ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখলে, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসবাদী রাষ্ট্র যে আমেরিকা, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর তা লাগামহীন হয়ে উঠেছে। মূলত, গায়ের জোরে পেরে ওঠেনা বলে অধিকাংশ দেশ মুখ বন্ধ করে থাকে। ব্যতিক্রম শুধু মধ্যপ্রাচ্যের গুটিকতক (ইরান, তুরস্ক ইত্যাদি) দেশ।
চিনের উইঘুরদের নিয়ে আমেরিকার মায়া কান্নার শেষ নেই। অথচ, প্যালেস্টাইনিদের বেলায় চোখ বন্ধ করে থাকে সে। উল্টে ইসরাইলকে নির্লজ্জভাবে অস্ত্র যোগান দিয়ে আসছে এবং এখনও দিচ্ছে। এই অস্ত্র প্যালেস্টাইনি নিরীহ নারী-শিশুদের নির্বিচারে হত্যার কাজে ব্যবহার করছে ইসরাইল। উদ্দেশ্য একটাই, জোর করে ফিলিস্তিনিদের নতুন নতুন এলাকা জবর দখল করা এবং ইতিমধ্যেই অধিকৃত অঞ্চলে জবরদখল কায়েম রাখা। এই সব কর্মকাণ্ড দেখেও না দেখার ভান করে আসছে আমেরিকা। অথচ, এরাই মানবাধিকারের কথা বলে, জাতির আত্মনিয়ন্ত্রের কথা বলে।
এরাই গণতন্ত্রের কথা বলে চিনের বিরোধিতা করে। আবার এরাই মধ্যপ্রাচ্যের রাজতান্ত্রিক স্বৈরশাসকদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে যাচ্ছে যুগের পর যুগ। নির্লজ্জ দ্বিচারিতা এর চাইতে বেশি কী হতে পারে?
প্রশ্ন হল, আমেরিকার এই দ্বিচারিতা কেন? তার কারণ মূলত দুটো। এক. তারা চিনের বিরোধিতা করে অর্থনৈতির নীতিগত পার্থক্যের কারণে। দুই. সামরিক তথা নব্য-সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য। কারণ, চিনই সোভিয়েত পরবর্তী সময়ে এব্যাপারে তার একমাত্র প্রতিবন্ধক এবং প্রতিদ্বন্দ্বীও বটে।
আমেরিকা চিনের বিরুদ্ধে মুখ খোলে। কেন খোলে? পরে আসছি। ইসরাইলের বিরুদ্ধে খোলে না। খোলে না তার কারণ, ইসরাইল মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার (ইউরোপের অন্যান্য পরাশক্তিদেরও) নিয়ন্ত্রণ কায়েম রাখার একটা শক্তিশালী হাতিয়ার। তিনটি হিসাব এখানে কাজ করে।
এক. ইসরায়েলকে সামনে রেখে (ইসরাইলকে ঘুটি হিসাবে ব্যবহার করে) আরব দেশগুলোকে সামরিক তৎপরতায় ব্যতিব্যস্ত রাখা, যাতে তারা আমেরিকার অস্ত্র কিনতে বাধ্য হয়।
দুই. যাতে এই দেশগুলোর স্বৈরশাসকরা আমেরিকার বশংবত হয়ে থাকে। এবং
তিন. একইভাবে ইসরাইলকেও তাদের অস্ত্রের ক্রেতা হিসাবে পায়।
এছাড়া বর্তমানে অস্ত্র উৎপাদনে প্রযুক্তিগত ও আর্থিক বিষয়ে যৌথ বিনিয়োগ ও সহযোগিতার নির্ভরযোগ্য পাটনার হিসাবে পাওয়ার বিষয়টিও গুরুত্ব পাচ্ছে। বিশেষ করে ইসরাইলের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা 'আয়রন ডোমে'র প্রযুক্তি ও তার উন্নততর সংস্করণ তৈরিতে আমেরিকা ইসরাইলকে পাশে পেতে চায়।
গণতন্ত্রের বিরোধিতা করা এবং তাকে গলাটিপে হত্যা করা সত্বেও আরবীয় রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে আমেরিকা কথা বলে না। বলে না, কারণ দুটো। এক অস্ত্র বিক্রি করা সহ বিভিন্ন বাণিজ্যিক সুবিধা আদায় করা। দুই. পৃথিবীর সর্ববৃহৎ পেট্রোলিয়াম ক্ষেত্র আরবদের নিয়ন্ত্রণে। তাই তার নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে রাখার বাধ্যবাধকতা।
কেন? কারণ, এই তেলই এখনও পর্যন্ত বিশ্বের অন্যতম সেরা চালিকাশক্তি। বিকল্প শক্তির উৎপাদন ব্যাপকতর ও সহজলভ্য না হওয়া পর্যন্ত এই পরিস্থিতি পাল্টাবে না। তাই এই তেলের দামের ওপর নির্ভর করে বিশ্ব অর্থনীতির ওঠাপড়া। ফলে এই তেলের ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ না রাখতে পারলে আমেরিকার দাদাগিরি কেউ মানবে না। সেকারণেই সেখানে নিয়ন্ত্রণ চাই তার। তাতে গণতন্ত্র চুলোয় যায়, যাক। গাওনি গাওয়ার জন্য তো চিন হাতে আছেই।
তেল নিয়ে দ্বিতীয় হিসাব হল, আমেরিকার নিজস্ব তেল উৎপাদন ব্যবস্থা। কম হলেও সেটা আছে। বৈজ্ঞানিক উপায়ে পেট্রালিয়াম উৎপাদন করে আমেরিকা। যার মূল্য প্রাকৃতিকভাবে পাওয়া আরবীয় তেলের চেয়ে দাম স্বাভাবিকভাবেই বেশি। একারণে তার বাজার সবসময় বেশ চ্যালেঞ্জের মুখে থাকে। আমেরিকা চায় আরব দেশগুলো তেলের উৎপাদন সীমিত রেখে বিশ্বে তেলের মূল্য একটি নির্দিষ্ট উচ্চতায় রেখে দিক। এতে তার মহার্ঘ তেলের বাণিজ্য শক্তিশালী হবে। গণতন্ত্রের গণকবর দিয়ে তাই আরবীয় স্বৈরতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রেখেছে আমেরিকা। আর তার বিনিময়ে প্যালেস্টাইনে গণহত্যা হলেও আমেরিকার মত আরব দেশগুলোও জেগে ঘুমায়। ইসলামিক ভ্রাতৃত্ববোধ এখানে কাজ করে না।
অন্যদিকে চিন নিয়ে চিন্তার অন্ত নেই আমেরিকার। কারণ, চিন প্রথমদিকে কট্টর সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি অনুসরণ করতো। এই অর্থনীতি কঠোরভাবে সরকার তথা সমাজ-নিয়ন্ত্রিত। সম্পদে ব্যক্তি মালিকানা সেখানে নিষিদ্ধ। স্বাভাবিকভাবেই এই অর্থনীতির প্রচার ও প্রসার আমেরিকার চক্ষুশূল। বিরোধিতা তাই চিনের স্বাধীনতার সময় থেকেই।
কিন্তু এই অর্থনীতির কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। জীবনজীবীকার মান খুব উচ্চ না হলেও অনিশ্চয়তার অনুপস্থিতির কারণে মানুষের মধ্যে প্রতিযোগিতার মনোভাব গড়ে ওঠে না। ফলে তিনটি সমস্যা দেখা দেয়।
এক. নতুন উদ্ভাবন ও উন্নয়নের গতি খানিকটা হলেও কম হয়। দুই. অভাব না থাকলেও এখানে মানুষের জীবনযাত্রার মান ইচ্ছামত উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া যায় না। কারণ, ব্যক্তিমালিকনা সেখানে স্বীকৃত নয়। তাই যোগ্যতম মানুষের মনে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। তিন. ব্যক্তির সামাজিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য বিষয়ে সমস্ত দায়িত্ব সরকার গ্রহণ করায় সরকারি তহবিল অপেক্ষাকৃতভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে ধনতান্ত্রিক দেশগুলি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত গবেষণা, বিশেষ করে প্রতিরক্ষা খাতে এবং পররাষ্ট্র নীতিকে নিজের অনুকূলে রাখতে অন্য পিছিয়েপড়া দেশগুলোকে আর্থিকভাবে সাহায্য ও সহযোগিতা করার যে নীতি নিয়ে থাকে আমেরিকাসহ ধনতান্ত্রিক দেশগুলো, তা সম্ভব হয় না। এই কারণে পররাষ্ট্র নীতির সাফল্য ও অন্যান্য দেশের সমর্থন ও আনুকূল্য পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। এককথায় ধনতান্ত্রিক দেশগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় এটে ওঠা কঠিন হয়ে ওঠে। এই পরিস্থিতিতে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর অস্তিত্বই সংকটে পড়ে যায়। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন তার জলন্ত উদাহরণ।
এই পরিস্থিতি থেকে বের হতে গিয়ে চিন তার আর্থিক নীতি সংস্কার করেছে। তবে তা ধনতান্ত্রিক দেশগুলোর মতো নিরেট ধনতন্ত্র নয়। সীমিত আকারে ব্যক্তি মালিকানার সুযোগ দিয়ে মানুষকে প্রতিযোগিতায় নামাতে চেয়েছে চিন। তথ্য বলছে, একাজে চিন অনেকটাই সফল। এই সমাজতান্ত্রিক ও ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির সমন্বয়ের ফলে করোনা অতিমারীর সময়ে কঠোর লকডাউনের নীতি ও চিকিৎসা খাতে যথাযথ ব্যয় বরাদ্ধ করে চিন সরকার দেশকে গভীর সংকটের হাত থেকে রক্ষা করেছে শুধু নয়, দেশের অর্থনীতিকে আরও চাঙ্গা করে তুলেছে, যা কোনও ধনতান্ত্রিক দেশ পারে নি।
কিন্তু আমেরিকা সমাজতান্ত্রিক কিংবা 'সমাজতান্ত্রিক ধাঁচে'র - কোনটাই সমর্থন করে না। বলা ভালো, এই ধরণের অর্থনীতির সে ঘোর বিরোধী। স্বাভাবিকভাবেই এই অর্থনীতি পৃথিবী ব্যাপী ছড়িয়ে পড়ুক, তা সে চায় না। সে চায় না, চিন তার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠুক। কিংবা তাকে ছাড়িয়ে যাক।
এই পরিস্থিতিতেই আমেরিকা চিনের বিরোধিতা করে। এবং মানুষকে চিনের দ্বারা প্রভাবিত না হতে উৎসাহিত করে। মানুষকে বোঝাতে চায় চিনে গণতন্ত্র নেই। সেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়। জাতির আত্মনিয়ন্ত্রের অধিকার সেখানে মানা হয় না। এই প্রসঙ্গেই চিনের উইঘুর জনজাতির ওপর 'নির্মম নির্যাতনে'র কথা আমেরিকা গলা উঁচিয়ে বলে থাকে।
মজার ব্যাপার হলো, প্যালেস্টাইনে এই সব বিষয়গুলো নির্মমভাবে লঙ্ঘন করছে ইসরাইল। আর তাকে আর্থিক, সামরিক ও নৈতিক সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে আমেরিকা। তারা মানবাধিকারের কথা বলে, আত্মনিয়ন্ত্রের কথা বলে, অথচ একবারও ভেবে দেখে না বা পৃথিবীর মানুষদের জানতে দেয় না যে, রেড ইন্ডিয়ানদের আত্মনিয়ন্ত্রের অধিকার কি ছিল না? কারা তাদের পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করেছে। আলাস্কার মানুষদের আত্মনিয়ন্ত্রের অধিকার থাকতে নেই? উদাহরণ টানলে উপাখ্যান হয়ে উঠবে। আর সেই উপাখানের সবচেয়ে বড় খলনায়ক হচ্ছে আমেরিকা। বিশ্ব ইতিহাসই তার সাক্ষী, একথা বলাই বাহুল্য।
--------------//------–---
২০/০৫/2021
প্রকাশ : দিনদর্পন দৈনিক সংবাদপত্র
২৪/০৫/২০২১
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন