সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

অখন্ড ভারত, মন্দির ধংস ও তার পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবি কতটা যুক্তি ও ইতিহাস সম্মত?

অখন্ড ভারত, মন্দির ধংস ও তার পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবি কতটা যুক্তি ও ইতিহাস সম্মত?

পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টে সেদেশে মন্দির ভাঙার বিরুদ্ধে মন্দির পুনর্নির্মাণ করে দেওয়ার আদেশ দিয়েছে। এবং সরকার সেই আদেশকে সমর্থন করে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই বিষয়ে আমার একটি পোস্টে মন্তব্য করেছেন M.K. Ray Chaudhury 

আমার পোষ্টের লিংক : এখানে ক্লিক করুন

তিনি লিখেছেন, "অখন্ড ভারতবর্ষে এই আইন অনুযায়ী পদক্ষেপ নেয়া উচিত, বাইরের দেশের জঙ্গিরা এসে এদেশের রাজা বা সম্রাট দের হঠিয়ে নিজেরা সম্রাট সেজে বসেছিল আর এদেশের হিন্দু মন্দির গুলো ধ্বংস করে অন্য ধর্মের উপাসনালয় বানিয়েছিল, পাকিস্তান আদালতের এই রায় মেনে আবার অখন্ড ভারতের সর্বত্র যেখানে যত হিন্দু মন্দির ধ্বংস হয়েছে, সকল মন্দির এর পুনঃ প্রতিষ্ঠা করা হোক। পাকিস্তান আদালতের এই রায় সাধুবাদ প্রাপ্য, তবে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের রায়ের ই অনুসারী খুব ভালো করে ভেবে দেখলে বোঝা যাবে।"

এখন প্রশ্ন হলো এই মতামত কতটা গ্রহণযোগ্য? আমার মতে এই মন্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, তিনি যে যুক্তি দেখিয়েছেন তা যথাযথ (যুক্তিবিজ্ঞানের ভাষায় বৈধ নয়/অবৈধ) নয় এবং ইতিহাস সম্মতও নয়।

১) হিন্দু পুরাণ মতে ব্রহ্মা ব্রহ্মান্ড এবং মানুষের সৃষ্টিকর্তা। এই তথ্য মানলে সারা পৃথিবীর মানুষ ব্রহ্মার থেকেই জন্ম নিয়েছে। আর ব্রহ্মা ভারতীয় দেবতা। তাহলে তো দাঁড়ায় শুধু ভারতীয় উপমহাদেশ নয় সমগ্র বিশ্বই অখন্ড ভারত। তাহলে কি সবদেশের অন্যান্য ধর্মের উপাসকরা হিন্দু ধর্মের মন্দির ধংস করে তাদের উপাসনালয় বানিয়েছে? আপনার যুক্তি মানলে শুধু পাকিস্তান নয়, সমগ্র বিশ্বের উপাসনালয়গুলি ভেঙে মন্দির বানানো উচিত। কি বলবেন, বানানোর চেষ্টা করবেন নাকি?

২) বাইরের দেশের জঙ্গিরা এদেশের সম্রাটদের হটিয়ে সম্রাট হয়ে এদেশের মন্দির ভেঙেছে বলছেন? তা বেশ। এবার বলুন তো এই 'জঙ্গি' শব্দটার জন্ম কবে হয়েছে? এই শব্দটি জাতিরাষ্টর ধারণা জন্ম নেওয়ার আগে ছিল না। গণতন্ত্রের জন্ম হওয়ার আগে এর অস্তিত্ব ছিল না। গণতন্ত্রের ঠিক বিপরীত মেরুতে এর অবস্থান। তাই গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি এই শব্দটির অস্তিত্বকে মান্যতা দেয়না। অর্থাৎ আজ যে অর্থে শব্দটি ব্যবহার করা হয় সেই দিক থেকে বিচার করলেও এর জন্ম আধুনিক যুগে। তার মানে দাঁড়ালো আধুনিক যুগে ভারতে বিদেশিরা ঢুকে মন্দিরগুলো ভেঙে দিয়েছে? বাহ দাদা, বাহ। বলিহারি আপনার বিশ্লেষণ।

৩) যে সময় বাইরের দেশ থেকে মুসলিমরা এদেশে এসেছিল, আমার জানা মতে সেটা মধ্যযুগ। যদিও প্রাচীন যুগেও বহু বিদেশি এদেশের এসেছিল এবং রাজত্ব কায়েম করেছিল। এবং এদেশে তারা তাদের উপাসকদের উপাসনাও চালু করেছিল। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নাম হল আর্য জাতি। তারা এদেশের আদিম অধিবাসীদের ধর্ম-সংস্কৃতিকে ধংস করে নিজেদের ধর্ম প্রচার করেছিল। সেই আর্য জাতির ধর্ম হল বৈদিক ধর্ম। সেই বৈদিক ধর্মই আজ সনাতন ধর্ম নামে পরিচিত। তাকেই আপনি বলেন হিন্দু ধর্ম। আদতে হিন্দু শব্দটাই ভারতীয় নয়। হিন্দু ধর্ম বলেও যে কিছু হয় না, তা হয় তো আপনি জানেন না।

যাইহোক, এবার বলুন তো, আপনার পরিচয় কী? ইতিহাস বলছে সনাতন ধর্মের মানুষরাও আসলে বিদেশি। কেন?

এখনও পর্যন্ত নৃবিজ্ঞানীরা যা জানাচ্ছেন তাতে মানব জাতির আদিমতম পূর্বপুরুষের বসবাস ছিল আফ্রিকায়। ভুগোলবিদদের মতে, আমাদের ভারত সেই আফ্রিকার সঙ্গেই যুক্ত ছিল সভ্যতার আদিলগ্নে। পরবর্তীতে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে ভারতীয় ভুখন্ড আফ্রিকা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আজকের অবস্থানে এসেছে। তাই আফ্রিকার মানুষের নৃতাত্বিক গঠনে অর্থাৎ ভারতের আদিবাসীদের গায়ের রঙ ও গড়নে প্রচুর মিল।

আপনি হয়তো জানেন না যে, এই জনজাতির সঙ্গে আর্যদের তেমন কোন মিলই নেই। কারণ তারা আফ্রিকা থেকে ইউরোপ হয়ে বহুযুগ ধরে বহু বিবর্তনের (আবহাওয়া ও জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে এই বিবর্তন হয়) পরে ভারতে প্রবেশ করে। এবং এরাই ভারতের আদিম অধিবাসীদের (আফ্রিকার সঙ্গে যাদের  আবহাওয়া ও জলবাহুগত বিশেষ পার্থক্য না থাকায় তাদের তেমন বিবর্তন হয় নি) হঠিয়ে এদেশে দখলদারিত্ব কায়ের করেছিল।

মজার ব্যাপার হল এদেরই অপর একটি গোষ্ঠী মধ্যযুগে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে এবং পরবর্তীতে ভারতে প্রবেশ করে ভারতে অধিকার কায়েম করে। পার্থক্য কোথায়? সনাতন ধর্মাবলম্বীরা প্রাচীন যুগে এদেশে ঢুকে এদেশের আদিম অধিবাসীদের হটিয়ে নিজেদের ধর্ম ও সংস্কৃতির চাষ শুরু করেছিল অস্ত্রের বলে। আর ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা মধ্যযুগে ভারতে এসে তাদের পূর্বপুরুষদের হটিয়ে ভারত দখল করেছিল।

তাহলে কী দাঁড়ালো? মধ্যযুগে ভারতে আসা ইসলাম ধর্মাবলম্বী শাসকরা যে অর্থে বিদেশি, সনাতন ধর্মাবলম্বীরাও সেই একই অর্থে বিদেশি। বৈদিক বা সনাতন ধর্মাবলম্বীরা আদিম অধিবাসী বা অনার্যদের হঠিয়ে ক্ষমতা দখল করেছে। আর মধ্যযুগে সনাতন ধর্মাবলম্বীদেরই উত্তরসূরি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে সনাতনীদের হঠিয়ে ভারতের ক্ষমতা দখল করেছে। আসলে ভাইয়ে ভাইয়ের ক্ষমতা দখলের লড়াই করেছে। শুধুমাত্র ধর্মটা পরিবর্তন করে নিয়েছে সুযোগ সুবিধা মত।

এবার বলুল, ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের যে কারণে দোষী সাব্যস্ত করা হচ্ছে (ভারত দখল করার 'অপরাধে') ঠিক সেই যুক্তিতেই সনাতন ধর্মাবলম্বীরাও তো দোষী সাব্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। দুটোই তো বিদেশি।

তাহলে আপনার মতের মান্যতা দিতে হলে তো মসজিদগুলোর সাথে সাথে মন্দিরগুলোও ভেঙে দিয়ে এদেশের আদিম অধিবাসীদের (আদিবাসীদের) প্রকৃতি পূজার জন্য যে ব্যবস্থা ছিল বা আছে তা কায়েম করা উচিত। এদেশ তো আদতে তাদেরই। শুধু ঐতিহাসিক ভাবে নয়, নৃতাত্বিক ভাবেও এই দাবি মান্যতা পাবে। রাজি আছেন?

সুতরাং বিদেশি তকমা দিয়ে শুধুমাত্র ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের অভিযুক্ত করার মধ্যে কোনো যুক্তি ও ইতিহাস সম্মত তথ্য নেই। সবই রাজনীতিকদের মনগড়া কাহিনী।

৪) এবারে আসুন আর একটা দিক থেকে বিচার করে দেখি। আর্যরা বা পরবর্তীকালে মুসলিমরা যখন ভারতে এসেছে তখন ছিল যথাক্রমে প্রাচীন ও মধ্যযুগ। সেসময় অস্ত্রের জোরে ক্ষমতা দখল করাই ছিল রাজকীয় নীতি এবং সেটাই ছিল সেযুগে বৈধ। শুধু মুসলিম শাসকরা মন্দির ভেঙেছে তা নয়, হিন্দু রাজরাও প্রয়োজনে মন্দির ভেঙেছে। আবার মুসলিম শাসকরা প্রয়োজনে শুধু মন্দির নয় মসজিদও ভেঙেছেন। মুসলিম শাসকরা মন্দির তৈরির জন্য জমি ও অর্থ প্রদান করেছেন এমন দলিলও মহাফেজ খানায় আছে। যদিও সে খবর আপনারা ইচ্ছাকৃতভাবেই চেপে যান রাজনীতি করার স্বার্থে।

কিন্তু আজ গণতন্ত্রের যুগ। অস্ত্র নয় ব্যালটই ক্ষমতা দখলের বৈধ হাতিয়ার। মানুষের মৌলিক অধিকার, বাকস্বাধীনতার স্বীকৃতিই এই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মূল বৈশিষ্ট্য। মধ্যযুগের রীতিনীতি ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা এখন কায়েম করলে তো আমাদের মধ্যযুগে ফিরে যেতে হয়। তাহলে আর গণতন্ত্রের কথা বলেন কেন? সরাসরি রাজতন্ত্র চালু করেদিন। রাজতন্ত্র কায়েম করবেন এটা প্রকাশ্যে বলে দিলেই তো হয়। নাটক করার তো কোনো দরকার থাকে না। তারপর মনের খুশিতে মসজিদ .......।

৫) এবারে বলুন তো মুসলিম শাসকরা এদেশে এলো। ক্ষমতা দখল করলো। আট শ বছরের মত বিরাট সময় ধরে রাজত্ব করলো। সবই বাস্তব সত্য। এটা যদি বাস্তব সত্য হয় এবং মুসলিম শাসকরা যদি হিন্দু বিদ্বেষী হত আর মন্দির ভেঙে যদি মসজিদ গড়াই যদি তাদের প্রধান লক্ষ্য হত তবে আজও সারা ভারতে কীভাবে হাজার হাজার প্রাচীন মন্দির ও মধ্যযুগীয় মন্দির রয়েগেল? আছে এ প্রশ্নের উত্তর আপনার কাছে?

সুতরাং পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্ট যে আদেশ দিয়েছে সেটাই যুগের চাহিদা। এটাই কাম্য। একে বিদ্রুপ নয়, স্যালুট জানানো উচিত। অন্যদিকে ভারতীয় কোর্টের অবস্থান সেদিক থেকে অনেকটা পিছনের সারিতে চলে গেছে বলেই ধারণা করছেন অনেকেই।


মন্তব্যসমূহ

📂 আলী হোসেনের জনপ্রিয় প্রবন্ধগুলি

হিন্দু কারা? তারা কীভাবে হিন্দু হল?

হিন্দু কারা? কীভাবে তারা হিন্দু হল? যদি কেউ প্রশ্ন করেন, অমিত শাহ হিন্দু হলেন কবে থেকে? অবাক হবেন তাই তো? কিন্তু আমি হবো না। কারণ, তাঁর পদবী বলে দিচ্ছে উনি এদেশীয়ই নন, ইরানি বংশোদ্ভুত। কারণ, ইতিহাস বলছে পারস্যের রাজারা ‘শাহ’ উপাধি গ্রহণ করতেন। এবং ‘শাহ’ শব্দটি পার্শি বা ফার্সি। লালকৃষ্ণ আদবানির নামও শুনেছেন আপনি। মজার কথা হল আদবানি শব্দটিও এদেশীয় নয়। আরবি শব্দ ‘আদবান’ থেকে উদ্ভূত। সুতরাং তাঁর পদবীও বলছে, তিনিও এদেশীয় নন। ভাষাতত্ত্ব ও নৃতত্ত্বের বিশ্লেষণ বলছে, উচ্চবর্ণের বিশেষ করে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের মানুষদের, উৎসভূমি হল পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চল। তারও আগে ছিল ইউরোপের ককেশাস অঞ্চলে। আসলে এরা (উচ্চবর্ণের মানুষ) কেউই এদেশীয় নয়। তারা নিজেদের আর্য বলে পরিচয় দিতেন এবং এই পরিচয়ে তারা গর্ববোধ করতেন। সিন্ধু সভ্যতা পরবর্তীকালে তারা পারস্যের বিভিন্ন এলাকা থেকে হিন্দুকুশ পর্বতের গিরিপথ ধরে এদেশে অভিবাসিত হয়েছেন। আর মধ্যযুগে এসে এদেরই উত্তরসূরী ইরানিরা (অমিত শাহের পূর্বপুরুষ) অর্থাৎ পারস্যের কিছু পর্যটক-ঐতিহাসিক, এদেশের আদিম অধিবাসীদের ’হিন্দু’ বলে অভিহিত করেছেন তাদের বিভিন্ন ভ্রমণ বৃত্তান্তে। ...

রবীন্দ্রনাথের ধর্মভাবনা ও তার বিবর্তন

রবীন্দ্রনাথের ধর্মভাবনা ও তার বিবর্তন আলী হোসেন  যদি প্রশ্ন করা হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ধর্ম কী? মনে হয় অনেকেই ঘাবড়ে যাবেন। কেউ বলবেন, তাঁর বাবা যখন ব্রাহ্ম ছিলেন, তখন তিনি নিশ্চয়ই ব্রাহ্ম হবেন। যারা লেখাপড়া জানেন না, তারা বলবেন, কেন! উনি তো হিন্দু ছিলেন। আবার কেউ কেউ তথ্য সহযোগে এও বলার চেষ্টা করবেন যে, উনি নাস্তিক ছিলেন। না হলে কেউ বলতে পারেন, ধর্মমোহের চেয়ে নাস্তিকতা অনেক ভালো?¹ রবীন্দ্রনাথের ধর্ম ভাবনার বিবর্তন  তাহলে সঠিক উত্তরটা কী? আসলে এর কোনোটাই সঠিক উত্তর নয়। চিন্তাশীল মানুষ-মাত্রই সারা জীবন ধরে ভাবতে থাকেন। ভাবতে ভাবতে তাঁর উপলব্ধি এগোতে থাকে ক্রমশঃ প্রগতির পথে। এই সময়কালে জগৎ ও জীবন থেকে তথ্য সংগ্রহ করে একে একে গড়ে তোলেন জীবনদর্শনের নিত্যনতুন পর্ব। তাই এ ধরনের চিন্তাশীল মানুষ আজীবন এক এবং অখণ্ড জীবনদর্শনের বার্তা বহন করেন না। সময়ের সাথে সাথে পাল্টে যায় তাঁর পথচলার গতিমুখ, গড়ে ওঠে উন্নততর জীবন দর্শন। মানুষ রবীন্দ্রনাথও তাই পাল্টে ফেলেছেন তাঁর জীবন ও ধর্মদর্শন; সময়ের এগিয়ে যাওয়াকে অনুসরণ করে। রবীন্দ্রনাথ ও  হিন্দু জাতীয়তাবাদ ১৮৬১ সালের ৭ই মে সোমবার রাত্রি ২টা ৩৮ ...

ভাগ্য : মুসলিম মনস্তত্ত্ব, ধর্মদর্শন ও প্রগতি

ভাগ্য : মুসলিম মনস্তত্ত্ব, ধর্মদর্শন ও প্রগতি - লিখছেন আলী হোসেন  কপালের লেখন খণ্ডায় কার সাধ্য? জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে কিংবা লেখাপড়া জানা-নাজানা নির্বিশেষে সমস্ত মানুষের সিংহভাগই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এই কথাটা মেনে নেয়। জীবনের উত্থান-পতনের ইতিহাসে কপালের লেখনকে জায়গা করে দিতে তারা কুণ্ঠাবোধ করে না। বরং বলা ভালো এব্যাপারে তারা অতিমাত্রায় উদার। মানুষের মনস্তত্বের এ-এক জটিল স্তর বিন্যাস। একই মানুষ বিভিন্ন সময়ে একই বিষয়ের বিচার বিশ্লেষণে ভিন্নভিন্ন দৃষ্টিকোণ ব্যবহার করে। এ রকমই একটি দৃষ্টিকোণ হলো কপাল বা ভাগ্যের ভূমিকাকে সাফল্যের চাবিকাঠি বলে ভাবা। কখনও সে ভাগ্যের নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠার চেষ্টা করে, আবার কখনও নিজেই ভাগ্যের কাছে নির্দিধায় আত্ম সমর্পন করে। নিজের ব্যার্থতার পিছনে ভাগ্যের অদৃশ্য হাতের কারসাজির কল্পনা করে নিজের ব্যার্থতাকে ঢাকা দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে থাকে। মজার কথা, এক্ষেত্রে মুসলিম মানসের মনস্তত্ত্ব কখনও চেতনমনে আবার কখনও অবচেতন মনে উপরওয়ালাকে (আল্লাহকে) কাঠ গড়ায় তোলে বিনা দ্বিধায়। নির্দিধায় বলে দেয়, উপরওয়ালা রাজি না থাকলে কিছুই করার থাকেনা। সাফল্য কিংবা ব্যর্থতা সবই তাঁর (আল...

সীমান্ত আখ্যান, বাঙালির আত্মানুসন্ধানের ডিজিটাল আখ্যান

সময়ের সঙ্গে সমস্যার চরিত্র বদলায়। কিন্তু মুলটা বদলায় না। যদি সে সমস্যা ইচ্ছা করে তৈরি হয়ে থাকে বিশেষ সুবিধা ভোগেই লোভে, তবে তো অন্য কথা চলেই না। স্বনামধন্য স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাতা সৌমিত্র দস্তিদারের ডকুমেন্টারি ফিল্প 'সীমান্ত আখ্যান' দেখার পর এই উপলব্ধি মাথা জুড়ে ঘুরপাক খাচ্ছে। দেখলাম, দেশ ভাগ হয়েছে। কিন্তু সমস্যার অবসান হয়নি। শুধু সমস্যার চরিত্রটা পাল্টেছে। এই যে সমস্যা রয়ে গেল, কোন গেল? তার উত্তর ও পাওয়া গেল 'সীমান্ত আখ্যান' এ। আসলে দেশ ভাগ তো দেশের জনগণ চাননি, চেয়েছেন দেশের নেতারা। চেয়েছেন তাঁদের ব্যক্তিগত, সম্প্রদায়গত সুবিধাকে নিজেদের কুক্ষিগত করার নেশায়। আর এই নেশার রসদ যোগান দিতে পারার নিশ্চয়তা নির্ভর করে রাজনৈতিক ক্ষমতার লাগাম নিজের হাতে থাকার ওপর। তাই রাজনীতিকরা এই ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য জনগণকে 'ডিভাইড এন্ড রুল' পলিছি দ্বারা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চেষ্টা করেছেন এবং করে চলেছেন। এ সমস্যা নতুন না, ব্রিটিশ সরকার এর বীজ রোপণ করে গেছেন, এখন কেউ তার সুফল ভোগ করছে (রাজনীতিকরা) আর কেউ কুফল (জনগন)। 'সীমান্ত আখ্যান চোখে আঙুল দিয়ে দে...

কাশ্মীর ফাইলস : প্রপাগান্ডার এক নয়া ব্রান্ড, কর্পোরেট পুঁজি ও রাজনৈতিক দলের গলাগলির এক সুচারু প্রদর্শনী

কাশ্মীর ফাইলস : প্রপাগান্ডার এক নয়া ব্রান্ড, কর্পোরেট পুঁজি ও রাজনৈতিক দলের গলাগলির এক সুচারু প্রদর্শনী রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয় উলুখাগড়ার প্রাণ যায়। ১৯৪৭ সালের পর থেকে জম্মু ও কাশ্মিরের জনগণের ভাগ্যলিপিতে লেখা হয়ে গেছে এই বিখ্যাত প্রবাদটির বিস্তারিত সারাৎসার। একদিকে পাকিস্তান আর অন্যদিকে ভারত – এই দুই প্রতিবেশি দেশের ভুরাজনৈতিক স্বার্থের যাঁতাকলে পড়ে তাদের এই হাল। কিন্তু কেন এমন হল? এই প্রশ্নের উত্তর জানে না এমন মানুষ ভুভারতে হয়তো বা নেই। কিন্তু সেই জানার মধ্যে রয়েছে বিরাট ধরণের ফাঁক। সেই ফাঁক গলেই ঢুকেছে কাশ্মির ফাইলসের মত বিজেপির রাজনৈতিক ন্যারেটিভ যা তারা বহুকাল ধরে করে চলেছে অন্য আঙ্গিকে। এবার নতুন মাধ্যমে এবং নবরূপে তার আগমন ঘটেছে, যায় নাম সিনেমা বা সেলুলয়েড প্রদর্শনী। যদিও ডিজিটাল মাধ্যমে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সৌজন্যে অনেক আগেই সফলভাবে তারা এই ন্যারেটিভ দিয়ে বিভাজনের রাজনীতি করে চলেছে বেশ কয়েক বছর ধরে। টেলিভিশন সম্প্রচারে কর্পোরেট পুজির অনুপ্রবেশের মাধ্যমে যার সূচনা হয়েছিল। রাষ্ট্রশক্তিকে কুক্ষিগত করতে না পারলে দেশের সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রন আনা সম্ভব নয়, একথা সাধারণ নিরক্ষর নাগরিক এবং ত...

শিক্ষা কী, কেন প্রয়োজন এবং কীভাবে অর্জন করা যায়?

শিক্ষা কী, কেন এবং কীভাবে অর্জন করতে হয়? সূচিপত্র : What is education, why it is needed and how to achieve it শিক্ষা কী শিক্ষা হল এক ধরনের অর্জন, যা নিজের ইচ্ছা শক্তির সাহায্যে নিজে নিজেই নিজের মধ্যে জমা করতে হয়। প্রকৃতি থেকেই সেই অর্জন আমাদের চেতনায় আসে। সেই চেতনাই আমাদের জানিয়ে দেয়, জগৎ ও জীবন পরিচালিত হয় প্রকৃতির কিছু অলংঘনীয় নিয়ম-নীতির দ্বারা। গভীর পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ শক্তিকে বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে কাজে লাগালেই এই নিয়মনীতিগুলো আমাদের আয়ত্বে আসে। এই নিয়ম-নীতিগুলো জানা এবং সেই জানার ওপর ভিত্তি করেই জগৎ ও জীবনকে সর্বোত্তম পর্যায়ে পৌঁছে দেয়ার পথ খুঁজে বের করার শক্তি অর্জনই শিক্ষা। মনে রাখতে হবে, এই শিক্ষা কখনও কারও মধ্যে জোর করে ঢুকিয়ে দেওয়া যায় না। এখন প্রশ্ন হল, শিক্ষা অর্জনের বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিটা আসলে কী। সেই আলোচনায় যাওয়ার আগে জানতে হবে, এই শিক্ষার সূচনা হয় কখন এবং কীভাবে? শিক্ষার সূচনা কখন হয় : এই অর্জনের সূচনা হয় মাতৃগর্ভে এবং তা প্রাকৃতিক ভাবেই। প্রকৃতির দেওয়া কিছু সহজাত শিক্ষাকে অবলম্বন করেই তার সূচনা। এই সহজাত শিক্ষাকে অবলম্বন করেই মানুষ তার পরবর্তী প...

শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি : নেতিবাচক রাজনীতি চর্চা - আলী হোসেন

শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি : নেতিবাচক রাজনীতি চর্চায় সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি : নেতিবাচক রাজনীতি চর্চা - আলী হোসেন আলী হোসেন বিচার একটি যৌথ প্রচেষ্টার ফসল। বিচারক কখনই সঠিক সিদ্ধান্তে আসতে পারেন না, যদি না এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন সংস্থা ও তার কর্মকর্তারা উপযুক্ত তথ্য সংগ্রহ করতে এবং বিচারককে তা সরবরাহ করতে পারেন। আর বিচার ব্যবস্থা হচ্ছে এমন একটি শক্তির আধার; তা যার হাতে থাকে, তিনিই বিচারক। এই শক্তি ন্যায়বিচার তখনই দিতে পারে, যখন বিচারক নিরপেক্ষ থাকার সৎ সাহস দেখান এবং সাংবিধানিক আইন এবং তার প্রয়োগ বিষয়ে আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে বিশেষ পারদর্শিতা অর্জন করেন। তবে তাঁর সফলতা নির্ভর করে তথ্য সংগ্রহকারী বিভিন্ন সংস্থা এবং আইনজীবীরা কতটা সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে সেই তথ্য বিচারকের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন, তার উপর। তাই একজন বিচারক বা বিচার ব্যবস্থা যা বিধান দেয়, তা সব সময় একশ শতাংশ সঠিক এবং যুক্তিযুক্ত হবে - এমন কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত কোনো একটি পক্ষ যদি পক্ষপাতদুষ্ট হয়, তাহলে ন্যায় বিচার পাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। মনে রাখতে হবে, ...

জল, না পানি : জল নিয়ে জলঘোলা করা পানির মত সহজ নয়

জল নিয়ে জলঘোলা করা পানির মত সহজ নয় আলী হোসেন  সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত সরকারি অনুষ্ঠানে চিত্র শিল্পী শুভাপ্রসন্ন ভট্টাচার্য পানি শব্দকে বাংলা নয় বলে দাবি করেছেন। বলেছেন, "আমরা কোনোদিন কখনও বাংলা ভাষায় পানি (শব্দটা) ব্যবহার করি না"। শুধু তা-ই নয়, পানি শব্দের ব্যবহারের মধ্যে তিনি 'সাম্প্রদায়িকতার ছাপ'ও দেখতে পেয়েছেন। প্রশ্ন হল - এক, এই ভাবনা কতটা বাংলা ভাষার পক্ষে স্বাস্থ্যকর এবং কতটা 'বাংলা ভাষার ইতিহাস' সম্মত? দুই, জল বা পানি নিয়ে যারা জলঘোলা করছেন তারা কি বাংলাকে ভালোবেসে করছেন? মনে হয় না। কারণ, খোঁজ নিলে দেখা যাবে, এরা কেউ নিজের সন্তানকে বাংলা মিডিয়াম স্কুলে পড়াননি বা পড়ান না। ব্যবহারিক জীবনেও তারা বাংলার ভাষার চেয়ে ইংরেজি বা হিন্দিতে কথা বলতে বা গান শুনতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন, বলা ভালো গর্ববোধ করেন। প্রসংগত মনে রাখা দরকার, বাংলা মিডিয়াম স্কুলগুলোতে যারা ভর্তি হয়, তারা অধিকাংশই গরীব ঘরের সন্তান। বলা ভালো, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে তারাই বাংলা ভাষাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। কারণ, সন্তানকে বাংলা মিডিয়ামে পড়ানোর পাশাপাশি, বা...

আধুনিক মিডিয়া : কর্পোরেট পুঁজির (পুঁজিপতিদের) তোতাপাখি

গোদি মিডিয়া : কর্পোরেট পুঁজির তোতাপাখি পশ্চিমী মিডিয়াকে 'ইসরাইল সরকারের তোতাপাখি' নামে পরিচয় দেওয়া হয় সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী স্বাধীন ও নিরপেক্ষ মিডিয়া হাউজের পক্ষ থেকে। সম্প্রতি একইভাবে ভারতীয় কর্পোরেট মিডিয়া ভারত সরকার তথা 'কর্পোরেট পুঁজির  তোতাপাখি' হিসাবে পরিচয় পাচ্ছে, যাকে নিন্দুকেরা 'গোদী মিডিয়া' নামে অভিহিত করে থাকে। মধ্যপ্রাচ্যের ঘটনা সম্পর্কে ইসরাইল যা বলে, ইউরোপ ও আমেরিকার মিডিয়া, তোতা পাখির মতো তা-ই প্রচার করে। সাংবাদিকতার প্রধান প্রধান শর্তগুলোকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ইসরাইলের দেওয়া তথ্যই তারা প্রচার করে অন্ধ ও নির্লজ্জভাবে। ভারতের ক্ষেত্রেও করপোরেট মিডিয়া বর্তমানে সেটাই করছে বলে অভিযোগ। অভিযোগ, নত মস্তকে ভারত সরকারের দেওয়া তথ্য বিনা বিচারে প্রচার করে চলেছে অধিকাংশ মিডিয়া হাউজ।  অর্থাৎ তাদের সম্প্রচারিত খবরের বড় অংশই হয় নিয়ন্ত্রিত অথবা কখনও কখনও অসত্য - এমন দাবিও করা হয়।  আসলে সিংহভাগ মিডিয়ার মালিক হচ্ছেন এক-একজন  করপোরেট পুঁজির মালিক বা পুঁজিপতি। এরা কি কখনও নিজের স্বার্থের বিরুদ্ধে যায় - এমন খবর, তথ্য বা তত্ত্ব প্রচার করবে? করবে না, করেও না। আর এ...

নিম্নবর্গের মানুষ মার খাচ্ছে কেন

নিম্নবর্গের মানুষ কীভাবে পিছিয়ে পড়েছেন? সমাধান কীভাবে? এদেশের নিম্নবর্গের মানুষ নিজেদের বাঁচাতে যুগ যুগ ধরে ধর্ম পরিবর্তন করেছে। কখনও বৌদ্ধ (প্রাচীন যুগ), কখনও মুসলমান (মধুযুগ), কিম্বা কখনো খ্রিস্টান (আধুনিক যুগ) হয়েছে। কিন্তু কখনই নিজেদের চিন্তা-চেতনাকে পাল্টানোর কথা ভাবেনি। পরিবর্তন হচ্ছে অলংঘনীয় প্রাকৃতিক নিয়ম। যারা এই নিয়ম মেনে সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে পারে, তারাই লাভবান হয়, টিকে থাকে। “পাল্টে গেলেই জীবন বাড়ে না পাল্টালে নয়, জীবন মানেই এগিয়ে যাওয়া নইলে মৃত্যু হয়” জীবনের এই চরম সত্য তারা অধিকাংশই উপলব্ধি করতে পারেনি। পৃথিবীর যেকোন উন্নত জাতির দিকে তাকান, তারা দ্রুততার সঙ্গে এই পরিবর্তনকে মেনে নিজেদেরকে পুনর্গঠন করে নিয়েছে। যারা পারেনি বা নেয়নি তারাই মার খাচ্ছে, অতীতেও খেয়েছে। বুদ্ধিমান জাতি নিজের দুর্বলতাকে মেনে নেয় এবং ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য সময়ের সঙ্গে তাল রেখে নিজেদের চিন্তা এবং চেতনায় পরিবর্তন আনে। খ্রিষ্টান, ইহুদি-সহ এশিয়া, ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন জাতি - যারাই এই পরিবর্তন মেনে নিয়েছে তারাই আরও উন্নত এবং শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। মহানবীর (সঃ) গৌরবময় উত্থান (যা এক ধরণ...