প্রসঙ্গ : বাবরি মসজিদ ও রামজন্ম ভূমির প্রকৃত উৎসমুখ : - পর্ব - ১
আগামী ২২ জানুয়ারি ২০২৪, অযোধ্যায় মন্দিরের উদ্বোধন। মন্দির উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। বিশেষ রাজৈতিক দলের সমর্থকরা উল্ল্যশিত হবেন, আবার কেউ মনোকষ্টে ভুগবেন। কিন্তু মন্দির না মসজিদ। এ নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। কারণ এ দুটোর কোনটারই ক্ষমতা নেই মানুষের মৌলিক চাহিদা মেটানোর। উল্টে, এই দুটো জিনিস মানুষের আত্মশক্তির প্রতি অবিশ্বাস তৈরি করে দেয়। ফলে মানুষের স্বাবলম্বী হবার পথে অন্তরায় তৈরি হয়। তবে ধর্মদর্শন-এর গুরুত্বের কথা অস্বীকার করা যায় না।কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, এই ধর্মদর্শনগুলি আবির্ভাবের পরপরই রাজনৈতিক ও ধর্ম ব্যবসায়ীদের অনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে তার কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে বর্তমানে ধর্ম অধর্মের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর সাম্প্রতিকতম দৃষ্টান্ত হলো বাবরি মসজিদ ও রাম জন্মভূমি বিতর্ক এবং তার পরিণতি।
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে বাবরি মসজিদের জায়গায় রাম মন্দির তৈরি করার অনুমতি পাওয়ার পরও বিতর্ক থামছে না। এই না থামাটাও রাজনীতির কারবারিদের কারসাজির জন্যেই ঘটে চলেছে। কেউ বলছেন, অন্যায় হয়েছে। আবার কেউ বলছেন, ন্যায় প্রতিষ্ঠা হয়েছে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে, যারা ন্যায় প্রতিষ্ঠার কথা বলছেন, তারাই। কারণ, তারা এই ন্যায় প্রতিষ্ঠার খবরটা প্রচার করার মধ্যদিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার চেষ্টা করছে এবং সেই চেষ্টা করতে গিয়েই নগ্নভাবে ইতিহাসের বিকৃতি ঘটানো হচ্ছে, যা না করলেও চলত।
আর এই কারণেই আমার এই আলোচনার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে বলে মনে করছি। কারণ এই বিকৃতির মাধ্যমে একটি বিশেষ রাজনৈতিক দল হিন্দু-মুসলিমের মধ্যে বিরোধ বাধানোর নতুন করে চেষ্টা শুরু করেছে। তাই এই বিকৃতি সম্পর্কে সচেতন না হলে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিশ্বাস ও সহবস্থান কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। ফলে ভারতীয় জাতিসত্তা কঠিন সংকটের মধ্যে পড়বে।
আসুন দেখে নেয়া যাক, এ বিষয়ে ইতিহাস কী বলছে।
ইতিহাসবিদ গৌতম নিয়োগী [1] বলছেন, ' রাম জন্মভূমি আর বাবরি মসজিদ দুটোই অনৈতিহাসিক। অন্তত ঐতিহাসিক প্রমাণসাপেক্ষ ঘটনা নয়'। কারণ,
১) 'রাম রামায়ণ মহাকাব্যের নায়ক । [2] এবং এখনো পর্যন্ত কেউ কোনো সাক্ষ্য প্রমাণ হাজির করেন নি যে, বাবরি মসজিদ যে ভূখণ্ডের নির্মিত, সেই জায়গায় আগে একটি মন্দির ছিল। তেমনি,
২) বাবরি মসজিদ যে বাবর তৈরি করেছিলেন কিংবা তার নির্দেশে তাঁর অনুগত অন্য কোন ব্যক্তি নির্মাণ করেছিলেন, সমসাময়িক দলিলে তার প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য নেই। তবে একটা মসজিদ যে ছিল সেটা ঐতিহাসিক।
শুধুমাত্র উভয় সম্প্রদায়ের বিশ্বাস অনুযায়ী, দুটোই পাশাপাশি ছিল। এবং অধিকাংশ সময়ই সম্প্রীতি বজায় রেখেই দুই সম্প্রদায়ের মানুষ উপাসনা করতেন। বাবরি মসজিদে মুসলমানরা আর তার পাশে একটি উঁচু বেদী বা মঞ্চের উপর হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ উপাসনা করতেন। এই বেদীর মাপ ছিল 17 ফুট × 21 ফুট। মাঝে ছিল একটি বেড়া যার দূরত্ব 100 গজ। উভয় সম্প্রদায়ের এই সহাবস্থানের এবং সম্প্রীতির প্রমাণ পাওয়া যায় নিকটবর্তী হনুমান মন্দিরের পান্ডাদের পুরনো নথিপত্র থেকে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, নবাবদের বহু পদস্থ মুসলমান কর্মচারী হিন্দু পূজারীদের উপহার দিচ্ছেন।
কিন্তু সমস্যা তৈরি হয় অযোধ্যার নবাব ওয়াজেদ আলী শাহের আমল থেকে। ওয়াজিদ আলি শাহ অযোধ্যার নবাব হলেও নবাবের শাসনকে নিয়ন্ত্রণ করত ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসকরাই। মনে রাখতে হবে, 1764 সালে বক্সারের যুদ্ধের পরাজয়ের ফলে বাংলার নবাব মীর কাসিম, অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌলা এবং দিল্লীর মুঘল বাদশা কোম্পানির দয়ার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। এবং নবাব ওয়াজেদ আলী শাহ এর সময় ইংরেজ শাসকরা অযোধ্যার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেয়ার জন্য ষড়যন্ত্র শুরু করে। এই ষড়যন্ত্রের অস্ত্র হিসেবে তারা হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে বিদ্বেষের বীজ বপন করাটাকে উপযুক্ত ও কার্যকরী অস্ত্র বলে সিদ্ধান্ত করে। আর এই কারণেই 1855 সালে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে দাঙ্গা বাঁধে।
তাহলে প্রশ্ন ওঠে, রাম জন্মভূমি ও বাবরি মসজিদ বিতর্কের মূল ভিত্তি কী?
দেখুন দ্বিতীয় পর্ব এখানে ক্লিক করুন
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন