সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ইসরাইলি আগ্রাসন ও আমেরিকার দ্বিচারিতা

ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখলে, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসবাদী রাষ্ট্র যে আমেরিকা, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর তা লাগামহীন হয়ে উঠেছে। মূলত, গায়ের জোরে পেরে ওঠেনা বলে অধিকাংশ দেশ মুখ বন্ধ করে থাকে। ব্যতিক্রম শুধু মধ্যপ্রাচ্যের গুটিকতক (ইরান, তুরস্ক ইত্যাদি) দেশ।

চিনের উইঘুরদের নিয়ে আমেরিকার মায়া কান্নার শেষ নেই। অথচ, প্যালেস্টাইনিদের বেলায় চোখ বন্ধ করে থাকে সে। উল্টে ইসরাইলকে নির্লজ্জভাবে অস্ত্র যোগান দিয়ে আসছে এবং এখনও দিচ্ছে। এই অস্ত্র প্যালেস্টাইনি নিরীহ নারী-শিশুদের নির্বিচারে হত্যার কাজে ব্যবহার করছে ইসরাইল। উদ্দেশ্য একটাই, জোর করে ফিলিস্তিনিদের নতুন নতুন এলাকা জবর দখল করা এবং ইতিমধ্যেই অধিকৃত অঞ্চলে জবরদখল কায়েম রাখা। এই সব কর্মকাণ্ড দেখেও না দেখার ভান করে আসছে আমেরিকা। অথচ, এরাই মানবাধিকারের কথা বলে, জাতির আত্মনিয়ন্ত্রের কথা বলে।

এরাই গণতন্ত্রের কথা বলে চিনের বিরোধিতা করে। আবার এরাই মধ্যপ্রাচ্যের রাজতান্ত্রিক স্বৈরশাসকদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে যাচ্ছে যুগের পর যুগ। নির্লজ্জ দ্বিচারিতা এর চাইতে বেশি কী হতে পারে?

প্রশ্ন হল, আমেরিকার এই দ্বিচারিতা কেন? তার কারণ মূলত দুটো। এক. তারা চিনের বিরোধিতা করে অর্থনৈতির নীতিগত পার্থক্যের কারণে। দুই. সামরিক তথা নব্য-সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য। কারণ, চিনই সোভিয়েত পরবর্তী সময়ে এব্যাপারে তার একমাত্র প্রতিবন্ধক এবং প্রতিদ্বন্দ্বীও বটে।

আমেরিকা চিনের বিরুদ্ধে মুখ খোলে। কেন খোলে? পরে আসছি। ইসরাইলের বিরুদ্ধে খোলে না। খোলে না তার কারণ, ইসরাইল মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার (ইউরোপের অন্যান্য পরাশক্তিদেরও) নিয়ন্ত্রণ কায়েম রাখার একটা শক্তিশালী হাতিয়ার। তিনটি হিসাব এখানে কাজ করে।
এক. ইসরায়েলকে সামনে রেখে (ইসরাইলকে ঘুটি হিসাবে ব্যবহার করে) আরব দেশগুলোকে সামরিক তৎপরতায় ব্যতিব্যস্ত রাখা, যাতে তারা আমেরিকার অস্ত্র কিনতে বাধ্য হয়।
দুই. যাতে এই দেশগুলোর স্বৈরশাসকরা আমেরিকার বশংবত হয়ে থাকে। এবং
তিন. একইভাবে ইসরাইলকেও তাদের অস্ত্রের ক্রেতা হিসাবে পায়।

এছাড়া বর্তমানে অস্ত্র উৎপাদনে প্রযুক্তিগত ও আর্থিক বিষয়ে যৌথ বিনিয়োগ ও সহযোগিতার নির্ভরযোগ্য পাটনার হিসাবে পাওয়ার বিষয়টিও গুরুত্ব পাচ্ছে। বিশেষ করে ইসরাইলের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা 'আয়রন ডোমে'র প্রযুক্তি ও তার উন্নততর সংস্করণ তৈরিতে আমেরিকা ইসরাইলকে পাশে পেতে চায়।

গণতন্ত্রের বিরোধিতা করা এবং তাকে গলাটিপে হত্যা করা সত্বেও আরবীয় রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে আমেরিকা কথা বলে না। বলে না, কারণ দুটো। এক অস্ত্র বিক্রি করা সহ বিভিন্ন বাণিজ্যিক সুবিধা আদায় করা। দুই. পৃথিবীর সর্ববৃহৎ পেট্রোলিয়াম ক্ষেত্র আরবদের নিয়ন্ত্রণে। তাই তার নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে রাখার বাধ্যবাধকতা।

কেন? কারণ, এই তেলই এখনও পর্যন্ত বিশ্বের অন্যতম সেরা চালিকাশক্তি। বিকল্প শক্তির উৎপাদন ব্যাপকতর ও সহজলভ্য না হওয়া পর্যন্ত এই পরিস্থিতি পাল্টাবে না। তাই এই তেলের দামের ওপর নির্ভর করে বিশ্ব অর্থনীতির ওঠাপড়া। ফলে এই তেলের ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ না রাখতে পারলে আমেরিকার দাদাগিরি কেউ মানবে না। সেকারণেই সেখানে নিয়ন্ত্রণ চাই তার। তাতে গণতন্ত্র চুলোয় যায়, যাক। গাওনি গাওয়ার জন্য তো চিন হাতে আছেই।

তেল নিয়ে দ্বিতীয় হিসাব হল, আমেরিকার নিজস্ব তেল উৎপাদন ব্যবস্থা। কম হলেও সেটা আছে। বৈজ্ঞানিক উপায়ে পেট্রালিয়াম উৎপাদন করে আমেরিকা। যার মূল্য প্রাকৃতিকভাবে পাওয়া আরবীয় তেলের চেয়ে দাম স্বাভাবিকভাবেই বেশি। একারণে তার বাজার সবসময় বেশ চ্যালেঞ্জের মুখে থাকে। আমেরিকা চায় আরব দেশগুলো তেলের উৎপাদন সীমিত রেখে বিশ্বে তেলের মূল্য একটি নির্দিষ্ট উচ্চতায় রেখে দিক। এতে তার মহার্ঘ তেলের বাণিজ্য শক্তিশালী হবে। গণতন্ত্রের গণকবর দিয়ে তাই আরবীয় স্বৈরতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রেখেছে আমেরিকা। আর তার বিনিময়ে প্যালেস্টাইনে গণহত্যা হলেও আমেরিকার মত আরব দেশগুলোও জেগে ঘুমায়। ইসলামিক ভ্রাতৃত্ববোধ এখানে কাজ করে না।

অন্যদিকে চিন নিয়ে চিন্তার অন্ত নেই আমেরিকার। কারণ, চিন প্রথমদিকে কট্টর সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি অনুসরণ করতো। এই অর্থনীতি কঠোরভাবে সরকার তথা সমাজ-নিয়ন্ত্রিত। সম্পদে ব্যক্তি মালিকানা সেখানে নিষিদ্ধ। স্বাভাবিকভাবেই এই অর্থনীতির প্রচার ও প্রসার আমেরিকার চক্ষুশূল। বিরোধিতা তাই চিনের স্বাধীনতার সময় থেকেই।

কিন্তু এই অর্থনীতির কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। জীবনজীবীকার মান খুব উচ্চ না হলেও অনিশ্চয়তার অনুপস্থিতির কারণে মানুষের মধ্যে প্রতিযোগিতার মনোভাব গড়ে ওঠে না। ফলে তিনটি সমস্যা দেখা দেয়।
এক. নতুন উদ্ভাবন ও উন্নয়নের গতি খানিকটা হলেও কম হয়। দুই. অভাব না থাকলেও এখানে মানুষের জীবনযাত্রার মান ইচ্ছামত উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া যায় না। কারণ, ব্যক্তিমালিকনা সেখানে স্বীকৃত নয়। তাই যোগ্যতম মানুষের মনে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। তিন. ব্যক্তির সামাজিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য বিষয়ে সমস্ত দায়িত্ব সরকার গ্রহণ করায় সরকারি তহবিল অপেক্ষাকৃতভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে ধনতান্ত্রিক দেশগুলি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত গবেষণা, বিশেষ করে প্রতিরক্ষা খাতে এবং পররাষ্ট্র নীতিকে নিজের অনুকূলে রাখতে অন্য পিছিয়েপড়া দেশগুলোকে আর্থিকভাবে সাহায্য ও সহযোগিতা করার যে নীতি নিয়ে থাকে আমেরিকাসহ ধনতান্ত্রিক দেশগুলো, তা সম্ভব হয় না। এই কারণে পররাষ্ট্র নীতির সাফল্য ও অন্যান্য দেশের সমর্থন ও আনুকূল্য পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। এককথায় ধনতান্ত্রিক দেশগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় এটে ওঠা কঠিন হয়ে ওঠে। এই পরিস্থিতিতে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর অস্তিত্বই সংকটে পড়ে যায়। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন তার জলন্ত উদাহরণ।

এই পরিস্থিতি থেকে বের হতে গিয়ে চিন তার আর্থিক নীতি সংস্কার করেছে। তবে তা ধনতান্ত্রিক দেশগুলোর মতো নিরেট ধনতন্ত্র নয়। সীমিত আকারে ব্যক্তি মালিকানার সুযোগ দিয়ে মানুষকে প্রতিযোগিতায় নামাতে চেয়েছে চিন। তথ্য বলছে, একাজে চিন অনেকটাই সফল। এই সমাজতান্ত্রিক ও ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির সমন্বয়ের ফলে করোনা অতিমারীর সময়ে কঠোর লকডাউনের নীতি ও চিকিৎসা খাতে যথাযথ ব্যয় বরাদ্ধ করে চিন সরকার দেশকে গভীর সংকটের হাত থেকে রক্ষা করেছে শুধু নয়, দেশের অর্থনীতিকে আরও চাঙ্গা করে তুলেছে, যা কোনও ধনতান্ত্রিক দেশ পারে নি।

কিন্তু আমেরিকা সমাজতান্ত্রিক কিংবা 'সমাজতান্ত্রিক ধাঁচে'র - কোনটাই সমর্থন করে না। বলা ভালো, এই ধরণের  অর্থনীতির সে ঘোর বিরোধী। স্বাভাবিকভাবেই এই অর্থনীতি পৃথিবী ব্যাপী ছড়িয়ে পড়ুক, তা সে চায় না। সে চায় না, চিন তার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠুক। কিংবা তাকে ছাড়িয়ে যাক।

এই পরিস্থিতিতেই আমেরিকা চিনের বিরোধিতা করে। এবং মানুষকে চিনের দ্বারা প্রভাবিত না হতে উৎসাহিত করে। মানুষকে বোঝাতে চায় চিনে গণতন্ত্র নেই। সেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়। জাতির আত্মনিয়ন্ত্রের অধিকার সেখানে মানা হয় না। এই প্রসঙ্গেই চিনের উইঘুর জনজাতির ওপর 'নির্মম নির্যাতনে'র কথা আমেরিকা গলা উঁচিয়ে বলে থাকে।

মজার ব্যাপার হলো, প্যালেস্টাইনে এই সব বিষয়গুলো নির্মমভাবে লঙ্ঘন করছে ইসরাইল। আর তাকে আর্থিক, সামরিক ও নৈতিক সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে আমেরিকা। তারা মানবাধিকারের কথা বলে, আত্মনিয়ন্ত্রের কথা বলে, অথচ একবারও ভেবে দেখে না বা পৃথিবীর মানুষদের জানতে দেয় না যে, রেড ইন্ডিয়ানদের আত্মনিয়ন্ত্রের অধিকার কি ছিল না? কারা তাদের পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করেছে। আলাস্কার মানুষদের আত্মনিয়ন্ত্রের অধিকার থাকতে নেই? উদাহরণ টানলে উপাখ্যান হয়ে উঠবে। আর সেই উপাখানের সবচেয়ে বড় খলনায়ক হচ্ছে আমেরিকা। বিশ্ব ইতিহাসই তার সাক্ষী, একথা বলাই বাহুল্য।
--------------//------–---
২০/০৫/2021
প্রকাশ : দিনদর্পন দৈনিক সংবাদপত্র
২৪/০৫/২০২১

মন্তব্যসমূহ

📂 আলী হোসেনের জনপ্রিয় প্রবন্ধগুলি

হিন্দু কারা? তারা কীভাবে হিন্দু হল?

হিন্দু কারা? কীভাবে তারা হিন্দু হল? যদি কেউ প্রশ্ন করেন, অমিত শাহ হিন্দু হলেন কবে থেকে? অবাক হবেন তাই তো? কিন্তু আমি হবো না। কারণ, তাঁর পদবী বলে দিচ্ছে উনি এদেশীয়ই নন, ইরানি বংশোদ্ভুত। কারণ, ইতিহাস বলছে পারস্যের রাজারা ‘শাহ’ উপাধি গ্রহণ করতেন। এবং ‘শাহ’ শব্দটি পার্শি বা ফার্সি। লালকৃষ্ণ আদবানির নামও শুনেছেন আপনি। মজার কথা হল আদবানি শব্দটিও এদেশীয় নয়। আরবি শব্দ ‘আদবান’ থেকে উদ্ভূত। সুতরাং তাঁর পদবীও বলছে, তিনিও এদেশীয় নন। ভাষাতত্ত্ব ও নৃতত্ত্বের বিশ্লেষণ বলছে, উচ্চবর্ণের বিশেষ করে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের মানুষদের, উৎসভূমি হল পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চল। তারও আগে ছিল ইউরোপের ককেশাস অঞ্চলে। আসলে এরা (উচ্চবর্ণের মানুষ) কেউই এদেশীয় নয়। তারা নিজেদের আর্য বলে পরিচয় দিতেন এবং এই পরিচয়ে তারা গর্ববোধ করতেন। সিন্ধু সভ্যতা পরবর্তীকালে তারা পারস্যের বিভিন্ন এলাকা থেকে হিন্দুকুশ পর্বতের গিরিপথ ধরে এদেশে অভিবাসিত হয়েছেন। আর মধ্যযুগে এসে এদেরই উত্তরসূরী ইরানিরা (অমিত শাহের পূর্বপুরুষ) অর্থাৎ পারস্যের কিছু পর্যটক-ঐতিহাসিক, এদেশের আদিম অধিবাসীদের ’হিন্দু’ বলে অভিহিত করেছেন তাদের বিভিন্ন ভ্রমণ বৃত্তান্তে।

রবীন্দ্রনাথের ধর্মভাবনা ও তার বিবর্তন

রবীন্দ্রনাথের ধর্মভাবনা ও তার বিবর্তন আলী হোসেন  যদি প্রশ্ন করা হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ধর্ম কী? মনে হয় অনেকেই ঘাবড়ে যাবেন। কেউ বলবেন, তাঁর বাবা যখন ব্রাহ্ম ছিলেন, তখন তিনি নিশ্চয়ই ব্রাহ্ম হবেন। যারা লেখাপড়া জানেন না, তারা বলবেন, কেন! উনি তো হিন্দু ছিলেন। আবার কেউ কেউ তথ্য সহযোগে এও বলার চেষ্টা করবেন যে, উনি নাস্তিক ছিলেন। না হলে কেউ বলতে পারেন, ধর্মমোহের চেয়ে নাস্তিকতা অনেক ভালো?¹ রবীন্দ্রনাথের ধর্ম ভাবনার বিবর্তন  তাহলে সঠিক উত্তরটা কী? আসলে এর কোনোটাই সঠিক উত্তর নয়। চিন্তাশীল মানুষ-মাত্রই সারা জীবন ধরে ভাবতে থাকেন। ভাবতে ভাবতে তাঁর উপলব্ধি এগোতে থাকে ক্রমশঃ প্রগতির পথে। এই সময়কালে জগৎ ও জীবন থেকে তথ্য সংগ্রহ করে একে একে গড়ে তোলেন জীবনদর্শনের নিত্যনতুন পর্ব। তাই এ ধরনের চিন্তাশীল মানুষ আজীবন এক এবং অখণ্ড জীবনদর্শনের বার্তা বহন করেন না। সময়ের সাথে সাথে পাল্টে যায় তাঁর পথচলার গতিমুখ, গড়ে ওঠে উন্নততর জীবন দর্শন। মানুষ রবীন্দ্রনাথও তাই পাল্টে ফেলেছেন তাঁর জীবন ও ধর্মদর্শন; সময়ের এগিয়ে যাওয়াকে অনুসরণ করে। রবীন্দ্রনাথ ও  হিন্দু জাতীয়তাবাদ ১৮৬১ সালের ৭ই মে সোমবার রাত্রি ২টা ৩৮ মিনিট ৩৭ সেকেন

ভাগ্য : মুসলিম মনস্তত্ত্ব, ধর্মদর্শন ও প্রগতি

ভাগ্য : মুসলিম মনস্তত্ত্ব, ধর্মদর্শন ও প্রগতি - লিখছেন আলী হোসেন  কপালের লেখন খণ্ডায় কার সাধ্য? জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে কিংবা লেখাপড়া জানা-নাজানা নির্বিশেষে সমস্ত মানুষের সিংহভাগই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এই কথাটা মেনে নেয়। জীবনের উত্থান-পতনের ইতিহাসে কপালের লেখনকে জায়গা করে দিতে তারা কুণ্ঠাবোধ করে না। বরং বলা ভালো এব্যাপারে তারা অতিমাত্রায় উদার। মানুষের মনস্তত্বের এ-এক জটিল স্তর বিন্যাস। একই মানুষ বিভিন্ন সময়ে একই বিষয়ের বিচার বিশ্লেষণে ভিন্নভিন্ন দৃষ্টিকোণ ব্যবহার করে। এ রকমই একটি দৃষ্টিকোণ হলো কপাল বা ভাগ্যের ভূমিকাকে সাফল্যের চাবিকাঠি বলে ভাবা। কখনও সে ভাগ্যের নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠার চেষ্টা করে, আবার কখনও নিজেই ভাগ্যের কাছে নির্দিধায় আত্ম সমর্পন করে। নিজের ব্যার্থতার পিছনে ভাগ্যের অদৃশ্য হাতের কারসাজির কল্পনা করে নিজের ব্যার্থতাকে ঢাকা দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে থাকে। মজার কথা, এক্ষেত্রে মুসলিম মানসের মনস্তত্ত্ব কখনও চেতনমনে আবার কখনও অবচেতন মনে উপরওয়ালাকে (আল্লাহকে) কাঠ গড়ায় তোলে বিনা দ্বিধায়। নির্দিধায় বলে দেয়, উপরওয়ালা রাজি না থাকলে কিছুই করার থাকেনা। সাফল্য কিংবা ব্যর্থতা সবই তাঁর (আল্লার

সীমান্ত আখ্যান, বাঙালির আত্মানুসন্ধানের ডিজিটাল আখ্যান

সময়ের সঙ্গে সমস্যার চরিত্র বদলায়। কিন্তু মুলটা বদলায় না। যদি সে সমস্যা ইচ্ছা করে তৈরি হয়ে থাকে বিশেষ সুবিধা ভোগেই লোভে, তবে তো অন্য কথা চলেই না। স্বনামধন্য স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাতা সৌমিত্র দস্তিদারের ডকুমেন্টারি ফিল্প 'সীমান্ত আখ্যান' দেখার পর এই উপলব্ধি মাথা জুড়ে ঘুরপাক খাচ্ছে। দেখলাম, দেশ ভাগ হয়েছে। কিন্তু সমস্যার অবসান হয়নি। শুধু সমস্যার চরিত্রটা পাল্টেছে। এই যে সমস্যা রয়ে গেল, কোন গেল? তার উত্তর ও পাওয়া গেল 'সীমান্ত আখ্যান' এ। আসলে দেশ ভাগ তো দেশের জনগণ চাননি, চেয়েছেন দেশের নেতারা। চেয়েছেন তাঁদের ব্যক্তিগত, সম্প্রদায়গত সুবিধাকে নিজেদের কুক্ষিগত করার নেশায়। আর এই নেশার রসদ যোগান দিতে পারার নিশ্চয়তা নির্ভর করে রাজনৈতিক ক্ষমতার লাগাম নিজের হাতে থাকার ওপর। তাই রাজনীতিকরা এই ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য জনগণকে 'ডিভাইড এন্ড রুল' পলিছি দ্বারা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চেষ্টা করেছেন এবং করে চলেছেন। এ সমস্যা নতুন না, ব্রিটিশ সরকার এর বীজ রোপণ করে গেছেন, এখন কেউ তার সুফল ভোগ করছে (রাজনীতিকরা) আর কেউ কুফল (জনগন)। 'সীমান্ত আখ্যান চোখে আঙুল দিয়ে দে

কাশ্মীর ফাইলস : প্রপাগান্ডার এক নয়া ব্রান্ড, কর্পোরেট পুঁজি ও রাজনৈতিক দলের গলাগলির এক সুচারু প্রদর্শনী

কাশ্মীর ফাইলস : প্রপাগান্ডার এক নয়া ব্রান্ড, কর্পোরেট পুঁজি ও রাজনৈতিক দলের গলাগলির এক সুচারু প্রদর্শনী রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয় উলুখাগড়ার প্রাণ যায়। ১৯৪৭ সালের পর থেকে জম্মু ও কাশ্মিরের জনগণের ভাগ্যলিপিতে লেখা হয়ে গেছে এই বিখ্যাত প্রবাদটির বিস্তারিত সারাৎসার। একদিকে পাকিস্তান আর অন্যদিকে ভারত – এই দুই প্রতিবেশি দেশের ভুরাজনৈতিক স্বার্থের যাঁতাকলে পড়ে তাদের এই হাল। কিন্তু কেন এমন হল? এই প্রশ্নের উত্তর জানে না এমন মানুষ ভুভারতে হয়তো বা নেই। কিন্তু সেই জানার মধ্যে রয়েছে বিরাট ধরণের ফাঁক। সেই ফাঁক গলেই ঢুকেছে কাশ্মির ফাইলসের মত বিজেপির রাজনৈতিক ন্যারেটিভ যা তারা বহুকাল ধরে করে চলেছে অন্য আঙ্গিকে। এবার নতুন মাধ্যমে এবং নবরূপে তার আগমন ঘটেছে, যায় নাম সিনেমা বা সেলুলয়েড প্রদর্শনী। যদিও ডিজিটাল মাধ্যমে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সৌজন্যে অনেক আগেই সফলভাবে তারা এই ন্যারেটিভ দিয়ে বিভাজনের রাজনীতি করে চলেছে বেশ কয়েক বছর ধরে। টেলিভিশন সম্প্রচারে কর্পোরেট পুজির অনুপ্রবেশের মাধ্যমে যার সূচনা হয়েছিল। রাষ্ট্রশক্তিকে কুক্ষিগত করতে না পারলে দেশের সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রন আনা সম্ভব নয়, একথা সাধারণ নিরক্ষর নাগরিক এবং ত

শিক্ষা কী, কেন প্রয়োজন এবং কীভাবে অর্জন করা যায়?

শিক্ষা কী, কেন এবং কীভাবে অর্জন করতে হয়? সূচিপত্র : What is education, why it is needed and how to achieve it শিক্ষা কী শিক্ষা হল এক ধরনের অর্জন, যা নিজের ইচ্ছা শক্তির সাহায্যে নিজে নিজেই নিজের মধ্যে জমা করতে হয়। প্রকৃতি থেকেই সেই অর্জন আমাদের চেতনায় আসে। সেই চেতনাই আমাদের জানিয়ে দেয়, জগৎ ও জীবন পরিচালিত হয় প্রকৃতির কিছু অলংঘনীয় নিয়ম-নীতির দ্বারা। গভীর পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ শক্তিকে বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে কাজে লাগালেই এই নিয়মনীতিগুলো আমাদের আয়ত্বে আসে। এই নিয়ম-নীতিগুলো জানা এবং সেই জানার ওপর ভিত্তি করেই জগৎ ও জীবনকে সর্বোত্তম পর্যায়ে পৌঁছে দেয়ার পথ খুঁজে বের করার শক্তি অর্জনই শিক্ষা। মনে রাখতে হবে, এই শিক্ষা কখনও কারও মধ্যে জোর করে ঢুকিয়ে দেওয়া যায় না। এখন প্রশ্ন হল, শিক্ষা অর্জনের বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিটা আসলে কী। সেই আলোচনায় যাওয়ার আগে জানতে হবে, এই শিক্ষার সূচনা হয় কখন এবং কীভাবে? শিক্ষার সূচনা কখন হয় : এই অর্জনের সূচনা হয় মাতৃগর্ভে এবং তা প্রাকৃতিক ভাবেই। প্রকৃতির দেওয়া কিছু সহজাত শিক্ষাকে অবলম্বন করেই তার সূচনা। এই সহজাত শিক্ষাকে অবলম্বন করেই মানুষ তার পরবর্তী প

জল, না পানি : জল নিয়ে জলঘোলা করা পানির মত সহজ নয়

জল নিয়ে জলঘোলা করা পানির মত সহজ নয় আলী হোসেন  সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত সরকারি অনুষ্ঠানে চিত্র শিল্পী শুভাপ্রসন্ন ভট্টাচার্য পানি শব্দকে বাংলা নয় বলে দাবি করেছেন। বলেছেন, "আমরা কোনোদিন কখনও বাংলা ভাষায় পানি (শব্দটা) ব্যবহার করি না"। শুধু তা-ই নয়, পানি শব্দের ব্যবহারের মধ্যে তিনি 'সাম্প্রদায়িকতার ছাপ'ও দেখতে পেয়েছেন। প্রশ্ন হল - এক, এই ভাবনা কতটা বাংলা ভাষার পক্ষে স্বাস্থ্যকর এবং কতটা 'বাংলা ভাষার ইতিহাস' সম্মত? দুই, জল বা পানি নিয়ে যারা জলঘোলা করছেন তারা কি বাংলাকে ভালোবেসে করছেন? মনে হয় না। কারণ, খোঁজ নিলে দেখা যাবে, এরা কেউ নিজের সন্তানকে বাংলা মিডিয়াম স্কুলে পড়াননি বা পড়ান না। ব্যবহারিক জীবনেও তারা বাংলার ভাষার চেয়ে ইংরেজি বা হিন্দিতে কথা বলতে বা গান শুনতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন, বলা ভালো গর্ববোধ করেন। প্রসংগত মনে রাখা দরকার, বাংলা মিডিয়াম স্কুলগুলোতে যারা ভর্তি হয়, তারা অধিকাংশই গরীব ঘরের সন্তান। বলা ভালো, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে তারাই বাংলা ভাষাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। কারণ, সন্তানকে বাংলা মিডিয়ামে পড়ানোর পাশাপাশি, বা

নিম্নবর্গের মানুষ মার খাচ্ছে কেন

নিম্নবর্গের মানুষ কীভাবে পিছিয়ে পড়েছেন? সমাধান কীভাবে? এদেশের নিম্নবর্গের মানুষ নিজেদের বাঁচাতে যুগ যুগ ধরে ধর্ম পরিবর্তন করেছে। কখনও বৌদ্ধ (প্রাচীন যুগ), কখনও মুসলমান (মধুযুগ), কিম্বা কখনো খ্রিস্টান (আধুনিক যুগ) হয়েছে। কিন্তু কখনই নিজেদের চিন্তা-চেতনাকে পাল্টানোর কথা ভাবেনি। পরিবর্তন হচ্ছে অলংঘনীয় প্রাকৃতিক নিয়ম। যারা এই নিয়ম মেনে সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে পারে, তারাই লাভবান হয়, টিকে থাকে। “পাল্টে গেলেই জীবন বাড়ে না পাল্টালে নয়, জীবন মানেই এগিয়ে যাওয়া নইলে মৃত্যু হয়” জীবনের এই চরম সত্য তারা অধিকাংশই উপলব্ধি করতে পারেনি। পৃথিবীর যেকোন উন্নত জাতির দিকে তাকান, তারা দ্রুততার সঙ্গে এই পরিবর্তনকে মেনে নিজেদেরকে পুনর্গঠন করে নিয়েছে। যারা পারেনি বা নেয়নি তারাই মার খাচ্ছে, অতীতেও খেয়েছে। বুদ্ধিমান জাতি নিজের দুর্বলতাকে মেনে নেয় এবং ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য সময়ের সঙ্গে তাল রেখে নিজেদের চিন্তা এবং চেতনায় পরিবর্তন আনে। খ্রিষ্টান, ইহুদি-সহ এশিয়া, ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন জাতি - যারাই এই পরিবর্তন মেনে নিয়েছে তারাই আরও উন্নত এবং শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। মহানবীর (সঃ) গৌরবময় উত্থান (যা এক ধরণ

আধুনিক মিডিয়া : কর্পোরেট পুঁজির (পুঁজিপতিদের) তোতাপাখি

গোদি মিডিয়া : কর্পোরেট পুঁজির তোতাপাখি পশ্চিমী মিডিয়াকে 'ইসরাইল সরকারের তোতাপাখি' নামে পরিচয় দেওয়া হয় সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী স্বাধীন ও নিরপেক্ষ মিডিয়া হাউজের পক্ষ থেকে। সম্প্রতি একইভাবে ভারতীয় কর্পোরেট মিডিয়া ভারত সরকার তথা 'কর্পোরেট পুঁজির  তোতাপাখি' হিসাবে পরিচয় পাচ্ছে, যাকে নিন্দুকেরা 'গোদী মিডিয়া' নামে অভিহিত করে থাকে। মধ্যপ্রাচ্যের ঘটনা সম্পর্কে ইসরাইল যা বলে, ইউরোপ ও আমেরিকার মিডিয়া, তোতা পাখির মতো তা-ই প্রচার করে। সাংবাদিকতার প্রধান প্রধান শর্তগুলোকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ইসরাইলের দেওয়া তথ্যই তারা প্রচার করে অন্ধ ও নির্লজ্জভাবে। ভারতের ক্ষেত্রেও করপোরেট মিডিয়া বর্তমানে সেটাই করছে বলে অভিযোগ। অভিযোগ, নত মস্তকে ভারত সরকারের দেওয়া তথ্য বিনা বিচারে প্রচার করে চলেছে অধিকাংশ মিডিয়া হাউজ।  অর্থাৎ তাদের সম্প্রচারিত খবরের বড় অংশই হয় নিয়ন্ত্রিত অথবা কখনও কখনও অসত্য - এমন দাবিও করা হয়।  আসলে সিংহভাগ মিডিয়ার মালিক হচ্ছেন এক-একজন  করপোরেট পুঁজির মালিক বা পুঁজিপতি। এরা কি কখনও নিজের স্বার্থের বিরুদ্ধে যায় - এমন খবর, তথ্য বা তত্ত্ব প্রচার করবে? করবে না, করেও না। আর এ

সংখ্যালঘুর মুখই গণতন্ত্রের আয়না

  সংখ্যালঘুর মুখই গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় এবং শক্তিশালী আয়না। The face of the minority is the mirror of democracy কোন দেশ কতটা গণতান্ত্রিক, তা বোঝা যায় সে দেশের সংখ্যালঘু মানুষের জীবন ও সম্পত্তির সুরক্ষা কতটা মজবুত, তা থেকে। কারণ, সংখ্যালঘুর মুখই হচ্ছে গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় এবং শক্তিশালী আয়না। সংখ্যালঘুরা সঙ্গত কারণেই সংখ্যাগরিষ্ঠদের চেয়ে বেশি বঞ্চনাজনিত মনস্তাত্ত্বিক চাপে থাকে। এই চাপ দু’ভাবে তৈরি হয়। ১) সংখ্যাগিষ্ঠতাজনিত সুবিধা যা সংখ্যাগুরুরা পায়, সংখ্যালঘুরা কখনই তা পায় না বা পাবে না - এই ধারণা, যার কিছুটা হলেও ভিত্তি রয়েছে ২) সংখ্যাগরিষ্ঠদের মধ্যে বৃহত্তম (?) জনগোষ্ঠীর অংশ হওয়ার সুবাদে যে কর্তৃত্ববাদী মানসিকতা তৈরি হয় এবং যা বহুজনের মধ্যে দৃষ্টিকটুভাবে প্রকাশ হয়ে পড়ে, তার ভয়ে। এই চাপ কতটা গভীর তা সংখ্যালঘু ছাড়া বোঝা খুব মুশকিল। তবে আলোকপ্রাপ্ত মানুষ মাত্রই যে তা উপলব্ধি করতে পারেন, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। এই ধরণের চাপ তৈরি করে কিছু অসাধু মানুষ যখন সংখ্যালঘুদের জীবন ও সম্পত্তির সামনে হুমকি হয়ে দাঁড়ায়, তখন তা কমানোর ক্ষমতা একমাত্র গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রশক্তির হাতেই থাকে