তালিবান উত্থানের নেপথ্য : আমেরিকার দায় ও দায়িত্ব
আলী হোসেন
সভ্যতার সূচনালগ্নে মানুষ প্রায় অন্যান্য প্রাণীদের মতই জীবন-ধারণ করত। বেঁচে থাকার জন্য অন্যদের মতই খাদ্য সংগ্রহ ও জীবনের নিরাপত্তা বিধানই ছিল তাদের প্রধান লক্ষ্য। কিন্তু অন্য প্রাণীদের তুলনায় মানুষের চিন্তন ক্ষমতা ও দৈহিক গঠন উন্নত হওয়ায়, তাকে কাজে লাগিয়ে খাদ্য উৎপাদন শুরু করে তারা। এই সূত্রেই জন্ম নেয় ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধারণা। সম্পত্তির উপর অধিকার কায়েম করতে গিয়েই বাধে গোষ্ঠী-লড়াই। জন্ম হয় রাজনীতি তথা রাজনৈতিক ক্ষমতার। এই ক্ষমতার লড়াইয়ে জয়লাভ করেছে সেই ব্যক্তি বা ব্যক্তি-গোষ্ঠী, যার পেশী ও মাথার জোর ছিল বেশী।
লক্ষ লক্ষ বছরের বিবর্তনের পথ বেয়ে সেই রাজনৈতিক ক্ষমতার দ্বন্দ্বই আজ বর্তমান চেহারা নিয়েছে। আসলে মানব সভ্যতার ইতিহাসের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হল এই ক্ষমতা দখলের লড়াই।
অন্যদিকে উন্নত চিন্তাশক্তিকে কাজে লাগিয়ে মানুষ বোঝার চেষ্টা করেছে, জগত ও জীবনের রহস্য উদ্ঘটনের। জানার চেষ্টা করেছে, সে কোথা থেকে এল, কেন সে রোগাক্রান্ত হয়, কেনই-বা মারা যায়। কেন প্রাকৃতিক দূর্যোগ হয়? এগুলোর থেকে মুক্তিরই বা উপায় কী?
এই প্রশ্নেই মানুষকে দুভাগে ভাগ হয়ে যেতে দেখছি ইতিহাসের পাতায়। এক পক্ষ তাদের গভীর পর্যবেক্ষণ শক্তিকে কাজে লাগিয়ে খুঁজে পেয়েছেন কার্য-কারণ সম্পর্কের। এই সম্পর্কের মূল কথা হল জগতের সমস্ত ঘটনার পিছনে রয়েছে কোন-না-কোন লৌকিক, জাগতিক কিম্বা মহাজাগতিক কারণ, যার সবই বস্তুগত। এরা হলেন বিজ্ঞানমনস্ক, প্রগতিশীল, যুক্তিবাদি মানুষ। এদের হাত ধরেই জন্ম নিয়েছে বিজ্ঞান।
অন্য পক্ষ জাগতিক রহস্যের পিছনে দেখেছেন, অলৌকিক শক্তির হাত। তাকেই নিয়ন্ত্রনকারী ধরে নিয়ে তাকে সন্তুষ্ট করার জন্য শুরু করে প্রকৃতি পূজা তথা মূর্তিপূজা। মানব প্রকৃতির বৈশিষ্ট্য হল, সহজ ও অনায়াসে সাফল্য লাভের প্রতি অদম্য টান। সেই টানই অলৌকিক শক্তির প্রতি আসক্ত করে তোলে মানুষকে। এদেরই কল্পনায় প্রথম জন্ম হয় ধর্ম, ঈশ্বর, ধর্মগুরু ও ধার্মীকের। রোগের কারণ খুঁজে তা থেকে মুক্তির চেয়ে কল্পিত শক্তিকে খুশি করে মুক্তির চেষ্টা অনেক সহজ ও দ্রুত ভেবে সংখ্যাগুরু মানুষ ধর্ম আর ধর্মগুরুর স্মরণাপন্ন হতে শুরু করে।
রাজনৈতিক ক্ষমতালোভীদের হাতে চলে আসে আরও এক নতুন অস্ত্র। মানুষকে নিজের নিয়ন্ত্রনে রাখার ও আনার কাজে পেশীশক্তি ও বৌদ্ধিক শক্তির সাথে যুক্ত হয় ধর্ম তথা ধর্ম-সংগঠন। শুরু হয় মানব সভ্যতার ইতিহাসের নতুন অধ্যায়। যিনি ধর্মগুরু, তিনিই বনে যান রাষ্ট্রগুরু। ইতিহাস বলছে, এই উদ্দেশ্যেই ৩৩০০ বছর আগের চতুর্থ আমেনহোটেপ মিশরে বহুত্ববাদের জায়গায় নিয়ে আসেন একেশ্বরবাদ। দেবতা আমুন এর জায়গার আনলেন সূর্যদেবতা ‘আটেন’কে । নিজের নাম রাখলেন আখেনাটেন অর্থাৎ ঈশ্বর আটেনের পুত্র। লক্ষ্য একটাই। নিজের ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করা।
ইউরোপীয় নবজাগরণের হাত ধরে, ধর্ম আর রাজনীতি আলাদা হয়। কিন্তু বিশ্বের বাকি অংশের অনেক জায়গায় এখনও প্রত্যক্ষ কিম্বা পরোক্ষভাবে রাজনৈতিক ক্ষমতালোভীরা ধর্মকেই কাজে লাগাচ্ছে ক্ষমতা দখলের হাতিয়ার হিসাবে। আল-কায়দা থেকে আইএসআইএস কিংবা আজকের বিশ্বরাজনীতি তোলপাড় করা তালিবানরা সেই কাজটাই করছে। মানুষের ধর্মীয় ভাবাবেককে কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক ও আর্থিক ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করছে্ তারাও।
তবে এদের উত্থানের ইতিহাস বেশ জটিল। ইসলামের আবির্ভাবের আগের এক হাজার বছর ধরে আরব দুনিয়া ছিল ‘অন্ধকারময় যুগ’ (আইয়াম-এ-জাহেলিয়াত)। হযরত মহম্মদ (স:) এই যুগের অবসান চেয়েছিলেন। দীর্ঘ চল্লিশ বছরের কর্মময় জীবন তাঁকে শিখিয়েছিল ‘সব মানুষই সমান এবং যে ব্যাক্তি ঈশ্বরের একান্ত অনুগত ও যিনি মানবকল্যাণে জীবন উৎসর্গ করেন তিনিই শ্রেষ্ঠ মানুষ’। এখানে ঈশ্বরের উল্লেখ বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। মহম্মদ উপলব্ধি করেছিলেন, অন্ধকার থেকে আলোয় আসতে গেলে দরকার সমাজ বিপ্লব, যা করতে দরকার মানুষের নিঃশর্ত সমর্থন।
এই সমর্থন পেতে তিনটি বিষয় ছিল খুবই জরুরী। ১) নতুন ধর্মদর্শন, যা মানুষের জন্য কল্যানকামী হবে ২) নিজেকে ঐশ্বরিক ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার কথা প্রচার করা। (এ কারণেই তিনি তার বক্তব্যে ‘ঈশ্বরের একান্ত অনুগত’ কথাটি ব্যবহার করেছেন এবং নিজেকে নবী বা ‘আল্লার বার্তাবাহক’ বলে দাবী করেছেন)। ৩) পুরানো ব্যবস্থা ভাঙতে দরকার রাষ্ট্রশক্তি তথা রাজনৈতিক ক্ষমতা, যা একান্তই জনসমর্থনের উপর নির্ভরশীল। এই তিন প্রয়োজনেই তাঁর হাত ধরে ইসলাম আত্মপ্রকাশ করে নতুন এক মানবিক চেহারায়। অর্থাৎ সমাজের প্রয়োজনে রাজনৈতিক ক্ষমতা আর রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রয়োজনে নতুন ধর্মদর্শনের স্বরণাপন্ন হলেন তিনিও।
কিন্তু মহম্মদের মৃত্যুর পর আস্তে আস্তে পরিবর্তন এসেছে এই সূত্রের । ইতিহাস বলছে, নানা টানাপোড়েনের মধ্যেও চারজন খলিফা তাঁর লক্ষ্যটাকে মোটামুটি ঠিক রাখতে পেরেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে মহম্মদের (স:) তৈরি এই সূত্রও পাল্টে যায়। ভ্রাতৃত্বের বন্ধন, যা ইসলামের ভিত্তিকে দৃঢ় করেছিল, তাও আস্তে আস্তে বেমালুম উবে যায় মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক আকাশ থেকে। জন্ম হয় নতুন সূত্রের.. ব্যক্তির আর্থিক ক্ষমতার প্রয়োজনে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করা প্রয়োজন, আর রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের প্রয়োজনে ধর্মের ব্যবহার প্রয়োজন। অর্থাৎ সমাজের পরিবর্তে ব্যক্তির আর্থিক প্রয়োজনই গুরুত্ব পেতে শুরু করে এই সময় থেকে।
আর এই নতুন সূত্রের কারণেই ইসলামী ধর্মদর্শন তথা রাষ্ট্র-দর্শন প্রথমে শিয়া-সুন্নি এবং পরে আরও অনেক ভাগে বিভক্ত হয়েছে, হয়েছে বিকৃত। রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্যই তা করা হয়েছে।
তালিবান, আল-কায়দা, কিম্বা আইএসআইএস, এদের উৎপত্তির ইতিবিত্ত লুকিয়ে রয়েছে এই নয়া সূত্রের মধ্যেই। এর মধ্যেই রয়েছে ১) শিয়া-সুন্নির আধিপত্যের লড়াই, ২) রয়েছে এই লড়াইকে কাজে লাগিয়ে ইউরোপীয় ও আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদী শক্তির মধ্যপ্রাচ্যে নয়া সাম্রাজ্যবাদ কায়েম করার ষড়যন্ত্র এবং ৩) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সোভিয়েত ইউনিয়নকে ভেঙে ধনতান্ত্রিক অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে তোলার চক্রান্ত।
এই লক্ষ্যেই সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে লড়াই করার ও তৎকালীন সোভিয়েত সমর্থিত বামপন্থী নজিবুল্লাহ সরকারকে উৎখাত করার জন্য আমেরিকা পাকিস্তানের শরাণার্থী শিবিরের তরুণদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেয়। সহযোগিতা করে পাকিস্তান। এই তরুণরা বেশিরভাগই ছিল মাদ্রাসার ছাত্র অর্থাৎ তালেব। এরা মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই দুর্ধর্ষ যোদ্ধা বাহিনীতে পরিণত হয়ে অতি দ্রুত পুরো আফগানিস্তান দখল করে তালেবানি শাসন কায়েম করে। নেতৃত্বে ছিলেন মোল্লা মহম্মদ উমর । সাহায্যে এগিয়ে আসে আল কায়দা নেতা ওসামা বিন লাদেন, যার পিছনে মদতদাতা আমেরিকা। কী বিপুল পরিমাণ অর্থ আমেরিকা এই কাজে ব্যয় করেছিল তা জানা যায় ভয়েস অব আমেরিকার কলকাতা সংবাদদাতা গৌতম গুপ্তের একটি প্রতিবেদন থেকে। ফলে সোভিয়েত ইউনিয়ন এক রকম বাধ্য হয়ে ১৯৯৬ সালে আফগানিস্থান ত্যাগ করে। শুরু হয় তালিবান শাসন।
এ পর্যন্ত সব ঠিকঠাকই ছিল। সোভিয়েতের ভাঙনের পর লাদেনের প্রয়োজন ফুরিয়ে আসে। লাদেন ফিরে আসে সৌদি আরব। এবার নজর দেয় ফিলিস্তিনীদের সমর্থনে, ইসরাইলের বিপক্ষে। ইসরাইল হল মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার আধিপত্য কায়েমের রক্ষাকবচ। ফলে বেঁকে বসে আমেরিকা। এই পরিস্থিতিতে মোল্লা উমরকে লাদেনের বিরুদ্ধে যাওয়ার নির্দেশ আসে। উমর তা অস্বীকার করলে নিজের হাতে তৈরি তালিবান গোষ্ঠীও চলে আসে আমেরিকার খতম তালিকায় । এই ঘটনাক্রম এবং উমর-লাদেনের বিদ্রোহী আত্মা আমেরিকার ঘুম কেড়ে নেয়। শুরু হয় লাদেন ও মোল্লা উমরের বিরুদ্ধে নতুন পরিকল্পনা। যার পরিণতি ২০০১ সালে আফগানিস্থানে তালিবান জমানার সমাপ্তি এবং পরবর্তীতে লাদেনের মৃত্যু।
তালিবান ও আল-কায়দাকে কখনও দ্বিমুখী, কখনও ত্রিমুখী কাজে ব্যবহার করে আসছে আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ। প্রথমতঃ ইসলামের নাম ভাঙ্গিয়ে এক শ্রেণীর যুবককে শত্রুর বিরুদ্ধে ব্যবহার করা, দ্বিতীয়তঃ এই উদ্দেশ্য হাসিলের পর সরলমনা ধর্মপ্রাণ যুবকদের ইসলামের নামে ধর্মান্ধতার মধ্যে ঠেলে দিয়ে ও জঙ্গিবাদী শাসন প্রতিষ্ঠার কাজে ব্যবহার করে বিশ্ববাসীর কাছে ইসলাম সম্পর্কে আতঙ্ক ও খারাপ ধারণা ছড়িয়ে দেয়া এবং তৃতীয়তঃ এদেরকে সন্ত্রাসী তৎপরতায় ব্যবহার করে, সেই একই সন্ত্রাস দমনের নামে দেশে দেশে হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করা। ২০০১ সাল থেকে আমেরিকা এই ভূমিকায় নিয়োজিত থেকেছে আফগান ভূমিতে। গত ১৮ ই আগস্ট মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের কথাতেই তা পরিষ্কার হয়ে ওঠে, “আমরা আফগানিস্থানে দেশ পুনর্গঠনের জন্য যাই নি, গিয়েছি আমেরিকার সার্থে”।
আজ আমেরিকা আফগানিস্থান ছাড়ছে স্বার্থ ফুরিয়েছে বলেই। কিন্তু অন্য কোন চাল যে তার মাথায় ঘুরছে না, জোর দিয়ে বলা মুশকিল। তবে ভিয়েতনামের অভিজ্ঞতা এবং আফগান জাতির অদম্য স্বাধীনচেতা মনোভাব যা ১৮৩৮, ১৯৯৭ এবং ২০০১ থেকে যথাক্রমে ব্রিটিশ, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং আমেরিকা দেখে আসছে, তা তাকে ভাবাবে নিশ্চয়ই।
--------------------------
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন