বিজেপি ও আরএসএস-এর রসায়ন সম্পর্কে সম্যক অবহিত আছেন, এমন মানুষদের সবাই জানেন বিজেপির সঙ্গে আরএসএস-এর গভীর সম্পর্কের কথা। এবং তাঁরা এটাও জানেন যে, আরএসএস দ্বারা বিজেপি নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয়। তাই এই দুই সংগঠনকে আপাতদৃষ্টিতে আলাদা মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে এরা আলাদা নয়। বরং এরা একে অপরের পরিপূরক।
অতিসম্প্রতি সঙ্ঘ পরিচালক মোহন ভাগবত ভারতে করোনা মোকাবেলায় বিজেপি সরকারের ব্যর্থতার অভিযোগ তুলেছেন এবং বিজেপি নেতৃত্বকে সমালোচনা করেছেন। বিজেপি বিরোধী অনেকেই ভাবছেন এটা আনন্দের খবর। ভাঙন ধরেছে হিন্দুত্ববাদী শক্তির। আসলেই কি তা-ই? কী রহস্য রয়েছে এই সমালোচনার নেপথ্যে? এপ্রসঙ্গেই পুনরায় প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, এই দুটি প্রতিষ্ঠান আদতে আলাদা কিনা। একটু গভীরে গিয়ে দেখলে বোঝা যায় যে, এরা মোটেও আলাদা কোনো প্রতিষ্ঠান নয়। একই উদ্দেশ্য সাধনকল্পে সঙ্ঘবদ্ধ একটি স্বার্থগোষ্ঠীর দু'টো মুখমাত্র। একটি রাজনৈতিক এবং অন্যটি সাংস্কৃতিক। তবে কে কাকে ছাপিয়ে যাবে কিংবা কে কাকে নিয়ন্ত্রণ করবে, এধরণের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব নিশ্চয়ই আছে। মনে রাখতে হবে, তার চরিত্র গোষ্ঠীগত নয়, তা অনেকটাই পারিবারিক দ্বন্দ্বের মতো।
কোন শাসক দলের রাজনৈতিক এজেন্ডা কার্যকরী করতে গেলে প্রধানত দুটো সমস্যা সামনে আসে। এক. পূর্ব-অভিজ্ঞতা না-থাকাজনিত ত্রুটি। এবং দুই. বিরোধীশক্তির প্রবল বিরোধিতা। বিজেপির জন্য যুক্ত হয়েছে আরও একটি বিশেষ সমস্যা। সেটা হল অন্ধ-বিশ্বাস ও কুসংস্কারকে আকড়ে এবং কখনও কখনও তা প্রয়োগ করে সমস্যা সমাধানের হাস্যকর প্রচেষ্টা। এই সব সমস্যাকে যথাযথভাবে সামাল দিতে না পারলে, রাজনৈতিক মুখটির 'পোড়া'র আশঙ্কাই থাকে বেশি। বিজেপি আজ সেই 'মুখ পোড়া' দশার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
এই ধরণের পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য দুটো পথ অবলম্বন করতে হয়, যেকোনো এককেন্দ্রিক স্বৈরশাসককে। প্রথমটি হল রাষ্ট্রীয় স্বশাসিত সংস্থাগুলোতে নিজ মতাদর্শের অনুসারী মানুষকে বসিয়ে তাকে নিয়ন্ত্রণ করা। এবং তাকে দিয়েই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া। কিম্বা রাষ্ট্রীয়ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করে অথবা ভয় দেখিয়ে এই সংস্থাগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা। অর্থাৎ নিজের পক্ষে কাজ করানো। সিবিআই, ইডি, নির্বাচন কমিশন ইত্যাদিকে তারা এভাবেই কাজে লাগিয়েছে বলে অনেকেই মনে করছেন।
দ্বিতীয়টি হল নিজের কাজের বৈধতা প্রমাণের জন্য এবং মানুষকে নিজের পক্ষে ধরে রাখার জন্য একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলা। একাজ হিটলার করেছিলেন। ১৯৪৯ সালে স্বাধীনতা লাভের পর চিনের কমিউনিস্ট শাসকেরাও করেছিলেন। এবং এখনও তারা তা করে যাচ্ছে। চিনের ক্ষেত্রে এই চেষ্টা সফল হলেও হিটলারের ক্ষেত্রে তা যে হয় নি, ইতিহাস সে সাক্ষ্য বয়ে বেড়াচ্ছে। আরএসএস নিজে এই দ্বিতীয় কাজটি করার প্রধান দায়িত্বপ্রাপ্ত সংগঠন।
প্রথম কাজটি বিজেপি যে মরিয়া হয়ে করার চেষ্টা করছে, তা আজ আর কারও অজানা নয়। গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত একটি সরকার যুক্তরাষ্ট্রীয় সাংবিধানিক রাষ্ট্র-কাঠামোর মধ্যে থেকেও এককেন্দ্রীক সরকারের মত কাজ করছেন বলে অহরহ অভিযোগ উঠছে। সম্প্রতি নারদা মামলায় সিবিআই-এর অযৌক্তিক ও অতিসক্রিয়তা এবং মুখ্যসচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়কে প্রথা ভেঙে অযৌক্তিক ভাবে দিল্লিতে বদলি করার সিদ্ধান্ত তারই সাম্প্রতিকতম উদাহরণ।
বাংলা-সহ কয়েকটি রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে আশানুরূপ ফল করতে পারে নি বিজেপি। তাই এখন প্রশ্ন উঠছে, দ্বিতীয় দায়িত্বটি পালন করার ক্ষেত্রে আরএসএস-ই বা কতটা সফল? একথা ঠিক যে, গোবলয়ে তাদের সাফল্য চোখে পড়ার মতো। কিন্তু বাংলা-সহ দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে এই দায়িত্ব পালনে ও সাফল্য অর্জনের ক্ষেত্রে এই সংগঠনটি যে এখনও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিতে পারে নি, তা অস্বীকার করা যাচ্ছে না।
বলে নেওয়া দরকার, এই কাজের জন্য আরএসএস সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে সামাজিক চেহারা দিয়ে মানুষের সামনে আনে এবং আস্তে আস্তে তা সমাজের বৃহত্তম অংশে ছড়িয়ে দিয়ে সাংস্কৃতিক বিপ্লব সংগঠিত করার চেষ্টা করে। ক্রমে এই সাংস্কৃতিক বিপ্লব জন্ম দেয় এমন এক জনগোষ্ঠী, যা একনায়কের জনভিত্তি তৈরি করে। এই জনভিত্তি তৈরির কাজটাই করছে আরএসএস। এরা সরাসরি রাজনীতি করে না। কিন্তু জনভিত্তি তৈরি করে পরোক্ষভাবে রাজনীতির নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠে। জনসমর্থনকে বিরোধী পক্ষে চলে যাওয়ার প্রবণতাকে আটকাতে সক্রিয় থাকাই হল তাদের মূল কাজ। তাই, বিজেপি ও আরএসএস আলাদা দুটি সংগঠন হলেও, প্রকৃত অর্থে তারা আলাদা নয়, একই মুদ্রার আলাদা পিঠ মাত্র।
আরএসএস এই সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মূল লক্ষ্য স্থির করেছে 'সংখ্যাগুরুর শাসন প্রতিষ্ঠা' করা। এবং মূলমন্ত্র ঠিক করেছে 'হিন্দুত্ব'। যদিও এদুটোই (সংখ্যাগুরুর শাসন ও হিন্দুত্ব) তাদের পোশাকি নাম কিম্বা ছদ্মবেশ মাত্র। কারণ তাদের এই পোশাকের আড়ালে আছে একটি অতিসংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর মানুষ ও তাদের কায়েমী স্বার্থসিদ্ধি করার তাগিদ। এরা মূলত ব্রাহ্মণ্যবাদের(মনুবাদের) সমর্থক ও অনুসারী। তাই তাদের এই 'হিন্দুত্ব' ও 'সংখ্যাগুরুর শাসন প্রতিষ্ঠা' বা 'হিন্দুরাষ্ট্র' প্রতিষ্ঠার বিষয়টি, বহিরাবরণের দিক থেকে সংখ্যাগুরু হলেও প্রকৃতপক্ষে (দৈহিক কাঠামোগত বাস্তবতার দিক থেকে) তা অতিসংখ্যালঘু। কারণ, এরা জনসংখ্যার মাত্র সাড়ে তিন শতাংশ (ব্রাহ্মণের শতকরা হার)। নিজেদের গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়গত স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য হিন্দুত্ব (যা প্রকৃত অর্থে ভারতের সমগ্র জনগোষ্ঠীর, ধর্ম-বর্ন নির্বিশেষে, সমন্বয়ে গঠিত বহুত্ববাদী সংস্কৃতিকে বোঝানো হয়) শব্দটা তারা ব্যবহার করে, বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সমর্থন আদায়ের কৌশল হিসেবে।
সাম্প্রতিক বাংলার নির্বাচনের ফলাফল বলছে, এই সাংস্কৃতিক বিপ্লব ঘটাতে আরএসএস তেমনভাবে এখনও সফল হয় নি। তবে, পুরোপুরি ব্যর্থ বলাটাও সত্য গোপন করার মত ভুল।
সুতরাং বিজেপির ব্যর্থতার দায় স্বাভাবিকভাবেই আরএসএস-এর ঘাড়েও গিয়ে পড়বে। বলা ভালো, পড়েছে। অর্থাৎ এতে দুটো প্রতিষ্ঠানেরই মুখ পুড়েছে।
বস্তুত, হিন্দুত্ববাদীদের জন্য বর্তমান ভারতের সামগ্রিক পরিস্থিতি এক গভীর সংকটের জন্ম দিয়েছে। বলা বাহুল্য, এই সংকটের জন্য বিজেপির অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতি এবং কর্মপরিকল্পনাই মূলত দায়ী। এই পরিস্থিতিতে তাদের নীতি ও কর্মসূচির প্রতি মানুষের অনাস্থা আসতে বাধ্য। এটা তারা ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছে। সময়মতো হাল ধরতে না পারলে জনগন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার ভয়ও যে আছে, এটাও তারা জানে।
আরএসএস প্রত্যক্ষভাবে কোনও রাজনৈতিক জামা পরে না। রাজনীতি নিরপেক্ষ চেহারায় সে জনগণের সঙ্গে মিশে থাকতে চায়। রাজনৈতিক জামা না পরে থাকাটা তার একটা ছদ্মবেশ বা বলা ভালো কৌশল। এতে সুবিধা হল, সাফল্য এলে ভাগিদার হতে বাধা নেই, অথচ ব্যর্থতার কোন দায় থাকে না। দাগহীন ভাবমূর্তি নিয়ে বেঁচে থাকা যায় জনমনের কাছে। এধরণের কৌশল নেওয়ার উদ্যেশ্য হচ্ছে জনগণকে 'হিন্দুত্ববাদী' ভাবনা বা চিন্তার যৌক্তিকতাকে অকাট্য হিসাবে তুলে ধরে জনগনের মধ্যে তাদের দর্শনকে বাঁচিয়ে রাখা এবং পরিস্থিতি অনুকূলে এলেই তাকে আবার এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। এভাবে হিন্দুত্ববাদী ভাবনার আড়ালে নিরঙ্গকুশ পুঁজিবাদী সমাজ গড়ে তোলাই এদের মূল লক্ষ্য।
নিরপেক্ষ ও স্বতন্ত্র অস্তিত্বের মোড়কে এভাবে নিজেকে আড়াল করার জন্যই বিজেপিকে তারা প্রয়োজনে সমালোচনা করে থাকে। মানুষকে বোঝাতে চায়, ভুলটা বিজেপি করেছে। ভুল ভাবে তাদের দর্শনকে কাজে লাগানোর কারণেই এই ব্যর্থতা। এর দায় তাই একমাত্র বিজেপির। আরএসএস-এরও নয়, এমনকি তাদের দর্শনেরও নয়। ঠিক এই প্রেক্ষাপটেই সঙ্ঘ প্রধান মোহন ভাগবত করোনা অতিমারী সম্পর্কে এই নির্মম সত্য উচ্চারণ করেছেন এবং বিজেপির সমালোচনা করেছেন। বলেছেন, 'অতিমারীর এই দ্বিতীয় ঝড় যে আসতে চলেছে, সেটা আমরা সবাই জানতাম। চিকিৎসকেরাও বারবার সাবধান করেছিলেন। তবু সরকার গা করেনি। এই অবহেলার জন্যই আজ এই হাল আমাদের।' এধরণের সত্যকে আশ্রয় করে এই বক্তব্যের উপস্থাপনা আরএসএস-এর দিক থেকে মানুষের মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টাকে অযৌক্তিক প্রতিপন্ন করবে বলে তারা বিশ্বাস করে। সেজন্যই তাঁর এই সত্য উচ্চারণ। সুতরাং ভাঙন নয়, এই মন্তব্য পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার কৌশল মাত্র।
একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আরএসএস তার নিজের প্রতি জনগণের এই আস্থা ধরে রাখতে পারলেই নির্বাচনের সময় সেই আস্থাকে সমর্থনে রূপান্তরিত করে খুব সহজেই বিজেপির ভোট বাক্সে পুনরায় ঠেলে দিতে পারবে। তারা তা বিশ্বাসও করে। সত্যি কথা বলতে কি, এভাবে ভাবাটাও এদেশে অবাস্তব কিছু নয়। কারণ, ভারতের মত ধর্মীয় আবেগসর্বস্ব ও সংস্কারাচ্ছন্ন জনগণকে (ব্যতিক্রমীদের বাদ দিয়ে) অবাস্তব ও অতিবাস্তব কিছু বিষয়ের উপস্থানের মাধ্যমে খুব সহজেই নিয়ন্ত্রণ করা যায়। তাদের কপালের লেখনই যে তাদের সকল দুর্ভোগের কারণ, এটা বোঝাতে খুব একটা বেগ পেতে হয় না। কিছুটা ব্যতিক্রমি ভাবনা রয়েছে শুধুমাত্র বাংলা ও কেরালায়। কিছুটা পাঞ্জাবেও।
সুতরাং বিজেপির এই দুর্দিনে জনগণের আস্থা ধরে রাখার জন্যই আরএসএস আজ বিজেপিকে এভাবে সমালোচনা করছে - একথা ভুললে আপনার ভুল আপনাকেই ছাপিয়ে যাবে। তাই আনন্দ বা উল্লাসের কিছুই নেই। আছে দেশ ও সময়কে নিয়ে আরও গভীরে গিয়ে ভাবার অভ্যাসের অবকাশ। আসুন সেটাই করি।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন