সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

জল-জমিনের পদাতিক: একটি দারিদ্র-লাঞ্ছিত রুগ্ন সমাজের বেড়ে ওঠার উপাখ্যান

বলা হয়, সাহিত্য সমাজের দর্পণ। আর এই দর্পণের নাম যদি হয় উপন্যাস, তবে তার কারিগর হচ্ছেন একজন কথাকার। কারিগরের কেরামতির উপর যেমন সৃষ্টির গুণমান অনেকটাই নির্ভরশীল, তেমনই কথাকারের কলমের জাদুতে ফুটে ওঠে সমাজের প্রাঞ্জল প্রতিচ্ছবি। আর একজন লেখকের সৃষ্টির গুনমান বিচারের ক্ষেত্রে তাঁর সামাজিক অবস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অন্নদাশঙ্কর রায় বলেছিলেন, লেখক যদি জনগণের ভাষায় লিখতে চান তবে তাঁকে বনবাস করার মতো জনবাস করতে হবে। অর্থাৎ চাষিদের সঙ্গে চাষি, মাঝিদের সঙ্গে মাঝি, জেলেদের সঙ্গে জেলে... মেথরের সঙ্গে মেথর ইত্যাদি হতে হবে। উত্তর আধুনিককালের মরমী লেখক মুর্শিদ এ এম এক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা ভোগ করেছেন, কেননা, এ ধরণের কৃচ্ছসাধন তাঁকে আলাদাভাবে করতে হয় নি। কারণ তিনি নিজে আজন্ম বেড়ে উঠেছেন দারিদ্র-লাঞ্ছিত অনগ্রসর রুগ্ন সমাজের ভেতরে থেকে। এধরনের জীবনকে তিনি দেখেছেন একেবারেই কাছ থেকে, চেনেন নিজের হাতের তালুর মত। তাই তাঁর লেখায় মেলে তাঁর কাহিনির কুশীলবদের নিখাত কণ্ঠস্বর, আর প্রাঞ্জল উচ্চারণ।

‘জলজমিনের পদাতিক’ আর্থিক ও শিক্ষার দিক থেকে পিছিয়ে পড়া সমাজের বেড়ে ওঠার উপাখ্যান। কাহিনির নায়ক আসাদ সচ্ছল পরিবারের ছেলে হয়েও যেন আজন্ম পরবাসি। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার দগদগে ঘা সঙ্গে করে সেই ছোট্টবেলা উঠেছে নানার বাড়ি, যেন ‘কুটুম’হয়ে, যা কোনদিন নিজের বাড়ি হয়ে ওঠে নি। শহরতলীর সচ্ছল ও অপেক্ষাকৃত শিক্ষার আলোয় আলোকিত পরিবারের সন্তান হয়েও তাকে কাশবেড়ের মত জলাভূমি অধ্যুষিত অজপাড়াগাঁয়ে থেকে যেতে হয়েছে দাঙ্গার কারণেই। তখন থেকেই শুরু হয়েছে তার টিকে থাকার আর বেড়ে ওঠার অসম লড়াই, জল আর জমিনের পদাতিকবেশে। নানির অপত্যস্নেহের কাছে নাতির আদর, আবদার কিম্বা দাবির অকাল মৃত্যু হতে দেখেছে ডাক্তার মামার সপ্তাহান্তে ফেরার অপেক্ষায় তুলে রাখা, অবশেষে নষ্ট হওয়া, লোভনীয় খাদ্য খেয়ে, যা নষ্ট হওয়ার আগেই তার প্রাপ্য ছিল বলে সে মনে মনে ভেবেছে।

পাঠক এই উপন্যাস পাঠে পাবেন ‘এক ঢিলে দুই পাখি মারা’র আনন্দ। একদিকে সাম্প্রদায়িক হানাহানি সংখ্যালঘু মানুষের মনস্তত্ত্বের উপর যে ভয়ঙ্কর চাপ তৈরি করে তা অবলোকন করা। আসাদের বাবা রাকিব যখন বন্ধুস্থানীয় ভিনধর্মি পরেশের সদর দরজায় ঘনঘন টোকা শুনে তোশকের তলা থেকে ছোট্ট ছোরাটা বের করতে গিয়ে অনুশোচনায় কাতর হয়ে পড়ে তখন এই চাপই স্পষ্ট হয়ে ওঠে, যা মূল ধারার লেখকদের কলমে অনুল্লিখিত থেকেছে দশকের পর দশক। অন্যদিকে রয়েছে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে যে আর্থসামাজিক পরিবেশ তৈরি হয়েছে, তার অংশিদার হিসাবে পিছিয়ে-পড়া, শিক্ষার আলোকবর্জিত ভূমি ও জলাভূমি-নির্ভর শ্রমজীবি সংখ্যালঘু সমাজের চালচিত্র। লেখকের দরদি হাতের ছোঁয়ায় অঙ্কিত হয়েছে এর একটার পর একটা সংবেদনশীল চিত্রকল্প।

গ্রামের ঘোর অন্ধকারের মধ্যে যখন কোনো একজন আলোর মশাল হয়ে প্রবেশ করে, লেখাপড়া না-জানা মানুষদের মনে জেগে ওঠে অনেক প্রত্যাশা। সে-প্রত্যাশা পূরণ না হলে শিক্ষিত মানুষের প্রতি বেড়ে ওঠে গোপন অভিমান। লেখক তাঁর কলমতুলির সূক্ষ্ণটানে এঁকেছেন সেই মরমি ছবি, ‘যতই তারা চোর বদমায়েশ মদখোর ফকিরের জাত হোক – পড়শি তো। ......সে যেদি ওই ছাইপাঁশ গিলে পোঁদ উলটে পড়ে থাকে আর বউরে, ভাদ্দরবউরে মাগি খানকি এইসব করে তবে করবিটা কী? ......তোদের কি উচিত ছেলো না ওই গাজি পাড়ার লোকগুলোরে এট্টু আদটু ভদ্দরলোক হবার জন্যি মেন্নত করা। না-হয় নাই পারলি ওসব। ডাক্তার হয়ে তো চিকিচ্ছে করলেও তোদের মান্যি করত’- ডাক্তার ছেলে সম্পর্কে মা পরিজানের এ মন্তব্য এবং প্রতিবেশি গোলাপির টিপ্পনিতে এই অভিমানই ফেটে পড়েছে।

গ্রাম-বাংলার মুসলমান সমাজের ভাষা ব্যবহারের একটা নিজস্ব ঘরানা আছে। বাংলা, আরবি ও উর্দু ভাষা, এবং ইসলাম ধর্ম ও সংস্কৃতির মিশেলে জন্ম নিয়েছে এই নতুন ঘরানা। আধুনিক শিক্ষাবর্জিত এই জনগোষ্ঠী সযত্নে লালন করে আসছে তাদের এই নিজস্ব ভাষা ব্যবহারের রীতি। লেখকের নজর এড়িয়ে যায় নি ভাষা ব্যবহারের এই নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। পরিজান, নেবুজান, কিম্বা গোলাপিদের কথোপকথনে স্পষ্ট করে তুলেছেন এই ঘরানাকে। ফলে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তাদের জীবনযন্ত্রণা।

আসাদের সমবয়সি প্রতিবেশি কিশোরী ফারহানার পরিবারের পরিচয় দিতে লেখক ব্যাবহার করেছেন ‘চুন্নির জাত’ শব্দবন্ধ, যার অর্থ যারা চুরি করে সংসার চালায়। আসাদ তাই ঘৃণা করে ওই পরিবারের সদস্যদের। ফারহানার ভাই অবশ্য ব্যাখ্যা করে, ‘চুরি নাকি? হেস! অত্ত রয়েছে, তাত্থেনে খানটা নিলি কী হয়? খাবার তারে তো নেই, মোরা কি বেচি!’ দারিদ্র-লাঞ্ছিত শিক্ষাদীক্ষাহীন প্রান্তিক মানুষদের এই ভাবনা জন্ম দিয়েছে এক সহজ-সরল গ্রামীণ জীবন দর্শনের। এধরনের দর্শনের উজ্জ্বল উপস্থিতি রয়েছে কাহিনির পরতে পরতে। দাঙ্গায় হারিয়ে যাওয়া সন্তান ভোলার শোকে কাতর আসাদের দাদিকে সান্তনা দেওয়ার জন্য তার জা নিজের ‘আণ্ডা দেওয়া ডেগি হাঁসটা’র দাঙ্গায় হারিয়ে যাওয়ার তুলনা করে ফেলে – এখানেও সেই গ্রামীণ সরলতা। তবে এর যে উল্টোপীঠও আছে, লেখকের চোখ এড়ায়নি তাও।

প্রকৃতির অকৃপণ অনাবিল ধুলোকাদায় লালিত হয়েছে লেখকের কৈশোর। আর সেকারণেই প্রকৃতির সঙ্গে মানবমনের গভীর সম্পর্কের অনুসঙ্গ এনে অনিন্দ্যসুন্দর চিত্রকল্প এঁকেছেন অবলীলায়। অসাধারণ উপমা ব্যবহার করে ফুটিয়ে তুলেছেন গ্রামীণ পরিবেশের প্রতিচ্ছবি ও সেখানকার মানুষের মনস্তত্ব। শিক্ষার আলো না-পড়া গ্রামের মহিলাদের মনস্তত্বের ফাঁকফোকর টেনে বের করেছেন নিপুণ হাতে, এঁকেছেন আসাদের বেড়ে ওঠার ধারাবাহিক স্থিরচিত্র, যেখানে ধরা পড়েছে তার কৈশোরের অনুসন্ধিৎসু অথচ উদ্ভট কল্পনার নিবিড় বিচরণ, কৈশোরের কৌতূহল, আর যৌবনের জান্তব চাহিদা ও চাঞ্চল্য এবং নৈতিকতার ঢাল দিয়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা।

কাহিনির এই পর্বের শেষে নায়ক আসাদ এক গভীর ষড়যন্ত্রের শিকার। এর পিছনে কি গ্রামের ওই সহজ-সরল জীবন দর্শন, না কি তাকে কাজে লাগিয়ে আখের গোছাতে চাওয়া কোন ছলনাময়ী নারী। সে কি পারবে লোভ, পাপ, দারিদ্র, অভাব আর অশিক্ষার আবর্তে ঘেটে যাওয়া সম্পর্কের জটিল টানাপোড়েন কাটিয়ে মায়ের আশা পুরণ করতে, একজন প্রকৃত মানুষের মত মানুষ হতে? এ প্রশ্ন একজন বিচক্ষণ, সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ কথাকারের মত তুলে ধরেছেন কাহিনি বিন্যাসের বিভিন্ন পর্বে। তাই পাঠককে পড়তেই হবে, আর পড়তে পড়তে ভাবতেই হবে। ভাবতে হবে, আসাদের জীবন-যন্ত্রণা কি শুধু তার ব্যক্তিগত, না সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর এক অতি সাধারণ যন্ত্রনা যা উপশমের উপায় খুঁজতে গিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে অসংখ্য আসাদ।

বাবা-মা থাকতেও দাঙ্গা তাকে অনাথ করেছে, অথচ প্রায় আজন্ম কাশবেড়ে থেকেও সেখানকার মানুষজনের আপন হতে পারে নি সে। পারেনি ফারহানার মত মেয়ের প্রগাড় প্রেমকে গ্রহণ করতে, যে নাকি একমাত্র মানুষ যে ‘তার মনের কথা বোঝে’- এ কথা জেনেও, শুধু সে ‘চুন্নির জাত’এর মেয়ে বলে। একাকিত্ব কাটাতে শামসাদকে ধরে যখন একটা নিজস্ব জগত গড়ে তোলার চেষ্টা করছে, সেসময়ও বিষয়-সম্পত্তিকে কেন্দ্র করে দুই পরিবারের পারিবারিক কোন্দল এবং মামিমা নয়নার চক্রান্ত সেই স্বপ্নসৌধটিকে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। নিজের মায়ের পঙ্গু এবং বোবা বোনকে ‘নষ্ট’ করার কুৎসিত অপবাদ মাথায় নিয়ে যখন নিজের বাপ-মায়ের কাছে ফিরতে চাইছে, তখন তার অসহায় উপলব্ধি, ‘এ কি তার ঘর হারানো, না ঘরে ফেরা!’ আসলে একদিকে নিষ্ঠুর ষড়যন্ত্র অন্যদিকে সবাই থেকেও কাউকে পাশে না পাওয়ার ভয় তার জীবনি শক্তিকে যেন কুরে কুরে খাচ্ছে ক্ষয়রোগের মত। একটু একটু করে হারিয়ে যাচ্ছে আসাদ। সে কি পারবে একজন রণনিপুণ কৌশুলী পিছুহঠা সেনানায়কের মত ঘুরে দাড়াতে - এপ্রশ্ন নিয়ে যখন পৌছবেন কাহিনির শেষ পাতায়, তখনই অস্থির হয়ে উঠবে পাঠকমন এর পরের পর্বে চোখ রাখার জন্য।

সবশেষে বলি, লেখকের গল্প বলার ভঙ্গিটা বেশ অভিনব। অনুমান করার ভাবনা প্রকাশ করতে বাক্যের শেষে মাঝে মাঝেই ‘হবে’ ক্রিয়াপদের ব্যবহারের বোধহয় দ্বিতীয় উদাহরণ নেই। তবে, শব্দ চয়নের ক্ষেত্রে একটা ছোট্ট অসংগতি নজরে পড়েছে। ধান কেটে নেওয়ার পর যে অংশ পড়ে থাকে তাকে নাড়া বলে। আর নাড়া কেটে নেওয়ার পর যে অংশ পড়ে থাকে তাকে নাড়ার-গোড়া বলে, যার খোচায় পা কেটে রক্ত বেরোনোটা গ্রাম-বাংলার পাঠকমন কতটা মেনে নেবে এ প্রশ্ন থেকেই যায়। লেখক ‘গোড়া’ শব্দ না ব্যবহার করে ‘গোঁজা’ শব্দ ব্যবহার করেছেন, যা আসলে পাট কেটে নেওয়ার পর মাটির সঙ্গে গেঁথে থাকা শুচালো অংশকে বোঝাতে ব্যবহার করা হয়। আর তার খোঁচায় পা কেটে রক্তপাত হওয়া একটা স্বাভাবিক সম্ভাবনার বার্তাবাহক।

জল-জমিনের পদাতিক

কথাকার: মুর্শিদ এ এম

প্রকাশক: মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ

১০, শ্যামাচরণ দে স্ট্রিট, কলকাতা – ৭৩

দামঃ ১০০টাকা

মন্তব্যসমূহ

📂 আলী হোসেনের জনপ্রিয় প্রবন্ধগুলি

হিন্দু কারা? তারা কীভাবে হিন্দু হল?

হিন্দু কারা? কীভাবে তারা হিন্দু হল? যদি কেউ প্রশ্ন করেন, অমিত শাহ হিন্দু হলেন কবে থেকে? অবাক হবেন তাই তো? কিন্তু আমি হবো না। কারণ, তাঁর পদবী বলে দিচ্ছে উনি এদেশীয়ই নন, ইরানি বংশোদ্ভুত। কারণ, ইতিহাস বলছে পারস্যের রাজারা ‘শাহ’ উপাধি গ্রহণ করতেন। এবং ‘শাহ’ শব্দটি পার্শি বা ফার্সি। লালকৃষ্ণ আদবানির নামও শুনেছেন আপনি। মজার কথা হল আদবানি শব্দটিও এদেশীয় নয়। আরবি শব্দ ‘আদবান’ থেকে উদ্ভূত। সুতরাং তাঁর পদবীও বলছে, তিনিও এদেশীয় নন। ভাষাতত্ত্ব ও নৃতত্ত্বের বিশ্লেষণ বলছে, উচ্চবর্ণের বিশেষ করে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের মানুষদের, উৎসভূমি হল পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চল। তারও আগে ছিল ইউরোপের ককেশাস অঞ্চলে। আসলে এরা (উচ্চবর্ণের মানুষ) কেউই এদেশীয় নয়। তারা নিজেদের আর্য বলে পরিচয় দিতেন এবং এই পরিচয়ে তারা গর্ববোধ করতেন। সিন্ধু সভ্যতা পরবর্তীকালে তারা পারস্যের বিভিন্ন এলাকা থেকে হিন্দুকুশ পর্বতের গিরিপথ ধরে এদেশে অভিবাসিত হয়েছেন। আর মধ্যযুগে এসে এদেরই উত্তরসূরী ইরানিরা (অমিত শাহের পূর্বপুরুষ) অর্থাৎ পারস্যের কিছু পর্যটক-ঐতিহাসিক, এদেশের আদিম অধিবাসীদের ’হিন্দু’ বলে অভিহিত করেছেন তাদের বিভিন্ন ভ্রমণ বৃত্তান্তে।

রবীন্দ্রনাথের ধর্মভাবনা ও তার বিবর্তন

রবীন্দ্রনাথের ধর্মভাবনা ও তার বিবর্তন আলী হোসেন  যদি প্রশ্ন করা হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ধর্ম কী? মনে হয় অনেকেই ঘাবড়ে যাবেন। কেউ বলবেন, তাঁর বাবা যখন ব্রাহ্ম ছিলেন তাহলে তিনি নিশ্চয়ই ব্রাহ্ম। যারা লেখাপড়া জানেন না, তারা বলবেন, কেন! উনি তো হিন্দু ছিলেন। আবার কেউ কেউ তথ্য সহযোগে এও বলার চেষ্টা করবেন যে, উনি নাস্তিক ছিলেন; না হলে কেউ বলতে পারেন, ধর্মমোহের চেয়ে নাস্তিকতা অনেক ভালো? ¹ রবীন্দ্রনাথের ধর্ম ভাবনার বিবর্তন  তাহলে সঠিক উত্তরটা কী? আসলে এর কোনোটাই সঠিক উত্তর নয়। চিন্তাশীল মানুষ-মাত্রই সারা জীবন ধরে ভাবেন, ভাবতে ভাবতে তাঁর উপলব্ধি বাড়তে থাকে ক্রমশঃ প্রগতির পথে। জগৎ ও জীবন থেকে তথ্য সংগ্রহ করে একে একে গড়ে তোলেন নিত্যনতুন জীবনদর্শন। তাই এ ধরনের মানুষ আজীবন এক এবং অখণ্ড জীবনদর্শনের বার্তা বহন করেন না। সময়ের সাথে সাথে পাল্টে যায় তাঁর পথচলার গতিমুখ। মানুষ রবীন্দ্রনাথও তাই পাল্টে ফেলেছেন তাঁর জীবন ও ধর্মদর্শন সময়ের বয়ে যাওয়াকে অনুসরণ করে। রবীন্দ্রনাথ ও  হিন্দু জাতীয়তাবাদ ১৮৬১ সালের ৭ই মে সোমবার রাত্রি ২টা ৩৮ মিনিট ৩৭ সেকেন্ডে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে জন্ম গ্রহণ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এর

সীমান্ত আখ্যান, বাঙালির আত্মানুসন্ধানের ডিজিটাল আখ্যান

সময়ের সঙ্গে সমস্যার চরিত্র বদলায়। কিন্তু মুলটা বদলায় না। যদি সে সমস্যা ইচ্ছা করে তৈরি হয়ে থাকে বিশেষ সুবিধা ভোগেই লোভে, তবে তো অন্য কথা চলেই না। স্বনামধন্য স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাতা সৌমিত্র দস্তিদারের ডকুমেন্টারি ফিল্প 'সীমান্ত আখ্যান' দেখার পর এই উপলব্ধি মাথা জুড়ে ঘুরপাক খাচ্ছে। দেখলাম, দেশ ভাগ হয়েছে। কিন্তু সমস্যার অবসান হয়নি। শুধু সমস্যার চরিত্রটা পাল্টেছে। এই যে সমস্যা রয়ে গেল, কোন গেল? তার উত্তর ও পাওয়া গেল 'সীমান্ত আখ্যান' এ। আসলে দেশ ভাগ তো দেশের জনগণ চাননি, চেয়েছেন দেশের নেতারা। চেয়েছেন তাঁদের ব্যক্তিগত, সম্প্রদায়গত সুবিধাকে নিজেদের কুক্ষিগত করার নেশায়। আর এই নেশার রসদ যোগান দিতে পারার নিশ্চয়তা নির্ভর করে রাজনৈতিক ক্ষমতার লাগাম নিজের হাতে থাকার ওপর। তাই রাজনীতিকরা এই ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য জনগণকে 'ডিভাইড এন্ড রুল' পলিছি দ্বারা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চেষ্টা করেছেন এবং করে চলেছেন। এ সমস্যা নতুন না, ব্রিটিশ সরকার এর বীজ রোপণ করে গেছেন, এখন কেউ তার সুফল ভোগ করছে (রাজনীতিকরা) আর কেউ কুফল (জনগন)। 'সীমান্ত আখ্যান চোখে আঙুল দিয়ে দে

ভাগ্য : মুসলিম মনস্তত্ত্ব, ধর্মদর্শন ও প্রগতি

ভাগ্য : মুসলিম মনস্তত্ত্ব, ধর্মদর্শন ও প্রগতি - লিখছেন আলী হোসেন  কপালের লেখন খণ্ডায় কার সাধ্য? জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে কিংবা লেখাপড়া জানা-নাজানা নির্বিশেষে সমস্ত মানুষের সিংহভাগই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এই কথাটা মেনে নেয়। জীবনের উত্থান-পতনের ইতিহাসে কপালের লেখনকে জায়গা করে দিতে তারা কুণ্ঠাবোধ করে না। বরং বলা ভালো এব্যাপারে তারা অতিমাত্রায় উদার। মানুষের মনস্তত্বের এ-এক জটিল স্তর বিন্যাস। একই মানুষ বিভিন্ন সময়ে একই বিষয়ের বিচার বিশ্লেষণে ভিন্নভিন্ন দৃষ্টিকোণ ব্যবহার করে। এ রকমই একটি দৃষ্টিকোণ হলো কপাল বা ভাগ্যের ভূমিকাকে সাফল্যের চাবিকাঠি বলে ভাবা। কখনও সে ভাগ্যের নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠার চেষ্টা করে, আবার কখনও নিজেই ভাগ্যের কাছে নির্দিধায় আত্ম সমর্পন করে। নিজের ব্যার্থতার পিছনে ভাগ্যের অদৃশ্য হাতের কারসাজির কল্পনা করে নিজের ব্যার্থতাকে ঢাকা দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে থাকে। মজার কথা, এক্ষেত্রে মুসলিম মানসের মনস্তত্ত্ব কখনও চেতনমনে আবার কখনও অবচেতন মনে উপরওয়ালাকে (আল্লাহকে) কাঠ গড়ায় তোলে বিনা দ্বিধায়। নির্দিধায় বলে দেয়, উপরওয়ালা রাজি না থাকলে কিছুই করার থাকেনা। সাফল্য কিংবা ব্যর্থতা সবই তাঁর (আল্লার

কাশ্মীর ফাইলস : প্রপাগান্ডার এক নয়া ব্রান্ড, কর্পোরেট পুঁজি ও রাজনৈতিক দলের গলাগলির এক সুচারু প্রদর্শনী

কাশ্মীর ফাইলস : প্রপাগান্ডার এক নয়া ব্রান্ড, কর্পোরেট পুঁজি ও রাজনৈতিক দলের গলাগলির এক সুচারু প্রদর্শনী রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয় উলুখাগড়ার প্রাণ যায়। ১৯৪৭ সালের পর থেকে জম্মু ও কাশ্মিরের জনগণের ভাগ্যলিপিতে লেখা হয়ে গেছে এই বিখ্যাত প্রবাদটির বিস্তারিত সারাৎসার। একদিকে পাকিস্তান আর অন্যদিকে ভারত – এই দুই প্রতিবেশি দেশের ভুরাজনৈতিক স্বার্থের যাঁতাকলে পড়ে তাদের এই হাল। কিন্তু কেন এমন হল? এই প্রশ্নের উত্তর জানে না এমন মানুষ ভুভারতে হয়তো বা নেই। কিন্তু সেই জানার মধ্যে রয়েছে বিরাট ধরণের ফাঁক। সেই ফাঁক গলেই ঢুকেছে কাশ্মির ফাইলসের মত বিজেপির রাজনৈতিক ন্যারেটিভ যা তারা বহুকাল ধরে করে চলেছে অন্য আঙ্গিকে। এবার নতুন মাধ্যমে এবং নবরূপে তার আগমন ঘটেছে, যায় নাম সিনেমা বা সেলুলয়েড প্রদর্শনী। যদিও ডিজিটাল মাধ্যমে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সৌজন্যে অনেক আগেই সফলভাবে তারা এই ন্যারেটিভ দিয়ে বিভাজনের রাজনীতি করে চলেছে বেশ কয়েক বছর ধরে। টেলিভিশন সম্প্রচারে কর্পোরেট পুজির অনুপ্রবেশের মাধ্যমে যার সূচনা হয়েছিল। রাষ্ট্রশক্তিকে কুক্ষিগত করতে না পারলে দেশের সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রন আনা সম্ভব নয়, একথা সাধারণ নিরক্ষর নাগরিক এবং ত

শিক্ষা কী, কেন প্রয়োজন এবং কীভাবে অর্জন করা যায়?

শিক্ষা কী, কেন এবং কীভাবে অর্জন করতে হয়? সূচিপত্র : What is education, why it is needed and how to achieve it শিক্ষা কী শিক্ষা হল এক ধরনের অর্জন, যা নিজের ইচ্ছা শক্তির সাহায্যে নিজে নিজেই নিজের মধ্যে জমা করতে হয়। প্রকৃতি থেকেই সেই অর্জন আমাদের চেতনায় আসে। সেই চেতনাই আমাদের জানিয়ে দেয়, জগৎ ও জীবন পরিচালিত হয় প্রকৃতির কিছু অলংঘনীয় নিয়ম-নীতির দ্বারা। গভীর পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ শক্তিকে বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে কাজে লাগালেই এই নিয়মনীতিগুলো আমাদের আয়ত্বে আসে। এই নিয়ম-নীতিগুলো জানা এবং সেই জানার ওপর ভিত্তি করেই জগৎ ও জীবনকে সর্বোত্তম পর্যায়ে পৌঁছে দেয়ার পথ খুঁজে বের করার শক্তি অর্জনই শিক্ষা। মনে রাখতে হবে, এই শিক্ষা কখনও কারও মধ্যে জোর করে ঢুকিয়ে দেওয়া যায় না। এখন প্রশ্ন হল, শিক্ষা অর্জনের বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিটা আসলে কী। সেই আলোচনায় যাওয়ার আগে জানতে হবে, এই শিক্ষার সূচনা হয় কখন এবং কীভাবে? শিক্ষার সূচনা কখন হয় : এই অর্জনের সূচনা হয় মাতৃগর্ভে এবং তা প্রাকৃতিক ভাবেই। প্রকৃতির দেওয়া কিছু সহজাত শিক্ষাকে অবলম্বন করেই তার সূচনা। এই সহজাত শিক্ষাকে অবলম্বন করেই মানুষ তার পরবর্তী প

জল, না পানি : জল নিয়ে জলঘোলা করা পানির মত সহজ নয়

জল নিয়ে জলঘোলা করা পানির মত সহজ নয় আলী হোসেন  সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত সরকারি অনুষ্ঠানে চিত্র শিল্পী শুভাপ্রসন্ন ভট্টাচার্য পানি শব্দকে বাংলা নয় বলে দাবি করেছেন। বলেছেন, "আমরা কোনোদিন কখনও বাংলা ভাষায় পানি (শব্দটা) ব্যবহার করি না"। শুধু তা-ই নয়, পানি শব্দের ব্যবহারের মধ্যে তিনি 'সাম্প্রদায়িকতার ছাপ'ও দেখতে পেয়েছেন। প্রশ্ন হল - এক, এই ভাবনা কতটা বাংলা ভাষার পক্ষে স্বাস্থ্যকর এবং কতটা 'বাংলা ভাষার ইতিহাস' সম্মত? দুই, জল বা পানি নিয়ে যারা জলঘোলা করছেন তারা কি বাংলাকে ভালোবেসে করছেন? মনে হয় না। কারণ, খোঁজ নিলে দেখা যাবে, এরা কেউ নিজের সন্তানকে বাংলা মিডিয়াম স্কুলে পড়াননি বা পড়ান না। ব্যবহারিক জীবনেও তারা বাংলার ভাষার চেয়ে ইংরেজি বা হিন্দিতে কথা বলতে বা গান শুনতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন, বলা ভালো গর্ববোধ করেন। প্রসংগত মনে রাখা দরকার, বাংলা মিডিয়াম স্কুলগুলোতে যারা ভর্তি হয়, তারা অধিকাংশই গরীব ঘরের সন্তান। বলা ভালো, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে তারাই বাংলা ভাষাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। কারণ, সন্তানকে বাংলা মিডিয়ামে পড়ানোর পাশাপাশি, বা

নিম্নবর্গের মানুষ মার খাচ্ছে কেন

নিম্নবর্গের মানুষ কীভাবে পিছিয়ে পড়েছেন? সমাধান কীভাবে? এদেশের নিম্নবর্গের মানুষ নিজেদের বাঁচাতে যুগ যুগ ধরে ধর্ম পরিবর্তন করেছে। কখনও বৌদ্ধ (প্রাচীন যুগ), কখনও মুসলমান (মধুযুগ), কিম্বা কখনো খ্রিস্টান (আধুনিক যুগ) হয়েছে। কিন্তু কখনই নিজেদের চিন্তা-চেতনাকে পাল্টানোর কথা ভাবেনি। পরিবর্তন হচ্ছে অলংঘনীয় প্রাকৃতিক নিয়ম। যারা এই নিয়ম মেনে সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে পারে, তারাই লাভবান হয়, টিকে থাকে। “পাল্টে গেলেই জীবন বাড়ে না পাল্টালে নয়, জীবন মানেই এগিয়ে যাওয়া নইলে মৃত্যু হয়” জীবনের এই চরম সত্য তারা অধিকাংশই উপলব্ধি করতে পারেনি। পৃথিবীর যেকোন উন্নত জাতির দিকে তাকান, তারা দ্রুততার সঙ্গে এই পরিবর্তনকে মেনে নিজেদেরকে পুনর্গঠন করে নিয়েছে। যারা পারেনি বা নেয়নি তারাই মার খাচ্ছে, অতীতেও খেয়েছে। বুদ্ধিমান জাতি নিজের দুর্বলতাকে মেনে নেয় এবং ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য সময়ের সঙ্গে তাল রেখে নিজেদের চিন্তা এবং চেতনায় পরিবর্তন আনে। খ্রিষ্টান, ইহুদি-সহ এশিয়া, ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন জাতি - যারাই এই পরিবর্তন মেনে নিয়েছে তারাই আরও উন্নত এবং শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। মহানবীর (সঃ) গৌরবময় উত্থান (যা এক ধরণ

আধুনিক মিডিয়া : কর্পোরেট পুঁজির (পুঁজিপতিদের) তোতাপাখি

গোদি মিডিয়া : কর্পোরেট পুঁজির তোতাপাখি পশ্চিমী মিডিয়াকে 'ইসরাইল সরকারের তোতাপাখি' নামে পরিচয় দেওয়া হয় সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী স্বাধীন ও নিরপেক্ষ মিডিয়া হাউজের পক্ষ থেকে। সম্প্রতি একইভাবে ভারতীয় কর্পোরেট মিডিয়া ভারত সরকার তথা 'কর্পোরেট পুঁজির  তোতাপাখি' হিসাবে পরিচয় পাচ্ছে, যাকে নিন্দুকেরা 'গোদী মিডিয়া' নামে অভিহিত করে থাকে। মধ্যপ্রাচ্যের ঘটনা সম্পর্কে ইসরাইল যা বলে, ইউরোপ ও আমেরিকার মিডিয়া, তোতা পাখির মতো তা-ই প্রচার করে। সাংবাদিকতার প্রধান প্রধান শর্তগুলোকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ইসরাইলের দেওয়া তথ্যই তারা প্রচার করে অন্ধ ও নির্লজ্জভাবে। ভারতের ক্ষেত্রেও করপোরেট মিডিয়া বর্তমানে সেটাই করছে বলে অভিযোগ। অভিযোগ, নত মস্তকে ভারত সরকারের দেওয়া তথ্য বিনা বিচারে প্রচার করে চলেছে অধিকাংশ মিডিয়া হাউজ।  অর্থাৎ তাদের সম্প্রচারিত খবরের বড় অংশই হয় নিয়ন্ত্রিত অথবা কখনও কখনও অসত্য - এমন দাবিও করা হয়।  আসলে সিংহভাগ মিডিয়ার মালিক হচ্ছেন এক-একজন  করপোরেট পুঁজির মালিক বা পুঁজিপতি। এরা কি কখনও নিজের স্বার্থের বিরুদ্ধে যায় - এমন খবর, তথ্য বা তত্ত্ব প্রচার করবে? করবে না, করেও না। আর এ

সংখ্যালঘুর মুখই গণতন্ত্রের আয়না

  সংখ্যালঘুর মুখই গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় এবং শক্তিশালী আয়না। The face of the minority is the mirror of democracy কোন দেশ কতটা গণতান্ত্রিক, তা বোঝা যায় সে দেশের সংখ্যালঘু মানুষের জীবন ও সম্পত্তির সুরক্ষা কতটা মজবুত, তা থেকে। কারণ, সংখ্যালঘুর মুখই হচ্ছে গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় এবং শক্তিশালী আয়না। সংখ্যালঘুরা সঙ্গত কারণেই সংখ্যাগরিষ্ঠদের চেয়ে বেশি বঞ্চনাজনিত মনস্তাত্ত্বিক চাপে থাকে। এই চাপ দু’ভাবে তৈরি হয়। ১) সংখ্যাগিষ্ঠতাজনিত সুবিধা যা সংখ্যাগুরুরা পায়, সংখ্যালঘুরা কখনই তা পায় না বা পাবে না - এই ধারণা, যার কিছুটা হলেও ভিত্তি রয়েছে ২) সংখ্যাগরিষ্ঠদের মধ্যে বৃহত্তম (?) জনগোষ্ঠীর অংশ হওয়ার সুবাদে যে কর্তৃত্ববাদী মানসিকতা তৈরি হয় এবং যা বহুজনের মধ্যে দৃষ্টিকটুভাবে প্রকাশ হয়ে পড়ে, তার ভয়ে। এই চাপ কতটা গভীর তা সংখ্যালঘু ছাড়া বোঝা খুব মুশকিল। তবে আলোকপ্রাপ্ত মানুষ মাত্রই যে তা উপলব্ধি করতে পারেন, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। এই ধরণের চাপ তৈরি করে কিছু অসাধু মানুষ যখন সংখ্যালঘুদের জীবন ও সম্পত্তির সামনে হুমকি হয়ে দাঁড়ায়, তখন তা কমানোর ক্ষমতা একমাত্র গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রশক্তির হাতেই থাকে