ধর্ষণ এবং প্রতিবাদের ধরণ - কিছু কথা
ধর্ষণ। জঘন্যতম অপরাধ। তার উপর নৃশংসভাবে খুন, যা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। হাজার শাস্তি দিযেও তাকে আটকানো যাচ্ছে না। ব্যাপক এবং গভীর আর্থ-সামাজিক সংকট এবং তজ্জনিত মানসিক অসুস্থতার মধ্যেই রয়েছে তার অন্তর্নিহিত কারণ।
কেন তা আটকানো যাচ্ছে না, আমার আলোচনা এখন তা নিয়ে নয়। আমি দেখছি বাঙালির এক অদ্ভুত মানসিকতা। দেখছি আর অবাক হচ্ছি।
ধর্ষণ এবং তারপর নৃশংসভাবে খুন, সে যেখানেই হোক, তা জঘন্যতম অপরাধ। তা নিয়ে হয়তো কবিতা লেখা যায় না। তা নিয়ে রসিকতা কিংবা মশকরা করাও যায় না। আর এসবের কিছু না করলেও কেউ আপনাকে সমালোচনা করবে না। কিন্তু তাই বলে এই অপরাধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবেন না? কিংবা কেউ করলে প্রশ্ন তুলবেন?
অন্য কোনো রাজনৈতিক ইস্যু হলে আড়াআড়িভাবে আমরা দুই ভাগে ভাগ হয়ে যাই। ভাগ হওয়াটাই স্বাভাবিক। কেউ সমালোচনা করলে অন্য পক্ষের উদাহরণ টেনে আমরা অন্যের প্রশ্নকে ভোঁতা করে দেওয়ার চেষ্টা করি। সেই চেষ্টা কতটা সংগত তা নিয়া প্রশ্ন তোলা গেলেও তাকে আমি অপরাধ বলে ভাবি না। কিন্তু ধর্ষণের মতো এরকম একটা জঘন্য অপরাধ নিয়ে যখন এ ধরনের বিতর্ক তৈরি হয় তখন সত্যিই লজ্জায় মাথা নত হয়ে আসে আমার।
লজ্জা পাই তখন, যখন দেখি কেউ বলেন, বাংলায় হলে প্রতিবাদ করেন, উত্তরপ্রদেশে বা অন্য জায়গায় হলে চুপ থাকেন কেন? কিংবা কথাটা উল্টে, উত্তরপ্রদেশ হলে প্রতিবাদ করছেন, আর বাংলায় হলে তো করেন না?
আমি অবাক হয়ে ভাবি, ধর্ষণের মত একটা অমানবিক কাজের বিরুদ্ধে কথা বললে এমনভাবে প্রশ্ন তোলা যায়? আমার বিবেচনায় বলে, যায় না। অপরাধ যেখানেই হোক, প্রতিবাদ করাটাই হচ্ছে মানুষের ধর্ম। সেই প্রতিবাদের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলার মানে হচ্ছে সেই প্রতিবাদকে রুখে দেয়ার চেষ্টা এবং অপরাধকে লঘু করে দেয়ার অপচেষ্টা।
যারা রাজনীতির কারবারি, অথচ রাজনৈতিক নীতি ও আদর্শের ধার ধারেন না, যারা এটাকে (রাজনীতিকে) পেশা হিসেবে নেন, আমি তাদের কথা বলছি না। কারণ এদেশের কিছু রাজনৈতিক দল এমনটাই করে থাকেন। বিশেষ একটি রাজনৈতিক দর্শন এমন করাকে অন্যায়ও বলে না ( রাষ্ট্র দর্শনের জনক মেকিয়াভেলি 'দ্য প্রিন্স' গ্রন্থে তেমন কথাই বলে গেছেন। তিনি রাজনীতিতে ন্যায়-অন্যায়, নীতিবোধ এগুলোকে গুরুত্ব দিতে চাননি। সেই দর্শন মূলত রাজতন্ত্র বিষয়ক) এবং যারা এই নীতি মেনে চলেন, তারা নিজের দোষ দেখেন না কিন্তু অন্যের দোষ দেখলেই তেড়ে-ফুঁড়ে ওঠেন।
কিন্তু তারা যে এমন করে থাকেন এবং তা যে ভয়ংকর ক্ষতিকারক, আধুনিক গণতান্ত্রিক কোনো দেশের পক্ষে, তাতো বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু এই ধরনের রাজনৈতিক দলগুলি অবলীলায় তা করে চলে। তারা যে এগুলো করে পার পেয়ে যায় তার জন্য দায়ী হচ্ছি আমরা। আমরা যারা সরাসরি রাজনীতি করি না, কিন্তু রাজনীতিকে সংগত কারনেই উপেক্ষা করতে পারিনা, পরোক্ষে জনমতকে প্রভাবিত করতে পারি, তাদের অশিক্ষা অথবা ক্ষুদ্র স্বার্থ এর জন্য দায়ী।
আজ যখন মনীষা বাল্মীকির প্রতি অন্যায়ের বিরুদ্ধে মানুষ প্রতিবাদে মুখর হচ্ছেন, তখন কোন কোন মানুষ প্রশ্ন তুলছেন। কামদুনি সহ বাংলায় ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনার উল্লেখ করছেন। কী উদ্দেশ্যে উল্লেখ করছেন? উদ্দেশ্য স্পষ্ট, উত্তরপ্রদেশের ঘটনাকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা, ঘটনার ভয়াবহতাকে লঘু করে দেখানোর চেষ্টা। আচ্ছা, নিজের কাছে প্রশ্ন করুন তো, কামদুনির ঘটনা যখন ঘটে ছিল, আপনি প্রতিবাদে রাস্তায় নামেননি? ফেসবুক তোলপাড় করেননি? মনে করে দেখুন করেছেন। (যদি না করে থাকেন, তো ঠিক করেন নি) সেটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু আজ যখন উত্তরপ্রদেশের ঘটনা ঘটলো, তখন আপনি সেই আট বছর আগের ঘটনাকে সামনে এনে কী প্রমাণ করতে চাইছেন? বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা আমাদের দেশের বিচার ব্যবস্থার একটা বড় দুর্বলতা। পুলিশের দুর্নীতি, রাজনীতিকদের প্রশাসনের ওপর অন্যায় হস্তক্ষেপ অহরহ ঘটছে। এর বিরুদ্ধে মুখ খুলতে তো আপনাকে কেউ বারণ করে নি। করলেও আপনি শুনবেন কেন? সেখানেও আপনি প্রতিবাদ করুন। কিন্তু এতদিন পর আপনার কামদুনির কথা মনে পড়ছে? আপনি এতদিন চুপ করে ছিলেন কেন? বিচারব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রিতা আর আর তার বিরুদ্ধে এতদিন আপনি চুপ করেছিলেন কেন? কেন আপনার কলম গর্জে ওঠে নি এতদিন?
আপনি যদি তথাকথিত কোন রাজনৈতিক দলের নেতা হন এ প্রশ্ন আমি আপনাকে করছি না। করছি আমার মত সাধারন মানুষ, যারা একটা অপরাধের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা মানুষের মুখ বন্ধ করার জন্য পিছনের কোন ঘটনাকে তুলে আনছেন, তুলনা করছেন, তাদের।
ভেবে দেখেছেন আপনার এই বিরোধিতা পরোক্ষে অপরাধীদের উৎসাহিত করে? ভেবে দেখেছেন এতে রাজনৈতিক দলগুলোর দুর্নীতি এবং অপকর্ম ও অপরাধ প্রবণতাকে প্রশ্রয় দেয়া হয়? আর এটা আমরা করি বলেই ভারতবর্ষের রাজনীতি আস্তে আস্তে পৃথিবীর নিকৃষ্টতম রাজনৈতিক দর্শনের ধ্বজাধারীদের আখড়ায় পরিণত হচ্ছে। গণতন্ত্রের মতো একটি শক্তিশালী অস্ত্র আজ ভোঁতা হয়ে যেতে বসেছে। শুধুমাত্র আমাদের মত নির্বোধ, অশিক্ষিত এবং ক্ষুদ্র স্বার্থের পিছনে ছুটে বেড়ানোর মানুষদের বাড়বাড়ন্তের কারণে। কোন রাজনৈতিক দলের ধ্বজাধারী হয়ে অনৈতিকভাবে কিছু সুবিধা পাওয়ার আশায় আমরা তাদের এই অন্যায় গুলোকে ছোট করে দেখি এবং রাজনীতিকদের অসাধু হতে সাহায্য করি।
আসুন ভেবে দেখি। রাজনীতিক নয়, একজন সাধারন মানুষ হিসাবে আমি আমার দায়িত্ব, নাগরিক দায়িত্ব, সঠিকভাবে পালন করছি তো? আর তা যদি আপনি করতে না পারেন, তাহলে মায়াকান্না কাঁদবেন না। আমার আপনার অপকর্মের ফল, নির্বুদ্ধিতার ফল, আমার মা বোন এবং সন্তানদের ভুগতে হবে। তৈরি থাকুন, কোন দিন দেখবেন আমি বা আপনিই দাঁড়িয়ে আছি কামদুনি বা হাতরাসের হতভাগ্য মা-বাবা বা ভাইদের লাইনে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন