প্রসঙ্গ : বাবরি মসজিদ ও রামজন্ম ভূমির প্রকৃত উৎসমুখ : পর্ব - ২
এই বিতরকের মূল ভিত্তি তৈরি করেন ইংরেজ ঐতিহাসিক লিডেন। ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি বাবরের ফারসি ভাষায় লেখা আত্মজীবনী অনুবাদ করেন। নাম দেন 'মেমোয়ার্স অফ জহির উদ্দিন মোহাম্মদ বাবর, এম্পারার অফ হিন্দুস্থান'। এই গ্রন্থে তিনি লেখেন, 'মনে হয় বাবর পাঠানদের বিরুদ্ধে অভিযান করার সময় অযোধ্যার মধ্য দিয়ে গিয়েছিলেন'। মনে রাখতে হবে, এই মন্তব্যটি সম্পাদক এবং অনুবাদকের অনুমান এবং ধারণা মাত্র। কারণ, এর স্বপক্ষে তিনি কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ উপস্থিত করেননি, এমনকি স্বয়ং বাবরের মূল লেখার মধ্যেও এ কথার উল্লেখ নেই। এখানে আর একটি কথা মনে রাখতে হবে যে, বাবর এর মূল গ্রন্থটি তার মাতৃভাষা চাঘাতাই তুর্কি ভাষায় লেখা। অনুবাদেের সময় জন লিডেন এই মূল গ্রন্থের অনুসরণ করেননি। তিনি অনুসরণ করেছিলেন আকবরের উদ্যোগে আব্দুর রহিম মির্জা কর্তৃক ফারসি ভাষায় অনূদিত 'বাবরনামা'। এই দুটি মূল গ্রন্থের কোথাও বাবরের অযোধ্যায়় উপস্থিতি এবং মীর বাকি কর্তৃক বাবরি মসজিদ স্থাপনের কোন উল্লেখ নেই।মজার ব্যাপার হলো, জন লিডেন-এর এই অনুমান ভিত্তিক তথ্য পরবর্তীকালে সত্য বলে প্রচার করতে থাকেন ইংরেজ ঐতিহাসিকরা। পরবর্তীতে আরো বিকৃতভাবে প্রচার শুরু করলেন যে, হিন্দু-বিরোধী বাবর রাম মন্দির ধ্বংস করেছেন এবং সেই জায়গাতেই মসজিদ তৈরি করেছেন। (এখানে আরেকটা কথা আবার স্মরণ করিয়ে দিই, জন লিডেন কিন্তু তার অনুবাদ গ্রন্থে মন্দির ভাঙ্গার কোন কথাই উল্লেখ করেননি।) এভাবেই জন্ম নেয় রাম জন্মভূমি ও বাবরি মসজিদ বিতর্ক।
উপনিবেশিক শাসকদের এই বিতর্ক তৈরীর মূল উদ্দেশ্য ছিল অযোধ্যার নবাবের এলাকায় সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়িয়ে শাসনতান্ত্রিক বিশৃঙ্খলা তৈরি করা এবং সেই অজুহাতে অযোধ্যাকে তাদের প্রত্যক্ষ শাসনে নিয়ে আসা। লক্ষ্য করুন, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে একটু অন্যরকম ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে একটু অন্যরকম পটভূমি তৈরি করেছিলেন দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন এর মধ্য দিয়ে এবং শাসনতান্ত্রিক বিশৃঙ্খলার বা অচলাবস্থার দোহাই দিয়ে বাংলার শাসন ক্ষমতা লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস 1772 হস্তগত করে।
লিওপোল্ড ভন রাঙ্কে বলেছেন, যে ঘটনা যেভাবে ঘটেছে তার সঠিক বর্ণনার মাধ্যমে দেখানোই হল ইতিহাস। ঐতিহাসিক বিউরি বলেছেন, ইতিহাস হলো একটি বিজ্ঞান, এর কম নয়, বেশিও নয়। তাই আমাদের চারিদিকে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন ঐতিহাসিক উৎস ও তথ্যের সাহায্যে কোন একজন ঐতিহাসিক সুসংবদ্ধ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহার করেই কেবলমাত্র যথার্থ ইতিহাস রচনার করতে পারেন। ইতিহাস চর্চার এই রীতি বাবরি মসজিদ এবং রাম জন্মভূমি সম্পর্কিত যে ইতিহাস সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে প্রচারিত হচ্ছে সেখানে এই রীতি প্রয়োগ মেনে লেখা করা হয়নি। বিশেষ করে ইংরেজি ঐতিহাসিককরা এবং পরবর্তীকালে উগ্র জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিকরা মেনে চলেন নি। উপরের আলোচনার দিকে নজর দিলে একথা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
◾আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত ইতিহাস লিখন পদ্ধতি জানার জন্য এখানে ক্লিক করুন
আধুনিক ইতিহাস চর্চার এই রীতি এবং লিখন পদ্ধতি মেনে নিলে একথা না মেনে উপায় নেই যে মধ্যযুগের ভারতের ইসলাম ধর্মাবলম্বী শাসকদের অধিকাংশই ছিলেন নিষ্ঠাবান মুসলমান, উদারচেতা ও পরমতসহিষ্ণু। সেইসঙ্গে একথা মানতে হবে, রাজনৈতিক কারণে তারা কখনও কখনও মন্দির ভেঙেছেন। আমার উল্টো ঘটনা চোখে পড়বে। হিন্দু তীর্থ ক্ষেত্র হিসেবে অযোধ্যার যে বিকাশ সেটা ঘটেছিল মুসলমান নবাবদের সমর্থন পেয়েই। আধুনিক গবেষণা থেকে দেখা যাচ্ছে, অযোধ্যার নবাবী শাসন নির্ভর করত কায়স্থদের সহযোগিতার উপরে আর নবাবী সেনাবাহিনীর মেরুদন্ড ছিল শৈব নাগারা। স্বাভাবিক কারণেই অযোধ্যার নবাব সাবদার জাহাঙ্গীর দেওয়ান অযোধ্যায় বেশ কয়েকটি মন্দির মেরামত করতে সাহায্য করেছিলেন। শুধু তাই নয় অযোধ্যার হনুমান পর্বত মন্দির নির্মাণের জন্য জমি দান করেছিলেন আর মোদী মন্দির ঘুরতে সাহায্য করেছিলেন নবাব আসাফ উদ দৌলার দেওয়ান। এই ঐতিহ্য বজায় ছিল ১৮৫৫ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আগ পর্যন্ত। আসলে ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ দমন এবং অযোধ্যা অধিগ্রহণের বৈধতা প্রমাণ করতে ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসকরা হিন্দু মুসলমান সাম্প্রদায়িক সংহতি বিনষ্ট করতে তৎপর হোন।
সুতরাং বোঝাা যাচ্ছে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল দখল করার জন্য ইংরেজরা বিভিন্ন সময় ভিন্ন ভিন্ন ষড়যন্ত্রের জাল বুনে ছিলেন। অযোধ্যা দখলের ক্ষেত্রে তাদের এই ষড়যন্ত্রের নাম হল বাবরি মসজিদ ও রাম জন্মভূমি এবং মন্দির ভেঙে মসজিদ তৈরি করার পরিকল্পিত কল্পকাহিনি।
দেখুন তৃতীয় পর্ব এখানে
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন