প্রসঙ্গ : ফ্রান্স, হযরত মুহাম্মদ-এর কার্টুন ও তার পরবর্তী সংকট
◾হে মানুষ! জ্ঞানীর কলমের কালি শহীদের রক্তের চেয়েও মূল্যবান, জ্ঞান অর্জন প্রত্যেক নর-নারীর জন্য ফরয ( অবশ্যপালনীয় কাজ)। কারণ, জ্ঞান মানুষকে সঠিক পথ দেখায় ।
◾'হে মানুষ! তোমরা কখনোই ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করো না। কারণ, অতীতে বহু জাতি ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ির কারণে ধ্বংস হয়ে গেছে।'
(হযরত মুহাম্মদ (সঃ) বিদায় হজ্জের ঐতিহাসিক ভাষণ)
এই কথাগুলো পড়ার পর আপনার কি মনে হচ্ছে না, যিনি কার্টুন আঁকলেন, যিনি কার্টুনটিকে ছাত্রদের দেখালেন (বাক স্বাধীনতার ব্যাখ্যা দিতে) আর দেখানোর অপরাধে যিনি ওই শিক্ষককে হত্যা করলেন এই তিনজনই আসলে উন্মাদ?
১) আপনি আপনার ধর্ম, ধর্মগুরু কিংবা ধর্মীয় আচার আচরণ নিয়ে ব্যঙ্গ চিত্র আঁকতে পারেন। এই যে আপনি পারেন, তার কারণ আপনার এক ধরণের বিশ্বাস, যার ভিত্তি হচ্ছে যুক্তিবাদী মানসিকতা। যে যুক্তিবাদী মন আপনাকে জানাচ্ছে যে, এটা করলে আসলে কিছুই হয় না। খেয়াল করে দেখুন এই যুক্তিবাদী মানসিকতার ভিত্তিটাও কিন্তু এক ধরণের বিশ্বাস। কেননা, এই যুক্তি কোনো বস্তুবাদী-কার্যকারণ সম্পর্কের উপর নির্ভর করে গড়ে ওঠেনি। আমরা জানি, যুক্তির ভিত্তি হচ্ছে কার্যকারণ সম্পর্ক। যেমন ধরুন, বাতাসে পর্যাপ্ত জলীয়বাষ্প থাকলেই কেবল বৃষ্টি হওয়া সম্ভব। এটা যুক্তির কথা। এই যুক্তি বস্তুবাদী-কার্যকারণ সম্পর্কের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা যুক্তির উদাহরণ। এবার ভেবে দেখুন, এই বৃষ্টি হওয়াটা বিশ্বাস-ভিত্তিক কার্যকারণ সম্পর্কের ওপর নির্ভরশীল নয়। অর্থাৎ বিশ্বাসে বৃষ্টি হয় না।
এখন আপনার এই বিশ্বাস-ভিত্তিক যুক্তি বলছে যে, এটা করা যায় এবং তা করা অপরাধ নয়। এই ভাবনা বা বিশ্বাস যদি আপনার থাকে, আর আপনার অনুসারীরা (সমাজ) যদি তা মেনে নেয়, তবে এই অধিকার আপনার জন্য বৈধ। এই বৈধ অধিকারটাকে যদি আপনি বাকস্বাধীনতা বলেন, নিশ্চয়ই তা বাকস্বাধীনতা। কারণ, নিজের মতো করে ভাবার এই অধিকার আপনার, আপনি যে বলয়ে থাকেন, সেই আধুনিক সমাজ স্বীকৃত। তাই সেটা আপনি করতেই পারেন।
কিন্তু মনে রাখতে হবে, এই অধিকার সবার ক্ষেত্রে যুক্তিগ্রাহ্য নয়। কারণ তা সর্বজনীন নয়। কেননা, আগেই বলেছি, এই অধিকার বস্তুবাদী-কার্যকারণ সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠেনি। তাই সবাই তা মানতে বাধ্য নয়। তাছাড়া অন্য ধর্মে বিশ্বাসী মানুষের, যাদের সমাজ বা ধর্মকে আমি বা আপনি বিষয় করছি, তাদের এতে স্বীকৃতি নেই। তাই আমি বা আপনি একাজ করতে পারি না। আপনি যুক্তি, বুদ্ধি ও তথ্য সহকারে আলোচনা করতে পারেন, প্রচার চালাতে পারেন। স্বীকৃতি আদায় করার জন্য, গণসচেতনা বৃদ্ধির জন্য, গণতান্ত্রিক ও অহিংস পদ্ধতিতে আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেন। কিন্তু অসম্মান করতে পারেন না, জবরদস্তি করতে পারেন না।
কেন?
কারণ, এই বিশ্বাস-ভিত্তিক যুক্তিবাদী ভাবনার অধিকার থাকাটা যদি আপনার স্বাধীনতা হয়, তাহলে ভিন্ন ধর্মে বিশ্বাসী মানুষের বিশ্বাসকে আপনি কোন যুক্তিতে খর্ব করবেন, বা আঘাত করবেন? সেটাও তো আপনার মতো, তারও বিশ্বাস-ভিত্তিক যুক্তিবাদী ভাবনার অধিকারের মধ্যে পড়ে। এবং এটা (আঘাত) যদি করা হয় এবং তাকে বাকস্বাধীনতা বা মত প্রকাশের স্বাধীনতা বলে দাবি করা হয়, তাহলে তা স্ববিরোধী হয়ে যায় না ? যায়। এটা মারাত্মক ভুল। তা করতে গেলেই সংকট দেখা দেবে।
যে বিশ্বাস ভিত্তিক কার্যকারণ সম্পর্কের ভিত্তিতে আপনি, এই যে অধিকার দাবি করছেন নিজ ধর্ম, ধর্মগুরু ইত্যাদির কার্টুন আঁকা যায়, সেই বিশ্বাস ভিত্তিক সম্পর্কের ভিত্তিতেই অন্য জনও দাবি করতে পারেন যে, তার ধর্মের কোনো বরেণ্য মানুষের ছবি বা কার্টুন আঁকা যাবে না। বা কেউ করলে তা তারা মানতে পারবেন না।
২) এই না মানতে পারার বিষয়টি সামনে রেখে আমি আপনিও প্রতিবাদ করতে পারি, গঠনমূলক সমালোচনাও করা যায়। তা আমার আপনার গণতান্ত্রিক অধিকার, একধরণের বাকস্বাধীনতাও বটে। কিন্তু এই স্বাধীনতা কখনও মানুষ (কার্টুনিস্ট বা তা দেখানো শিক্ষক) হত্যাকে মান্যতা দেয় না। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে তা করার অধিকার সবার আছে। তাই এই বিষয়টি নিয়ে হত্যা যজ্ঞ শুরু করলে, তা ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করাই সামিল হয়, বা বোঝায়, যার স্বীকৃতি ইসলামে নেই। আর তা যে নেই, তার প্রমাণ হযরত মোহাম্মদের দ্বিতীয় উদ্ধৃতিটি।
তাহলে প্রশ্ন হল, এরা এই কাজগুলো করে কেন?
আসলে, এই উন্মাদের জন্মদাতারা হচ্ছেন রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করার জন্য ধর্মকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারকারী এক ধরণের রাজনৈতিক চক্রান্তকারি। তারা বিভিন্নভাবে, কখনো অর্থ দিয়ে, কখনো ভয় দেখিয়ে, কখনো মৃত্যু পরবর্তী কল্প-জীবনের গল্প দিয়ে ব্রেন ওয়াশ করে এদেরকে উন্মাদ করে ফেলে। অর্থাৎ পুরোটাই ধর্মব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার কারবারিদের একটা ঘৃণ্য চক্রান্তের ভয়াবহ পরিণতি। যার বলি হায়, সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ বা সমাজের মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়। আর তার অনৈতিক সুযোগ এবং সুবিধা ভোগ করে ধর্মব্যবসায়ী ও রাজনীতির কারবারিরা।
তাই আসুন, আগে মানুষ হই। তারপর ধার্মিক হওয়ার কথা ভাবি। আর আমার মনে হয়, একজন প্রকৃত মানুষই কেবলমাত্র প্রকৃত ধার্মিক হতে পারেন। খেয়াল করে দেখুন, হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এই ভাষণে (বিদায় হজ্জের ঐতিহাসিক ভাষণ) বারবার 'হে মানুষ' ('হে ধার্মিক' সম্মোধন করেন নি) সম্মোধনটি ব্যবহার করেছেন। অর্থাৎ সমগ্র মানবজাতিকেই উদ্দেশ্য করে তিনি তার এই শেষ ভাষণ দিয়েছেন।
সুতরাং ধার্মিক হওয়ার আগে, আসুন আগে মানুষ হই। আর তা যদি হতে পারি, তাহলে ঘটা করে ধার্মিক সাজার প্রয়োজন হয়না। প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই আপনি ধার্মিক হয়ে যাবেন।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন