পালটে গেলেই জীবন
বাড়ে, না পাল্টালে নয়
জীবন মানে এগিয়ে
যাওয়া, নইলে মৃত্যু হয়
আলী হোসেন
যখন ছোট ছিলাম, মাঠে যেতাম গরু চরাতে। দিগন্তের দিকে তাকিয়ে
ভাবতাম মাঠ পেরিয়ে ওপাশের গাছপালায় ঘেরা সবুজ গ্রামটার ওপারেই আকাশটা বোধহয় মাটিতে
নেমে এসেছে। ওটাই পৃথিবীর শেষ প্রান্ত। একছুট্টে পৃথিবীর শেষ প্রান্তটা, ইচ্ছা
করলেই ছুঁয়ে আসতে পারি আমি। এই ছুঁয়ে দেখার ভাবনা অনেক সময় ওই ইচ্ছাটাকে ভীষণ রকম
উস্কে দিত। তার এই উস্কানিতেই একদিন হাঁটতে শুরু করি, আকাশ ছুঁয়ে দেখবো বলে। তারপর
অনেকদূর এগোনোর পর, নিজের গ্রামটার দিকে তাকাতেই বুকের ভিতরটা যেন কেমন করে উঠে। নিজের গ্রামটাকে ঘিরে থাকা
গাছগুলো কেমন যেন ছোট হয়ে গেছে কোন এক মন্ত্র বলে। পালটে গেল ভাবনাটা। মনে হল, এত
দূরে আসার কী দরকার? আমার গ্রামের ওপারেরই তো আকাশটা নেমে গেছে মাটিতে। ওখানে
গেলেই তো আকাশটা ছুঁতে পারি। এভাবেই পালটে যেতে দেখেছি একের পর এক ভাবনা। আর এভাবে
পালটে গেলেই, মনে হত, আমি যেন অনেকটা বড় হয়ে গেছি। এখন বুঝি এই বড় হওয়ার আসলে কোন
অন্ত নেই। অন্তহীন এই বেড়ে ওঠা, বেড়ে চলা। সমীরদার সঙ্গে প্রথম পরিচয়েই আর একবার
আমার সেই উপলব্ধিটা প্রামান্যতা পেয়েছিল। এখানে সেই গল্পটারই কয়েক ঝলক...।
বাবার কাছে গল্প শুনেছি গোবরডাঙার জমিদার বাড়ির কথা।
রূপকথার মতো মনে হত সে কাহিনী। তিতুমীরের সাথে জমিদার কালীপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায়ের
বিরোধ এবং ইংরেজ নীলকর সাহেবদের সহযোগীতায় তিতুর বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণের কাহিনী,
পরিশেষে বাঁশের কেল্লার পতনের ইতিহাস রোমাঞ্চিত করত। মেলাতে পারতাম না,
দোদণ্ডপ্রতাপ ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে একটি অজ-গ্রামের তিতুমীর কিভাবে যুদ্ধে
যাওয়ার সাহস করেছিল। মেলাতে পারতাম না, ভারতীয় হওয়া সত্ত্বেও কালীপ্রসন্নরা কেন
ইংরেজদের সহযোগী হয়েছিলেন। এখন ইতিহাসের শিক্ষক হওয়ার সুবাদে সে উত্তর যেমন
পেয়েছি, তেমনি পেয়েছি, সময়ের সাথে সাথে আমাদের জানাবোঝার পরিধি প্রসারের
অনিবার্যতার উত্তর। এমনই নতুন নতুন বিষয়ে জানা-বোঝার অক্লান্ত শিক্ষাশ্রমিকের
সন্ধান পেয়েছিলাম সমীর রায়চৌধুরী, আমাদের সমীরদার মধ্যে।
উত্তর ২৪ পরগনার
বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকার কাছাকাছি এই জমিদার বাড়ি দেখার ইচ্ছা বুকের ভিতর জমতে থাকে
ছেলেবেলা থেকেই। তারপর যখন জানলাম জমিদার বাড়ির উলটো দিকে যমুনা নদীর পাড়ে বসে
বিরাট মেলা, তখন বানভাসি নদীর ঢেউয়ের মত আছড়ে পড়তো সেই ইচ্ছা মন-যমুনায়। মেলা বসার সময় যত
এগোতো, বুকের ভেতরের সেই ঢেউ উথাল-পাতাল করে উঠতো। আমার সেই ইচ্ছা শক্তি একদিন
বাধ্য করলো আব্বাকে। রাজি হলেন মেলা আর জমিদার বাড়ি দেখাতে। সেই দুই দেখার আবেগ ও
অভিজ্ঞতার অবর্ননীয় বর্ণনা দেওয়া এ লেখার উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু মেলা দেখতে যাওয়ার
পথে মাঠের পর গ্রাম, গ্রামের পর আবার মাঠ, পার হতে হয়েছে আমাকে। এভাবে একের পর এক মাঠ আর গ্রাম পার
হতে গিয়ে বুঝলাম আমার দেখা ও ভাবনার সঙ্গে বাস্তবের বিরাট বড় অসঙ্গতি রয়েছে। কারণ,
যত এগোচ্ছি দিগন্ত ততই পিছোচ্ছে। পালটে যাচ্ছে আগের ভাবনা, পালটে যাচ্ছি আমি।
সমীরদার মধ্যে দেখেছি, এভাবেই সময়ের দাবিতে নিজেকে পালটে নেওয়ার উদগ্র আকাঙ্খা। সময়ের
সাথে সাথে নিজেকে পালটে ফেলার প্রয়োজনীয়তা তাকে তাড়া করে নিয়ে বেড়াত প্রতিনিয়ত।
সমীরদার সংগে আমার পরিচয় লেখালেখির সূত্র ধরে নয়, অন্য
সূত্রে। একদিন সন্ধ্যাবেলা মুর্শিদদার (সাহিত্যির মূর্শিদ এ এম) ফোন এলো। কল রিসিভ
করে বললাম, ‘বলুন’। উনি খুব কম কথা বলেন, বলা ভালো মেপে মেপে। কোন ভনিতা না করেই
বললেন, ‘সমীরদা আপনাকে একটু দেখা করতে বলেছেন, খুব জরুরী’। আমি বেশ অপ্রস্তুত হয়ে
গেলাম। নামটাই তো শুনিনি কোনদিন। কিন্তু মুর্শিদদা এমন করে বললেন, যেন আমার সাথে
তাঁর বেশ জানা-পরিচয় আছে। আমি কিন্তু কিন্তু করে শেষ পর্যন্ত বলেই ফেললাম, সমিরদা
কে? উনি যেন আকাশ থেকে পড়লেন। ‘আপনি সমীরদাকে চেনেন না?’ আমি খুব লজ্জিত কণ্ঠেই
বললাম, ‘না’। মনে মনে বললাম, কলকাতায় এলাম আর কদিন হল, যে পরিচয় হবে! ঠিক আছে, পরে
চিনলেও হবে। আপনার যদি সময় হয়, একটু যান। উনি লেখালেখি করেন। একটা পত্রিকার
সম্পাদনাও করেন। বাকিটূকু গেলেই জানতে পারবেন। কদিন ধরেই আমাকে বলছেন। আমিও
ব্যস্ততার জন্য সময় করে উঠতে পারিনি, আপনাকে বলাও হয় নি। কিন্তু কেন যাব একথা আর
জিজ্ঞাসা করা হয়নি। কেননা, সমীরদাকে না চেনার উত্তরের প্রতিক্রিয়া মুর্শিদদা
যেভাবে দেখিয়েছিলেন, তাতে জিজ্ঞাসা করার মত বুকবল ঐ মূহুর্তে আর ধরে রাখতে পারিনি।
মনে মনে আন্দাজ করলাম, হয়তো লেখালেখির ব্যপারেই কথা বলবেন। লেখা চাইতেও পারেন।
সুতরাং পরের দিন স্কুল থেকে ফিরে সন্ধ্যাবেলা হাজির হলাম।
মুর্শিদদা-ই পথনির্দেশ দিয়েছিলেন। দরজার কড়া নাড়তেই যিনি বেরিয়ে এলেন, পরে জানলাম
উনি বৌদি। আমাকে দেখেই যেন কেমন অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন। গলা উচু করে বললেন, দেখোতো
কে একজন এসেছে। বলে, পিছন ফিরতে গিয়ে আবার আমার দিকে তাকালেন। কৌতুহল নিয়েই বললেন,
কি চাই ভাই তোমার? নাম কি? বললাম, সমীরদাকে। আমাকে আসতে বলেছিলেন। নাম বলতেই বেশ
অবাক হয়ে জিজ্ঞাস করলেন, আলী! আরও কিছু হয়তো জিজ্ঞেস করতেন। হয়তো বলতেন, কই, আলী
বলে তো কাউকে আমরা চিনি না। কিন্তু সমীরদাই থামিয়ে দিয়ে ভিতর থেকে শ্বসব্যস্ত হয়ে
বললেন, আরে! আলী এসেছো। এসে এসো, কদিন ধরে তোমার অপেক্ষায় আছি। অবশেষে তোমার সময়
হল? অশক্ত শরীর নিয়ে যেভাবে তাড়াহুড়ো করে তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন, তাতে বৌদি
খানিকটা ঘাবড়েই গেলেন। তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেলেন, হাত বাড়িয়ে দিলেন, ঠিক যেন একজন
বন্ধুর মত। বলতে বাধা নেই, অনেক মানুষের মধ্যে সমীরদাকে অন্য রকম লেগেছিল সেদিন।
মনে হয়েছিল, কতদিনের পরিচয় রয়েছে যেন ওঁনার সাথে। তারপর গ্রীলের তালা খুলে ঘরে
নিয়ে গেলেন আমাকে।
সময় নষ্ট না করে বৌদির সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন।
পরিচয়ের সময় এমন কিছু কথা, বলা ভালো প্রশংসা করলেন, তাতে ভিতরে ভিতরে একটা যেমন
ভালো লাগা কাজ করছিল, তেমন অসস্থিও লাগছিল। অবাকও হচ্ছিলাম এই ভেবে যে, উনি এত কথা
আমাকে বলছেন কেন এবং কিভাবে? যেহেতু এই প্রথম পরিচয়, তাই শুনে যাওয়া ছাড়া আমার
তেমন কিছু বলারও নেই। মানুষটাকে জানিই না তো সেভাবে। শ্রোতা হয়েই তাই কাটলো কয়েক
মুহূর্ত। তারপর হঠাৎ বললেন, আমার সঙ্গে এসো; কাজের কাজটা আগে সেরে ফেলি। তারপর গল্প করা
যাবে। দোতলার ঘরের চাবি নিয়ে সিড়ি দিয়ে তরতর করে ওঠার চেষ্টা করলেন। কয়েক ধাপ
উঠতেই দেখলাম সতর্ক হয়ে গেলেন। বুঝতে পারলেন, বয়সের ভারটা বইতে পারার ক্ষমতা আগের
মত নেই। আমি বুঝলাম, কী অস্বাভাবিক মনোবল এই সত্তরোর্ধ মানুষটির। যদিও আমার ঘোর
তখনও কাটেনি। কেননা, চোখের সামনে ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলোর কোনোটার ব্যখ্যাই আমার কাছে
পরিস্কার নয় তখনও। এই বয়সে এত আগ্রাসী আবেগ নিয়ে তিনি কী করতে চাইছেন। আর কেনই বা
আমাকে নিয়ে এত আগ্রহ দেখাছেন? আমি ওনার জন্য কী-ই বা করতে পারি!
সিঁড়ি পেরিয়ে দোতলায় পৌছালাম। বাঁদিকে বাঁক নিতেই দেখি একটি
ঘরে অসংখ্য বই। নিজের লেখা যেমন আছে, তেমনি অন্যান্য অসংখ্য বই ও পত্রপত্রিকা।
নিজের সম্পাদননার পত্রিকার বেশকিছু কপিও রয়েছে সেখানে। নতুন বিষয় কেন্দ্রিক বা
অন্য ধারার লেখা বই দেখলেই পা’টা যেন আটকে যায়। মনে পড়ে স্কুল ও
কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সময় গুলোর কথা। বই কেনার বাহানা করে বুক স্টলের সামনে
দাঁড়িয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা বই ও পত্রপত্রিকা পড়ে নেওয়ার চালাকীর কথা। বই বিক্রেতা কখনও কখনও বিরক্ত হতেন। বুঝতে
পারতাম। তবু কিছুটা নির্লজ্জের মতই দাঁড়িয়ে থাকতাম; পড়ে যেতাম। কখনও পরের দিন
কেনার মিথ্যা প্রতিশ্রুতিও দিতাম, বিক্রেতার মনপাওয়ার জন্য। আজ আর সে সময় নেই। বই
কিনে পড়ার মত পয়সা আমার হাতে আছে। কিনিও। কিন্তু জীবনের চাহিদা সময়কে অনেকটা কেড়ে
নিয়েছে। যে অর্থের অভাবের কারণে, একদিন বই বিক্রেতার সঙ্গে ছলনা করেছি, সেই অর্থের
যোগান গতিহীনতার গ্রাসে যাতে না পড়ে তার চেষ্টায় পড়ার সময় চুরি হয়ে গেছে অনেকটাই।
কিন্তু চোখের নেশা তো সহজে যায় না। নতুন কিছু দেখলে তো নয়ই। স্বাভাবিক ভাবেই চোখ
আটকে গেল সরু লনের বাঁপাশের ঘরের অসংখ্য বইতে, যার নতুনত্বের গন্ধ আমার মনকে দাড়
করিয়ে দিল ক্ষণিকের জন্য।
তারপর আচমকাই কানে এলো সমীরদার গলা। কী হল, দাঁড়িয়ে গেলে
কেন? তাকিয়ে দেখি একটু দূরের একটি ঘর থেকে মুখ বাড়িয়ে আমাকে ডাকছেন। কাছে যেতেই
বললেন, তুমি বই পড়তে ভালোবাস বুঝি? আমি আবার একবার অবাক হয়ে গেলাম। মুখের দিকে
অপলক তাকিয়ে থাকতে দেখে বললেন, ঠিক আছে তোমাকে কিছু বই পড়তে দেব। দেখ ভালো লাগে
কিনা। তবে তোমরা তো সুনীলের লেখা পড়ে বড় হয়েছ। ফলে আমাদের মত অনামী মানুষের লেখা
না ভালো লাগতেও পারে। তবু তোমাকে দেব। সময় পেলে পড়ে দেখ। তার আগে দেখত আমার এই
যন্ত্রটা ঠিক করে দিতে পার কিনা। বড্ড পিছিয়ে পড়েছি। যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে পারছি
না। সময় এগোচ্ছে আর আমি ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছি। এটা মোটেও মানতে পারছি না। অথচ এই
বুড়োটাকে কেউ সাহায্য করতে এগিয়েও আসছে না। দেখতো, তুমি আমাকে একটু সাহায্য করতে
পার কিনা।
ঘরটার ভিতরটা দেখলাম একপলক। ধুলোবালিতে ভরা। অব্যবহৃত আসবাব
আর অন্য নানা রকমের বাদপড়া জিনিসে ভরা ঘরটা। সেই জিনিস গুলোর মধ্যে অনেক যন্ত্রই
আছে, যারা সংসারের ভার বইতে বইতে বানপ্রস্থে যাওয়ার বয়সে এসে পৌঁছেছে। আমি বুঝে
উঠতে পারছি না। আমাকে ঠিক কী ঠিক করে দেওয়ার কথা বলছেন, যা ওঁনার খুব প্রয়োজন; যা
তাঁকে পিছিয়ে দিচ্ছে, এই বয়সে! আমার না বুঝতে পারার শরীরি ভাষা পড়ে উনি আঙুল
বাড়ালেন। আঙুল অনুসরণ করতেই নজর পড়লো একটি ধুলোর ঘোমটায় ঢাকা একটি লাজুক মুখের
উপর, যার পোশাকি নাম মনিটর। ১৯ ইঞ্চির একটি বাদপড়া সিআরটি মনিটরকে দেখিয়ে বললেন,
ওটাকে তোমাকে সারিয়ে দিতে হবে।
এবার বুঝলাম উনি কী করতে আমাকে ডেকেছেন। কিন্তু কেন ডেকেছেন
তার হিসাব তখনও মেলেনি। অর্থাৎ বিস্ময়ের ভুত তখনও মাথা থেকে নামে নি। আমি বললাম,
এটা সারিয়ে আপনি কী করবেন? এতে যা খরচ হবে তাতে আপনার পোশাবে না। তার থেকে একটা
নতুন কিনে নিন, অনেকদিন চলবে। তাছাড়া যার জন্য কিনছেন সে অনেকদিন নিশ্চিন্তে কাজ
করতে পারবে। শুধু তাই নয়, এই মনিটরগুলো প্রচুর বিদ্যুৎ খরচ করায়। এখন টিএফটি মনিটর
বেরিয়ে গেছে, যাতে অনেক বিদ্যুৎ সাশ্রয় হয়। ওটাই কিনে দিন। ... আমার কথা মাঝপথে
থামিয়ে বললেল, ‘দাঁড়াও দাঁড়াও, তুমি জাননা, বুড়োদের পোশাকেই বুড়োদের মানায় ভালো?’ ভাবুন
একবার, কোন কথার কোন উত্তর! বিস্ময়ের ভুত ঘাড় থেকে নামবে কী, আরও চেপে বসলো। কী
বলবো ভাবছি। ভাবছি বলি, নাতি বা নাতনির জন্য যন্ত্রটি সারাতে চাইছেন তো, তা এটা না
সারিয়ে একটা নতুন কিনে দিন; ওরা অনেকদিন নিশ্চিন্তে চালাতে পারবে। কিন্তু কথায় বলে
না, মোল্লার দোড় মসজিদ পর্যন্ত। তেমনি আমার বুঝতে দেরি হল না, আমার ভাবনার দোড়
ভবানিপুর পর্যন্ত। কারণ, সমীরদা কম্পিউটারটা সারাবেন নাতি-নাতনির জন্য নয়, যেটা
আমার মাথায় এতক্ষণ ঢোকেনি। আর ওটা নাতি কিম্বা নাতনিদের বাদ দেওয়া কম্পিউটার। তারা
নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়ে, তাই পুরানো মডেলের কম্পিউটার তাদের চলবে না। তাই ধুলোর
ঘোমটা পরে কনে সেজে ঘরের কোনে লাজুক মুখে বসে আছে।
হয়তো ভাবছেন, এতে আবার অবাক হওয়ার কি আছে? হয় তো নেই, কারও
কারও কাছে। কিন্তু আমার কাছে খুবই অবাক হওয়ার মত ঘটনা ছিল এটা। কারণ, আমার
প্রজন্মের মানুষ-জনের মধ্যে পাঁচ শতাংশ মানুষের মধ্যেও এই প্রযুক্তি সম্পর্কে
জানাবোঝার আগ্রহ নজরে আসেনি। এমনকি আমার থেকে অনেক ছোট, যাদের জন্মলগ্নেই এ রাজ্যে
কম্পিউটার প্রযুক্তির প্রসার ঘটতে শুরু করেছে, তাদের মধ্যেও দেখেছি অনাগ্রহ এবং
অহেতুক ভয়। অথচ সমীরদা তাদের মধ্যে ব্যতিক্রম। কেননা, তিনি কম্পিউটার শিখতে চান শুধু
নয়, ইউনিকোড ফণ্টে বাংলা লেখাও শিখতে চান। তাঁর কাছে এই নতুনকে আপন না করতে পারাটা
পিছিয়ে থাকার সামিল, যা তিনি মেনে নিতে পারছেন না। তাই আমার ডাক পড়েছে তাঁর ঘরে।
পালটে যাওয়ার বাসনায়। কারণ, না হলে যে জীবন বাড়ে না।
‘বাংলা সাহিত্য’
অনলাইন ম্যাগাজিনের দপ্তরে বসে বাংলা লেখার চেষ্টা করছেন
তারপর যে অধ্যাবসয় নিয়ে তিনি এই কাজে মননিবেশ করেছিলেন, তা
এককথায় অকল্পনীয়। নিজের বাড়িতে আমাকে ডেকে নিয়ে যেমন এই চেষ্টা করেছেন, তেমনি যখন
আমি যাওয়ার সময় বের করতে পারিনি ফোনে জেনে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন। অনেক সময় অশক্ত
শরীর নিয়ে আমার বাড়ী পর্যন্ত ছুটে এসেছেন। বলতে বাধা নেই, তার এই অদম্য ইচ্ছাশক্তির
কারণে আমি ফোন-ফোবিয়ায় আক্রান্ত হয়ে পড়েছিলাম। প্রতি মুহূর্তে এই আতঙ্ক আমায় তাড়া
করে নিয়ে বেড়াতো যে, এই বুঝি সমীরদার ফোন ঢুকলো। আমি শেষ পর্যন্ত সমীরদার ফোন কলের
জন্য রিংটোন পার্সনালাইজ করতে বাধ্য হয়েছিলাম। আজকের এই লেখার সুবাদে তাই তার কাছে
ক্ষমা চেয়ে নেওয়ার সুযোগকে হাতছাড়া করতে চাইনা। যেখানেই থাকুন, যেভাবেই থাকুন,
পারলে এই ছোট ভাইটিকে ক্ষমা করে দেবেন, যেন এই অপরাধ বোধ নিয়ে এই সুন্দর-সম্পর্কের
পৃথিবী ছাড়তে না হয় যে, আমি আপনার সব ফোনকল রিসিপ করিনি। আপনার প্রত্যাশা পুরণের
রসদ আপনাকে আমি সম্পূর্ণ দিতে না পারলেও আপনার অদম্য আগ্রহ আমার মধ্যে এক অমোঘ
সত্য উপলব্ধিতে সাহায্য করেছে, যা এ লেখার শিরোনাম হয়ে বেঁচে থাকবে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন