অখন্ড ভারত, মন্দির ধংস ও তার পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবি কতটা যুক্তি ও ইতিহাস সম্মত?
পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টে সেদেশে মন্দির ভাঙার বিরুদ্ধে মন্দির পুনর্নির্মাণ করে দেওয়ার আদেশ দিয়েছে। এবং সরকার সেই আদেশকে সমর্থন করে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই বিষয়ে আমার একটি পোস্টে মন্তব্য করেছেন M.K. Ray Chaudhury
আমার পোষ্টের লিংক : এখানে ক্লিক করুন
তিনি লিখেছেন, "অখন্ড ভারতবর্ষে এই আইন অনুযায়ী পদক্ষেপ নেয়া উচিত, বাইরের দেশের জঙ্গিরা এসে এদেশের রাজা বা সম্রাট দের হঠিয়ে নিজেরা সম্রাট সেজে বসেছিল আর এদেশের হিন্দু মন্দির গুলো ধ্বংস করে অন্য ধর্মের উপাসনালয় বানিয়েছিল, পাকিস্তান আদালতের এই রায় মেনে আবার অখন্ড ভারতের সর্বত্র যেখানে যত হিন্দু মন্দির ধ্বংস হয়েছে, সকল মন্দির এর পুনঃ প্রতিষ্ঠা করা হোক। পাকিস্তান আদালতের এই রায় সাধুবাদ প্রাপ্য, তবে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের রায়ের ই অনুসারী খুব ভালো করে ভেবে দেখলে বোঝা যাবে।"
এখন প্রশ্ন হলো এই মতামত কতটা গ্রহণযোগ্য? আমার মতে এই মন্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, তিনি যে যুক্তি দেখিয়েছেন তা যথাযথ (যুক্তিবিজ্ঞানের ভাষায় বৈধ নয়/অবৈধ) নয় এবং ইতিহাস সম্মতও নয়।
১) হিন্দু পুরাণ মতে ব্রহ্মা ব্রহ্মান্ড এবং মানুষের সৃষ্টিকর্তা। এই তথ্য মানলে সারা পৃথিবীর মানুষ ব্রহ্মার থেকেই জন্ম নিয়েছে। আর ব্রহ্মা ভারতীয় দেবতা। তাহলে তো দাঁড়ায় শুধু ভারতীয় উপমহাদেশ নয় সমগ্র বিশ্বই অখন্ড ভারত। তাহলে কি সবদেশের অন্যান্য ধর্মের উপাসকরা হিন্দু ধর্মের মন্দির ধংস করে তাদের উপাসনালয় বানিয়েছে? আপনার যুক্তি মানলে শুধু পাকিস্তান নয়, সমগ্র বিশ্বের উপাসনালয়গুলি ভেঙে মন্দির বানানো উচিত। কি বলবেন, বানানোর চেষ্টা করবেন নাকি?
২) বাইরের দেশের জঙ্গিরা এদেশের সম্রাটদের হটিয়ে সম্রাট হয়ে এদেশের মন্দির ভেঙেছে বলছেন? তা বেশ। এবার বলুন তো এই 'জঙ্গি' শব্দটার জন্ম কবে হয়েছে? এই শব্দটি জাতিরাষ্টর ধারণা জন্ম নেওয়ার আগে ছিল না। গণতন্ত্রের জন্ম হওয়ার আগে এর অস্তিত্ব ছিল না। গণতন্ত্রের ঠিক বিপরীত মেরুতে এর অবস্থান। তাই গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি এই শব্দটির অস্তিত্বকে মান্যতা দেয়না। অর্থাৎ আজ যে অর্থে শব্দটি ব্যবহার করা হয় সেই দিক থেকে বিচার করলেও এর জন্ম আধুনিক যুগে। তার মানে দাঁড়ালো আধুনিক যুগে ভারতে বিদেশিরা ঢুকে মন্দিরগুলো ভেঙে দিয়েছে? বাহ দাদা, বাহ। বলিহারি আপনার বিশ্লেষণ।
৩) যে সময় বাইরের দেশ থেকে মুসলিমরা এদেশে এসেছিল, আমার জানা মতে সেটা মধ্যযুগ। যদিও প্রাচীন যুগেও বহু বিদেশি এদেশের এসেছিল এবং রাজত্ব কায়েম করেছিল। এবং এদেশে তারা তাদের উপাসকদের উপাসনাও চালু করেছিল। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নাম হল আর্য জাতি। তারা এদেশের আদিম অধিবাসীদের ধর্ম-সংস্কৃতিকে ধংস করে নিজেদের ধর্ম প্রচার করেছিল। সেই আর্য জাতির ধর্ম হল বৈদিক ধর্ম। সেই বৈদিক ধর্মই আজ সনাতন ধর্ম নামে পরিচিত। তাকেই আপনি বলেন হিন্দু ধর্ম। আদতে হিন্দু শব্দটাই ভারতীয় নয়। হিন্দু ধর্ম বলেও যে কিছু হয় না, তা হয় তো আপনি জানেন না।
যাইহোক, এবার বলুন তো, আপনার পরিচয় কী? ইতিহাস বলছে সনাতন ধর্মের মানুষরাও আসলে বিদেশি। কেন?
এখনও পর্যন্ত নৃবিজ্ঞানীরা যা জানাচ্ছেন তাতে মানব জাতির আদিমতম পূর্বপুরুষের বসবাস ছিল আফ্রিকায়। ভুগোলবিদদের মতে, আমাদের ভারত সেই আফ্রিকার সঙ্গেই যুক্ত ছিল সভ্যতার আদিলগ্নে। পরবর্তীতে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে ভারতীয় ভুখন্ড আফ্রিকা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আজকের অবস্থানে এসেছে। তাই আফ্রিকার মানুষের নৃতাত্বিক গঠনে অর্থাৎ ভারতের আদিবাসীদের গায়ের রঙ ও গড়নে প্রচুর মিল।
আপনি হয়তো জানেন না যে, এই জনজাতির সঙ্গে আর্যদের তেমন কোন মিলই নেই। কারণ তারা আফ্রিকা থেকে ইউরোপ হয়ে বহুযুগ ধরে বহু বিবর্তনের (আবহাওয়া ও জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে এই বিবর্তন হয়) পরে ভারতে প্রবেশ করে। এবং এরাই ভারতের আদিম অধিবাসীদের (আফ্রিকার সঙ্গে যাদের আবহাওয়া ও জলবাহুগত বিশেষ পার্থক্য না থাকায় তাদের তেমন বিবর্তন হয় নি) হঠিয়ে এদেশে দখলদারিত্ব কায়ের করেছিল।
মজার ব্যাপার হল এদেরই অপর একটি গোষ্ঠী মধ্যযুগে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে এবং পরবর্তীতে ভারতে প্রবেশ করে ভারতে অধিকার কায়েম করে। পার্থক্য কোথায়? সনাতন ধর্মাবলম্বীরা প্রাচীন যুগে এদেশে ঢুকে এদেশের আদিম অধিবাসীদের হটিয়ে নিজেদের ধর্ম ও সংস্কৃতির চাষ শুরু করেছিল অস্ত্রের বলে। আর ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা মধ্যযুগে ভারতে এসে তাদের পূর্বপুরুষদের হটিয়ে ভারত দখল করেছিল।
তাহলে কী দাঁড়ালো? মধ্যযুগে ভারতে আসা ইসলাম ধর্মাবলম্বী শাসকরা যে অর্থে বিদেশি, সনাতন ধর্মাবলম্বীরাও সেই একই অর্থে বিদেশি। বৈদিক বা সনাতন ধর্মাবলম্বীরা আদিম অধিবাসী বা অনার্যদের হঠিয়ে ক্ষমতা দখল করেছে। আর মধ্যযুগে সনাতন ধর্মাবলম্বীদেরই উত্তরসূরি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে সনাতনীদের হঠিয়ে ভারতের ক্ষমতা দখল করেছে। আসলে ভাইয়ে ভাইয়ের ক্ষমতা দখলের লড়াই করেছে। শুধুমাত্র ধর্মটা পরিবর্তন করে নিয়েছে সুযোগ সুবিধা মত।
এবার বলুল, ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের যে কারণে দোষী সাব্যস্ত করা হচ্ছে (ভারত দখল করার 'অপরাধে') ঠিক সেই যুক্তিতেই সনাতন ধর্মাবলম্বীরাও তো দোষী সাব্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। দুটোই তো বিদেশি।
তাহলে আপনার মতের মান্যতা দিতে হলে তো মসজিদগুলোর সাথে সাথে মন্দিরগুলোও ভেঙে দিয়ে এদেশের আদিম অধিবাসীদের (আদিবাসীদের) প্রকৃতি পূজার জন্য যে ব্যবস্থা ছিল বা আছে তা কায়েম করা উচিত। এদেশ তো আদতে তাদেরই। শুধু ঐতিহাসিক ভাবে নয়, নৃতাত্বিক ভাবেও এই দাবি মান্যতা পাবে। রাজি আছেন?
সুতরাং বিদেশি তকমা দিয়ে শুধুমাত্র ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের অভিযুক্ত করার মধ্যে কোনো যুক্তি ও ইতিহাস সম্মত তথ্য নেই। সবই রাজনীতিকদের মনগড়া কাহিনী।
৪) এবারে আসুন আর একটা দিক থেকে বিচার করে দেখি। আর্যরা বা পরবর্তীকালে মুসলিমরা যখন ভারতে এসেছে তখন ছিল যথাক্রমে প্রাচীন ও মধ্যযুগ। সেসময় অস্ত্রের জোরে ক্ষমতা দখল করাই ছিল রাজকীয় নীতি এবং সেটাই ছিল সেযুগে বৈধ। শুধু মুসলিম শাসকরা মন্দির ভেঙেছে তা নয়, হিন্দু রাজরাও প্রয়োজনে মন্দির ভেঙেছে। আবার মুসলিম শাসকরা প্রয়োজনে শুধু মন্দির নয় মসজিদও ভেঙেছেন। মুসলিম শাসকরা মন্দির তৈরির জন্য জমি ও অর্থ প্রদান করেছেন এমন দলিলও মহাফেজ খানায় আছে। যদিও সে খবর আপনারা ইচ্ছাকৃতভাবেই চেপে যান রাজনীতি করার স্বার্থে।
কিন্তু আজ গণতন্ত্রের যুগ। অস্ত্র নয় ব্যালটই ক্ষমতা দখলের বৈধ হাতিয়ার। মানুষের মৌলিক অধিকার, বাকস্বাধীনতার স্বীকৃতিই এই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মূল বৈশিষ্ট্য। মধ্যযুগের রীতিনীতি ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা এখন কায়েম করলে তো আমাদের মধ্যযুগে ফিরে যেতে হয়। তাহলে আর গণতন্ত্রের কথা বলেন কেন? সরাসরি রাজতন্ত্র চালু করেদিন। রাজতন্ত্র কায়েম করবেন এটা প্রকাশ্যে বলে দিলেই তো হয়। নাটক করার তো কোনো দরকার থাকে না। তারপর মনের খুশিতে মসজিদ .......।
৫) এবারে বলুন তো মুসলিম শাসকরা এদেশে এলো। ক্ষমতা দখল করলো। আট শ বছরের মত বিরাট সময় ধরে রাজত্ব করলো। সবই বাস্তব সত্য। এটা যদি বাস্তব সত্য হয় এবং মুসলিম শাসকরা যদি হিন্দু বিদ্বেষী হত আর মন্দির ভেঙে যদি মসজিদ গড়াই যদি তাদের প্রধান লক্ষ্য হত তবে আজও সারা ভারতে কীভাবে হাজার হাজার প্রাচীন মন্দির ও মধ্যযুগীয় মন্দির রয়েগেল? আছে এ প্রশ্নের উত্তর আপনার কাছে?
সুতরাং পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্ট যে আদেশ দিয়েছে সেটাই যুগের চাহিদা। এটাই কাম্য। একে বিদ্রুপ নয়, স্যালুট জানানো উচিত। অন্যদিকে ভারতীয় কোর্টের অবস্থান সেদিক থেকে অনেকটা পিছনের সারিতে চলে গেছে বলেই ধারণা করছেন অনেকেই।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন