বলা হয়, সাহিত্য সমাজের দর্পণ। আর এই দর্পণের নাম যদি হয় উপন্যাস, তবে তার কারিগর হচ্ছেন একজন কথাকার। কারিগরের কেরামতির উপর যেমন সৃষ্টির গুণমান অনেকটাই নির্ভরশীল, তেমনই কথাকারের কলমের জাদুতে ফুটে ওঠে সমাজের প্রাঞ্জল প্রতিচ্ছবি। আর একজন লেখকের সৃষ্টির গুনমান বিচারের ক্ষেত্রে তাঁর সামাজিক অবস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অন্নদাশঙ্কর রায় বলেছিলেন, লেখক যদি জনগণের ভাষায় লিখতে চান তবে তাঁকে বনবাস করার মতো জনবাস করতে হবে। অর্থাৎ চাষিদের সঙ্গে চাষি, মাঝিদের সঙ্গে মাঝি, জেলেদের সঙ্গে জেলে... মেথরের সঙ্গে মেথর ইত্যাদি হতে হবে। উত্তর আধুনিককালের মরমী লেখক মুর্শিদ এ এম এক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা ভোগ করেছেন, কেননা, এ ধরণের কৃচ্ছসাধন তাঁকে আলাদাভাবে করতে হয় নি। কারণ তিনি নিজে আজন্ম বেড়ে উঠেছেন দারিদ্র-লাঞ্ছিত অনগ্রসর রুগ্ন সমাজের ভেতরে থেকে। এধরনের জীবনকে তিনি দেখেছেন একেবারেই কাছ থেকে, চেনেন নিজের হাতের তালুর মত। তাই তাঁর লেখায় মেলে তাঁর কাহিনির কুশীলবদের নিখাত কণ্ঠস্বর, আর প্রাঞ্জল উচ্চারণ।
‘জলজমিনের পদাতিক’ আর্থিক ও শিক্ষার দিক থেকে পিছিয়ে পড়া সমাজের বেড়ে ওঠার উপাখ্যান। কাহিনির নায়ক আসাদ সচ্ছল পরিবারের ছেলে হয়েও যেন আজন্ম পরবাসি। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার দগদগে ঘা সঙ্গে করে সেই ছোট্টবেলা উঠেছে নানার বাড়ি, যেন ‘কুটুম’হয়ে, যা কোনদিন নিজের বাড়ি হয়ে ওঠে নি। শহরতলীর সচ্ছল ও অপেক্ষাকৃত শিক্ষার আলোয় আলোকিত পরিবারের সন্তান হয়েও তাকে কাশবেড়ের মত জলাভূমি অধ্যুষিত অজপাড়াগাঁয়ে থেকে যেতে হয়েছে দাঙ্গার কারণেই। তখন থেকেই শুরু হয়েছে তার টিকে থাকার আর বেড়ে ওঠার অসম লড়াই, জল আর জমিনের পদাতিকবেশে। নানির অপত্যস্নেহের কাছে নাতির আদর, আবদার কিম্বা দাবির অকাল মৃত্যু হতে দেখেছে ডাক্তার মামার সপ্তাহান্তে ফেরার অপেক্ষায় তুলে রাখা, অবশেষে নষ্ট হওয়া, লোভনীয় খাদ্য খেয়ে, যা নষ্ট হওয়ার আগেই তার প্রাপ্য ছিল বলে সে মনে মনে ভেবেছে।
পাঠক এই উপন্যাস পাঠে পাবেন ‘এক ঢিলে দুই পাখি মারা’র আনন্দ। একদিকে সাম্প্রদায়িক হানাহানি সংখ্যালঘু মানুষের মনস্তত্ত্বের উপর যে ভয়ঙ্কর চাপ তৈরি করে তা অবলোকন করা। আসাদের বাবা রাকিব যখন বন্ধুস্থানীয় ভিনধর্মি পরেশের সদর দরজায় ঘনঘন টোকা শুনে তোশকের তলা থেকে ছোট্ট ছোরাটা বের করতে গিয়ে অনুশোচনায় কাতর হয়ে পড়ে তখন এই চাপই স্পষ্ট হয়ে ওঠে, যা মূল ধারার লেখকদের কলমে অনুল্লিখিত থেকেছে দশকের পর দশক। অন্যদিকে রয়েছে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে যে আর্থসামাজিক পরিবেশ তৈরি হয়েছে, তার অংশিদার হিসাবে পিছিয়ে-পড়া, শিক্ষার আলোকবর্জিত ভূমি ও জলাভূমি-নির্ভর শ্রমজীবি সংখ্যালঘু সমাজের চালচিত্র। লেখকের দরদি হাতের ছোঁয়ায় অঙ্কিত হয়েছে এর একটার পর একটা সংবেদনশীল চিত্রকল্প।
গ্রামের ঘোর অন্ধকারের মধ্যে যখন কোনো একজন আলোর মশাল হয়ে প্রবেশ করে, লেখাপড়া না-জানা মানুষদের মনে জেগে ওঠে অনেক প্রত্যাশা। সে-প্রত্যাশা পূরণ না হলে শিক্ষিত মানুষের প্রতি বেড়ে ওঠে গোপন অভিমান। লেখক তাঁর কলমতুলির সূক্ষ্ণটানে এঁকেছেন সেই মরমি ছবি, ‘যতই তারা চোর বদমায়েশ মদখোর ফকিরের জাত হোক – পড়শি তো। ......সে যেদি ওই ছাইপাঁশ গিলে পোঁদ উলটে পড়ে থাকে আর বউরে, ভাদ্দরবউরে মাগি খানকি এইসব করে তবে করবিটা কী? ......তোদের কি উচিত ছেলো না ওই গাজি পাড়ার লোকগুলোরে এট্টু আদটু ভদ্দরলোক হবার জন্যি মেন্নত করা। না-হয় নাই পারলি ওসব। ডাক্তার হয়ে তো চিকিচ্ছে করলেও তোদের মান্যি করত’- ডাক্তার ছেলে সম্পর্কে মা পরিজানের এ মন্তব্য এবং প্রতিবেশি গোলাপির টিপ্পনিতে এই অভিমানই ফেটে পড়েছে।
গ্রাম-বাংলার মুসলমান সমাজের ভাষা ব্যবহারের একটা নিজস্ব ঘরানা আছে। বাংলা, আরবি ও উর্দু ভাষা, এবং ইসলাম ধর্ম ও সংস্কৃতির মিশেলে জন্ম নিয়েছে এই নতুন ঘরানা। আধুনিক শিক্ষাবর্জিত এই জনগোষ্ঠী সযত্নে লালন করে আসছে তাদের এই নিজস্ব ভাষা ব্যবহারের রীতি। লেখকের নজর এড়িয়ে যায় নি ভাষা ব্যবহারের এই নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। পরিজান, নেবুজান, কিম্বা গোলাপিদের কথোপকথনে স্পষ্ট করে তুলেছেন এই ঘরানাকে। ফলে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তাদের জীবনযন্ত্রণা।
আসাদের সমবয়সি প্রতিবেশি কিশোরী ফারহানার পরিবারের পরিচয় দিতে লেখক ব্যাবহার করেছেন ‘চুন্নির জাত’ শব্দবন্ধ, যার অর্থ যারা চুরি করে সংসার চালায়। আসাদ তাই ঘৃণা করে ওই পরিবারের সদস্যদের। ফারহানার ভাই অবশ্য ব্যাখ্যা করে, ‘চুরি নাকি? হেস! অত্ত রয়েছে, তাত্থেনে খানটা নিলি কী হয়? খাবার তারে তো নেই, মোরা কি বেচি!’ দারিদ্র-লাঞ্ছিত শিক্ষাদীক্ষাহীন প্রান্তিক মানুষদের এই ভাবনা জন্ম দিয়েছে এক সহজ-সরল গ্রামীণ জীবন দর্শনের। এধরনের দর্শনের উজ্জ্বল উপস্থিতি রয়েছে কাহিনির পরতে পরতে। দাঙ্গায় হারিয়ে যাওয়া সন্তান ভোলার শোকে কাতর আসাদের দাদিকে সান্তনা দেওয়ার জন্য তার জা নিজের ‘আণ্ডা দেওয়া ডেগি হাঁসটা’র দাঙ্গায় হারিয়ে যাওয়ার তুলনা করে ফেলে – এখানেও সেই গ্রামীণ সরলতা। তবে এর যে উল্টোপীঠও আছে, লেখকের চোখ এড়ায়নি তাও।
প্রকৃতির অকৃপণ অনাবিল ধুলোকাদায় লালিত হয়েছে লেখকের কৈশোর। আর সেকারণেই প্রকৃতির সঙ্গে মানবমনের গভীর সম্পর্কের অনুসঙ্গ এনে অনিন্দ্যসুন্দর চিত্রকল্প এঁকেছেন অবলীলায়। অসাধারণ উপমা ব্যবহার করে ফুটিয়ে তুলেছেন গ্রামীণ পরিবেশের প্রতিচ্ছবি ও সেখানকার মানুষের মনস্তত্ব। শিক্ষার আলো না-পড়া গ্রামের মহিলাদের মনস্তত্বের ফাঁকফোকর টেনে বের করেছেন নিপুণ হাতে, এঁকেছেন আসাদের বেড়ে ওঠার ধারাবাহিক স্থিরচিত্র, যেখানে ধরা পড়েছে তার কৈশোরের অনুসন্ধিৎসু অথচ উদ্ভট কল্পনার নিবিড় বিচরণ, কৈশোরের কৌতূহল, আর যৌবনের জান্তব চাহিদা ও চাঞ্চল্য এবং নৈতিকতার ঢাল দিয়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা।
কাহিনির এই পর্বের শেষে নায়ক আসাদ এক গভীর ষড়যন্ত্রের শিকার। এর পিছনে কি গ্রামের ওই সহজ-সরল জীবন দর্শন, না কি তাকে কাজে লাগিয়ে আখের গোছাতে চাওয়া কোন ছলনাময়ী নারী। সে কি পারবে লোভ, পাপ, দারিদ্র, অভাব আর অশিক্ষার আবর্তে ঘেটে যাওয়া সম্পর্কের জটিল টানাপোড়েন কাটিয়ে মায়ের আশা পুরণ করতে, একজন প্রকৃত মানুষের মত মানুষ হতে? এ প্রশ্ন একজন বিচক্ষণ, সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ কথাকারের মত তুলে ধরেছেন কাহিনি বিন্যাসের বিভিন্ন পর্বে। তাই পাঠককে পড়তেই হবে, আর পড়তে পড়তে ভাবতেই হবে। ভাবতে হবে, আসাদের জীবন-যন্ত্রণা কি শুধু তার ব্যক্তিগত, না সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর এক অতি সাধারণ যন্ত্রনা যা উপশমের উপায় খুঁজতে গিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে অসংখ্য আসাদ।
বাবা-মা থাকতেও দাঙ্গা তাকে অনাথ করেছে, অথচ প্রায় আজন্ম কাশবেড়ে থেকেও সেখানকার মানুষজনের আপন হতে পারে নি সে। পারেনি ফারহানার মত মেয়ের প্রগাড় প্রেমকে গ্রহণ করতে, যে নাকি একমাত্র মানুষ যে ‘তার মনের কথা বোঝে’- এ কথা জেনেও, শুধু সে ‘চুন্নির জাত’এর মেয়ে বলে। একাকিত্ব কাটাতে শামসাদকে ধরে যখন একটা নিজস্ব জগত গড়ে তোলার চেষ্টা করছে, সেসময়ও বিষয়-সম্পত্তিকে কেন্দ্র করে দুই পরিবারের পারিবারিক কোন্দল এবং মামিমা নয়নার চক্রান্ত সেই স্বপ্নসৌধটিকে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। নিজের মায়ের পঙ্গু এবং বোবা বোনকে ‘নষ্ট’ করার কুৎসিত অপবাদ মাথায় নিয়ে যখন নিজের বাপ-মায়ের কাছে ফিরতে চাইছে, তখন তার অসহায় উপলব্ধি, ‘এ কি তার ঘর হারানো, না ঘরে ফেরা!’ আসলে একদিকে নিষ্ঠুর ষড়যন্ত্র অন্যদিকে সবাই থেকেও কাউকে পাশে না পাওয়ার ভয় তার জীবনি শক্তিকে যেন কুরে কুরে খাচ্ছে ক্ষয়রোগের মত। একটু একটু করে হারিয়ে যাচ্ছে আসাদ। সে কি পারবে একজন রণনিপুণ কৌশুলী পিছুহঠা সেনানায়কের মত ঘুরে দাড়াতে - এপ্রশ্ন নিয়ে যখন পৌছবেন কাহিনির শেষ পাতায়, তখনই অস্থির হয়ে উঠবে পাঠকমন এর পরের পর্বে চোখ রাখার জন্য।
সবশেষে বলি, লেখকের গল্প বলার ভঙ্গিটা বেশ অভিনব। অনুমান করার ভাবনা প্রকাশ করতে বাক্যের শেষে মাঝে মাঝেই ‘হবে’ ক্রিয়াপদের ব্যবহারের বোধহয় দ্বিতীয় উদাহরণ নেই। তবে, শব্দ চয়নের ক্ষেত্রে একটা ছোট্ট অসংগতি নজরে পড়েছে। ধান কেটে নেওয়ার পর যে অংশ পড়ে থাকে তাকে নাড়া বলে। আর নাড়া কেটে নেওয়ার পর যে অংশ পড়ে থাকে তাকে নাড়ার-গোড়া বলে, যার খোচায় পা কেটে রক্ত বেরোনোটা গ্রাম-বাংলার পাঠকমন কতটা মেনে নেবে এ প্রশ্ন থেকেই যায়। লেখক ‘গোড়া’ শব্দ না ব্যবহার করে ‘গোঁজা’ শব্দ ব্যবহার করেছেন, যা আসলে পাট কেটে নেওয়ার পর মাটির সঙ্গে গেঁথে থাকা শুচালো অংশকে বোঝাতে ব্যবহার করা হয়। আর তার খোঁচায় পা কেটে রক্তপাত হওয়া একটা স্বাভাবিক সম্ভাবনার বার্তাবাহক।
জল-জমিনের পদাতিক
কথাকার: মুর্শিদ এ এম
প্রকাশক: মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ
১০, শ্যামাচরণ দে স্ট্রিট, কলকাতা – ৭৩
দামঃ ১০০টাকা
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন