প্রসঙ্গ মাধ্যমিক ও উচ্চমাধামিক পরীক্ষা : অতিমারী পর্বে শিক্ষার্থীদের লাভ-ক্ষতির হিসাব ও প্রাসঙ্গিক বিতর্ক
করোনা অতিমারী বিশ্বের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে গভীরভাবে আলোড়িত করেছে। তার অভিঘাত এখনও কাটিয়ে ওঠা যায় নি। বিশেষ করে আমাদের দেশে তা গভীর সংকটজনক পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছে। একথা সত্য যে, এই অতিমারীর মোকাবিলা করতে যে দূরদৃষ্টি ও বিজ্ঞানমনস্ক দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে সরকারের (বিশেষ করে কেন্দ্রের) কাজে নামা উচিত ছিল, তা তারা করে নি কিম্বা পারে নি। কেন পারে নি? তা বিশ্লেষণ এই আলোচনার বিষয় নয়। বিষয় হল এই পরিস্থিতির কারণে শিক্ষাব্যবস্থায় যে অভূতপূর্ব সংকট তৈরি হয়েছে সে বিষয়ে একটি সাম্প্রতিক বিতর্ক।
সম্প্রতি শিক্ষা-দপ্তর মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক
স্তরের পরীক্ষা (শিক্ষা বিজ্ঞানের ভাষায় মূল্যায়ন) বাতিল ঘোষণা করেছে।
প্রত্যাশিতভাবেই এতে ছাত্রছাত্রীদের লাভ-ক্ষতির হিসাব নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে দানা
বেধেছে নানা বিতর্ক। বলা বাহুল্য, লাভ নয়, ক্ষতির পরিমাণটাই বিতর্কের বিষয় হওয়া
উচিত বলে আমার মনে হয়েছে। কেননা, সাধারণ অবস্থায় পরীক্ষা না হলে লাভের চেয়ে, ক্ষতিই
যে বেশি হয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
বর্তমান অতিমারী পরিস্থিতিতে জীবন ও সম্পত্তির
ক্ষতি আমরা আটকাতে পারছি না। সরকারও বিভিন্ন ভুল পদক্ষেপের জন্য তা পারে নি। তাই পরীক্ষা
না হওয়াটা এমনই একটা ক্ষতি, যেটা মেনে
নেওয়া ছাড়া অন্য কোনও বিকল্প আমাদের সামনে নেই। তাই, লাভ নয়, ক্ষতি কীভাবে কতটা
কমানো যায়, বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু হওয়া উচিত সেটাই। এই প্রেক্ষাপটেই বিচার করতে
হবে, ‘পরীক্ষা নেওয়া উচিত কিংবা উচিত নয়’- এই বিষয়টির।
প্রথমেই উঠে আসে যে প্রশ্নটি তা হলো, পড়ালেন না,
বা পড়াতে পারলেন না যখন, তখন পরীক্ষা নেবেন কোন যুক্তিতে?
একথা ঠিক যে, অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলেমেয়েরা
অনলাইনে স্কুল (বেসরকারি) কিম্বা প্রাইভেট টিউশন থেকে কিছুটা পাঠ নিশ্চয়ই পেয়েছে।
এবং এক্ষেত্রে তারা প্রায় সবাই সিবিএসই বা আইসিএসই বোর্ড নিয়ন্ত্রিত বিভিন্ন
বেসরকারি স্কুলের পড়ুয়া। বাস্তবতা হচ্ছে, তাদের কোনো পরীক্ষা দিতে হচ্ছে না।
ইতিমধ্যেই তারা পরের ক্লাসের পড়াশুনা শুরু করেছে।
অন্যদিকে গরিব, নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত
ঘরের ছেলেমেয়েরা, তারা তেমন
কোনো সুবিধাই পায় নি। কিন্তু তাদেরকে পরীক্ষা দিতে বলছি। ভেবে দেখুন, আমরা নানা কারণে
এদের অনলাইন ক্লাস হয় নিই নি অথবা নিতে পরি নি। যুক্তি ছিল, গরীব-নিম্নবিত্তদের
কম্পিউটার বা স্মার্ট ফোন ও তাতে ডাটা
(ইন্টারনেট) প্যাকেজ ভরার সমর্থ নেই।
যুক্তিটা অনেকটাই সংগত। কিন্তু পুরোপুরি নয়।
কারণ, সরকারী অনুদানপ্রাপ্ত বিদ্যালয়ে যারা পড়ে, তারা প্রধানত মধ্যবিত্ত (বিশেষত,
গ্রামীণ এলাকায়), নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং দরিদ্র পরিবাবেরর ছেলেমেয়ে। অস্বীকার করা
যাবে না যে, তাদের অনেকেরই সেই ক্ষমতা নেই। কিন্তু খোঁজ নিলে দেখা যাবে, এদের একটা
অংশের হাতে কম দামের হলেও স্মার্ট ফোন ছিলো এবং আছে। যাদের আছে, তারা কিছুটা হলেও
অনলাইনের সুবিধা নিতে পারতো। কিন্তু অধিকাংশ সরকারী অনুদানপ্রাপ্ত স্কুল সার্কুলার
নেই এই অজুহাতে দায়িত্ব এড়িয়ে গিয়েছে। সুতরাং যাদের ক্লাসই নিলাম না, তাদের
পরীক্ষায় বসানোর যুক্তিটা কতটা যুক্তিবিজ্ঞান সম্মত সে প্রশ্ন থেকেই যায়।
এক্ষেত্রে আরও একটি সংগত প্রশ্ন উঠেছে, ক্লাস
রুমের পঠন-পঠনের সুবিধা কী অনলাইনে পাওয়া সম্ভব? উত্তর হলো, না। তাহলে এই ক্লাস
করে লাভ কী? এখানেও সেই একই ভুল। লাভের কথার চেয়ে ক্ষতির পরিমাণ কমানোটাই এখানে
আলোচ্য বিষয় হওয়া উচিত। অতিমারী পর্বে কেবলমাত্র হাতে গোনা গুটিকতক কর্পোরেট
সেক্টর ছাড়া লাভের মুখ দেখে নি কেউই। দেখার মত পরিস্থিতি তৈরি করার সামর্থ ও ইচ্ছা
কোনটাই আমাদের সরকারের মধ্যে তেমনভাবে চোখে পড়ে নি। সুতরাং লাভ নয়, ক্ষতি কমানোটাই
এখানে লাভ হিসাবে ধরতে হবে।
দু’ভাবে ক্ষতি কমানো যেতো। এক. যাদের সামর্থ
আছে, তারা কিছুটা হলেও শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পেতো । দুই. একেবারে বাড়িতে বসে যাওয়া
ছাত্রছাত্রীরা কিছুটা পড়াশোনা সংক্রান্ত কাজ পাওয়ার কারণে তা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে পারতো।
এতে তিনটি লাভ হওয়ার সম্ভাবনা ছিলো। প্রথমত, তাদের পড়াশোনার মধ্যে যুক্ত রাখা যেতো।
ফলে পড়াশোনা-ছুট থেকে স্কুল-ছুট হওয়ার সম্ভাবনার বা প্রবণতার গতিকে কিছুটা হলেও
মন্থর করা যেতো। দ্বিতীয়ত, এতে চুপচাপ বসে থেকে ‘অলস মস্তিস্ক শয়তানের আখড়া’
হওয়াজনিত সমস্যা, যা ছাত্রছাত্রীদের মানসিক চাপ তৈরি করে, কিছুটা হলেও তা
নিয়ন্ত্রিত হওয়ার সুযোগ পেতো। তৃতীয়ত, বাড়তি পাওনা হিসাবে পড়াশোনার কাজটা খানিকটা
হলেও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যেত। যেটা ‘নেই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো’র মতো ধরাই যায়।
প্রশ্ন উঠতে পারে, আমরা একটা অংশকে (যাদের
অনলাইনের সুবিধা নেই) বাদ দিয়ে অন্যের কথা ভাববো কোন যুক্তিতে?
এই যুক্তিটি আপাত দৃষ্টিতে বেশ শক্তিশালী,
কিন্তু অকাট্য ও প্রশ্নাতীত নয়। কারণ, প্রশ্ন উঠবে, স্বাভাববিক পরিস্থিতিতেও কী
আমরা সব ছেলেমেয়েরদের শিখন-সমর্থের নির্ধারিত লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে পারি? সরকারি
স্কুলের পরিকাঠামো, এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত কি ওই লক্ষ্যে পৌঁছানোর পক্ষে
যথেষ্ট? উত্তর হলো, না। আর সে কারণেই একটা ক্লাসের সমস্ত ছেলেমেয়েকে সমানভাবে সময়
ও মনোযোগ দিতে শিক্ষক-শিক্ষিকারা প্রায়শই পারেন না। সুতরাং স্বাভাবিক অবস্থায় যখন পারা
যায় না, তখন এই অতিমারীর সময় তা পারা যাবে আশা করি কীভাবে? এবং সেটাকে ইস্যু করে
কিছু লাভের সম্ভাবনাকে অস্বীকার করি কোন যুক্তিতে?
অস্বীকার করার উপায় নেই যে, শিখন সমর্থের নির্ধারিত লক্ষ্যে পৌছনটা
খুবই কঠিন একটি কাজ। তবে এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, এক শতাংশের কাছে পৌঁছানো গেলেও
সেটা সমাজের জন্য লাভজনক। এই ভাবনা থেকেই হাজারও সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সরকার প্রচুর
অর্থ খরচ করে শিক্ষা-ব্যবস্থাকে চালু রাখে।
আসলে এই সমস্যা থেকে মুক্তির রসদ ধনতান্ত্রিক
রাষ্ট্র-কাঠামোর কাছে নেই। বিশেষ করে আমাদের দেশে। অর্থই যেখানে সবকিছু প্রাপ্তির
মূল চাবিকাঠি, ব্যক্তির জন্য সম্পদের পুঞ্জীভবন যেখানে কোনভাবেই নিয়ন্ত্রিত নয়,
উল্টে নিয়ন্ত্রিত ধনবৈষম্যকেই যেখানে অর্থনীতির চালিকা শক্তি ভাবা হয়, শিক্ষাহীনতা,
দুর্নীতিপরায়ণতা, দুষ্কৃতী ও দুর্বৃত্তায়ণ যেখানে রাজনীতিকদের অলিখিত যোগ্যতা হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেখানে এই রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রেখে এই সমস্যার সমাধান আশা করা
বাতুলতা কিংবা বাচালতামাত্র। তাই, এখানেও সেই ক্ষতি কমানোর হিসাবটাই আমাদের
একমাত্র রক্ষা-কবজ ভাবা ছাড়া গত্যন্তর থাকে না।
সুতরাং, পুরো অংশকে সম্ভব নয় বলে, কিছু অংশের
ক্ষতি না আটকে, পুরটাকেই ক্ষতির খাতায় ফেলে দেওয়াটা কোনভাবেই যুক্তিযুক্ত মনে করা
যায় না। তাছাড়া, এই ‘পুরো অংশ’ তো আসলে সম্পূর্ণ অংশ নয়। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত এবং
কোন কোন ক্ষেত্রে নিম্ন মধ্যবিত্ত, যারা শত কষ্টের মধ্যেও সন্তানের শিক্ষার কোনও
সুযোগ থাকলে তা থেকে বঞ্চিত হতে দিতে চায় না, তারা তো বাইরে থাকছেই। অর্থাৎ তারা
তো অনলাইন ব্যবস্থার সুযোগ নিচ্ছে। সুতরাং কোনভাবেই সম্পূর্ণ অংশকে নিজের ভাবনার
আঙিনায় ধরে রেখে(শিক্ষা সুযোগ আটকে) শিক্ষাপ্রাপ্তির সমতাবিধান করতে যাওয়াটা
অযৌক্তিক। তাই এই প্রশ্ন অনেকটাই অবান্তর এবং কোনভাবেই বিকল্পহীন নয়।
ঠিক একই কারণে এই প্রশ্নটিই অন্য আর এক কঠিন
প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। আর তাহল, কোন যুক্তিতে সুবিধাবঞ্চিত
ছেলেমেয়েদের পরীক্ষায় বসতে বাধ্য করতে পরি? যখন সবাইকে আনতে পারা যাবে না বলে, অনলাইলে পড়ানো থেকে
বিরত থাকছি, তখন সেই ছেলেমেয়েদের পরীক্ষার বেঞ্চে ডেকে আনার কোনও নৈতিক ও যৌক্তিক
দাবি কি করা যায়?
প্রশ্ন উঠতে পারে। আর্থিক দিক থেকে অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলেমেয়েদের (দিল্লি বোর্ডের) কোন পরীক্ষাই দিতে হচ্ছে না। তা সত্ত্বেও তারা একটা মোটামুটি যুতসই গড় রেজাল্ট হাতে পাবে। অথচ গরীব-মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের ছেলেমেয়েদের পরীক্ষার দাবি করছি। হিসাবের এই নিরিখে দাবিটা কতটা যুক্তিযুক্ত? এরা সারা বছর কোনো পড়ার সুযোগ পেল না। স্কুল এবং স্কুলের শিক্ষকরাই ছিলো এদের একমাত্র ভরসার জায়গা। তা থেকে তারা বঞ্চিত হলো। উপযুক্ত প্রাইভেট টিউশন নিতে গেলে যে অর্থ দরকার হয়, তা তাদের এমনিতেই থাকে না। তার ওপর লকডাউনের কারণে অভিভাবকদের কর্মহীন হয়ে পড়া তো রয়েছেই। এই অবস্থায়, এই সব অভাবী ঘরের ছেলেমেয়েদের জোর করে পরীক্ষায় বসানোর সত্যিই কি কোনও যুক্তি আছে? এরা কীভাবে আশানুরূপ রেজাল্ট করবে? যদি না পারে, পরীক্ষা তবে কীভাবে সুবিচারের মাপকাঠি হয়?
তাই, যারা পরীক্ষা ব্যবস্থাকে সুবিচারের
মাপকাঠি ভাবছেন, তাদের ভাবনায় যুক্তি ও তথ্যের অপ্রতুলতাজনিত দুর্বলতা আছে। যুক্তি
ও তথ্য বলছে, পরীক্ষা নিলে কোনোভাবেই ছেলেমেয়েদের ওপর সুবিচার করা হত না। সব
বাবা-মা সন্তানের জন্য সাধ্যমত ভাবলেও বর্তমান পরিস্থিতি তাদের জন্য মোটেও অনুকূল
নয়। এটা সবাই হয়তো বুঝবেন না। কিন্তু ভুক্তভোগীমাত্রই বুঝবেন এবং বুঝছেন।
তাছাড়া, শুধুমাত্র আমাদের রাজ্যেই পরীক্ষা
বাতিল হয়েছে এমন তো নয়। পরিস্থিতি বিবেচনা করে অধিকাংশ রাজ্য ও কেন্দ্র সরকার
পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের অবজার্ভেশনও পরীক্ষা বন্ধের
পক্ষে।
সুতরাং তর্কের জন্য তর্ক করাই যায়। তাতে যুক্তির অভাব না থাকলেও বাস্তবতার নিরিখে অনেক সময় সেই যুক্তি বৈধতার মানদন্ড পেরতে পারে না। বর্তমান পরিস্থিতি
সেরকমই।
সবচেয়ে অবাক হওয়ার বিষয় হলো, যারা পরীক্ষা
বাতিলের বিরুদ্ধে, পারলে বিপ্লব করে ফেলেন, তাদের ছেলেমেয়েরা অধিকাংশই দিল্লি বোর্ডে (সিবিএসই কিম্বা
আইসিএসই) পড়ে। এবং এই বোর্ডগুলো অনেক আগেই পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই
সিদ্ধান্তের সময় কিন্তু তাদের অধিকাংশই চুপচাপ থেকেছেন। অথচ এখন যুক্তির জল বুনছেন
বর্তমান প্রজন্মের ভবিষ্যত অন্ধকার ভেবে। জানিনা এই দ্বিচারিতার কী যুক্তি এবং
ব্যাখ্যা আছে তাদের কাছে।
কেন্দ্র সরকারের অবৈজ্ঞানিক নীতি ও সিদ্ধান্ত
এবং রাজ্য সরকারের আরও মনোযোগী না হওয়ার কারণে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে পড়েছে।
মোদ্দাকথা হলো, ধৈর্য ধরা ছাড়া কোনও বিকল্প জনগণের
হাতে নেই। ‘আশায় মরে চাষার মত’ বুকে ভরসা নিয়ে তাই আসুন ভাবি, নিশ্চয়ই সময়
পাল্টাবে এবং সরকার বিকল্প পথের সন্ধানে এগিয়ে আসবে। আমরা আবারও ঘুরে দাঁড়াবো এই
বিশ্বাসে বুক বেঁধে ডুব সাতারে হলেও চলুন কিছুটা এগিয়ে ভাবার ও যাওয়ার চেষ্টা করি।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন