সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ভারত বিভাজন ও হিন্দু মুসলিম সাম্প্রদায়িকতা

ভারত বিভাজন ও হিন্দু মুসলিম সাম্প্রদায়িকতা

ভালো-মন্দ যাহাই আসুক সত্যরে লও সহজে - কথাটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। কিন্তু কথাটার উত্তরাধিকার শুধু বাঙালি নয়, শুধু ভারতীয় নয়, ছড়িয়ে আছে বিশ্বময়। তাই আপনি বা আমি সবাই তারই অংশ। অর্থাৎ আমাদের জন্যও কথাটা স্মরণযোগ্য।

সত্যকে মেনে নেয়ার ক্ষমতা সবার থাকে না। অনেক বড় মনের মানুষ হতে হয় তার জন্য। হৃদয়ের ভিতরের আয়তনটাও অনেক বড় হওয়া দরকার। তবেই সেই সত্যকে সহজে নেওয়া যায়। শ্রদ্ধেয় অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় তেমনি একজন বড় হৃদয়ের মানুষ। যে-হৃদয় সত্যকে সহজে গ্রহণ করার শক্তি অর্জন করেছে।

আপনার সে শক্তি নেই। সেটা আপনার মন্তব্যে বোঝা গেল। কিন্তু আপনার ক্ষমতার উপরে বা শক্তির উপরেই তো শুধুমাত্র সত্য নির্ভরশীল নয়। তার নিজস্ব একটা শক্তি আছে। সে শক্তিকে আত্মস্থ করার মতো ক্ষমতা সবার হয় না, বলা ভালো থাকেনা। তাকে অর্জন করতে হয়। আপনার বোধ হয় সে সুযোগটুকু হয়ে ওঠেনি।

তবে এটাকে আমি আপনার ব্যক্তিগত দোষ বলে মনে করিনা। কারণ, আপনার মনের কোণে যে সংশয়, সন্দেহ, অবিশ্বাস জায়গা করে নিয়েছে তা নিয়ে আপনি জন্মাননি। বিখ্যাত একজন পাশ্চাত্য দার্শনিক বলেছিলেন, জন্মের সময় মানুষের মন থাকে সাদা কাগজের মতো। আপনিও সেই সাদা মন নিয়েই জন্মেছিলেন। একটু চিন্তা করলেই দেখবেন কথাটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, আপনি হিন্দু না মুসলিম, জন্মের পরপর যখন আপনার একটু একটু করে জ্ঞান হয়, আপনি তা জানতেন না । আপনার পরিবার, আপনার সমাজ, বারে বারে আপনাকে যেটা শিখিয়েছে, সেটাই শিখেছেন। তাই আপনি হিন্দু আমি মুসলিম। এটা আমার আপনার অর্জন নয়। এটা অন্যের কাছ থেকে পাওয়া একটা উপলব্ধি মাত্র। অর্থাৎ অন্যের উপলব্ধি, যা আমার আপনার ঘাড়ে এসে চেপে বসেছে।

আপনি ওটাকে ছুড়ে ফেলুন। মাথার ভেতরের জায়গাটাকে খালি করে দিন। একটু পড়াশোনা করুন। দেখবেন, জগতের আসল সত্যটা আস্তে আস্তে সেখানে জায়গা করে নিচ্ছে। যে সত্য সৌমিত্র বাবু উপলব্ধি করেছেন, অর্থাৎ অর্জন করেছেন, তা আপনারও অর্জনের আওতায় চলে আসছে।

সেদিন আপনিও বুঝতে পারবেন, ভারত উপমহাদেশ একটি বহুজাতিক ভূখন্ড। আর এ কারণেই এখানে কোন একটি বিশেষ ধর্ম নিজের আধিপত্য কায়েম করতে পারেনি। প্রাচীন যুগ থেকেই ভারতীয় উপমহাদেশ বহুত্ববাদের পীঠস্থান হয়ে উঠেছে। 'শক হুন দল পাঠান মোগল', তারও আগে আর্যদের এখানে আসার পরেও, তারা তাদের নিজস্ব যে ধর্ম বা সংস্কৃতি, যা তারা বয়ে এনেছিলেন, তাকে কায়েম করতে পারেন নি। এটা একটা ঐতিহাসিক সত্য। কিন্তু হাল ছাড়েননি ব্রাহ্মণ্যবাদী বৈদিক সভ্যতার ধারক ও বাহকরা।

স্বাধীনতার প্রাক্কালে, আরএসএস গঠন করে এবং জাতীয় কংগ্রেসের মধ্যে ঢুকে কৌশলে হিন্দুত্ববাদের নাম করে নতুন করে উঠেপড়ে লাগে ভারতকে এক জাতি ও এক ধর্মের অনুসারী দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে।

গোলটা পাকে সেখানেই। গান্ধীজী, সুভাষ বসু, চিত্তরঞ্জন দাস, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ এবং মোহাম্মদ আলী জিন্নাহসহ কংগ্রেসের প্রথম সারির নেতারা চেষ্টা করেছিলেন ভারতকে অখন্ড রাখতে। কিন্তু হিন্দুত্ববাদী নেতারা বুঝেছিলেন অখন্ড ভারত থাকলে তাদের স্বপ্নের হিন্দুরাষ্ট্র, যা মনুবাদের উপর ভিত্তি করে গড়ে তোলার ইচ্ছা যুগ যুগ ধরে বয়ে নিয়ে আসছেন, তা কার্যকরী হবে না। সে-ক্ষেত্রে প্রধান বাধা হচ্ছে ব্রাহ্মণ্যবাদী জনগোষ্ঠীর নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকা। আর তা না থাকলে তাদের মনুবাদী রাজ কায়েম করা সম্ভব হবে না। তাই ভারত বিভাগের ষড়যন্ত্র তারাই করেছিলেন, যারা নিজেদেরকে একক বৃহত্তম জনগোষ্ঠী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে চাইছিলেন। মুসলিমরা অন্য অন্য  রাষ্ট্র পেলে সেখানে চলে যাবে এবং ভারতে তারা একক সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীতে পরিণত হবে। এবং মনুবাদী হিন্দু রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েম করতে পারবে। এটা একটা রাজনৈতিক চক্রান্ত। যার পরিণতিতে ধর্মের ভিত্তিতে ভারত বিভাজন।

ধর্মীয় কারণে মুসলিমরা যদি ভারত বিভাজনের জন্য দাবি করবে, তাহলে নিজের কাছে প্রশ্ন করুন, পাকিস্তান কেন দু'ভাগে বিভক্ত হয়ে গেল? পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ তো ছিল ইসলাম ধর্মাবলম্বী। যুক্তিবাদী মন নিয়ে এই তথ্য বিশ্লেষণ করুন। দেখবেন সেখানে উঠে আসবে জাতিরাষ্ট্রের ধারণা। পাকিস্তান যদি যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে মেনে নিত এবং বাঙালি জাতির জাতিসত্তাকে সম্মান জানাত তাহলে পাকিস্তান ভাগ হতো না। ভারত বা বাংলা বিভাজনের পিছনে ধর্মের নয়, হিন্দুত্ববাদী মনুবাদী রাজনৈতিক দর্শনই মূল ভূমিকায় ছিল। পরবর্তীতে মুসলিম মৌলবাদীরা সক্রিয় হয়ে ওঠে, যা ভারত বিভাজনকে ত্বরান্বিত করেছিল মাত্র।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র 50টিও বেশি স্টেট নিয়ে গড়ে ওঠা একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় রাষ্ট্রকাঠামো। সেখানে প্রত্যেকটা প্রদেশের জন্য আলাদা আলাদা পতাকা এবং সংবিধান রয়েছে। এগুলোকে স্বীকার করে নিয়েই যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীতে বৃহৎ শক্তিতে পরিণত হয়েছে। এই সত্য যদি ভারতের ক্ষেত্রে আরএসএস স্বীকার করে নিত, মুসলিম জনসংখ্যার অনুপাতে যদি রাজনৈতিক ক্ষমতার ভাগাভাগি মেনে নিত, তাহলে কখনই ভারত বিভক্ত হতো না। এটাই আসল ইতিহাস। আজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তাবেদারী করতে হতোনা ভারতকে। উল্টে ভারতও একটি মহাশক্তিতে পরিণত হতো।

আরএসএস এবং ব্রিটিশের চক্রান্তে মুসলিম লীগের জন্ম এবং পরবর্তীতে মুসলিম লীগ ও আরএসএস এর মুখপাত্র শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের চক্রান্তে অবিভক্ত বাংলাও বিভক্ত হয়ে গেল। এর পিছনেও রয়েছে মনুবাদীদের বাঙালি বিদ্বেষী রাজনীতি। দুই বাংলা যদি ঐক্যবদ্ধ থাকতো এবং ভারত যদি অবিভক্ত থাকতো তাহলে ভারতের রাজনৈতিক ক্ষমতার ভরকেন্দ্র গুজরাট বা উত্তরপ্রদেশ নয়, হতো বাংলা এবং বাঙালি। শ্যামাপ্রসাদ প্রথমদিকে এই চক্রান্ত ধরতে পারেন নি। বাংলা ভাগের পর বাংলাদেশ থেকে আসা শরণার্থীদের চরম দূর্দশার প্রত্যক্ষদর্শী হওয়ার পরই তার ভুল ভেঙেছিল। বুঝেছিলেন, তিনি ভুল করেছেন বাংলা ভাগ চেয়ে। 1952 সালের নদীয়ায় এক জনসভায় তিনি বলেছিলেন, বাংলা ভাগের জন্য মানুষের (পড়ুন উদ্বাস্তুদের) এত কষ্ট হবে, এ যদি আগে বুঝতে পারতাম তাহলে বাংলা ভাগ চাইতাম না।

আগেই বলেছি ভারত একটি বহুজাতিক ভূখন্ড। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধান বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান। বিবিধের মাঝে মিলন যে-দেশের মর্মবাণী, ইতিহাসের পাতা খুলে দেখুন, এ শিক্ষাকে সর্বপ্রথম উপেক্ষা করেছেন বা অস্বীকার করেছেন আরএসএসের নেতারা। তাদের একের পর এক চক্রান্তের কারণে জিন্না পৃথক রাষ্ট্রের দাবি করে বসেন। আর গান্ধীজি আরএসএস-র হাতে শহীদ হন।

সুতরাং একটা বহুজাতিক ভূখণ্ডের উপযুক্ত রাজনৈতিক দর্শন যা হওয়া উচিৎ তা হল ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ও যুক্তরাষ্ট্রীয় রাষ্ট্রব্যবস্থা। ঐক্যবদ্ধ থাকলে সেটাই হত ভারতের রাষ্ট্র দর্শন তথা সংবিধানের মূল ভিত্তি। উপমহাদেশের বৃহত্তম ভূখণ্ড নিয়ে গড়ে ওঠা ভারত রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ ও যুক্তরাষ্ট্রীয় চরিত্র নিয়ে আত্মপ্রকাশ করাই ছিল স্বাভাবিক বাস্তবতা। ( যদিও বাস্তবের তা হতে দেয় নি যারা, তারা ইতিহাসের আড়ালে রয়ে গেছেন।) স্বাধীন ভারতও এই ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েই গড়ে উঠেছে। এটাই আসল ভারত বর্ষ। এর উল্টো পথে হাঁটতে গেলেই  ভারতের অখন্ডতা  হুমকির মুখে পড়বে।

সুতরাং ধর্মনিরপেক্ষতা, ভারতের প্রাচীনতম একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা। আধুনিক সময়ে, যুক্তরাষ্ট্রীয় রাষ্ট্র দর্শন এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এই শব্দটির সংযুক্তির পিছনে রয়েছে ভারতবর্ষের ঐক্য ও সংহতির মূল চাবিকাঠি। তাকে ভাঙার চেষ্টা করার যে চেষ্টা আরএসএস প্রমূখ হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি করেছিল তার ফলেই দেশটা বিভক্ত হয়েছে।

ধর্মের ভিত্তিতে মুসলিমরাই যদি ভারত ভাগ করতে চাইত তাহলে মুসলিমদের নিয়ে তৈরি পাকিস্তান দু'ভাগে বিভক্ত হয়ে যেত না। কারণ এই দুই অংশেরই বৃহৎ জনগোষ্ঠী ছিল ইসলাম ধর্মাবলম্বী। সুতরাং আপনার ধারণা অসম্পূর্ণ এবং ভুল তথ্য দ্বারা প্রভাবিত।

মন্তব্যসমূহ

📂 আলী হোসেনের জনপ্রিয় প্রবন্ধগুলি

হিন্দু কারা? তারা কীভাবে হিন্দু হল?

হিন্দু কারা? কীভাবে তারা হিন্দু হল? যদি কেউ প্রশ্ন করেন, অমিত শাহ হিন্দু হলেন কবে থেকে? অবাক হবেন তাই তো? কিন্তু আমি হবো না। কারণ, তাঁর পদবী বলে দিচ্ছে উনি এদেশীয়ই নন, ইরানি বংশোদ্ভুত। কারণ, ইতিহাস বলছে পারস্যের রাজারা ‘শাহ’ উপাধি গ্রহণ করতেন। এবং ‘শাহ’ শব্দটি পার্শি বা ফার্সি। লালকৃষ্ণ আদবানির নামও শুনেছেন আপনি। মজার কথা হল আদবানি শব্দটিও এদেশীয় নয়। আরবি শব্দ ‘আদবান’ থেকে উদ্ভূত। সুতরাং তাঁর পদবীও বলছে, তিনিও এদেশীয় নন। ভাষাতত্ত্ব ও নৃতত্ত্বের বিশ্লেষণ বলছে, উচ্চবর্ণের বিশেষ করে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের মানুষদের, উৎসভূমি হল পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চল। তারও আগে ছিল ইউরোপের ককেশাস অঞ্চলে। আসলে এরা (উচ্চবর্ণের মানুষ) কেউই এদেশীয় নয়। তারা নিজেদের আর্য বলে পরিচয় দিতেন এবং এই পরিচয়ে তারা গর্ববোধ করতেন। সিন্ধু সভ্যতা পরবর্তীকালে তারা পারস্যের বিভিন্ন এলাকা থেকে হিন্দুকুশ পর্বতের গিরিপথ ধরে এদেশে অভিবাসিত হয়েছেন। আর মধ্যযুগে এসে এদেরই উত্তরসূরী ইরানিরা (অমিত শাহের পূর্বপুরুষ) অর্থাৎ পারস্যের কিছু পর্যটক-ঐতিহাসিক, এদেশের আদিম অধিবাসীদের ’হিন্দু’ বলে অভিহিত করেছেন তাদের বিভিন্ন ভ্রমণ বৃত্তান্তে। ...

রবীন্দ্রনাথের ধর্মভাবনা ও তার বিবর্তন

রবীন্দ্রনাথের ধর্মভাবনা ও তার বিবর্তন আলী হোসেন  যদি প্রশ্ন করা হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ধর্ম কী? মনে হয় অনেকেই ঘাবড়ে যাবেন। কেউ বলবেন, তাঁর বাবা যখন ব্রাহ্ম ছিলেন, তখন তিনি নিশ্চয়ই ব্রাহ্ম হবেন। যারা লেখাপড়া জানেন না, তারা বলবেন, কেন! উনি তো হিন্দু ছিলেন। আবার কেউ কেউ তথ্য সহযোগে এও বলার চেষ্টা করবেন যে, উনি নাস্তিক ছিলেন। না হলে কেউ বলতে পারেন, ধর্মমোহের চেয়ে নাস্তিকতা অনেক ভালো?¹ রবীন্দ্রনাথের ধর্ম ভাবনার বিবর্তন  তাহলে সঠিক উত্তরটা কী? আসলে এর কোনোটাই সঠিক উত্তর নয়। চিন্তাশীল মানুষ-মাত্রই সারা জীবন ধরে ভাবতে থাকেন। ভাবতে ভাবতে তাঁর উপলব্ধি এগোতে থাকে ক্রমশঃ প্রগতির পথে। এই সময়কালে জগৎ ও জীবন থেকে তথ্য সংগ্রহ করে একে একে গড়ে তোলেন জীবনদর্শনের নিত্যনতুন পর্ব। তাই এ ধরনের চিন্তাশীল মানুষ আজীবন এক এবং অখণ্ড জীবনদর্শনের বার্তা বহন করেন না। সময়ের সাথে সাথে পাল্টে যায় তাঁর পথচলার গতিমুখ, গড়ে ওঠে উন্নততর জীবন দর্শন। মানুষ রবীন্দ্রনাথও তাই পাল্টে ফেলেছেন তাঁর জীবন ও ধর্মদর্শন; সময়ের এগিয়ে যাওয়াকে অনুসরণ করে। রবীন্দ্রনাথ ও  হিন্দু জাতীয়তাবাদ ১৮৬১ সালের ৭ই মে সোমবার রাত্রি ২টা ৩৮ ...

ভাগ্য : মুসলিম মনস্তত্ত্ব, ধর্মদর্শন ও প্রগতি

ভাগ্য : মুসলিম মনস্তত্ত্ব, ধর্মদর্শন ও প্রগতি - লিখছেন আলী হোসেন  কপালের লেখন খণ্ডায় কার সাধ্য? জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে কিংবা লেখাপড়া জানা-নাজানা নির্বিশেষে সমস্ত মানুষের সিংহভাগই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এই কথাটা মেনে নেয়। জীবনের উত্থান-পতনের ইতিহাসে কপালের লেখনকে জায়গা করে দিতে তারা কুণ্ঠাবোধ করে না। বরং বলা ভালো এব্যাপারে তারা অতিমাত্রায় উদার। মানুষের মনস্তত্বের এ-এক জটিল স্তর বিন্যাস। একই মানুষ বিভিন্ন সময়ে একই বিষয়ের বিচার বিশ্লেষণে ভিন্নভিন্ন দৃষ্টিকোণ ব্যবহার করে। এ রকমই একটি দৃষ্টিকোণ হলো কপাল বা ভাগ্যের ভূমিকাকে সাফল্যের চাবিকাঠি বলে ভাবা। কখনও সে ভাগ্যের নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠার চেষ্টা করে, আবার কখনও নিজেই ভাগ্যের কাছে নির্দিধায় আত্ম সমর্পন করে। নিজের ব্যার্থতার পিছনে ভাগ্যের অদৃশ্য হাতের কারসাজির কল্পনা করে নিজের ব্যার্থতাকে ঢাকা দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে থাকে। মজার কথা, এক্ষেত্রে মুসলিম মানসের মনস্তত্ত্ব কখনও চেতনমনে আবার কখনও অবচেতন মনে উপরওয়ালাকে (আল্লাহকে) কাঠ গড়ায় তোলে বিনা দ্বিধায়। নির্দিধায় বলে দেয়, উপরওয়ালা রাজি না থাকলে কিছুই করার থাকেনা। সাফল্য কিংবা ব্যর্থতা সবই তাঁর (আল...

সীমান্ত আখ্যান, বাঙালির আত্মানুসন্ধানের ডিজিটাল আখ্যান

সময়ের সঙ্গে সমস্যার চরিত্র বদলায়। কিন্তু মুলটা বদলায় না। যদি সে সমস্যা ইচ্ছা করে তৈরি হয়ে থাকে বিশেষ সুবিধা ভোগেই লোভে, তবে তো অন্য কথা চলেই না। স্বনামধন্য স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাতা সৌমিত্র দস্তিদারের ডকুমেন্টারি ফিল্প 'সীমান্ত আখ্যান' দেখার পর এই উপলব্ধি মাথা জুড়ে ঘুরপাক খাচ্ছে। দেখলাম, দেশ ভাগ হয়েছে। কিন্তু সমস্যার অবসান হয়নি। শুধু সমস্যার চরিত্রটা পাল্টেছে। এই যে সমস্যা রয়ে গেল, কোন গেল? তার উত্তর ও পাওয়া গেল 'সীমান্ত আখ্যান' এ। আসলে দেশ ভাগ তো দেশের জনগণ চাননি, চেয়েছেন দেশের নেতারা। চেয়েছেন তাঁদের ব্যক্তিগত, সম্প্রদায়গত সুবিধাকে নিজেদের কুক্ষিগত করার নেশায়। আর এই নেশার রসদ যোগান দিতে পারার নিশ্চয়তা নির্ভর করে রাজনৈতিক ক্ষমতার লাগাম নিজের হাতে থাকার ওপর। তাই রাজনীতিকরা এই ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য জনগণকে 'ডিভাইড এন্ড রুল' পলিছি দ্বারা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চেষ্টা করেছেন এবং করে চলেছেন। এ সমস্যা নতুন না, ব্রিটিশ সরকার এর বীজ রোপণ করে গেছেন, এখন কেউ তার সুফল ভোগ করছে (রাজনীতিকরা) আর কেউ কুফল (জনগন)। 'সীমান্ত আখ্যান চোখে আঙুল দিয়ে দে...

কাশ্মীর ফাইলস : প্রপাগান্ডার এক নয়া ব্রান্ড, কর্পোরেট পুঁজি ও রাজনৈতিক দলের গলাগলির এক সুচারু প্রদর্শনী

কাশ্মীর ফাইলস : প্রপাগান্ডার এক নয়া ব্রান্ড, কর্পোরেট পুঁজি ও রাজনৈতিক দলের গলাগলির এক সুচারু প্রদর্শনী রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয় উলুখাগড়ার প্রাণ যায়। ১৯৪৭ সালের পর থেকে জম্মু ও কাশ্মিরের জনগণের ভাগ্যলিপিতে লেখা হয়ে গেছে এই বিখ্যাত প্রবাদটির বিস্তারিত সারাৎসার। একদিকে পাকিস্তান আর অন্যদিকে ভারত – এই দুই প্রতিবেশি দেশের ভুরাজনৈতিক স্বার্থের যাঁতাকলে পড়ে তাদের এই হাল। কিন্তু কেন এমন হল? এই প্রশ্নের উত্তর জানে না এমন মানুষ ভুভারতে হয়তো বা নেই। কিন্তু সেই জানার মধ্যে রয়েছে বিরাট ধরণের ফাঁক। সেই ফাঁক গলেই ঢুকেছে কাশ্মির ফাইলসের মত বিজেপির রাজনৈতিক ন্যারেটিভ যা তারা বহুকাল ধরে করে চলেছে অন্য আঙ্গিকে। এবার নতুন মাধ্যমে এবং নবরূপে তার আগমন ঘটেছে, যায় নাম সিনেমা বা সেলুলয়েড প্রদর্শনী। যদিও ডিজিটাল মাধ্যমে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সৌজন্যে অনেক আগেই সফলভাবে তারা এই ন্যারেটিভ দিয়ে বিভাজনের রাজনীতি করে চলেছে বেশ কয়েক বছর ধরে। টেলিভিশন সম্প্রচারে কর্পোরেট পুজির অনুপ্রবেশের মাধ্যমে যার সূচনা হয়েছিল। রাষ্ট্রশক্তিকে কুক্ষিগত করতে না পারলে দেশের সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রন আনা সম্ভব নয়, একথা সাধারণ নিরক্ষর নাগরিক এবং ত...

শিক্ষা কী, কেন প্রয়োজন এবং কীভাবে অর্জন করা যায়?

শিক্ষা কী, কেন এবং কীভাবে অর্জন করতে হয়? সূচিপত্র : What is education, why it is needed and how to achieve it শিক্ষা কী শিক্ষা হল এক ধরনের অর্জন, যা নিজের ইচ্ছা শক্তির সাহায্যে নিজে নিজেই নিজের মধ্যে জমা করতে হয়। প্রকৃতি থেকেই সেই অর্জন আমাদের চেতনায় আসে। সেই চেতনাই আমাদের জানিয়ে দেয়, জগৎ ও জীবন পরিচালিত হয় প্রকৃতির কিছু অলংঘনীয় নিয়ম-নীতির দ্বারা। গভীর পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ শক্তিকে বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে কাজে লাগালেই এই নিয়মনীতিগুলো আমাদের আয়ত্বে আসে। এই নিয়ম-নীতিগুলো জানা এবং সেই জানার ওপর ভিত্তি করেই জগৎ ও জীবনকে সর্বোত্তম পর্যায়ে পৌঁছে দেয়ার পথ খুঁজে বের করার শক্তি অর্জনই শিক্ষা। মনে রাখতে হবে, এই শিক্ষা কখনও কারও মধ্যে জোর করে ঢুকিয়ে দেওয়া যায় না। এখন প্রশ্ন হল, শিক্ষা অর্জনের বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিটা আসলে কী। সেই আলোচনায় যাওয়ার আগে জানতে হবে, এই শিক্ষার সূচনা হয় কখন এবং কীভাবে? শিক্ষার সূচনা কখন হয় : এই অর্জনের সূচনা হয় মাতৃগর্ভে এবং তা প্রাকৃতিক ভাবেই। প্রকৃতির দেওয়া কিছু সহজাত শিক্ষাকে অবলম্বন করেই তার সূচনা। এই সহজাত শিক্ষাকে অবলম্বন করেই মানুষ তার পরবর্তী প...

শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি : নেতিবাচক রাজনীতি চর্চা - আলী হোসেন

শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি : নেতিবাচক রাজনীতি চর্চায় সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি : নেতিবাচক রাজনীতি চর্চা - আলী হোসেন আলী হোসেন বিচার একটি যৌথ প্রচেষ্টার ফসল। বিচারক কখনই সঠিক সিদ্ধান্তে আসতে পারেন না, যদি না এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন সংস্থা ও তার কর্মকর্তারা উপযুক্ত তথ্য সংগ্রহ করতে এবং বিচারককে তা সরবরাহ করতে পারেন। আর বিচার ব্যবস্থা হচ্ছে এমন একটি শক্তির আধার; তা যার হাতে থাকে, তিনিই বিচারক। এই শক্তি ন্যায়বিচার তখনই দিতে পারে, যখন বিচারক নিরপেক্ষ থাকার সৎ সাহস দেখান এবং সাংবিধানিক আইন এবং তার প্রয়োগ বিষয়ে আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে বিশেষ পারদর্শিতা অর্জন করেন। তবে তাঁর সফলতা নির্ভর করে তথ্য সংগ্রহকারী বিভিন্ন সংস্থা এবং আইনজীবীরা কতটা সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে সেই তথ্য বিচারকের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন, তার উপর। তাই একজন বিচারক বা বিচার ব্যবস্থা যা বিধান দেয়, তা সব সময় একশ শতাংশ সঠিক এবং যুক্তিযুক্ত হবে - এমন কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত কোনো একটি পক্ষ যদি পক্ষপাতদুষ্ট হয়, তাহলে ন্যায় বিচার পাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। মনে রাখতে হবে, ...

জল, না পানি : জল নিয়ে জলঘোলা করা পানির মত সহজ নয়

জল নিয়ে জলঘোলা করা পানির মত সহজ নয় আলী হোসেন  সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত সরকারি অনুষ্ঠানে চিত্র শিল্পী শুভাপ্রসন্ন ভট্টাচার্য পানি শব্দকে বাংলা নয় বলে দাবি করেছেন। বলেছেন, "আমরা কোনোদিন কখনও বাংলা ভাষায় পানি (শব্দটা) ব্যবহার করি না"। শুধু তা-ই নয়, পানি শব্দের ব্যবহারের মধ্যে তিনি 'সাম্প্রদায়িকতার ছাপ'ও দেখতে পেয়েছেন। প্রশ্ন হল - এক, এই ভাবনা কতটা বাংলা ভাষার পক্ষে স্বাস্থ্যকর এবং কতটা 'বাংলা ভাষার ইতিহাস' সম্মত? দুই, জল বা পানি নিয়ে যারা জলঘোলা করছেন তারা কি বাংলাকে ভালোবেসে করছেন? মনে হয় না। কারণ, খোঁজ নিলে দেখা যাবে, এরা কেউ নিজের সন্তানকে বাংলা মিডিয়াম স্কুলে পড়াননি বা পড়ান না। ব্যবহারিক জীবনেও তারা বাংলার ভাষার চেয়ে ইংরেজি বা হিন্দিতে কথা বলতে বা গান শুনতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন, বলা ভালো গর্ববোধ করেন। প্রসংগত মনে রাখা দরকার, বাংলা মিডিয়াম স্কুলগুলোতে যারা ভর্তি হয়, তারা অধিকাংশই গরীব ঘরের সন্তান। বলা ভালো, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে তারাই বাংলা ভাষাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। কারণ, সন্তানকে বাংলা মিডিয়ামে পড়ানোর পাশাপাশি, বা...

আধুনিক মিডিয়া : কর্পোরেট পুঁজির (পুঁজিপতিদের) তোতাপাখি

গোদি মিডিয়া : কর্পোরেট পুঁজির তোতাপাখি পশ্চিমী মিডিয়াকে 'ইসরাইল সরকারের তোতাপাখি' নামে পরিচয় দেওয়া হয় সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী স্বাধীন ও নিরপেক্ষ মিডিয়া হাউজের পক্ষ থেকে। সম্প্রতি একইভাবে ভারতীয় কর্পোরেট মিডিয়া ভারত সরকার তথা 'কর্পোরেট পুঁজির  তোতাপাখি' হিসাবে পরিচয় পাচ্ছে, যাকে নিন্দুকেরা 'গোদী মিডিয়া' নামে অভিহিত করে থাকে। মধ্যপ্রাচ্যের ঘটনা সম্পর্কে ইসরাইল যা বলে, ইউরোপ ও আমেরিকার মিডিয়া, তোতা পাখির মতো তা-ই প্রচার করে। সাংবাদিকতার প্রধান প্রধান শর্তগুলোকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ইসরাইলের দেওয়া তথ্যই তারা প্রচার করে অন্ধ ও নির্লজ্জভাবে। ভারতের ক্ষেত্রেও করপোরেট মিডিয়া বর্তমানে সেটাই করছে বলে অভিযোগ। অভিযোগ, নত মস্তকে ভারত সরকারের দেওয়া তথ্য বিনা বিচারে প্রচার করে চলেছে অধিকাংশ মিডিয়া হাউজ।  অর্থাৎ তাদের সম্প্রচারিত খবরের বড় অংশই হয় নিয়ন্ত্রিত অথবা কখনও কখনও অসত্য - এমন দাবিও করা হয়।  আসলে সিংহভাগ মিডিয়ার মালিক হচ্ছেন এক-একজন  করপোরেট পুঁজির মালিক বা পুঁজিপতি। এরা কি কখনও নিজের স্বার্থের বিরুদ্ধে যায় - এমন খবর, তথ্য বা তত্ত্ব প্রচার করবে? করবে না, করেও না। আর এ...

নিম্নবর্গের মানুষ মার খাচ্ছে কেন

নিম্নবর্গের মানুষ কীভাবে পিছিয়ে পড়েছেন? সমাধান কীভাবে? এদেশের নিম্নবর্গের মানুষ নিজেদের বাঁচাতে যুগ যুগ ধরে ধর্ম পরিবর্তন করেছে। কখনও বৌদ্ধ (প্রাচীন যুগ), কখনও মুসলমান (মধুযুগ), কিম্বা কখনো খ্রিস্টান (আধুনিক যুগ) হয়েছে। কিন্তু কখনই নিজেদের চিন্তা-চেতনাকে পাল্টানোর কথা ভাবেনি। পরিবর্তন হচ্ছে অলংঘনীয় প্রাকৃতিক নিয়ম। যারা এই নিয়ম মেনে সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে পারে, তারাই লাভবান হয়, টিকে থাকে। “পাল্টে গেলেই জীবন বাড়ে না পাল্টালে নয়, জীবন মানেই এগিয়ে যাওয়া নইলে মৃত্যু হয়” জীবনের এই চরম সত্য তারা অধিকাংশই উপলব্ধি করতে পারেনি। পৃথিবীর যেকোন উন্নত জাতির দিকে তাকান, তারা দ্রুততার সঙ্গে এই পরিবর্তনকে মেনে নিজেদেরকে পুনর্গঠন করে নিয়েছে। যারা পারেনি বা নেয়নি তারাই মার খাচ্ছে, অতীতেও খেয়েছে। বুদ্ধিমান জাতি নিজের দুর্বলতাকে মেনে নেয় এবং ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য সময়ের সঙ্গে তাল রেখে নিজেদের চিন্তা এবং চেতনায় পরিবর্তন আনে। খ্রিষ্টান, ইহুদি-সহ এশিয়া, ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন জাতি - যারাই এই পরিবর্তন মেনে নিয়েছে তারাই আরও উন্নত এবং শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। মহানবীর (সঃ) গৌরবময় উত্থান (যা এক ধরণ...