হয়ে পাথরের টুকরো'য় এসে পৌঁছয় মানুষ। হাতিয়ার হিসেবে বেছে নেয় পাথরের টুকরোকে এবং নতুন জীবিকায় যোগ হয় পশু শিকার। এভাবেই মানুষ তার জীবনের নিরাপত্তাকে বাড়াতে জন্ম দেয় প্রস্তর সংস্কৃতির। ইতিহাসের পাতায় আমরা তাকে প্রস্তরযুগীয় সংস্কৃতি বলে অভিহিত করি।
এভাবেই যুগ যুগ ধরে মানুষের সংস্কৃতির বিবর্তন ঘটেছে। কৃষির আবিষ্কারের সাথে সাথে মানুষ খাদ্য সংগ্রাহকের সংস্কৃতি ত্যাগ করে খাদ্য উৎপাদক বা কৃষি সংস্কৃতির জন্ম দেয়। এভাবে - আগুন, ধাতু, জীবাশ্ম জ্বালানির স্তর পার হয়ে আজ ডিজিটাল প্রযুক্তিকে মাধ্যম করে মানুষ আরও এক নতুন ও অত্যাধুনিক ডিজিটাল সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে। মানুষের জীবনকে পৌঁছে দিয়েছে একটি উন্নততর পর্যায়ে।
সুতরাং সংস্কৃতি হল বিভিন্ন প্রাকৃতিক উপাদানকে ব্যবহার করে গড়ে তোলা এক ধরণের মৌলিক জীবন-কৌশল বা জীবনবোধ যা মানুষ যুগ যুগ ধরে বিবর্তনের বিভিন্ন পর্যায় পেরিয়ে ক্রমশ উন্নত থেকে উন্নততর পর্যায়ে পৌঁছানোর চেষ্টা করে। মনে রাখতে হবে, এই জীবন-কৌশল বা জীবন-বোধ মানুষের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রকে (সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্ম, ভাষা, বিনোদন ইত্যাদি) ছুঁয়ে যায় এবং তাকে নিয়ন্ত্রণ করে।
বাংলা ও বাঙালির লৌকিক সংস্কৃতি
সংস্কৃতির এই পরিবর্তন বা বিবর্তন মানুষের জীবনের সঙ্গে সঙ্গে জগতের ভৌগোলিক তথা প্রাকৃতিক পরিবেশের দ্বারা পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়। কারণ, মাটি, জল, হাওয়া ইত্যাদি প্রাকৃতিক পরিবেশের এই উপাদানগুলিও মানুষের জীবনের মান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এক কথায়, এগুলোর দ্বারা মানুষের জীবনের নিরাপত্তা ও সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার প্রক্রিয়াটি নিয়ন্ত্রিত হয়।
তাই ভিন্ন ভিন্ন জল হওয়ায় এবং ভিন্ন ভূ-প্রাকৃতিক অবস্থানের কারণে মানুষের জীবনধারণের উপাদান ও তাকে ব্যবহার করার কৌশল ভিন্ন ভিন্ন রকমের হয়। তাই পৃথিবীব্যাপী ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির অবস্থান আমরা টের পাই।
স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের নদী বিধৌত ও উর্বর পলিগঠিত ভূপ্রকৃতি এবং মৌসুমী জলবায়ুর প্রভাবে এখানকার মানুষের মধ্যে জন্ম নিয়েছিল এক বিশেষ ধরণের কৃষি ভিত্তিক জীবন বোধ বা জীবন কৌশল। অবিভক্ত বাংলাদেশের সেই ভৌগোলিক পরিচয়কে সামনে রেখে আমরা তাকে ‘বাংলা বা বাঙালির সংস্কৃতি’ নামে অভিহিত করে থাকি।
সংস্কৃতির বিবর্তন :
সংস্কৃতিকে আমরা দুটি ধারায় ক্রিয়াশীল থাকতে দেখি। একটি শাস্ত্রীয় ধারা। অন্যটি লোক-ধারা। প্রসঙ্গগত মনে রাখা দরকার, ধর্মের সঙ্গে সংস্কৃতির সম্পর্ক গভীর। সে কারণেই শাস্ত্রীয় ধারায় রয়েছে শাস্ত্রীয় ধর্মের গভীর প্রভাব। আর লোক-ধারায় রয়েছে লৌকিক ধর্মের। অর্থাৎ শাস্ত্রীয় ধর্মের অনুসারী মানুষের জীবনধারণের প্রতিটি ক্ষেত্রকে ছুঁয়ে যায় শাস্ত্রীয় ধর্মের নানান আচার-বিচার, রীতিনীতি বা নিয়ম-কানুন। অন্যদিকে লৌকিক ধর্মের অনুসারীদের জীবনবোধকে প্রভাবিত করে লৌকিক ধর্মের নানার আচরণ অনুষ্ঠান ও রীতিনীতি।
লক্ষণীয় বিষয় হল, বাংলার মাটিতে কোন শাস্ত্রীয় ধর্মের আবির্ভাব ঘটেনি। শাস্ত্রীয় ধর্মের যে প্রভাব আমরা এখানে দেখি তা মূলত বহিরাগত আর্য ও ইসলামিক সংস্কৃতির প্রভাব। আর্যদের ভারত আগমনের বহু পরে তা বাংলার মাটিতে প্রবেশ করে। তাই শাস্ত্রীয় ধর্ম বাংলাদেশে বহিরাগত। স্বাভাবিক কারণেই আর্যপূর্ব কাল থেকেই বাংলাদেশের মানুষ নিজস্ব ধর্ম ও সংস্কৃতি ধারণ করে আসছে, যা ‘বাংলার লোকসংস্কৃতি’ নামে পরিচিত। এই সংস্কৃতি, তাই নানা আচার-বিচার, শাস্ত্রীয় মন্ত্র কিংবা যাগযজ্ঞের ভারে ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠেনি। আর্য সংস্কৃতির এই সমস্ত বৈশিষ্ট্য প্রকটভাবে লক্ষ্য করা যায়, উত্তর, মধ্য ও পশ্চিম ভারতে। সে কারণ এখানে আলোচ্য নয়।
আর বাংলাদেশে বাঙালির নিজস্ব লৌকিক ধর্মমতগুলো বাংলার উর্বর মাটিতে ফসলের মত বেড়ে উঠেছে এবং তাতে পুষ্টি জুগিয়েছে বাঙালির নিজস্ব জীবনমুখী সহজ সরল ইহলোককেন্দ্রিক যৌথ-জীবন দর্শন। তাই বাঙালির লৌকিক ধর্মকে না বুঝলে বাঙালির লোকসংস্কৃতি ও দর্শনকে বোঝা যাবে না। শাস্ত্রীয় ধর্মের কঠিন আচার বিচার, মন্দির মসজিদকেন্দ্রিক পূজা বা উপাসনা, জাতিভেদ ইত্যাদিকে নিঃসংকচে ত্যাগ করে বেড়ে উঠেছে বাঙালির লৌকিক ধর্ম। এই ধর্মে পুজোর মন্দিরের চেয়ে ‘হৃদয় মন্দিরে’র গুরুত্ব বেশি। কাগজের শাস্ত্র অপেক্ষা ‘দেল-কেতাব’ চর্চার গুরুত্ব বেশি।
বাংলার এই নিজস্ব লৌকিক ধর্ম ও সংস্কৃতির কারণে বৈদিক ব্রাহ্মণ্য ধর্মশাস্ত্রগুলোতে বাংলাদেশের মানুষদের পরিচয় দিতে গিয়ে নিন্দাসূচক শব্দবন্ধ ব্যবহার করা হয়েছে। বাংলার অধিবাসীদের ‘মহাভারতে ম্লেচ্ছ, ভাগবত পুরাণে ‘পাপ কোম’, এবং ‘ঐতরেয় ব্রাহ্মণ’ গ্রন্থে ‘দস্যু’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। বৌদ্ধ ‘আর্য মঞ্জুশ্রী মূলকল্প’ গ্রন্থে বাঙালির ভাষাকে ‘অসুর’ ভাষা এবং ‘ঐতরেও আরণ্যকে’ এই অঞ্চলের ভাষাকে পাখির ভাষার (দুর্বোধ্য) সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। এমনকি বহিরাগত মুসলমানরাও বাংলা সম্পর্কে অবজ্ঞা ও উন্নাসিকতা প্রকাশ করেছে। তারা এই এলাকাকে ‘দার উল হারব’ বা বসবাসের অযোগ্য ও অশান্তির এলাকা বলে চিহ্নিত করেছে। স্বাভাবিকভাবেই এখানকার মানুষরা শাস্ত্রীয় ধর্মের বিধি-বিধান অর্থাৎ শাস্ত্রীয় ধারার সংস্কৃতিকে বিনা প্রতিরোধে গ্রহণ করেনি। বিভিন্ন সময় (যেমন বল্লাল সেনের সময় ব্রাহ্মণ্য ধর্ম) রাজানুকূল্য পাওয়া বাইরের ধর্মসংস্কৃতির নির্যাসকে নিজস্ব ভাব ও সংস্কৃতির জারক রসে জারিত করে নিজের ঘরের জিনিস বানিয়ে গ্রহণ করেছে। ফলে বাংলার লোকসংস্কৃতি তার নিজস্বতা সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেলেনি। অর্থাৎ বাংলার লোকসংস্কৃতি বিবর্তনের মধ্য দিয়ে এলেও নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রেখেছে। বাঙালির লৌকিক ধর্ম, বিশেষ করে নাথধর্ম, সহজযান, মন্ত্রযান, সহজিয়া বাউল, সহজিয়া বৈষ্ণব, লৌকিক সূফীবাদ, সাংখ্য, যোগ ইত্যাদি এই সংস্কৃতিকে পুষ্ট করে রেখেছে।
উল্লেখ্য, শাস্ত্রীয় ধর্মের প্রতি রাষ্ট্রীয় আনুকুল্য, পুঁজির পৃষ্ঠপোষকতা ইত্যাদিকে উপেক্ষা করে নিজের অস্তিত্বকে কতদিন টিকিয়ে রাখতে পারবে, সে বিষয়ে প্রশ্ন চিহ্ন উঠতে শুরু করেছে। কারণ, এই দুই আনুকূল্য বর্তমান সময়ে শাস্ত্রীয় ধর্ম ও সংস্কৃতিকে অনেকটাই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এগিয়ে রাখছে। ডিজিটাল প্রযুক্তি এক্ষেত্রে শাস্ত্রীয় ধর্মের প্রচারকদের প্রধান অস্ত্র হয়ে উঠেছে যা লৌকিক ধর্মের অনুসারীদের প্রায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। কেন বাইরে সে কথায় পরে আসছি।
দেবতা নয়, দেবীর প্রাধান্য:
অসংখ্য নদ, নদী শিরা-উপশিরার মত ছড়িয়ে আছে সারা বাংলা জুড়ে। এই নদীবাহিত পলি দ্বারা গঠিত উর্বর মাটি উৎপাদিকা শক্তিতে ভরপুর। ঠিক যেন নারীর সন্তান উৎপাদনের শক্তির মতো। স্বাভাবিকভাবেই বাঙালির লৌকিক সংস্কৃতিতে নারী পেয়েছে মায়ের মর্যাদা। বাংলাদেশে তাই নারী আর প্রকৃতি সমানভাবে গুরুত্ব পায় এবং পুজিত হয়। লৌকিক ধর্ম ও সংস্কৃতিতে নারী দেবতার প্রাধান্য তাই চোখে পড়ার মতো। বাংলার সাধারন মানুষের আরাধ্য দেবতারা সবাই দেবীরূপে কল্পিত হয়। শাস্ত্রীয় ধর্মগুলোর বিকাশ পুরুতান্ত্রিক সমাজে হলেও প্রাক-আর্য বাংলায় ধর্ম ও দর্শন চিন্তা বিকাশ লাভ করেছিল মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার মধ্যেই। তাই পরবর্তীকালে পৌরাণিক ধর্মে মাতৃ দেবীর প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়, যা বৈদিক যুগে ছিল না। সেখানে ছিল পুরুষ দেবতার আধিপত্য।
এ কারণেই বাংলার কর্তা ভজা, লৌকিক বৈষ্ণব, আউল বাউল সম্প্রদায়ের মধ্যে নারী বিশেষ মর্যাদায় সু প্রতিষ্ঠিত। বাউল সাধন তত্ত্বের সাধনায় একজন বাউল তাই নির্দ্বিধায় বলতে পারে -
“মেয়ের চরণ নেরে মাথায় করে।
মেয়ে বিনে এ ভবনে গতি নাইরে।।”
লৌকিক তন্ত্রশাস্ত্র নির্দ্বিধায় নিদান দিতে পারে :
“স্ত্রী গুরুর কাছে মন্ত্র গ্রহণ করলে শুভ ফল হয়। মায়ের কাছে মন্ত্র গ্রহণে আট গুণ অধিক ফল হয়।”
শুধু তাই নয় বাংলার লোকসংস্কৃতির অন্দরে উকি মারলে সেখানেও নারীর একচেটিয়া প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। বাঙালির ব্রত অনুষ্ঠানগুলোতে আমরা তা-ই লক্ষ্য করি। বাঙালি মেয়েরা স্বামী সন্তান সহ সমগ্র পরিবারের মঙ্গল ও সমৃদ্ধি কামনায় নিষ্ঠার সঙ্গে ব্রত পালন করে, যা বাঙালির পারিবারিক জীবনকে দিয়েছে বিশিষ্টতা এবং সংসার জীবনকে করে তুলেছে মাধুর্যময়।
এই ব্রত অনুষ্ঠানগুলোর জন্ম বাংলাদেশের আদিম সমাজে। জাদুবিদ্যা বা ইন্দ্রজালের আবাহ তৈরি করার মধ্য দিয়ে অতিপ্রাকৃতিক বা প্রাকৃতিক শক্তিকে বশ করার চেষ্টা থেকে এর জন্ম। আর্চার টেলারের কথা অনুযায়ী জাদুবিদ্যা হল অতিপ্রাকৃতিক শক্তিকে বশ করার এবং অতিপ্রাকৃত উপায়ে প্রকৃতিকে জানা বোঝা ও জয় করার কৌশল। লোকসংস্কৃতির গবেষক মফিজুর রহমান রুন্ নু এই যাদু বিদ্যাকে বিজ্ঞানের আদিম অবস্থা বলে বর্ণনা করেছেন। কারণ এখানে প্রকৃতিকে জানা বোঝা ও জয় করার অদম্য ইচ্ছা শক্তি কাজ করে। কোন কিছুতে দেবত্ব আরোপ করে তার পায়ে মাথা নিচু করে আবেদন নিবেদনের কোন চেষ্টা এখানে দেখা যায় না, যা প্রাতিষ্ঠানিক বা শাস্ত্রীয় ধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। প্রাতিষ্ঠানিক বা শাস্ত্রীয় সংস্কৃতির মধ্যে যেখানে ভক্তি ও আত্মসমর্পণই মূল কথা, সেখানে লৌকিক সংস্কৃতির মধ্যে থাকা যাদু বিদ্যা বা ইন্দ্রজালে আত্মসমর্পণের কোন প্রশ্নই নেই। এখানে দলবদ্ধভাবে যাদু অনুষ্ঠানের মাধ্যমে যৌথ প্রচেষ্টায় প্রকৃতিকে জয় করে নিজেদের জীবনের নিরাপত্তা বিধান করার তাগিদ দৃঢ়ভাবে ফুটে ওঠে। এখানে কোন পুরোহিত লাগেনা,লাগেনা কোন মাওলানা কিম্বা মৌলবি ।
কৃষি আবিষ্কারের ফলে প্রাকৃতিক সম্পদকে কিছু মানুষ নিজেদের দখলে রাখার চেষ্টা করলে, মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির যে বশে আনার লড়াই, তার অভিমুখ পাল্টে যায়। যাদুবিদ্যা বা ইন্দ্রজালের মাধ্যমে প্রকৃতিকে নিজের ইচ্ছা পূরণে বাধ্য করার ধারণার সাথে জুড়ে যায় কিছু শ্রমবিমুখ বুদ্ধিমান অসাধু মানুষের কাছে অর্জিত সম্পদ না হারানোর লড়াই। এই লড়াইয়ে যাদুবিদ্যা অকার্যকর হয়ে পড়ে। কারণ, প্রকৃতির সঙ্গে যে লড়াই তা ছিল ছায়ার সঙ্গে লড়াই। এ লড়াইয়ে ছিল প্রাপ্তি আর অপ্রাপ্তি নিরাপদ কাহিনী। কিন্তু শ্রমবিমুখ মানুষের সঙ্গে লড়াইয়ে এই দুটোর বাইরে ছিল সব হারানোর ভয়। অসহায় সাধারণ মানুষ তাই এই কর্মবিমুখ বুদ্ধিমান (পড়ুন চালাক) মানুষের তৈরি শাস্ত্রীয়ধর্মকে আঁকড়ে ধরে বাঁচার চেষ্টা করে। আর সুন্দর পরকালের আশ্বাসে জীবনমৃত্যুকে পায়ের ভৃত্য করতে বাধ্য হয়।
এভাবে আদিম যাদুবিদ্যা নির্ভর সংস্কৃতি গুরুত্ব হারাতে শুরু করে। তারই কিছু কিছু এখনো আমরা আমাদের সমাজে ধুকপুক করে টিকে থাকতে দেখি। আমাদের ধর্মীয় আচার-আচরণের মধ্যেই তারা মন্ত্রগুপ্তি, তুকতাক, বাণমারা, তাবিজ-মাদুলি গ্রহণের মধ্যে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। কৃষিভিত্তিক সামাজিক পরিবেশের কারণে মেয়েরাই এগুলো বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে ব্রত অনুষ্ঠানের মত আচার অনুষ্ঠানকে সামনে রেখে।
নব্য প্রস্তর যুগের জনসমাজে কৃষি আবিষ্কারের মধ্য উদ্ভিদের ফলন বৃদ্ধি ও প্রজনন সংক্রান্ত বিষয় গুরুত্ব পায়। এক্ষেত্রে মেয়েদের ভূমিকা প্রধান হয়ে দাঁড়ায়। কারণ, মাটির উর্বরতা কামনায় নারী বেশি শক্তিশালী রূপে সমাজের চিহ্নিত হতো। ধরা হতো, মাটি আর নারী উভয়ই উর্বরতার প্রতীক এবং সৃষ্টির মূল চালিকাশক্তি। স্বাভাবিকভাবে প্রকৃতির কাছ থেকে দাবি আদায়ে নারীর সক্ষমতা বেশি ধরে নিয়ে ধরিত্রীর কাছ থেকে দাবি আদায়ের ব্রত অনুষ্ঠান তাদের হাতেই নিবেদিত হয়।
আর্যরা ভারতবর্ষে প্রবেশ করার পর লক্ষ্য করেছিল এখানকার মানুষেরা যাগযজ্ঞ করে না, করে ব্রত পালন। তাই আদিম জনজাতিকে তারা নাম দিয়েছিল অন্যব্রত। বৈদিক সাহিত্যের শেষের দিকে তাই ব্রত কথাটি উল্লেখ থাকতে দেখি। মনুসংহিতায় ভারতের আদি জনসমাজকে সেকারণই ‘ব্রাত্য ক্ষত্রিয়’ বা ব্রতধারী ক্ষত্রিয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
কিন্তু আর্যদের আসার পর বৈদিক ধর্মের চাপে ব্রত অনুষ্ঠানগুলি ক্রমশ হয় বিলুপ্ত হয়েছে, নয়তো চরিত্র পাল্টে গেছে। নীহার রঞ্জন রায় বলছেন, “আমাদের গ্রাম্য সমাজে বিশেষভাবে নারীদের ভিতর যেসব ব্রত আজও প্রচলিত আছে তাহার অধিকাংশই অবৈদিক, অস্মার্ত, অপৌরাণিক ও অব্রাহ্মণ্য এবং মূলত গুহ্য যাদু ও প্রজনন শক্তির পূজা, যে-পূজা গ্রাম্য কৃষি সমাজের সঙ্গে একান্ত সম্পৃক্ত”।
মজার ব্যাপার হলো বৈদিক যুগ থেকে আজ পর্যন্ত হিন্দু ধর্মের পূজো ও নানা রকমের ধর্মানুষ্ঠানের মধ্যে আদিম জাদুর প্রভাব রয়ে গেছে। ম্যাকডোনাল উল্লেখ করেছেন বৈদিক যজ্ঞ অনুষ্ঠানগুলোতে যাদুমূলক উপাদানের উপস্থিতির কথা। শুধু তাই নয় লৌকিক ধর্মের সংস্পর্শে ব্রাহ্মণ্য ধর্মেও অনেক পরিবর্তন ঘটে গেছে। প্রচুর অবৈদিক ও অব্রাহ্মণ্য উপাদান ব্রাহ্মণ্য ধর্মে প্রবেশ করেছে। এই সূত্রেই ব্রত অনুষ্ঠান ব্রাহ্মণ্য ও পৌরাণিক পরিমণ্ডলে ঢুকে পড়ে। এই ধরনের অনুষ্ঠানে ব্রাহ্মণ পুরোহিত এর প্রয়োজন হয়। কিন্তু বাঙালি মেয়েদের একান্ত নিজস্ব যে প্রচুর ব্রত পালনের আচার অনুষ্ঠান রয়েছে, সেখানে মেয়েরাই সব,কোন পুরোহিতের দরকার হয় না।
শুধু ব্রত অনুষ্ঠানই নয় আদিম যাদু বিশ্বাসের প্রভাব রয়েছে লোকসংস্কৃতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে। যেমন বৃষ্টি কামনা, গাজন, মাগন, ফসল কামনা, ব্যাধি নিরাময়, ওঝা বা গুনিনদের উচ্চারিত মন্ত্র, নানা আচার অনুষ্ঠান, প্রথাপার্বণ, মৃতদেহ সৎকার ইত্যাদিতে এই যাদু বিশ্বাসের ছোঁয়া দেখতে পাওয়া যায়। বাংলার কৃষি প্রধান অঞ্চলে এই ধরনের ব্রতকথা পাঠ করতে দেখা যায়।
হাত ধুইয়া দিলাম পানি
ধান হয় যেন শ'মন খানি।
অথবা
আয়রে তরা ভুঁই নিড়াইতে যাই।
ভুঁই মোর গো মাতা-পিতা ভুঁই মোর গো পুত।
ভূঁইর দৌলতে মোর গো আশী কোঠা সুখ।
ওগো সপ্তডিঙা মধুকরে যত ধান্য ধরে
এবার যেন সোনার ধানে আমার গলা ভরে।
লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, শাস্ত্রীয় ব্রতের সঙ্গে লৌকিক ব্রতের বেশ কিছু মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। শাস্ত্রীয় ব্রতে পারলৌকিক সুখের অন্বেষণ করা হয় আর লৌকিক ব্রতের মাধ্যমে পারিবারিক ও সামাজিক; এক কথায় ইহলৌকিক সুখের অন্বেষণ করা হয়। স্বাভাবিকভাবেই সাধারণ খেটে খাওয়া কৃষিভিত্তিক জনজাতি অর্থাৎ বাঙালি লৌকিক ব্রতের প্রতি বেশি আগ্রহ দেখায়। এ ধরনের একটি ব্রতের নাম আদর্শ সিংহাসন ব্রত। এই ব্রত অনুষ্ঠানের জনপ্রিয়তায় ব্রাহ্মণ্য ধর্মে শুরু করা হয় ব্রাহ্মণাদর ব্রত।
এই দুটি ব্রত অনুষ্ঠানের পার্থক্য হল আদর্শ সিংহাসন ব্রততে একজন সধবা নারীকে হাত পায়ের নখ কেটে, সিঁথিতে সিঁদুর দিয়ে, লাল শাড়ি পরিয়ে, নানা রকম উপহার দিয়ে তাকে আপ্যায়ন করা হয়। একজন নারী তার স্বামীর কাছ থেকে যে ধরণের আদর, আপ্যায়ন বা মূল্যায়ন আশা করে, তা-ই এখানে পূরণ করার চেষ্টা হয়। এখানে কোন পুরোহিত লাগেনা। অন্যদিকে ব্রাহ্মণাদর ব্রতে একজন ব্রাহ্মণকে এভাবে আপ্যায়িত করা হয়। শাস্ত্রীয় ব্রত পালন সংক্রান্ত কয়েকটি ব্রতের নাম হলো ব্রাহ্মণব্রত, বামন দ্বাদশী ব্রত, দধি সংক্রান্তি ব্রত, ষোলকলাব্রত, তালনবমী ব্রত, ফসল সংক্রান্তি ব্রত, কলাছড়া ব্রত, ঘৃত সংক্রান্তি ব্রত, মিস্টি সংক্রান্তি ব্রত, দাড়িম্ব সংক্রান্তি ব্রত, ধন-গছানো ব্রত ইত্যাদি। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গবেষণা থেকে উঠে আসছে এগুলো কেবল নৈবেদ্য ও দক্ষিণার লোভ থেকে পূজারীরা সৃষ্টি করেছে।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে নানা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে বাংলার লোকসংস্কৃতি আজ বর্তমান অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। এখন প্রশ্ন হল, বাঙালি কি তাদের লোকসংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবে? এই অবস্থায় শাস্ত্রীয় সংস্কৃতিকে বৃহৎ কর্পোরেট পুঁজির পৃষ্ঠপোষকতা এবং ডিজিটাল মিডিয়াকে ব্যবহার করার মধ্য দিয়ে ভারত ভূখণ্ডে বসবাসকারী বাঙালি যেভাবে নিজস্ব সংস্কৃতির কথা ভুলে উত্তর, মধ্য ও পশ্চিম ভারতীয় ভাষা ও শাস্ত্রীয় সংস্কৃতির তথা ব্রাহ্মণ্য ধর্মের দ্বারা পৃষ্ঠপোষিত পুরুষকেন্দ্রিক সংস্কৃতিকে আপন করার উদার্য দেখাচ্ছে, তাতে বাঙালির মাতৃকেন্দ্রিক সংস্কৃতির নাভিশ্বাস উঠবে বলে সংস্কৃতি জগতের মানুষজন আশঙ্কা প্রকাশ করছেন।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন