প্রসঙ্গ : বাবরি মসজিদ ও রামজন্ম ভূমির প্রকৃত উৎসমুখ - পর্ব - ৩
উনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক দুর্নীতির অঙ্গ হিসেবে এই ইতিহাস বিরোধী কাজ শুরু হয়। এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্য ও আধুনিক যুগের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ডক্টর সুশীল শ্রীবাস্তবের পূর্ণাঙ্গ গবেষণা থেকে জানা যাচ্ছে, যে কিভাবে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ চাতুর্যের সঙ্গে বাবরি মসজিদ ও রাম জন্মভূমি বিতর্ককে তৈরি করে তাদের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থকে চরিতার্থ করার কাজে লাগিয়েছিলেন। এই কাজে লখনৌ শহরের তৎকালীন ব্রিটিশ রেসিডেন্ট কর্নেল স্লিম্যান (১৮৪৮-৫৪) এ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তার আমলেই বাবরি মসজিদ সংলগ্ন রসুইঘর-এর ( সীতার রান্নাঘর) জায়গায় রীতিমতো পুজো শুরু হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত ১৮৫৫) সালে হিন্দু সম্প্রদায় সমগ্র মসজিদ এলাকাটি দাবি করলে সংঘর্ষ বেধে যায়। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে লর্ড ডালহৌসি কুশাসনের অজুহাতে অযোধ্যা অধিগ্রহণ করে নেয়।১৮৫৬ সালের অন্যায় ভাবে অযোধ্যা দখল করে নেয়ার পরের বছর অর্থাৎ ১৮৫৭ সালে দেশজুড়ে শুরু হয়ে যায় মহাবিদ্রোহ। ব্রিটিশের গদি ভয়ংকরভাবে জ্বলে ওঠে। এর পরপরই শুরু হয়ে যায় ভয়ঙ্কর নগ্নভাবে ইতিহাস বিকৃতির চর্চা। ১৮৬০ সালের পর থেকে ব্রিটিশ সরকারি নথিপত্রে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস চর্চায় বাবরি মসজিদ এবং রাম জন্মভূমি বিতর্ক সংযুক্ত করে দেয়া হয়। শুধু তাই নয় মন্দির ভেঙে মসজিদ গড়ার কাহিনী সরকারি নথিপত্রে স্থান পেতে শুরু করে। ফৈজাবাদ জেলার তৎকালীন কমিশনার সেটেলমেন্ট অফিসার পি কার্নেগী ১৮৬১ সালে অযোধ্যার এক বিস্তারিত ইতিহাস লেখেন। লেখক নিজেই জানিয়েছেন এই ইতিহাস সর্বদা সাক্ষ্য প্রমাণের উপর নির্ভরশীল তো নয়ই, বহু স্থানে তার সিদ্ধান্তের ভিত্তি হলো স্থানীয় মানুষের মত ও বিশ্বাস। এই গ্রন্থে তিনি লিখেছেন যে অযোধ্যায় ' জন্মস্থানে অন্তত সুন্দর একটি মন্দির ছিল (Ayodhya 'must at least have possessed a fine temple in the Janmasthan')। এই গ্রন্থের অন্য এক জায়গায় লিখেছেন, ' এটা মনে হয় যে বাবর 1528 সালে অযোধ্যা পরিদর্শন করেন এবং তার নির্দেশেই এই প্রাচীন মন্দির টি ধ্বংস করা হয়' ('It seems that in 1582 Babar visited Ayodhya andunder his orders this ancient temple was destroyer's)।
অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে যে পি কার্নেগী 'মনে হওয়ার' ওপর ভিত্তি করে রাম জন্মভূমি তত্ত্বটি দাঁড়িয়ে আছে, যার স্বপক্ষে তিনি কোনো সমসাময়িক ঐতিহাসিক পাথরে প্রমাণ হাজির করেন নি।
মজার কথা হল, এরপর ১৮৭০ এবং ১৯০৫ সালের ফৈজাবাদ ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার সংকলনে মন্দির ভেঙে মসজিদ গড়ে ওঠার কথাটি পাকাপাকি জায়গা পেয়ে যায়। ব্রিটিশ শাসকদের সরকারি নথি বা প্রতিবেদনে রাম জন্মভূমি মন্দির ভেঙে অংশত ভেঙে মসজিদের কাহিনী ইতিহাস' রূপে স্বীকৃতি লাভ করে।
অধ্যাপক শ্রীবাস্তব দেখিয়েছেন ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারের ও রচনা ভিত্তি ছিল জনশ্রুতি। 1980 র দশকে এই বিষয়টিকে কেন্দ্র করে অনৈতিহাসিক এবং অবাস্তব বিতর্ক তৈরি করা হয়েছে এবং হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের সাধারণ সরল ধর্মভীরু এবং ইতিহাস বিমুখ জনগণকে জাগিয়ে তুলে উন্মাদনা তৈরি করা হয়েছিল তা ডক্টর শ্রীবাস্তব এক পাণ্ডিত্যপূর্ণ যুক্তিগ্রাহ্য তথ্যাশ্রয়ী প্রতিবেদনের মাধ্যমে তুলে ধরেছিলেন Probe India, January, 1988 সংখ্যায়।
ডক্টর শ্রীবাস্তব এর মতে, ফৈজাবাদ এলাকাটি বাবরের অধিকারের কয়েকশো বছর আগে থেকেই দিল্লি সুলতানদের অধিকারে ছিল। আর বাবর হিন্দুদের বিরুদ্ধে নয়, পাঠানদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে এই এলাকা দখল করেছিল। স্বাভাবিকভাবেই এই এলাকায় বাবর এর পক্ষে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষকে নিজের পক্ষে রাখা দরকার ছিল। তাই মন্দির ভেঙে মসজিদ গড়ার বিষয়টি যুক্তিতে টেকে না। এবং বাস্তবিকপক্ষে ওই স্থানে রামের-নাম যুক্ত কোন মন্দির আদেও ছিল তেমন কোনো প্রত্যক্ষ ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই। কোন হিন্দ শাস্ত্রেও এ ধরনের কোন মন্দিরের উল্লেখ নেই। এবং তা ভেঙে ফেলারও তেমন প্রমাণ সেখানে নেই।
১৮৫৪ সালে William Erskine লেখেন, A History of India under the two First Soverigns of the House of Timur, Babur and Humayun (London, Vols 2)। স্লিম্যান-এর পরবর্তী রেসিডেন্ট জেমস উঠরাম এই গ্রন্থ বিকৃত করতে শুরু করেন। পরিণতিতে জনগণের মধ্যে বিরোধ ক্রমে উগ্ররূপ গ্রহণ করে। ফলে ১৮৫৫ সালে অযোধ্যায় দাঙ্গা শুরু হয়ে যায়। এবং এই দাঙ্গার উদ্দেশ্য সম্পর্কে পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। আসলে অযোধ্যা ছিল বাংলা-বিহার রাজ্য ও মারাঠাদের রাজ্যের মধ্যে সেতুস্বরূপ। তাই এই রাজ্যটি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন