গণতন্ত্রের চারটি স্তম্ভ। বিচার বিভাগ, আইনবিভাগ, শাসন বিভাগ এবং সংবাদমাধ্যম। এরা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারলেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় এবং মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষিত হয়।
বর্তমান ভারতে এই চারটি স্তম্ভই এখন একটি রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠী এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে। কোন বিভাগই স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না। বাবরি মসজিদ সংক্রান্ত দুটি মামলার রায়, হাতরাসে মনীষা বাল্মীকির ধর্ষণ কাণ্ড এবং পুলিশের ভূমিকা, দিল্লির সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং সিএবি কিংবা এনআরসি বিরোধী আন্দোলনের সময় প্রশাসনের ভূমিকা তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
আসলে আমরা এক আধুনিক রাজতন্ত্রের নাগরিক হিসাবে সময় কাটাচ্ছি। এখানে শাসকের ধর্মই শাসিতের ধর্ম বলে বিবেচিত হচ্ছে, সংখ্যালঘু দলিত শ্রেণী দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে জীবন কাটানোর আশঙ্কায় ভুগছে।শাসকের কথাই আইন বলে বিবেচিত হচ্ছে। এবং তার বিরুদ্ধে কেউ কথা বললেই দেশদ্রোহী হিসাবে আখ্যায়িত হচ্ছেন। ঠিক যেমন প্রাচীন ও মধ্যযুগে রাজা বা সামন্তপ্রভুরা দেশ শাসনের জন্য করতেন। প্রতিনিয়ত তা-ই ঘটছে। তবে পার্থক্য শুধু একটাই, যে তা করা হচ্ছে গণতন্ত্র নামে এক আধুনিক আলখাল্লার মোড়কে।
এখন প্রশ্ন হলো, স্বাধীনতার এত বছর পর ভারতবর্ষের এই পিছন দিকে হাঁটার কারণ কী?
কারণ অনেক। প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় যে, যে রাজনৈতিক দল আজ ক্ষমতায় তার রাজনৈতিক দর্শন মধ্যযুগীয় এবং প্রাচীনপন্থী। রাজনীতির সঙ্গে ধর্মকে জুড়ে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল এবং তাকে টিকিয়ে রাখার যে নীতি সে যুগে প্রচলিত ছিল তা-ই এদের রাজনৈতিক দর্শনের মূল ভিত্তি। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় আবেগকে নিজের নিয়ন্ত্রণে আনতে পারলেই রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করা যায়। বর্তমান শাসক এই অস্ত্রটাকেই সুনিপুণভাবে প্রয়োগ করছেন।
এই কাজকে সহজ করে তুলেছে পূর্ববর্তী শাসকদের কিছু ভুল নীতি এবং পদক্ষেপ। ধর্মীয় আবেগ এবং তার ব্যবহারকে অকেজো করে দিতে সবচেয়ে বেশি জরুরি ছিল মানুষের মধ্যে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও যুক্তি বিজ্ঞানের প্রচার এবং প্রসার। সমস্ত ক্ষেত্রকে ছাপিয়ে এই ক্ষেত্রে অর্থ বরাদ্দ এবং সুপরিকল্পিতভাবে শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর প্রয়োজন ছিল।
স্বাধীনতার লাভের প্রথম দশকে এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেয়া হলেও পরবর্তীতে ক্রমান্বয়ে অর্থ বরাদ্দ কমেছে শিক্ষাক্ষেত্রে। ফলে অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার থেকে বেরিয়ে আসার জন্য যে যুক্তি বিজ্ঞান সবচেয়ে বেশি জরুরি ছিল তা ক্রমান্বয়ে ক্ষয় রোগে আক্রান্ত হয়েছে। ফলে মানুষ এখনও তার আর্থিক উন্নতি, শারীরিক সুস্থতা এবং সামগ্রিক সফলতার পিছনে অলৌকিক শক্তির অনিবার্য ভূমিকার কথা মন থেকে মুছে ফেলতে পারেনি। ফলে ধর্মীয় আবেগ বা ভাবাবেগ মানুষের মধ্যে প্রতিদিন প্রতি নিয়ত বেড়ে চলেছে। আর এই ধর্মীয় আবেগকে পুঁজি করছে রাজনৈতিক দলগুলি, বিশেষ করে বর্তমান শাসকদল।
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে ভারতের মিডিয়াগুলি। এই মিডিয়াগুলি পরিচালিত হয় পুরোপুরি কর্পোরেট হাউসগুলোর দ্বারা। মিডিয়া সেক্টরে বেসরকারি বিনিয়োগ শুরু হওয়ার সাথে সাথে ঘটে গেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। অসংখ্য টিভি চ্যানেল মনোরঞ্জনের নাম করে প্রতিটি ঘরে ঢুকছে অলৌকিক ঐশ্বরিক শক্তির মাহাত্ম্য প্রচার করতে। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে সেখানে এটাই প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা হচ্ছে মানুষ আসলে ভাগ্যের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, এবং ভাগ্যের খাতায় ভাগ্যলিপি লিখে দেন স্বয়ং ভগবান বা ঈশ্বর। তাকে সন্তুষ্ট করতে পারলেই ইহলৌকিক ও পারলৌকিক সবক্ষেত্রেই লাভবান হওয়া যাবে। ফলে মানুষের চিন্তা এবং চেতনায় গেড়ে বসেছে 'বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর'। মানুষ ভুলতে বসেছে যুক্তিবিজ্ঞান এর মূলমন্ত্র 'যুক্তিতে মেলায় বস্তু বিশ্বাসে বহুদূর। সুতরাং ধর্মীয় আবেগ প্রতিদিন বাড়ছে, ঝড়ের গতিতে। সুযোগ বাড়ছে ধর্মীয় সুড়সুড়ি কাজে লাগিয়ে মানুষের আবেগ কেনাবেচার এবং তাকে ব্যালট বাক্সে প্রতিফলিত করার।
কর্পোরেট হাউসগুলো জানে যে, মানুষের শ্রমকে স্বল্পমূল্যে পেতে হলে, এবং দ্রুত মুনাফা অর্জনকে সফল করতে হলে মানুষকে আধুনিক ও যুক্তিবাদী শিক্ষার আলোয় আনা যাবে না। রাজনৈতিক চেতনা বৃদ্ধি পায় এমন কোন বিষয় পাঠ্যক্রমে আনা যাবে না। তাদের সেক্টর গুলিতে হাতে কলমে কাজ করার জন্য যেটুকু প্রযুক্তিগত শিক্ষা প্রয়োজন শিক্ষাক্ষেত্রে কেবলমাত্র সেটুকুই দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। তার অতিরিক্ত কিছু নয়। মজার ব্যাপার হলো ভোটের রাজনীতিতে রাজনৈতিক দলগুলি এই কর্পোরেট হাউসগুলো থেকে প্রচুর অর্থ সাহায্য নেয় এবং তাদের পরামর্শ মেনে শিক্ষাব্যবস্থাকে এমনভাবে সাজায় এবং সেখানে অর্থ বরাদ্দ করে যাতে প্রকৃত শিক্ষার আলো ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে (যারা ভবিষ্যৎ নাগরিক) না প্রবেশ করে। ফলের স্বাধীনতা-উত্তরকালে লেখাপড়া জানা মানুষের সংখ্যা বাড়লেও সচেতন শিক্ষিত নাগরিকের সংখ্যা সমানুপাতিক হারে বাড়ে নি বরং ক্রমান্বয়ে কমে গেছে। বেড়ে গেছে ভক্তিতে ভরসা করার মানুষের সংখ্যা। সুতরাং অন্ধকারের দিকে হাঁটার জন্য যে ভক্ত বাহিনীর দরকার তার কোনো অভাব বর্তমান সময়ে নেই।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন