ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে প্রতিযোগিতা হল অসম প্রতিযোগিতা
Joyanta Roy Chowdhury তোমার কথা আমি বুঝেছি। তোমার কথাগুলো সত্যি। কিন্তু তা ত্রুটিমুক্ত নয়। তোমার দেখাটা অনেকটাই ওপরে ওপরে দেখা হয়েছে।
১) দুধ আর দুগ্ধজাত দ্রব্যের দাম কি এক হয়? মদ নেশার জিনিস। স্যানিটাইজার স্বাস্থ্য সুরক্ষার জিনিস। এই দুটো জিনিসের উপরেই জিএসটি অর্থাৎ সরকারের ট্যাক্স কেন একরকম হবে?
করোনার আগে না পরে এটা কোন বিষয় নয়। এটা তোমাকে আগে বুঝতে হবে। বাই ডিফল্ট কে করেছে? সরকার করেছে। আমার প্রশ্ন কেন করেছে?
দুগ্ধজাত দ্রব্যে যত ট্যাক্স বসানো যায়, দুধে তা বসানো যায় না। কেন যায় না, সেটা যদি তুমি বুঝতে পারো, তাহলে নিশ্চয়ই আমার বক্তব্যটাও তুমি বুঝতে পারবে।
সমাজে যদি সম্পদের সুষম বন্টন হয়, তাহলে সমাজে ধনী-দরিদ্র্যের সৃষ্টি হয় না। অর্থনীতির এই সূত্র যারা না বুঝবে তারা আমার কথার মানে বুঝতে পারবে না। ভারতের যা সম্পদ আছে, আমি প্রাকৃতিক সম্পদের কথা বলছি, তার যদি সুষম বন্টন হয় তাহলে এই ভয়ঙ্কর দারিদ্রতা আসতে পারে না। এই দারিদ্রতা না থাকলে সোনা কিনতে কারোরই নাভিশ্বাস হওয়ার কথা নয়।
সম্ভবত 1995 সালে বর্তমান পত্রিকার এক রবিবারের পাতায় নৌবাহিনীর এক সদ্য অবসর নেয়া অফিসার লিখেছিলেন একপাতা নিবন্ধ। সেখানে এক জায়গায় তিনি লিখেছিলেন, সোভিয়েত ইউনিয়নে কোথাও যৌনপল্লী পাওয়া যেত না, সমস্ত মেয়েরা চাকরি করতো। রাস্তায় কোন সোনার নেকলেস পড়ে থাকলে তাকেও ছুয়ে দেখতো না কেউ। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার 4-5 বছরের মধ্যে চাকরি হারিয়ে মেয়েরা দেহ ব্যবসায় নামতে বাধ্য হয়েছিল। নৌবাহিনী চাকরির সূত্রে তিনি দীর্ঘ সময় রাশিয়ার উত্তরে অবস্থিত উত্তর সাগরের বিভিন্ন সমুদ্রবন্দরে যাতায়াতের সূত্রে তার এই অভিজ্ঞতার কথা তিনি জানিয়েছিলেন।
কেন জানো এমন ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নে? কারণ সেখানে সম্পদের সুষম বণ্টনের ব্যবস্থা ছিল। তাই গরিব শব্দটা তাদের অভিধানের ছিল না।
২) আর প্রতিযোগিতার কথা বলছ? প্রতিযোগিতা তো অবশ্যই দরকার। প্রতিযোগিতা ছাড়া অগ্রগতি হয় না। একথা খুবই সত্য। 100% সত্য। এটা তুমি জানো। কিন্তু যেটা জানো না, সেটা হল যে, এই প্রতিযোগিতা সুস্থ প্রতিযোগিতা হওয়া দরকার। অসম প্রতিযোগিতায় অসাম্য তৈরি হয়। তুমি আমি গরীব অবস্থা থেকে আজকে যে জায়গায় পৌঁছেছি, সেটা কিন্তু আমাদের মেধাগত সামর্থের নিরিখে খুবই কম। কারণ অর্থের অভাবে আমরা আমাদের মেধার যথাযথ ব্যবহার করতে পারিনি। তাই সামান্য স্কুল শিক্ষক হিসেবে নিজেকে আটকে রাখতে হয়েছে।
৩) একজন গরীব মানুষের সন্তান একজন বড়লোক ঘরের সন্তানের সঙ্গে কীভাবে প্রতিযোগিতা করবে? হয় কখনো তা? দুজনার আর্থিক সামর্থের মধ্যে আসমান-জমিন ডিফারেন্স। এদের মধ্যে যে প্রতিযোগিতা হয় তা অসম প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতায় 99 শতাংশ গরিবের সন্তান ব্যর্থ হয়। এবং ফ্রাস্টেশন এ কেউ মাতাল হয়, কেউ লম্পট হয়, কেউ অসহ্য জীবন যন্ত্রণা সহ্য করে ঈশ্বরের ঘাড়ে সমস্ত দায় চাপিয়ে নিজেকে সান্ত্বনা দেয়। তুলনায় অনেক অনেক বেশি সংখ্যক অর্থবান মানুষের সন্তান তার মেধাকে কাজে লাগিয়ে সমাজের সম্পদ নিজের করায়ত্ত করে নেয়। এতে সমাজের ছোট্ট একটা অংশের উন্নতি হয়। সমগ্র অংশের হয়না। আর হয় না বলেই আমাদের দেশ আজও পিছিয়ে রয়েছে।
গরিবি ছাড়া প্রতিযোগিতা হয় না এই ভাবনাটা অতি সাধারন ভাবনা। এবং সেই ভাবনায় রয়েছে মস্ত বড় ফাঁক, যা সাধারণ চোখে ধরা পড়ে না। কেউ গরিব না থাকলে, তুমি কি মনে করো যে আর প্রতিযোগিতা থাকবে না? যদি মনে করো তাহলে যেন তুমি একটা প্রচন্ড ভুল ধারণা বয়ে বেড়াচ্ছে। খেয়াল করে দেখো তো, আম্বানির সঙ্গে টাটা কোম্পানির প্রতিযোগিতা আছে, না নেই? আছে। এবং গভীরভাবে আছে। একজন ধনিকের ছেলের সঙ্গে আর একজন ধনীদের ছেলের প্রতিযোগিতা হয় না? হয়। দারুন ভাবে হয়। এই প্রতিযোগিতার সুষমা প্রতিযোগিতা। প্রতিযোগিতা সম্মানের সঙ্গে সমান হয়। একজন যুবকের সঙ্গে একটা বাচ্চা শিশুর প্রতিযোগিতাকে সত্তিকারের প্রতিযোগিতা বলেনা। সুতরাং প্রতিযোগিতার জন্য গরিব থাকা দরকার এই সিদ্ধান্ত খুবই অযৌক্তিক।
৪) গরীবেরই শুধু মদ খাওয়া দেখলে? গরিব মানুষ যত মদ খায়, তার থেকে অনেক অনেক বেশি টাকার মদ খায় ধনী লোকেরা। তাদের খাওয়া যদি দোষের না হয়, গরিবের খাওয়ার মধ্যে দোষ কেন দেখো? খাওয়াটা তো মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। কেউ খায়, কেউ নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে। এ কাজের সঙ্গে ধনী-দরিদ্র্যের তুলনা চলে না। প্রচুর গরীব মানুষ আছে, তারা মদ খায় না। ব্যাখ্যা করো তো তাদের কেন অবস্থার উন্নতি হয় না? সেখানে মদ খাওয়ার ভূমিকা কতটা আছে?
আসলে এগুলো খুব সস্তা যুক্তি। আমাদের এখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আরও সচেতন হতে হবে।
৫) তবে তোমার এই মতের সঙ্গে আমি একমত, যে এই অবস্থা থেকে মানুষকেই বেড়িয়ে আসার চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে তা করতে গেলে যে চেতনার দরকার হয়, আর সেই চেতনা অর্জন করতে গেলে যে পড়াশোনা দরকার হয়, তা সরকার না চাইলে কোনদিন কোন গরিব মানুষ অর্জন করতে পারবে না।
এবার বল, একটার পর একটা শিক্ষাব্যবস্থাকে বেসরকারিকরণ করে দিয়ে, শিক্ষাখাতে বরাদ্দ কমিয়ে দিয়ে, সরকার কি সেই শিক্ষা জনগণের মধ্যে প্রসার করার চেষ্টা করছেন, না আটকানোর চেষ্টা করছে? তুমি কী ভাবছো জানিনা, আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি সরকার আটকানোর চেষ্টা করছে। কারণ দেশের বড় দলগুলি নির্বাচন ধনীদের টাকায়। আর দেশটা পরিচালনা করে ধনীদের সুবিধে করার জন্যই। তাই গরিব গরিব থাকবে, বড়লোক আরও বড়লোক। গরীব মানুষ ধনিকের বাড়িতে কাজের লোক হয়ে জীবন কাটাবে, তাদের সম্পদ পাহারা দেবে - এই হচ্ছে পরিকল্পনা।
ভেবে দেখো, একটা দেশের সরকার এবং তার পরিচালক রাজনৈতিক দল যদি না চায় তবে কোনোভাবেই কোন সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। রাজনৈতিক দলগুলো এবং তাদের তৈরি সরকার যদি আমাদের দেশের সম্পদের সুষম বণ্টনের ব্যবস্থা না করে, তবে দেশ থেকে দারিদ্রতা দূর হতে পারে না। আর তার মানে কিন্তু এই নয় যে, সরকার তাদের বসে বসে খাওয়াবে।
যাই হোক ভালো থেকো। ধানে থাকো
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন