হিজাব, চাপিয়ে দেয়া অযৌক্তিক এবং অশাস্ত্রীয়
হিজাব বিতর্ক কেন?
হিজাব সম্পর্কে আলোচনা চলছে সারা ভারত জুড়ে, বলা ভালো বিশ্ব জুড়ে। তবে এটা যতটা না স্বাস্থ্যকর বির্তক, তার চেয়ে বেশি পরস্পরের প্রতি বিদ্বেষ ভাষণ। এবং এর পুরোটাই রাজনৈতিক উদ্দশ্যপ্রণোদিত।
এখন প্রশ্ন হল, আমি বা আপনি কোন্ পক্ষে? সোজাসুজি এর পক্ষে কিংবা বিপক্ষে অবস্থান নেওয়া অযৌক্তিক । হিজাবের পক্ষে বিপক্ষে আলোচনা করলেই এর সারবত্তা বোঝা যাবে।
হিজাব কি নিষিদ্ধ করা উচিত?
আমি ব্যাক্তিগতভবে হিজাব ব্যবহারের পক্ষে কিংবা বিপক্ষে এভাবে বলতে পারিনা এবং চাইও না। এটা যে পরবে তার রুচিবোধ এবং ব্যক্তিগত জীবনদর্শনের বিষয়। যে এটা ব্যবহার করে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে, সে ব্যবহার করবে। এ স্বাধীনতা তার একান্তই ব্যক্তিগত এবং তা সংবিধান সম্মত। আমি কাউকে তা যেমন চাপিয়ে দিতে পারিনা, তেমনি নিষেধও করতে পারি না।
নিষেধ করতে পারি না। কারণ, এর (হিজাব) দ্বারা ব্যাক্তি, সমাজ বা রাষ্ট কোনো পক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত হয় না, হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। ‘নেই বললেই চলে’ বললাম একারণে যে, আমরা অনেকেই হিজাব পরার ব্যাপারে সন্তানদের চাপ দিয়ে থাকি, বা বাধ্য করি। ধর্মের নামে তাকে ভয় দেখাই, যা ঠিক নয়।
অন্যদিকে, চাপিয়ে দিতে পারিনা। কারণ, তাহলে ব্যক্তি স্বাধীনতা ক্ষুন্ন হয়। অযৌক্তিকভাবে তাদের উপর এই ধরণের বিধি-নিষেধ চাপিয়ে দেয়া হলে, তাদের স্বাধীনভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা কমে যায়। সব কিছুর শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা খুঁজতে গিয়ে চিন্তার পরিসর ক্রমশ ছোট হয়ে যায়। যা তার ব্যক্তিত্বের বিকাশকে বাধাগ্রস্থ করে।
হিজাবের পক্ষে বিপক্ষে যুক্তি ঃ
এবার আসা যাক, হিজাব পরার যৌক্তিকতা নিয়ে আলোচনায়। হিজাব পরার ক্ষেত্রে যেসব যুক্তি দেখানো হয় সেগুলো হলো :
১) মেয়েদের সৌন্দর্যকে আড়ালে রাখো। নিজেদের হেফাজত করার জন্য এটা জরুরী। এটা না করলে মেয়েদের প্রতি ছেলেদের যৌন আকাঙ্ক্ষা বৃদ্ধি পাবে। সমাজে ধর্ষকের সংখ্যা বেড়ে যাবে।
দৈহিক সৌন্দর্য মানুষকে আকর্ষণ করে এটা প্রকৃতি প্রদত্ত একটা প্রবৃত্তি। কারণ, এই আকর্ষণকারী প্রবৃত্তির দ্বারা নারী-পুরুষ উভয়ই পরস্পরকে আকর্ষণ করে। করে বলেই তারা পরস্পরের কাছে আসে এবং প্রজনন প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়। অন্যান্য জীবের মত মানুষের জীবনেও এর গুরুত্ব এক রত্তি কম নয়।
এই প্রক্রিয়ায় একজন নারীর সৌন্দর্যের প্রতি একজন পুরুষের যেমন আকর্ষণ তৈরি হয়, একজন পুরুষের প্রতি একজন নারীও তেমনই আকর্ষণ অনুভব করে। এটা কখনোই এক তরফা নয়। পরিস্থিতি বিবেচনায় এই আকর্ষণকে মানুষ নিয়ন্ত্রিত করে, মানুষের সভ্যতাকে সুশৃংখল এবং নিরাপদ রাখার জন্য। এই প্রক্রিয়ায় তাই উভয়েরই সংযমের প্রয়োজন রয়েছে।
কিন্তু দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হলো, আমাদের সমাজে এক্ষেত্রে পুরুষকে সম্পূর্ণ ছাড় দেয়া হয়। অন্যদিকে নারীকে আপাদমস্তক ঢেকে রেখে নিজেকে রক্ষার দায়িত্ব তার নিজের কাঁধেই চাপিয়ে দেয়া হয়।
হিজাব সম্পর্কে পবিত্র কোরআন কী বলছে?
নারীর পোশাক নিয়ে, আমার জানা মতে, কোরআনে মোট তিন আয়াত আছে। সুরা নুর-এর ৩১ নং আয়াত, সুরা আহযাব-এর ৩৩ এবং ৫৯ নং আয়াত। এছাড়া সুরা আরফ-এর ২৬ ও ৩১ নং আয়াতে সাধারণভাবে পোশাক পরার কথা বলা হয়েছে, এখানে হিজাব বা বিশেষ ধরণের কোন পোশাকের কথা বলা হয়নি। অন্য দিকে আহযাবের ৩০-৩৪ নং আয়াতে যা বলা হয়েছে তা কেবলমাত্র নবিজির স্ত্রীদের জন্য, তা সাধারণ নারীদের জন্য নয়। কারণ, ৩০ নং আয়াত শুরুই হয়েছে একথা বলে যে, 'হে নবী পত্নীগণ! তোমরা অন্য নারীদের মত নও।'
পবিত্র কোরআন-এ নারী এবং পুরুষ উভয়কেই তার গোপনাঙ্গ সুরক্ষিত রাখার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে এবং উভয়েরই নজরকে সংযত বা অবনত রাখার বিধান দেওয়া হয়েছে। লক্ষণীয় হল, পবিত্র কোরআন এ বিষয়ে পুরুষকেই আগে সতর্ক করেছে। এর ঠিক পরের আয়াতে নারীকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এমনকি নারীদের এ বিষয়ে সতর্ক করার পর এই একই আয়াতে পুনরায় পুরুষকে সতর্ক করা হয়েছে --
"মু’মিনদের (পুরুষদের) বল, তাদের দৃষ্টি অবনমিত করতে আর তাদের লজ্জাস্থান সংরক্ষণ করতে, এটাই তাদের জন্য বেশি পবিত্র, তারা যা কিছু করে সে সম্পর্কে আল্লাহ খুব ভালভাবেই অবগত।"
(QS. An-Nur 24: Verse 30)
"আর ঈমানদার নারীদেরকে বলে দাও তাদের দৃষ্টি অবনমিত করতে আর তাদের লজ্জাস্থান সংরক্ষণ করতে, আর তাদের শোভা সৌন্দর্য প্রকাশ না করতে, যা এমনিতেই প্রকাশিত হয়, তা ব্যতীত। তারা যেন তাদের ওড়না দিয়ে তাদের বক্ষদেশকে আবৃত করে রাখে। ......... হে মু’মিনগণ! তোমরা আল্লাহর নিকট তাওবাহ কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার।"
(QS. An-Nur 24: Verse 31)
প্রশ্ন হল, এখানে হিজাব কোথায়? বোরখা পরে পা থেকে মাথা পর্যন্ত ঢেকে রাখার বিধানই বা কই?
হিজাব কীভাবে একমাত্র নারীর জন্য বাধ্যতামূলক হয়?
যদি তাই হয়, তাহলে সৌন্দর্য্যকে আড়াল করে ধর্ষককে নিয়ন্ত্রন করার দায় একা কেন নারীকেই বয়ে বেড়াতে হবে? পোশাকের ব্যাপারের পুরুষ যে স্বাধীনতা ভোগ করে, তা মেয়েরা কেন করবে না?
আসলে পোশাক পরিধানের মাধ্যমে শারীরিক সৌন্দর্যকে নিয়ন্ত্রিত করে সমাজের শৃঙ্খলা রক্ষার দায় এবং দায়িত্ব নারী-পুরুষ উভয়েরই। এখানে কেউই ছাড় পেতে পারে না। মধ্যপ্রাচ্যের দিকে তাকালে এর সত্যতা উপলব্ধি করা যাবে। সেখানে উভয়ই সমস্ত শরীর ঢেকে রাখে (যদিও এ ধরণের পোশাক পরার পিছনে ভৌগোলিক বা জলবাযুগত কারণ রয়েছে, ধর্মীয় নয়) এবং তা ইসলাম আগমনের আগে থেকেই।
দ্বিতীয়তঃ একজন পুরুষ যতটা নারীর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়, ঠিক ততটাই একজন নারী কোন পুরুষের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করে। এই জৈবিক চাহিদা একমাত্র পুরুষের নয়, নারীরও সমানভাবে আছে। নারী এই চাহিদাকে নিয়ন্ত্রণ করে প্রধানত ৪টি কারণে।
১) পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীর এই জৈবিক চাহিদাকে পূরণ করার স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেয় না।
২) প্রকৃতির নিয়মেই কেবল নারীকেই এই চাহিদা পূরণের ফলশ্রুতি হিসেবে কিছু দায়-দায়িত্ব পালন করতে হয়, যা পুরুষকে করতে হয় না।
৩) এই চাহিদা পূরণের পরিণতিতে একজন নারী সন্তান সম্ভবা হলে তাকে যে সামাজিক প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়, তা পুরুষতান্ত্রিক সমাজেরই তৈরি, তাই পুরুষকে তা বইতে হয় না।
৪) প্রাকৃতিক কারণে নারী পুরুষের তুলনায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দৈহিক দিক থেকে দুর্বল।
এই প্রতিবন্ধকতা না থাকলে আমরা পুরুষের মত কিছু নারীকেও হয়তো পুরুষের ধর্ষণকারী হিসেবে দেখতে পেতাম। প্রকৃতির দেয়া এই দায়-দায়িত্ব একজন নারী পালন করতে বাধ্য হয় বলে, পুরুষ কি নারীকে শৃঙ্খলিত রেখে নিজেকে শৃংখল মুক্ত রাখতে পারে?
আসলে আমাদের চিন্তার গভীরে রয়েছে লিঙ্গ ভিত্তিক শ্রেণিবৈষম্য। অবাঞ্ছিত গর্ভধারণের দায় পুরুষকে নিতে হয় না বলেই তারা নারীর প্রতি দায় চাপিয়ে দেয়ার সাহস দেখায়।
হিজাব কি একমাত্র শালীন পোশাক?
এবারে আসুন, হিজাব বা বোরখাকে অন্ধভাবে চাপিয়ে দেওয়ার বিরোধিতা করলেই কিছু মানুষ প্রশ্ন করেন, তাহলে কি মেয়েরা অশ্লীল পোশাক পরে রাস্তায় দাঁড়াবে? এই প্রশ্নটার মধ্যে যুক্তির চেয়ে অযৌক্তিক ধারনার প্রাধান্য বেশি। তাই যুক্তিবিজ্ঞানের ভাষায় এটা অবৈধ যুক্তি। কারণ হিজাব বা পর্দাকে একমাত্র শালীন পোশাক বললে বাইরে আর যত পোশাক আছে তাদের সবটাকে অশ্লীল বলতে হয়। কিন্তু বাস্তবে তা তো নয়।
আসলে হিজাবকে স্বীকৃতি দিতে গিয়ে সমস্ত ট্রেডিশনাল কিম্বা আধুনিক পোশাককে অশ্লীল বলে দেয়ার মধ্যে সূক্ষ্ম চালাকি রয়েছে। এই চালাকির ভিত্তি হলো পুরুষতান্ত্রিক একপেশে সুবিধাবাদী মানসিকতা। একজন পুরুষের যদি শালীন যেকোনো পোষাক পরার অধিকার থাকে, তাহলে একজন নারীরও সেই অধিকার রয়েছে। তাই শালীনতার প্রশ্নে পুরুষ কখনোই নারীর তুলনায় অধিক স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে না। ইসলাম সমতার ধর্ম, সেখানে নারী-পুরুষের মধ্যে সাম্যের কথা বলা হয়েছে বলে দাবী করবেন, আবার নারীর ঘাড়ে শালীনতা ও শৃঙ্খলা রক্ষার সমস্ত দায় চাপিয়ে দেবেন, এটা এক ধরনের ভন্ডামি।
আপনি আপনার দৈহিক সৌন্দর্য দেখিয়ে একজন নারীকে আকর্ষিত করার চেষ্টা করবেন, আর নারীকে বলবেন তাকে তার সৌন্দর্যকে আবৃত রাখতে, এটা অযৌক্তিক, বৈষম্যমুলক এবং অবশ্যই শস্ত্র (কোরআন) সম্মত নয়।
* লেখাটি এই সময় দৈনিক সংবাদপত্রে পাঠানো হয়েছে।
১৬/০৩/২০২২
সম্পাদক হিরাক বাবুকে হোয়াটস অ্যাপ-এ পাঠানো হয়েছে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন