সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

হিজাব, কতটা যৌক্তিক এবং শাস্ত্রসম্মত?

হিজাব, চাপিয়ে দেয়া অযৌক্তিক এবং অশাস্ত্রীয় :

হিজাব বিতর্ক কেন?

হিজাব সম্পর্কে আলোচনা চলছে সারা ভারত জুড়ে, বলা ভালো বিশ্ব জুড়ে। তবে এটা যতটা না স্বাস্থ্যকর বির্তক, তার চেয়ে বেশি পরস্পরের প্রতি বিদ্বেষ ভাষণ। এবং এর পুরোটাই রাজনৈতিক উদ্দশ্যপ্রণোদিত।

এখন প্রশ্ন হল, আমি বা আপনি কোন্ পক্ষে? সোজাসুজি এর পক্ষে কিংবা বিপক্ষে অবস্থান নেওয়া অযৌক্তিক । হিজাবের পক্ষে বিপক্ষে আলোচনা করলেই এর সারবত্তা বোঝা যাবে।

হিজাব কি নিষিদ্ধ করা উচিত?

আমি ব্যাক্তিগতভবে হিজাব ব্যবহারের পক্ষে কিংবা বিপক্ষে এভাবে বলতে পারিনা এবং চাইও না। এটা যে পরবে তার রুচিবোধ এবং ব্যক্তিগত জীবনদর্শনের বিষয়। যে এটা ব্যবহার করে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে, সে ব্যবহার করবে। এ স্বাধীনতা তার একান্তই ব্যক্তিগত এবং তা সংবিধান সম্মত। আমি কাউকে তা যেমন চাপিয়ে দিতে পারিনা, তেমনি নিষেধও করতে পারি না।

নিষেধ করতে পারি না। কারণ, এর (হিজাব) দ্বারা ব্যাক্তি, সমাজ বা রাষ্ট কোনো পক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত হয় না, হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। ‘নেই বললেই চলে’ বললাম একারণে যে, আমরা অনেকেই হিজাব পরার ব্যাপারে সন্তানদের চাপ দিয়ে থাকি, বা বাধ্য করি। ধর্মের নামে তাকে ভয় দেখাই, যা ঠিক নয়।

অন্যদিকে, চাপিয়ে দিতে পারিনা। কারণ, তাহলে ব্যক্তি স্বাধীনতা ক্ষুন্ন হয়। অযৌক্তিকভাবে তাদের উপর এই ধরণের বিধি-নিষেধ চাপিয়ে দেয়া হলে, তাদের স্বাধীনভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা কমে যায়। সব কিছুর শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা খুঁজতে গিয়ে চিন্তার পরিসর ক্রমশ ছোট হয়ে যায়। যা তার ব্যক্তিত্বের বিকাশকে বাধাগ্রস্থ করে।

হিজাবের পক্ষে বিপক্ষে যুক্তি ঃ

এবার আসা যাক, হিজাব পরার যৌক্তিকতা নিয়ে আলোচনায়। হিজাব পরার ক্ষেত্রে যেসব যুক্তি দেখানো হয় সেগুলো হলো :
১) মেয়েদের সৌন্দর্যকে আড়ালে রাখো। নিজেদের হেফাজত করার জন্য এটা জরুরী। এটা না করলে মেয়েদের প্রতি ছেলেদের যৌন আকাঙ্ক্ষা বৃদ্ধি পাবে। সমাজে ধর্ষকের সংখ্যা বেড়ে যাবে।

দৈহিক সৌন্দর্য মানুষকে আকর্ষণ করে এটা প্রকৃতি প্রদত্ত একটা প্রবৃত্তি। কারণ, এই আকর্ষণকারী প্রবৃত্তির দ্বারা নারী-পুরুষ উভয়ই পরস্পরকে আকর্ষণ করে। করে বলেই তারা পরস্পরের কাছে আসে এবং প্রজনন প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়। অন্যান্য জীবের মত মানুষের জীবনেও এর গুরুত্ব এক রত্তি কম নয়।

এই প্রক্রিয়ায় একজন নারীর সৌন্দর্যের প্রতি একজন পুরুষের যেমন আকর্ষণ তৈরি হয়, একজন পুরুষের প্রতি একজন নারীও তেমনই আকর্ষণ অনুভব করে। এটা কখনোই এক তরফা নয়। পরিস্থিতি বিবেচনায় এই আকর্ষণকে মানুষ নিয়ন্ত্রিত করে, মানুষের সভ্যতাকে সুশৃংখল এবং নিরাপদ রাখার জন্য। এই প্রক্রিয়ায় তাই উভয়েরই সংযমের প্রয়োজন রয়েছে। 

কিন্তু দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হলো, আমাদের সমাজে এক্ষেত্রে পুরুষকে সম্পূর্ণ ছাড় দেয়া হয়। অন্যদিকে নারীকে আপাদমস্তক ঢেকে রেখে নিজেকে রক্ষার দায়িত্ব তার নিজের কাঁধেই চাপিয়ে দেয়া হয়।

হিজাব সম্পর্কে পবিত্র কোরআন কী বলছে?

নারীর পোশাক নিয়ে, আমার জানা মতে, কোরআনে মোট তিন আয়াত আছে। সুরা নুর-এর ৩১ নং আয়াত, সুরা আহযাব-এর ৩৩ এবং ৫৯ নং আয়াত। এছাড়া সুরা আরফ-এর ২৬ ও ৩১ নং আয়াতে সাধারণভাবে পোশাক পরার কথা বলা হয়েছে, এখানে হিজাব বা বিশেষ ধরণের কোন পোশাকের কথা বলা হয়নি। অন্য দিকে আহযাবের ৩০-৩৪ নং আয়াতে যা বলা হয়েছে তা কেবলমাত্র নবিজির স্ত্রীদের জন্য, তা সাধারণ নারীদের জন্য নয়। কারণ, ৩০ নং আয়াত শুরুই হয়েছে একথা বলে যে, 'হে নবী পত্নীগণ! তোমরা অন্য নারীদের মত নও।'

পবিত্র কোরআন-এ নারী এবং পুরুষ উভয়কেই তার গোপনাঙ্গ সুরক্ষিত রাখার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে এবং উভয়েরই নজরকে সংযত বা অবনত রাখার বিধান দেওয়া হয়েছে। লক্ষণীয় হল, পবিত্র কোরআন এ বিষয়ে পুরুষকেই আগে সতর্ক করেছে। এর ঠিক পরের আয়াতে নারীকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এমনকি নারীদের এ বিষয়ে সতর্ক করার পর এই একই আয়াতে পুনরায় পুরুষকে সতর্ক করা হয়েছে --
"মু’মিনদের (পুরুষদের) বল, তাদের দৃষ্টি অবনমিত করতে আর তাদের লজ্জাস্থান সংরক্ষণ করতে, এটাই তাদের জন্য বেশি পবিত্র, তারা যা কিছু করে সে সম্পর্কে আল্লাহ খুব ভালভাবেই অবগত।"
(QS. An-Nur 24: Verse 30)
"আর ঈমানদার নারীদেরকে বলে দাও তাদের দৃষ্টি অবনমিত করতে আর তাদের লজ্জাস্থান সংরক্ষণ করতে, আর তাদের শোভা সৌন্দর্য প্রকাশ না করতে, যা এমনিতেই প্রকাশিত হয়, তা ব্যতীত। তারা যেন তাদের ওড়না দিয়ে তাদের বক্ষদেশকে আবৃত করে রাখে। ......... হে মু’মিনগণ! তোমরা আল্লাহর নিকট তাওবাহ কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার।"
(QS. An-Nur 24: Verse 31)

প্রশ্ন হল, এখানে হিজাব কোথায়? বোরখা পরে পা থেকে মাথা পর্যন্ত ঢেকে রাখার বিধানই বা কই?

হিজাব কীভাবে একমাত্র নারীর জন্য বাধ্যতামূলক হয়?

যদি তাই হয়, তাহলে সৌন্দর্য্যকে আড়াল করে ধর্ষককে নিয়ন্ত্রন করার দায় একা কেন নারীকেই বয়ে বেড়াতে হবে? পোশাকের ব্যাপারের পুরুষ যে স্বাধীনতা ভোগ করে, তা মেয়েরা কেন করবে না?

আসলে পোশাক পরিধানের মাধ্যমে শারীরিক সৌন্দর্যকে নিয়ন্ত্রিত করে সমাজের শৃঙ্খলা রক্ষার দায় এবং দায়িত্ব নারী-পুরুষ উভয়েরই। এখানে কেউই ছাড় পেতে পারে না। মধ্যপ্রাচ্যের দিকে তাকালে এর সত্যতা উপলব্ধি করা যাবে। সেখানে উভয়ই সমস্ত শরীর ঢেকে রাখে (যদিও এ ধরণের পোশাক পরার পিছনে ভৌগোলিক বা জলবাযুগত কারণ রয়েছে, ধর্মীয় নয়) এবং তা ইসলাম আগমনের আগে থেকেই।

দ্বিতীয়তঃ একজন পুরুষ যতটা নারীর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়, ঠিক ততটাই একজন নারী কোন পুরুষের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করে। এই জৈবিক চাহিদা একমাত্র পুরুষের নয়, নারীরও সমানভাবে আছে। নারী এই চাহিদাকে নিয়ন্ত্রণ করে প্রধানত ৪টি কারণে।
১) পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীর এই জৈবিক চাহিদাকে পূরণ করার স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেয় না।
২) প্রকৃতির নিয়মেই কেবল নারীকেই এই চাহিদা পূরণের ফলশ্রুতি হিসেবে কিছু দায়-দায়িত্ব পালন করতে হয়, যা পুরুষকে করতে হয় না।
৩) এই চাহিদা পূরণের পরিণতিতে একজন নারী সন্তান সম্ভবা হলে তাকে যে সামাজিক প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়, তা পুরুষতান্ত্রিক সমাজেরই তৈরি, তাই পুরুষকে তা বইতে হয় না।
৪) প্রাকৃতিক কারণে নারী পুরুষের তুলনায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দৈহিক দিক থেকে দুর্বল।

এই প্রতিবন্ধকতা না থাকলে আমরা পুরুষের মত কিছু নারীকেও হয়তো পুরুষের ধর্ষণকারী হিসেবে দেখতে পেতাম। প্রকৃতির দেয়া এই দায়-দায়িত্ব একজন নারী পালন করতে বাধ্য হয় বলে, পুরুষ কি নারীকে শৃঙ্খলিত রেখে নিজেকে শৃংখল মুক্ত রাখতে পারে?

আসলে আমাদের চিন্তার গভীরে রয়েছে লিঙ্গ ভিত্তিক শ্রেণিবৈষম্য। অবাঞ্ছিত গর্ভধারণের দায় পুরুষকে নিতে হয় না বলেই তারা নারীর প্রতি দায় চাপিয়ে দেয়ার সাহস দেখায়।

হিজাব কি একমাত্র শালীন পোশাক?

এবারে আসুন, হিজাব বা বোরখাকে অন্ধভাবে চাপিয়ে দেওয়ার বিরোধিতা করলেই কিছু মানুষ প্রশ্ন করেন, তাহলে কি মেয়েরা অশ্লীল পোশাক পরে রাস্তায় দাঁড়াবে? এই প্রশ্নটার মধ্যে যুক্তির চেয়ে অযৌক্তিক ধারনার প্রাধান্য বেশি। তাই যুক্তিবিজ্ঞানের ভাষায় এটা অবৈধ যুক্তি। কারণ হিজাব বা পর্দাকে একমাত্র শালীন পোশাক বললে বাইরে আর যত পোশাক আছে তাদের সবটাকে অশ্লীল বলতে হয়। কিন্তু বাস্তবে তা তো নয়।

আসলে হিজাবকে স্বীকৃতি দিতে গিয়ে সমস্ত ট্রেডিশনাল কিম্বা আধুনিক পোশাককে অশ্লীল বলে দেয়ার মধ্যে সূক্ষ্ম চালাকি রয়েছে। এই চালাকির ভিত্তি হলো পুরুষতান্ত্রিক একপেশে সুবিধাবাদী মানসিকতা। একজন পুরুষের যদি শালীন যেকোনো পোষাক পরার অধিকার থাকে, তাহলে একজন নারীরও সেই অধিকার রয়েছে। তাই শালীনতার প্রশ্নে পুরুষ কখনোই নারীর তুলনায় অধিক স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে না। ইসলাম সমতার ধর্ম, সেখানে নারী-পুরুষের মধ্যে সাম্যের কথা বলা হয়েছে বলে দাবী করবেন, আবার নারীর ঘাড়ে শালীনতা ও শৃঙ্খলা রক্ষার সমস্ত দায় চাপিয়ে দেবেন, এটা এক ধরনের ভন্ডামি।

আপনি আপনার দৈহিক সৌন্দর্য দেখিয়ে একজন নারীকে আকর্ষিত করার চেষ্টা করবেন, আর নারীকে বলবেন তাকে তার সৌন্দর্যকে আবৃত রাখতে, এটা অযৌক্তিক, বৈষম্যমুলক এবং অবশ্যই শস্ত্র (কোরআন) সম্মত নয়।

* লেখাটি এই সময় দৈনিক সংবাদপত্রে পাঠানো হয়েছে। 
১৬/০৩/২০২২
সম্পাদক হিরাক বাবুকে হোয়াটস অ্যাপ-এ পাঠানো হয়েছে।

মন্তব্যসমূহ

📂 আলী হোসেনের জনপ্রিয় প্রবন্ধগুলি

হিন্দু কারা? তারা কীভাবে হিন্দু হল?

হিন্দু কারা? কীভাবে তারা হিন্দু হল? যদি কেউ প্রশ্ন করেন, অমিত শাহ হিন্দু হলেন কবে থেকে? অবাক হবেন তাই তো? কিন্তু আমি হবো না। কারণ, তাঁর পদবী বলে দিচ্ছে উনি এদেশীয়ই নন, ইরানি বংশোদ্ভুত। কারণ, ইতিহাস বলছে পারস্যের রাজারা ‘শাহ’ উপাধি গ্রহণ করতেন। এবং ‘শাহ’ শব্দটি পার্শি বা ফার্সি। লালকৃষ্ণ আদবানির নামও শুনেছেন আপনি। মজার কথা হল আদবানি শব্দটিও এদেশীয় নয়। আরবি শব্দ ‘আদবান’ থেকে উদ্ভূত। সুতরাং তাঁর পদবীও বলছে, তিনিও এদেশীয় নন। ভাষাতত্ত্ব ও নৃতত্ত্বের বিশ্লেষণ বলছে, উচ্চবর্ণের বিশেষ করে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের মানুষদের, উৎসভূমি হল পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চল। তারও আগে ছিল ইউরোপের ককেশাস অঞ্চলে। আসলে এরা (উচ্চবর্ণের মানুষ) কেউই এদেশীয় নয়। তারা নিজেদের আর্য বলে পরিচয় দিতেন এবং এই পরিচয়ে তারা গর্ববোধ করতেন। সিন্ধু সভ্যতা পরবর্তীকালে তারা পারস্যের বিভিন্ন এলাকা থেকে হিন্দুকুশ পর্বতের গিরিপথ ধরে এদেশে অভিবাসিত হয়েছেন। আর মধ্যযুগে এসে এদেরই উত্তরসূরী ইরানিরা (অমিত শাহের পূর্বপুরুষ) অর্থাৎ পারস্যের কিছু পর্যটক-ঐতিহাসিক, এদেশের আদিম অধিবাসীদের ’হিন্দু’ বলে অভিহিত করেছেন তাদের বিভিন্ন ভ্রমণ বৃত্তান্তে।

রবীন্দ্রনাথের ধর্মভাবনা ও তার বিবর্তন

রবীন্দ্রনাথের ধর্মভাবনা ও তার বিবর্তন আলী হোসেন  যদি প্রশ্ন করা হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ধর্ম কী? মনে হয় অনেকেই ঘাবড়ে যাবেন। কেউ বলবেন, তাঁর বাবা যখন ব্রাহ্ম ছিলেন তাহলে তিনি নিশ্চয়ই ব্রাহ্ম। যারা লেখাপড়া জানেন না, তারা বলবেন, কেন! উনি তো হিন্দু ছিলেন। আবার কেউ কেউ তথ্য সহযোগে এও বলার চেষ্টা করবেন যে, উনি নাস্তিক ছিলেন; না হলে কেউ বলতে পারেন, ধর্মমোহের চেয়ে নাস্তিকতা অনেক ভালো? ¹ রবীন্দ্রনাথের ধর্ম ভাবনার বিবর্তন  তাহলে সঠিক উত্তরটা কী? আসলে এর কোনোটাই সঠিক উত্তর নয়। চিন্তাশীল মানুষ-মাত্রই সারা জীবন ধরে ভাবেন, ভাবতে ভাবতে তাঁর উপলব্ধি বাড়তে থাকে ক্রমশঃ প্রগতির পথে। জগৎ ও জীবন থেকে তথ্য সংগ্রহ করে একে একে গড়ে তোলেন নিত্যনতুন জীবনদর্শন। তাই এ ধরনের মানুষ আজীবন এক এবং অখণ্ড জীবনদর্শনের বার্তা বহন করেন না। সময়ের সাথে সাথে পাল্টে যায় তাঁর পথচলার গতিমুখ। মানুষ রবীন্দ্রনাথও তাই পাল্টে ফেলেছেন তাঁর জীবন ও ধর্মদর্শন সময়ের বয়ে যাওয়াকে অনুসরণ করে। রবীন্দ্রনাথ ও  হিন্দু জাতীয়তাবাদ ১৮৬১ সালের ৭ই মে সোমবার রাত্রি ২টা ৩৮ মিনিট ৩৭ সেকেন্ডে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে জন্ম গ্রহণ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এর

সীমান্ত আখ্যান, বাঙালির আত্মানুসন্ধানের ডিজিটাল আখ্যান

সময়ের সঙ্গে সমস্যার চরিত্র বদলায়। কিন্তু মুলটা বদলায় না। যদি সে সমস্যা ইচ্ছা করে তৈরি হয়ে থাকে বিশেষ সুবিধা ভোগেই লোভে, তবে তো অন্য কথা চলেই না। স্বনামধন্য স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাতা সৌমিত্র দস্তিদারের ডকুমেন্টারি ফিল্প 'সীমান্ত আখ্যান' দেখার পর এই উপলব্ধি মাথা জুড়ে ঘুরপাক খাচ্ছে। দেখলাম, দেশ ভাগ হয়েছে। কিন্তু সমস্যার অবসান হয়নি। শুধু সমস্যার চরিত্রটা পাল্টেছে। এই যে সমস্যা রয়ে গেল, কোন গেল? তার উত্তর ও পাওয়া গেল 'সীমান্ত আখ্যান' এ। আসলে দেশ ভাগ তো দেশের জনগণ চাননি, চেয়েছেন দেশের নেতারা। চেয়েছেন তাঁদের ব্যক্তিগত, সম্প্রদায়গত সুবিধাকে নিজেদের কুক্ষিগত করার নেশায়। আর এই নেশার রসদ যোগান দিতে পারার নিশ্চয়তা নির্ভর করে রাজনৈতিক ক্ষমতার লাগাম নিজের হাতে থাকার ওপর। তাই রাজনীতিকরা এই ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য জনগণকে 'ডিভাইড এন্ড রুল' পলিছি দ্বারা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চেষ্টা করেছেন এবং করে চলেছেন। এ সমস্যা নতুন না, ব্রিটিশ সরকার এর বীজ রোপণ করে গেছেন, এখন কেউ তার সুফল ভোগ করছে (রাজনীতিকরা) আর কেউ কুফল (জনগন)। 'সীমান্ত আখ্যান চোখে আঙুল দিয়ে দে

ভাগ্য : মুসলিম মনস্তত্ত্ব, ধর্মদর্শন ও প্রগতি

ভাগ্য : মুসলিম মনস্তত্ত্ব, ধর্মদর্শন ও প্রগতি - লিখছেন আলী হোসেন  কপালের লেখন খণ্ডায় কার সাধ্য? জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে কিংবা লেখাপড়া জানা-নাজানা নির্বিশেষে সমস্ত মানুষের সিংহভাগই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এই কথাটা মেনে নেয়। জীবনের উত্থান-পতনের ইতিহাসে কপালের লেখনকে জায়গা করে দিতে তারা কুণ্ঠাবোধ করে না। বরং বলা ভালো এব্যাপারে তারা অতিমাত্রায় উদার। মানুষের মনস্তত্বের এ-এক জটিল স্তর বিন্যাস। একই মানুষ বিভিন্ন সময়ে একই বিষয়ের বিচার বিশ্লেষণে ভিন্নভিন্ন দৃষ্টিকোণ ব্যবহার করে। এ রকমই একটি দৃষ্টিকোণ হলো কপাল বা ভাগ্যের ভূমিকাকে সাফল্যের চাবিকাঠি বলে ভাবা। কখনও সে ভাগ্যের নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠার চেষ্টা করে, আবার কখনও নিজেই ভাগ্যের কাছে নির্দিধায় আত্ম সমর্পন করে। নিজের ব্যার্থতার পিছনে ভাগ্যের অদৃশ্য হাতের কারসাজির কল্পনা করে নিজের ব্যার্থতাকে ঢাকা দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে থাকে। মজার কথা, এক্ষেত্রে মুসলিম মানসের মনস্তত্ত্ব কখনও চেতনমনে আবার কখনও অবচেতন মনে উপরওয়ালাকে (আল্লাহকে) কাঠ গড়ায় তোলে বিনা দ্বিধায়। নির্দিধায় বলে দেয়, উপরওয়ালা রাজি না থাকলে কিছুই করার থাকেনা। সাফল্য কিংবা ব্যর্থতা সবই তাঁর (আল্লার

কাশ্মীর ফাইলস : প্রপাগান্ডার এক নয়া ব্রান্ড, কর্পোরেট পুঁজি ও রাজনৈতিক দলের গলাগলির এক সুচারু প্রদর্শনী

কাশ্মীর ফাইলস : প্রপাগান্ডার এক নয়া ব্রান্ড, কর্পোরেট পুঁজি ও রাজনৈতিক দলের গলাগলির এক সুচারু প্রদর্শনী রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয় উলুখাগড়ার প্রাণ যায়। ১৯৪৭ সালের পর থেকে জম্মু ও কাশ্মিরের জনগণের ভাগ্যলিপিতে লেখা হয়ে গেছে এই বিখ্যাত প্রবাদটির বিস্তারিত সারাৎসার। একদিকে পাকিস্তান আর অন্যদিকে ভারত – এই দুই প্রতিবেশি দেশের ভুরাজনৈতিক স্বার্থের যাঁতাকলে পড়ে তাদের এই হাল। কিন্তু কেন এমন হল? এই প্রশ্নের উত্তর জানে না এমন মানুষ ভুভারতে হয়তো বা নেই। কিন্তু সেই জানার মধ্যে রয়েছে বিরাট ধরণের ফাঁক। সেই ফাঁক গলেই ঢুকেছে কাশ্মির ফাইলসের মত বিজেপির রাজনৈতিক ন্যারেটিভ যা তারা বহুকাল ধরে করে চলেছে অন্য আঙ্গিকে। এবার নতুন মাধ্যমে এবং নবরূপে তার আগমন ঘটেছে, যায় নাম সিনেমা বা সেলুলয়েড প্রদর্শনী। যদিও ডিজিটাল মাধ্যমে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সৌজন্যে অনেক আগেই সফলভাবে তারা এই ন্যারেটিভ দিয়ে বিভাজনের রাজনীতি করে চলেছে বেশ কয়েক বছর ধরে। টেলিভিশন সম্প্রচারে কর্পোরেট পুজির অনুপ্রবেশের মাধ্যমে যার সূচনা হয়েছিল। রাষ্ট্রশক্তিকে কুক্ষিগত করতে না পারলে দেশের সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রন আনা সম্ভব নয়, একথা সাধারণ নিরক্ষর নাগরিক এবং ত

শিক্ষা কী, কেন প্রয়োজন এবং কীভাবে অর্জন করা যায়?

শিক্ষা কী, কেন এবং কীভাবে অর্জন করতে হয়? সূচিপত্র : What is education, why it is needed and how to achieve it শিক্ষা কী শিক্ষা হল এক ধরনের অর্জন, যা নিজের ইচ্ছা শক্তির সাহায্যে নিজে নিজেই নিজের মধ্যে জমা করতে হয়। প্রকৃতি থেকেই সেই অর্জন আমাদের চেতনায় আসে। সেই চেতনাই আমাদের জানিয়ে দেয়, জগৎ ও জীবন পরিচালিত হয় প্রকৃতির কিছু অলংঘনীয় নিয়ম-নীতির দ্বারা। গভীর পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ শক্তিকে বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে কাজে লাগালেই এই নিয়মনীতিগুলো আমাদের আয়ত্বে আসে। এই নিয়ম-নীতিগুলো জানা এবং সেই জানার ওপর ভিত্তি করেই জগৎ ও জীবনকে সর্বোত্তম পর্যায়ে পৌঁছে দেয়ার পথ খুঁজে বের করার শক্তি অর্জনই শিক্ষা। মনে রাখতে হবে, এই শিক্ষা কখনও কারও মধ্যে জোর করে ঢুকিয়ে দেওয়া যায় না। এখন প্রশ্ন হল, শিক্ষা অর্জনের বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিটা আসলে কী। সেই আলোচনায় যাওয়ার আগে জানতে হবে, এই শিক্ষার সূচনা হয় কখন এবং কীভাবে? শিক্ষার সূচনা কখন হয় : এই অর্জনের সূচনা হয় মাতৃগর্ভে এবং তা প্রাকৃতিক ভাবেই। প্রকৃতির দেওয়া কিছু সহজাত শিক্ষাকে অবলম্বন করেই তার সূচনা। এই সহজাত শিক্ষাকে অবলম্বন করেই মানুষ তার পরবর্তী প

জল, না পানি : জল নিয়ে জলঘোলা করা পানির মত সহজ নয়

জল নিয়ে জলঘোলা করা পানির মত সহজ নয় আলী হোসেন  সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত সরকারি অনুষ্ঠানে চিত্র শিল্পী শুভাপ্রসন্ন ভট্টাচার্য পানি শব্দকে বাংলা নয় বলে দাবি করেছেন। বলেছেন, "আমরা কোনোদিন কখনও বাংলা ভাষায় পানি (শব্দটা) ব্যবহার করি না"। শুধু তা-ই নয়, পানি শব্দের ব্যবহারের মধ্যে তিনি 'সাম্প্রদায়িকতার ছাপ'ও দেখতে পেয়েছেন। প্রশ্ন হল - এক, এই ভাবনা কতটা বাংলা ভাষার পক্ষে স্বাস্থ্যকর এবং কতটা 'বাংলা ভাষার ইতিহাস' সম্মত? দুই, জল বা পানি নিয়ে যারা জলঘোলা করছেন তারা কি বাংলাকে ভালোবেসে করছেন? মনে হয় না। কারণ, খোঁজ নিলে দেখা যাবে, এরা কেউ নিজের সন্তানকে বাংলা মিডিয়াম স্কুলে পড়াননি বা পড়ান না। ব্যবহারিক জীবনেও তারা বাংলার ভাষার চেয়ে ইংরেজি বা হিন্দিতে কথা বলতে বা গান শুনতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন, বলা ভালো গর্ববোধ করেন। প্রসংগত মনে রাখা দরকার, বাংলা মিডিয়াম স্কুলগুলোতে যারা ভর্তি হয়, তারা অধিকাংশই গরীব ঘরের সন্তান। বলা ভালো, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে তারাই বাংলা ভাষাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। কারণ, সন্তানকে বাংলা মিডিয়ামে পড়ানোর পাশাপাশি, বা

নিম্নবর্গের মানুষ মার খাচ্ছে কেন

নিম্নবর্গের মানুষ কীভাবে পিছিয়ে পড়েছেন? সমাধান কীভাবে? এদেশের নিম্নবর্গের মানুষ নিজেদের বাঁচাতে যুগ যুগ ধরে ধর্ম পরিবর্তন করেছে। কখনও বৌদ্ধ (প্রাচীন যুগ), কখনও মুসলমান (মধুযুগ), কিম্বা কখনো খ্রিস্টান (আধুনিক যুগ) হয়েছে। কিন্তু কখনই নিজেদের চিন্তা-চেতনাকে পাল্টানোর কথা ভাবেনি। পরিবর্তন হচ্ছে অলংঘনীয় প্রাকৃতিক নিয়ম। যারা এই নিয়ম মেনে সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে পারে, তারাই লাভবান হয়, টিকে থাকে। “পাল্টে গেলেই জীবন বাড়ে না পাল্টালে নয়, জীবন মানেই এগিয়ে যাওয়া নইলে মৃত্যু হয়” জীবনের এই চরম সত্য তারা অধিকাংশই উপলব্ধি করতে পারেনি। পৃথিবীর যেকোন উন্নত জাতির দিকে তাকান, তারা দ্রুততার সঙ্গে এই পরিবর্তনকে মেনে নিজেদেরকে পুনর্গঠন করে নিয়েছে। যারা পারেনি বা নেয়নি তারাই মার খাচ্ছে, অতীতেও খেয়েছে। বুদ্ধিমান জাতি নিজের দুর্বলতাকে মেনে নেয় এবং ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য সময়ের সঙ্গে তাল রেখে নিজেদের চিন্তা এবং চেতনায় পরিবর্তন আনে। খ্রিষ্টান, ইহুদি-সহ এশিয়া, ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন জাতি - যারাই এই পরিবর্তন মেনে নিয়েছে তারাই আরও উন্নত এবং শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। মহানবীর (সঃ) গৌরবময় উত্থান (যা এক ধরণ

আধুনিক মিডিয়া : কর্পোরেট পুঁজির (পুঁজিপতিদের) তোতাপাখি

গোদি মিডিয়া : কর্পোরেট পুঁজির তোতাপাখি পশ্চিমী মিডিয়াকে 'ইসরাইল সরকারের তোতাপাখি' নামে পরিচয় দেওয়া হয় সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী স্বাধীন ও নিরপেক্ষ মিডিয়া হাউজের পক্ষ থেকে। সম্প্রতি একইভাবে ভারতীয় কর্পোরেট মিডিয়া ভারত সরকার তথা 'কর্পোরেট পুঁজির  তোতাপাখি' হিসাবে পরিচয় পাচ্ছে, যাকে নিন্দুকেরা 'গোদী মিডিয়া' নামে অভিহিত করে থাকে। মধ্যপ্রাচ্যের ঘটনা সম্পর্কে ইসরাইল যা বলে, ইউরোপ ও আমেরিকার মিডিয়া, তোতা পাখির মতো তা-ই প্রচার করে। সাংবাদিকতার প্রধান প্রধান শর্তগুলোকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ইসরাইলের দেওয়া তথ্যই তারা প্রচার করে অন্ধ ও নির্লজ্জভাবে। ভারতের ক্ষেত্রেও করপোরেট মিডিয়া বর্তমানে সেটাই করছে বলে অভিযোগ। অভিযোগ, নত মস্তকে ভারত সরকারের দেওয়া তথ্য বিনা বিচারে প্রচার করে চলেছে অধিকাংশ মিডিয়া হাউজ।  অর্থাৎ তাদের সম্প্রচারিত খবরের বড় অংশই হয় নিয়ন্ত্রিত অথবা কখনও কখনও অসত্য - এমন দাবিও করা হয়।  আসলে সিংহভাগ মিডিয়ার মালিক হচ্ছেন এক-একজন  করপোরেট পুঁজির মালিক বা পুঁজিপতি। এরা কি কখনও নিজের স্বার্থের বিরুদ্ধে যায় - এমন খবর, তথ্য বা তত্ত্ব প্রচার করবে? করবে না, করেও না। আর এ

সংখ্যালঘুর মুখই গণতন্ত্রের আয়না

  সংখ্যালঘুর মুখই গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় এবং শক্তিশালী আয়না। The face of the minority is the mirror of democracy কোন দেশ কতটা গণতান্ত্রিক, তা বোঝা যায় সে দেশের সংখ্যালঘু মানুষের জীবন ও সম্পত্তির সুরক্ষা কতটা মজবুত, তা থেকে। কারণ, সংখ্যালঘুর মুখই হচ্ছে গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় এবং শক্তিশালী আয়না। সংখ্যালঘুরা সঙ্গত কারণেই সংখ্যাগরিষ্ঠদের চেয়ে বেশি বঞ্চনাজনিত মনস্তাত্ত্বিক চাপে থাকে। এই চাপ দু’ভাবে তৈরি হয়। ১) সংখ্যাগিষ্ঠতাজনিত সুবিধা যা সংখ্যাগুরুরা পায়, সংখ্যালঘুরা কখনই তা পায় না বা পাবে না - এই ধারণা, যার কিছুটা হলেও ভিত্তি রয়েছে ২) সংখ্যাগরিষ্ঠদের মধ্যে বৃহত্তম (?) জনগোষ্ঠীর অংশ হওয়ার সুবাদে যে কর্তৃত্ববাদী মানসিকতা তৈরি হয় এবং যা বহুজনের মধ্যে দৃষ্টিকটুভাবে প্রকাশ হয়ে পড়ে, তার ভয়ে। এই চাপ কতটা গভীর তা সংখ্যালঘু ছাড়া বোঝা খুব মুশকিল। তবে আলোকপ্রাপ্ত মানুষ মাত্রই যে তা উপলব্ধি করতে পারেন, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। এই ধরণের চাপ তৈরি করে কিছু অসাধু মানুষ যখন সংখ্যালঘুদের জীবন ও সম্পত্তির সামনে হুমকি হয়ে দাঁড়ায়, তখন তা কমানোর ক্ষমতা একমাত্র গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রশক্তির হাতেই থাকে