কাড়াকাড়িই জন্ম দেয় হানাহানির। কেননা, কাড়াকাড়িই হল বঞ্চনার কারণ। তাই বঞ্চনার অবসান না করতে পারলে, হানাহানি বন্ধ হবে না।
পৃথিবীর কোনও পুঁজিবাদী সরকারই বঞ্চনার এই উৎস সমূলে উৎপাটন করতে চায় না। তাই পৃথিবীও হানাহানি মুক্ত হয় না। যেটা করা হয়, সেটা হল কৌশলে বঞ্চনাকে জিইয়ে রাখার চেষ্টা। বঞ্চনাকে জিইয়ে রাখতে না পারলে সম্পদের পুঞ্জিভবন সম্ভব নয়।
আপনি যদি ইতিহাসে পাতায় ভর করে কল্পনার দাঁড় বেয়ে পৃথিবীর আদিমতম সময়ে চলে যান, সেখানে দেখবেন মানুষও অন্যান্য প্রাণীর মতোই এক সাধারণ জীব। চিন্তাশক্তির বিশেষ ক্ষমতা ছাড়া, অন্য সব বিষয়ে সে অন্যান্য জীবের মতই একজন খাদ্য সংগ্রহকারী। প্রকৃতির সম্পদ আহরণ ও শিকারই তার বা তাদের জীবনযাপনের মূল মন্ত্র। কোন অলৌকিক শক্তি তাদের কারও নামে কোনো সম্পদের অধিকার বা স্বত্ত্ব দিয়ে পাঠায় নি। অন্যান্য প্রাণীদের মতই ভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর সঙ্গে জীবনযুদ্ধ করে তাকে টিকে থাকতে হয়েছে। মানব সভ্যতার ইতিহাস বা কোন ধর্মগ্রন্থ গভীরভাবে অধ্যয়ন করলে কোনো বিশেষ মানুষ বা মানব সম্প্রদায়কে সম্পদের মালিকানা স্বত্ত্ব দেওয়ার কথা সেখানে পাওয়া যাবে না।
সুতরাং পৃথিবীর এই প্রাকৃতিক সম্পদের বিশেষ মালিকানা স্বত্ত্ব কোনো স্বাভাবিক বা সহজাত বিষয় নয়। প্রাকৃতিক নিয়মে এই সম্পদের ওপর সবার সমান অধিকার। আমরা কি এই নিয়মে সম্পদের অধিকার ভোগ করতে পারি? পারি না। কারণ, এক শ্রেণির মানুষ ব্যক্তিগত স্বার্থকে সমষ্টিগত স্বার্থের উর্দ্ধে তুলে নিজের জীবনের সুখ-সমৃদ্ধিকে প্রাধান্য দেওয়ায় বৈষম্যের জন্ম হয়েছে। এবং ব্যক্তি মালিকানার জন্ম হয়েছে। পেশী শক্তি ও ধুর্তামির সমন্বয় ঘটিয়ে এক শ্রেণির মানুষ এই মালিকানার ধারণাকে প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা দিয়েছে। যার মূল কথা হল, সম্পদের ওপর অন্যের অধিকার সঙ্কুচিত কিংবা হরণ করতে পারলেই কেবল ব্যক্তির পুঁজি বাড়বে।
এই মালিকানার ধারণাই সম্পদের পুঞ্জিভবনকে উৎসাহিত করেছে। যার আধুনিক সংস্করণ হল পুঁজিবাদ বা পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা।
তাই, সম্পদের পুঞ্জিভবন হল পুঁজিবাদের প্রাণ-ভোমরা। সুতরাং পুঁজিবাদী সরকার কখনোই বঞ্ছনাকে সমূলে উৎপাটন করবে না, বা করতে চাইবে না। তাই সেখানে হানাহানিও বন্ধ হবে না।
কৌশলে বঞ্চনাকে জিইয়ে রাখার চেষ্টার ফসল হল পুঁজিবাদী রাষ্ট্রযন্ত্র, আইন-আদালত সহ অন্যান্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। এদের কাজ বঞ্চনাকে বৈধতার আবরণে মুড়ে ফেলা, যাতে বঞ্চিতরা বুঝতে না পারে যে, তারা বঞ্চিত হচ্ছে।
খেয়াল করলেই বোঝা যায়, পুঁজিবাদী রাষ্ট্র-ব্যবস্থার কোনো রক্ষাকবজই বঞ্চিত মানুষদের সহায়ক হয়ে ওঠে না। পয়সাওয়ালারাই সেখানে সুবিধা পায়।
বিচার ব্যবস্থা এই সুরক্ষা কবজের প্রধান স্তম্ভ। সেখানে একজন হত-দরিদ্র মানুষ কীভাবে বিচার পাবে? সে তো উকিলের ফি দেওয়ার ক্ষমতাই রাখে না। নিন্ম আদালতে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে যেতে পারলেও তার পক্ষে কি সুপ্রিম কোর্টে যাওয়া সম্ভব?
তাহলে কাদের জন্য এই সুরক্ষা ব্যবস্থা? হাঁ, ঠিক ধরেছেন, পয়সাওয়ালাদের জন্য। একজন পয়সাওয়ালা যখন আর একজন পয়সওয়ালাকে ঠকায় তখন বিচার ব্যবস্থা তাদের সত্যিকারের রক্ষাকবজ হয়ে ওঠে। বঞ্চিতরা জগৎ ও জীবনের এই রহস্যের দোর গোড়ায় পৌঁছতে পারে না বলে আসল সত্য ধরতে পারে না। পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার তথাকথিত সত্যকে শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে আর এই তথাকথিত মহান এই রাষ্ট্র-ব্যবস্থার কার্যকলাপে মুগ্ধ হয়, এবং তার ছদ্ম মহিমায় আপ্লুত হয়ে তথাকথিত দেশভক্তে পরিণত হয়।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন