বামপন্থা খিল্লি শেখায় না, শেখায় গঠনমূলক সমালোচনা। সমালোচনা সৃষ্টিশীল আর খিল্লি ধ্বংসাত্মক ও বিকারগ্রস্থ মানসিকতার পরিচয় বহন করে। জন্ম দেয় অপসংস্কৃতির, যা বামপন্থার পক্ষে অস্বাস্থ্যকর।
যে প্রক্রিয়ায় মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীকে একাদেমির পুরস্কার দেওয়া হয়েছে, তা হয় তো সমালোচনার উর্ধে নয়। ‘হয় তো’ বলছি এই কারণে যে, তাঁর এই গ্রন্থটি আমি পড়িনি। অথবা কেউ পড়ে তার কোন রিভিউ লিখেছেন বলে আমি শুনিনি। পুরস্কার পাওয়ার জন্য মনোনয়ন পাওয়ার ক্ষেত্রে এ ধরনের রিভিউ গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক ভূমিকা পালন করে। আমি জানি না তা হয়েছে কিনা। অন্যদিকে, কারও সমালোচনা করতে হলে তাঁর সম্পর্কে গভীরভাবে জানা প্রয়োজন, তাঁর লেখার সঙ্গে প্রত্যক্ষ পরিচয় থাকাও দরকার, যা এক্ষেত্রে আমার নেই। তার লেখা একটিমাত্র বই পড়ার সুযোগ এ পর্যন্ত আমার হয়েছে। ‘বিপন্ন ভারত’ নামে যে বইটি তিনি লিখেছেন, তা পড়ে আমি সত্যিই মুগ্ধ না হয়ে পারিনি। কিন্তু তার কবিসত্তা নিয়ে কোন লেখা এখনো আমার নজরে আসেনি। তাই সে বিষয়ে কথা বলার এক্তিয়ার আমার নেই বলেই আমি মনে করি।
রাজনৈতিক বিশ্বাস বা আদর্শগত পার্থক্য আছে যাদের (আমিও তাদের একজন), তারা রাজনৈতিক ইস্যুতে সমালোচনা করবেন আপোষহীন আন্দোলন করবেন- সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু লেখক হিসাবে তাঁর সমালোচনা করার সময়, তাঁর রাজনৈতিক পরিচয় উপেক্ষণীয় না হলেও তা কখনই প্রধান বা একমাত্র বিষয় হিসাবে বিবেচিত হয় না - একথা মনে রাখা প্রয়োজন।
যে কাব্য গ্রন্থের জন্য তিনি পুরস্কার পেয়েছেন, বা বলা ভাল, দেওয়া হয়েছে সেই গ্রন্থটি কি আমরা পড়েছি? উত্তর যদি হয় ‘না’, তবে আমাদের সমালোচনা মানায় না। খিল্লি তো নয়ই। আমরা যারা লেখালেখি করি, তাদের সব লেখা কি উচ্চমানের হয়? হয় না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জীবনানন্দ দাশের অনেক লেখাই তো তারা নিজেরাই পরবর্তীকালে বাতিল করে দিয়েছেন। অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষার ফসলও শেষমেশ গ্রহনযোগ্যতার মান অর্জন করতে পারে না। কিন্তু তার মনে তো এটা নয় যে, তার হাতে ভালো মানের সৃষ্টি সম্ভব নয়। তাই মূল গ্রন্থ না পড়ে কোন ব্যক্তির কোন নিম্নমানের লেখাকে সামনে এনে তার নামে খিল্লি করলে খিল্লিকারির যোগ্যতা, সামর্থ্য ও উদ্দেশ্য বিষয়ে প্রশ্নচিহ্ন উঠে যায়।
কোন গ্রন্থ বা লেখক পুরস্কৃত হলে তার পর্যালোচনা বের হয়। লেখার বিষয় নিয়ে যার পাণ্ডিত্য আছে এমন ব্যক্তি গ্রন্থটি পড়েন এবং তারপর রিভিউ রেব করেন। সেটাই নিয়ম, সেটাই রীতি। এক্ষেত্রে সেই অবকাশ কি আমরা পেয়েছি?
তাই, যেভাবে এই বিষয়টি নিয়ে খিল্লি করা হচ্ছে, তা ঠিক নয় বলে আমার মনে হয়েছে।। আসলে সমালোচনার নামে বিষয়টি নিয়ে খিল্লি করাই যেন প্রধান বিষয় হয়ে উঠেছে। খিল্লি করার এই সংস্কৃতি চেতনার ক্ষেত্রে সুস্থতা নয়, এক ধরনের অসুস্থতারই লক্ষণ।
তাই পুরস্কার দেওয়ার পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও তিনি পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য কিনা তা আমারা সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে যারা উদ্দিষ্ট গ্রন্থটি পড়িনি, করতে পারি না; খিল্লি তো নয়ই।
আসলে খিল্লি করা, পরনিন্দা পরচর্চা করা আমাদের মজ্জাগত সমস্যা। বিশেষ কিছু রাজনৈতিক দলের কাছে এটা কালচার। সোশ্যাল মিডিয়ায় চোখ রাখলেই তা হামেশাই নজরে আসে। কিন্তু একজন বামপন্থী মতাদর্শে বিশ্বাসী মানুষ হিসাবে আমি মানতে পারি না এই ধরণের কালচারের চর্চাকে।
সজন-পোষণ ভারতীয় সংস্কৃতিতে আইনসিদ্ধ অপরাধ হয়ে গেছে। অর্থাৎ এটা অনিয়ম জেনেও আমরা মুখ বুঁজে থাকি। নিজে নির্দ্বিধায় সে কাজ করে থাকি। আবার গলা উচুঁ করে তার সমালোচনাও করি। কোনও রকম লজ্জাবোধ আমাদের মধ্যে কাজ করে না। অফিস আদালতে নিজের কাজটা অবৈধভাবে আগে ভাগে করে নেওয়ার জন্য নির্দ্বিধায় ঘুষ দেই। আর বাড়ি ফিরেই সমালোচনা করি সরকারি কর্মচারীরা ঘুষ খান। কেউ যদি ঘুষ না দেই, ঘুষ খাওয়ার সুযোগই তৈরি হয় না, বেমালুম ভুলে যাই এই সত্যকে। ঘুষ নামক অপরাধের জন্ম যে উপভোক্তার অনৈতিকভাবে অগ্রিম সুবিধা আদায়ের ইচ্ছার গর্ভগৃহে তা আমরা হয় জানি না, অথবা জেনেও না জানার ভান করি।
এই অনৈতিক ইচ্ছাই জন্ম দেয়, তোষামোদি মানুষিকতার, জন্ম হয় মোসাহেবি মানুষের। আমার মধ্যে কি এই প্রবনতা নেই? যদি না থাকে, তবে আমি সমালোচক হওয়ার যোগ্য এবং খিল্লি করা আমার কাজ না। যে গ্রন্থের জন্য মুখ্যমন্ত্রী পুরস্কার পেয়েছেন তা পড়া এবং সমালোচনামলক নিবন্ধ প্রকাশ করার অধিকার অবশ্যই আমার আছে। পড়ার পর যদি তা পুরস্কার পাওয়ার অযোগ্য বলে বিবেচিত হয়, তবে তা নিয়ে খিল্লি নয়, গঠনমূলক সমালোচনা করা, এমন কি প্রতিবাদ করাও আমার অধিকার। এটাই সুস্থ সংস্কৃতির চিরায়ত বৈশিষ্ট্য। বিশ্বাস করি, সমস্ত বামপন্থী মানুষ এটার উপর ভিত্তি করেই নিজের পরিচয় উপস্থাপন করেন।
এ কাজে যারা ব্যর্থ হন, তারা আর যাই হোন, বামপন্থী হতে পারেন না। কারণ, বামপন্থা কারো সম্পত্তি নয়, যেটা উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া যায়। এটা অর্জন করতে হয়। শিক্ষিত এবং রুচিবান সমস্ত মানুষই এ কারণেই বামপন্থী মানুষদের শ্রদ্ধার চোখে দেখেন। এই শ্রদ্ধার জায়গা বামপন্থীদের ধরে রাখতে হবে এবং তা যদি হারিয়ে থাকে তা পুনরুদ্ধার করতে হবে। তবেই মানুষ তাদের পাশে এসে দাঁড়াবে। মনে রাখতে হবে, হিংসা দিয়ে যেমন হিংসাকে জয় করা যায় না, তেমনি খিল্লি করে খিল্লির পাত্রকে শিক্ষা দেয়া শোভন হয় না।
আপনি যদি এ ধারণায় বিশ্বাস না করেন এবং জীবনে চলার পথে তা মেনে না চলেন, তবে আপনি সাধারণ মানুষের কাছে মেকি বামপন্থী বা ক্ষেত্র বিশেষে ‘রামপন্থী’ হিসাবে বিবেচিত হবেন এ কথা হলফ করে বলা যায়। তাই আসুন, বামপন্থাকে একটি সংস্কৃতি হিসাবে আমরা আমাদের জীবনে ও মননে জায়গা করে দেই। খিল্লি ছেড়ে সুস্থ এবং একজন সচেতন সমালোচক ও সুনাগরিক হয়ে উঠি।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন